একসময় দেখলাম, সবই কল্পনা, বাস্তবতায় শূন্য পৃথিবী। নিতাইনগর, গ্রামের নাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খোরস্রোতা এক নদী (নামটা মনে নাই)।
এই নদীর পাশেই বাস করত, সিরাত আলী নামক এক লোক। সিরাত আলীর বাবা, বা ও বৌ নিয়েই সংসার।
সে পেশায় একজন শিক্ষক, কনভেনশনাল একজন মানুষ। খুব সহজেই বন্ধু বনে যান। খুব সহজে আবার বিরাগভাজন হন। এই সিরাত আলীর এক সমস্যা দেখা দিল। তিনি সংসারে ব্যাপক অশান্তিতে বাস করছিলেন।
সকালে ঝগড়া হয়, বউ এর সাথে, বিকালে তার মা দুই একটা কথা শুনাইয়া দেয়, আর রাতে বাবার ধমকে বুকের ভেতরের সব শান্তি নষ্ট হয়ে যায়।
সিরাত আলী বুঝে না, তাকে নিয়ে সবার এত সমস্যা কেন? বউ নিশাত বেগম, প্রথমে ভালই ঘরনী ছিল। ইদানীং কি যে হইছে, কথায় কথায় থালা বাসন ছুড়ে মারে। সিরাত আলী এসব দেখে সেই নিশাত আর এই নিশাতকে যেন মেলাতে পারে না। অপর দিকে, স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার সময়, যদিচ সিরাত আলীর মা হুসনেয়ারা মৌন থাকেন, কার পক্ষে কিছু বুঝা যায় না।
বিকালে সিরাত আলীকে সে দুই তিনটা কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়ে না। ঐদিকে তো আছেন, সিরাত আলীর বাপ। নাসিরুদ্দিন ফিরোজ শাহ। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তি। তার আসল নাম নাসিরুদ্দিন।
তিনি বলে থাকেন, গ্রামের মানুষ নাকি তাকে ফিরোজ শাহ উপাধি দিয়েছেন। বিখ্যাত বাদশাহ ফিরোজ শাহ এর নামে। সত্য কি মিথ্যা কে বলতে পারে। তিনি এক কালে গ্রামের সদরের একমাত্র কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এখন গ্রামের মাতব্বর।
এই নাসিরুদ্দিন ফিরোজ শাহ, রাতে বেলা একবার হলেও ছেলেকে কথা শোনান।
এই তিনটি মানুষের প্রতি সিরাত আলীর বিতৃষ্ণা চলে আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার একটা সমস্যা হয়েছে। কাউকেই তিনি দোষারপ করতে পারেন না। কেন পারেন না, সেইটাই এই গল্পের মূল কাহিনী।
"ব্যোম ব্যোম ব্যোম, ভ্যাস!"। এই বলে বাবা চোখ খুললেন। বাবার সাদা সাদা দাড়ি, মাথায় সাদা সাদা চুল। নিতাইনগরের দক্ষিণের কোন এক বনে এই বাবার বাস। অনেক কষ্ট করে বাবার কাছে এসেছে সিরাত আলী।
-কি বলবি বল।
বাবার প্রশ্ন শুনে সিরাত আলীর মনটা এক্কেবারে চুপসে যায়। সে বুঝে এখানে আসাটাই তার ভুল হইছে।
-ঐ আমারে কেউ দেখতে পারে না।
এই কথা শুনে বাবা বলেন, তাই নাকি বাছা? তারপর করেন চোখ বন্ধ।
সিরাত আলী অধৈর্য হয়ে বলেন, সবাই আমাকে দোষারপ করে, সবাই আমাকে খারাপ বলতে চায়, কিন্তু আমি কোন মতেই কাউরে দোষ দিতে পারিনা, কাউরে কিছু বলতে পারি না।
-হুম...তারপর?
-তারপর কি? প্যারার উপর দিয়া যাইতেছি। সকালে বউ চেচায়, বিকালে আম্মা, রাতে বাপ। রুটিন করে সবাই আমাকে পেদাচ্ছে!
-তারপর?
-বউয়ের দিকে আঙ্গুল তুলতাম আগে। এখন তুলতে গেলে এক অদ্ভুত ব্যপার হয়!
-কি অদ্ভুত ব্যাপার?
-সামনে একটা আয়না দেখতেই পাই।
সেই আয়নায় দেখি, আমার আঙ্গুলের ওপাশে আমিই দাঁড়িয়ে আছি।
-হুম!
-ব্যস, আমি ওমনি দমে যাই। বউ বউয়ের মত ঝাটা, থালাবাসন মারে! আমি সেটা খাই।
-হুম!
-আম্মাকে সেদিন কিছু বলতে গেলাম, দেখি কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে। আবার সেই আয়না, আবার সেই আমি।
জীবনটা তেনা হয়ে গেল!
-বুঝলাম! বাছা! সবই বুঝলাম। তা তোমার বউ যে চিল্লায়? চিল্লায় কি বলে?
-থাপড়ায় দাত ফেলে দিবো! তোর সংসার তুই সামলা, আমেনারে নিয়ে ঘর কর...ইত্যাদি!
-আমেনা? আমেনাটা কে?
-পাশের বাড়ির বিধমা মেয়ে।
-ওহ! তো আমেনার সাথে তুমি কি করো?
