আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নীল বিদ্রোহঃ বাংলার সর্বপ্রথম সফল বিদ্রোহ ☤হাতি পোস্ট☤

ব্যাঘ্র যুগে শুধু মৃত হরিণীর মাংস পাওয়া যায় প্রথমেই আমার মত যারা বড় পোস্ট দেখে ভয় পান তাঁদের বলি, পোস্টের শুধু 'সশস্ত্র বিদ্রোহের শুরু ও কিছু ঘটনা' প্যারাটা পড়ে দেখেন, গ্যারান্টি ইন্টারেস্টিং লাগবে। এবার মূল কথায় আসি। একাদেমিক সূত্রে নীল চাষ ও নীল বিদ্রোহ নিয়ে কয়দিন ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছিল। স্বভাবতই ইন্টারনেটেও খুঁজেছি। কিন্তু আশ্চর্য হলাম যে এই বিষয়ে নেটে সঠিক তথ্য তো দূর, তথ্যই খুব কম।

তাই ঠিক করলাম রিসার্চের একটা সম্পূর্ণ সারমর্ম লেখা উচিত। সপ্তাহ দুএক লাগল, তবু লিখে ফেললাম। সামান্য গর্ব করে বলতে পারি, এই পোস্টের প্রত্যেকটা লাইনের রেফারেন্স দেয়া যাবে। দরকার অনুসারে উইকির মত করে রেফারেন্স দিয়েওছি। ভবিষ্যতে কেউ নীল চাষ সম্পর্কে জানতে চাইলে আমার এই লেখা পড়ে যদি উপকৃত হন, তবেই আনন্দ।

লেখার কপিরাইট সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। নির্বিচারে কপি-পেস্ট মারতে পারেন। উইকিপিডিয়ান কেউ থাকেন যদি, তবে একটা আবদার করব, এখান থেকে তথ্য নিয়ে বাংলা উইকিতে অ্যাড করে দেবেন দয়া করে। এবার নিন, পড়া শুরু করুন। আর হ্যাঁ, শুরুর আগে আমার প্রিয় একজন লেখক, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' বইয়ের এক স্থানে ফুটে ওঠা নীলকুঠির বর্ণনা শোনাইঃ ''সুচাঁদ বলে- বাবারা বলত, অ্যাই বড় বড় ঘোড়া, এই ঝালর দেওয়া সওয়ারি অর্থাৎ পালকি।

এই সব বাংলা-ঘর, ফুল বাগিচা, বাঁধানো খেলার জায়গা, কাঠ-কাঠরার আসবাব; সে ঐশ্বর্যের কথা এক মুখে বলা যায় না। এক দিকে কাছারি গমগম করত, বন্দুক নিয়ে পাহারা দিত পাইক আটপৌরেরা- মাথায় পাগড়ি বেঁধে লাঠি নিয়ে বসে পাহারা দিত। জোড়হাত করে বসে থাকত চাষি সজ্জনেরা- ভয়ে মুখ চুন। দু-দশজনাকে বেঁধে রাখত। কারুর শুধু হাতে দড়ি, কারুর বা হাত-পা দুই-ই বাঁধা।

সায়েব লোক, রাঙা রাঙা মুখ, কটা কটা চোখ, গিরিমাটির মত চুল, পায়ে অ্যাই বুট জুতো- খটমট করে বেড়াত, পিঠে 'প্যাটে' জুতোসুদ্ধ লাথি বসিয়ে দিত, মুখে কটমটে হিন্দি বাত- মারডালো, লাগাও চাবুক, দেখলাও শালোলোগকো সায়েব লোকের প্যাঁচ। কখনো হুকুম হত- কয়েদ কর। কখনো হুকুম হত- ভাঙ দেও শালোলোকের ধানকো জমি। লয়তো, কাটকে লেও শালোকে জমির ধান। সে তোমার বামুন নাই, কায়েত নাই, সদগোপ নাই- সব এক হাল।

'আতে' সারি সারি বাতি জ্বলত- টুং- টাং- ক্যাঁ- কোঁ- ভ্যাঁ- পো ভ্যাঁ- পো বাজনা বাজত, সায়েব মেম বিলিতি মদ খেত, হাত ধরাধরি করে নাচত, কয়েদখানায় মানুষ চেঁচালে হাঁকিড়ে উঠত বাঘের মত- মৎ চিল্লাও। বেশি 'আত' হলে সেপাইরা বন্দুকের রজ করত- দুম- দুম- দুম- দুম। হাঁক দিত- ও- হো- ই। তফাত যাও- তফাত যাও- চোর বদমাশ হুঁশিয়ার! চোরই হোক আর সাধুই হোক এতে ওদিকে হাঁটলে অক্ষে থাকত না, দুম করে গুলি করে দিত। '' এবারে মূল লেখা- ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলার কৃষক সম্প্রদায় নীল ব্যবসায়ী বা নীলকরদের বিরুদ্ধে একজোটে যে বিদ্রোহ করে, তা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

এই বিদ্রোহ আসলে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে জমে ওঠা ক্ষুব্ধতার বহিঃপ্রকাশ ছিল মাত্র। প্রথমদিকে নীল চাষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারে ছিল। ১৮৩৩ সালের সনদ আইনের ফলে তাঁদের একচেটিয়া অধিকার লোপ পায় এবং ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা বাংলায় আগমন করে ইচ্ছামত নীলের চাষ শুরু করে। তখন থেকেই কৃষকদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। ফলে ১৮৫৯ সালে তারা নীল চাষ করতে সঙ্ঘবদ্ধভাবে অস্বীকৃতি জানায়।

প্রথমদিকে এই আন্দোলন অহিংস ছিল, কিন্তু নীলচাষ না করার কারণে চাষিদের ওপর ভয়ানক নির্যাতন, গ্রেপ্তার শুরু হলে এ আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়। (১) নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে 'নীল কমিশন' গঠন করে। এই কমিশন সরেজমিনে তদন্ত করে চাষিদের অভিযোগ যথার্থ বলে অভিমত দেয়। ফলে সরকার নীলচাষের ওপর একটি আইন পাস করেন। এতে ১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়।

১৯০০ সালের মাঝে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি উঠে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলায় সম্পূর্ণভাবে নীলচাষের অবসান ঘটে। (২) নীল চাষের পটভূমি প্রাচীন ও আধুনিক নীলচাষ অতি প্রাচীন কালেও এদেশে নীল চাষ প্রচলিত ছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতীয় ভেষজ বিজ্ঞানের নানা গ্রন্থে, প্রাচীন প্রতিমূর্তির বর্ণে, অঙ্কিত পট ও চিত্রে। ইংরেজিতে নীল indigo নামে আর গ্রিক ও রোমান ভাষায় indicum নামে পরিচিত। উভয় শব্দই india শব্দের সমার্থবোধক।

আবার প্রাচীন দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মাঝে নীলের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। তারা বাস করত সিন্ধু নদের (the indus) তীরে এবং তাই ধারণা করা হয় এদেশেই নীল চাষের উৎপত্তি। (৩) এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে নীলচাষ ও এর ব্যবহার প্রচলনের কৃতিত্ব একজন ফরাসি বণিকের, তার নাম লুই বন্ড। তিনি ১৭৭৭ আমেরিকা থেকে এদেশে নীলবীজ ও আধুনিক চাষের পদ্ধতি নিয়ে আসেন। একই বছরে হুগলী নদীর তীরবর্তী গোন্দালপাড়া ও তালডাঙ্গা গ্রামে সর্বপ্রথম তিনি নীলকুঠি স্থাপন করেন(৪)।