- কি করি মানে? কিছুই করিনা। তাও আমার বউয়ের সন্দেহ যায় না।
-আমেনার সাথে তুমি কি করো?
আবারও একই প্রশ্ন শুনে সিরাত আলী কিছুক্ষনের জন্য দমে যায়।
এরপর বলে, মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরার সময় দুইচারটা কথা কই। হাসাহাসি করি। এইটাই নিশাত সহ্য করতে পারে না।
-হুম! আর?
-আর মানে? আর কি করব? মাঝে মাঝে তো ইচ্ছা করে ওরে নিয়েই আমার সংসার করা উচিৎ আছিলো!
সাধুবাবা চুপ মেরে থাকেন। ধীরে ধীরে উঠে দাড়ান।
তার সুন্দর মত তক্তপোশের পাশে পায়চারি করেন। সিরাত আলী মনে মনে ভাবে, শালার ভন্ড।
সাধুবাবা সরলভাবে বলে, ধরো সিরাত আলী, পাশের বাসার আমেনার স্বামী যদি বাইচ্চা থাকত, আর আমেনা যদি না থাকত, আর তোমার বউ যদি আমেনার স্বামীর সাথে হাসাহাসি করত...তাইলে তুমি কি করতা?
-থাপড়াইয়া ওরে মাইরে ফেলাইতাম।
উত্তর শুনে সাধুবাবা হাসেন। মেয়েরা তো সেটা পারে না।
পারলে নিশাত তোমারে মাইরাই ফেলাইত। এই দুনিয়াটা বড় অদ্ভুত। স্ত্রী জাতির ভরসা তার স্বামী। স্বামীর গায়ে হাত তোলা যে পাপ! কিন্তু যে জিদ তোমার হয়, সেটা ওরও হয়, তাই সে তোমার সাথে চিৎকার করে।
সিরাত আলী কি যেন ভাবে।
সাধুবাবা ফির বলেন, তোমার মায়ের অভিযোগ কি?
-আমি মদখোর, মদ খেয়ে জুয়া খেলে নাকি টাকা উড়াই।
-উড়াও?
-তা মাঝে মাঝে একটু-আধটু তো সবাই খায় বাবা, তা আমিও খাই। খেয়ে জুয়ো খেলি। খেলে আমি হেরে গেলে তো আমার দোষ না? নাকি?
সাধুবাবা বার ঘুরেন। ঘুরে ঘুরেই বলতে শুরু করেন, এইখানেও যে দোষটা তোমার।
এই যে তুমি মদ খাও, সেটা কি ঠিক? না, সেটা ঠিক না। মদ খাইলে মানুষ মানুষ থাকে না, পশু হইয়া যায়। এবার বলো তোমার বাবা কি বলেন?
-আমি একটা অপদার্থ। তার ইচ্ছা ছিল আমি উকিল হবো! তা আমার আর ওত পড়াশোনা হয়নি।
-তোমার বাবা তোমাকে পড়ার টাকা দেয়নি?
-আলবৎ দিয়েছেন।
-পড়লে না কেন?
-এত কষ্ট করতে...
-এইখানেও দোষটা যে তোমারই। এমন বাপ কয়জনের হয় বলো তো? এই পৃথিবীটা বড় অদ্ভূত। দাত থাকতে কেউ দাতের মর্যাদা বোঝে না।
সিরাত আলী আবার ভাবনায় ডুবে যায়। সে ঠিকই অনেক পড়াশোনা করতে পারত।
বন্ধুদের নিয়ে মদের আড্ডাটা শুরু হতেই তার সব শেষ হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিরাত আলি।
সাধুবাবা ধীরে ধীরে বলেন, আজ তুমি বাসায় যাবা। রাত হলে প্রথমে আব্বার কাছে গিয়ে বলবা, আমার জীবনের সমস্ত কর্মকান্ডের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমি তোমার মত সত্যনিষ্ঠ একজন মানুষ হতে চাই, আমাকে আশীর্বাদ কর।
এরপর মায়ের কাছে যাবা। মাকে বলবা, মা, আমি আর কোনদিন মদ্যপান করিবো না। আমি এখন থেকে শুধু তোমার কথামত চলব।
সিরাত আলী চুপ করেই থাকে। সাধুবাবা একটু বিরতি নেন।
তক্তপোষের উপর বসেন। "তোমার বউয়ের কাছে যাবা। সুযোগমত, তাকে জড়ায় ধরবা। সে ছুটতে চাইবে, তাকে শক্ত করে ধরে, কানে কানে বলবা, তুমি তাকে সবথেকে বেশি ভালোবাস, আর কোনদিন সে কষ্ট পায় এমন কাজও তুমি করবা না। তোমার বউয়ের শক্ত শরীর ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসবে, সেও ধীরে ধীরে তোমাকে শক্ত করে ধরবে! তোমাদের মধ্যেকার সব ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়ে যাবে"।
সিরাত আলী বলল, তারপর আমি আর আয়না দেখবো না, সুখে শান্তিতে বাকি জীবন কেটে যাবে?
-ব্যাপারটা এত সহজ না সিরাত আলী, তোমাকে সাধনা করতে হবে, মদ মেয়ে মানুষের লোভ মন থেকে মুছে ফেলতে সাধনা করতে হবে, সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য সাধনা করতে হবে। তবেই তুমি শান্তি পাবে... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।