কয়েক বছরের ভেতরে মালদহে, ১৮১৪ সালে বাকিপুরে, এবং তারপরে যশোরের ন'হাটা ও কালনাতে নীলকুঠি ও কারখানা স্থাপন করেন। ১৮২০ সালে কালনা থেকে প্রায় দেড় হাজার মণ পরিশোধিত নীল রপ্তানি করে বন্ড উপমহাদেশ ও ব্রিটেনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। ১৮২০ সালে তার মৃত্যু হয়। (৫) বাংলায় নীলচাষের প্রসার লুই বন্ডের এক বছর পর ক্যারল ব্লুম নামের একজন ইংরেজ কুষ্টিয়ায় একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন(৬)। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নীলচাষে বিপুল মুনাফার কথা অবহিত করে দ্রুত নীলের কারবার শুরু করার আহ্বান জানান ও ১৭৭৮ সালে গভর্নর জেনারেলের কাছে এই বিষয়ে সপারিষদ একটি স্মারকপত্র দাখিল করেন(৭)।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় এবং কাপড় রং করার জন্য নীলের চাহিদা শতগুনে বেড়ে যায়। ফলে ওই সময়ে নীল চাষের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হয়ে ওঠে। কোম্পানি লাভের সম্ভাবনা দেখে শীঘ্রই সমস্ত কারবার হস্তগত করে নেয় এবং অত্যন্ত লাভবান হয়। এক হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৮০৩ সাল পর্যন্ত নীল চাষে যে খরচ হত, তার সবটাই কোম্পানি অল্প সুদে অগ্রিম প্রদান করত। এতে যে নীল উৎপাদিত হত, তার সবটাই যেত ইংল্যান্ডে এবং কোম্পানি বহুগুণ বেশি লাভ করত।

এই ব্যবসা এতই লাভজনক প্রমানিত হয় যে, বহু কর্মচারী ও সরকারি আমলা চাকরি ও রাজনীতি ছেড়ে নীলচাষের কারবারে আত্মনিয়োগ করে। বহু দেশীয় জমিদার ও মহাজন ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথ মালিকানায় কারবার খোলে এবং দেখতে না দেখতে ১৮১৫ সালের মাঝে নদীয়া, যশোর, খুলনা, চব্বিশ পরগনা, বগুড়া, রাজশাহী, মালদহ, পাবনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় অসংখ্য নীলকুঠি গড়ে ওঠে। এসব এলাকার নীলের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যবঙ্গের উৎকৃষ্ট নীলের ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী হবার কাহিনি সকল ধনিক ও বণিক সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করে এবং ক্রমশ ফরাসি, ডাচ, পর্তুগীজ, দিনেমার প্রভৃতি দেশের ধনিক গোষ্ঠীও দলে দলে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। (৮) নীল চাষের প্রসার দেখে বাংলার শীর্ষস্থানীয় মুৎসুদ্দি, নব প্রতিষ্ঠিত জমিদার গোষ্ঠী ও উদীয়মান শহুরে শ্রেণী নীলকরদের সুযোগ-সুবিধা ও নীলচাষের প্রসারের জন্য আন্দোলন শুরু করে।

তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ সরকারের সুনজরে থাকা। এদের মাঝে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায় অন্যতম। তারা ১৮২৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে এক সভা করেন এবং নীল চাষ প্রসারের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ পাঠান। পার্লামেন্ট তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দাস মালিক ও দাস পরিচালনাকারীদের বাংলায় এনে নীলচাষের তদারকিতে নিয়োজিত করে। এছাড়া ব্যাপক নীল চাষের কারণে বিহার ও উড়িষ্যা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

এই উদ্দেশ্যে ইংরেজরা আগ্রা ও অয্যোধ্যা দখল করে। (৯) সবমিলিয়ে নীলচাষ বিলেতের পার্লামেন্ট থেকে কৃষকের পর্ণকুটির পর্যন্ত সর্বত্র আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ২০ লক্ষ ৪০ হাজার বিঘা জমিতে ১২ লক্ষ ৮০ হাজার মণ নীল উৎপন্ন হত। বাংলায় ১১৬টি কোম্পানি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ৬২৮টি সদর কুঠির অধীনে সর্বমোট ৭৪৫২টি নীলকুঠি ছিল (ব্যক্তিগত ও দেশীয় জমিদার-মহাজনদের কুঠি বাদে)। নীলচাষে কর্মরত ছিল ১ কোটি ১২ লক্ষ ৩৬ হাজার কৃষক এবং নীলকুঠিগুলোতে নিযুক্ত কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৪শ ৮২ জন।

ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূলধনের শতকরা ৭৩ ভাগ নীলের কারবারে লগ্নিকৃত ছিল। সে সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোন পন্য নীলের মত এত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে নি। (১০) নীল কুঠি ও কারবার পরিচালনা একটি কোম্পানি একাধিক কুঠি স্থাপন করে ব্যবসা চালাত। তার মাঝে একটি কুঠিতে সমগ্র কারবার পরিচালনা করার জন্য একটি বোর্ড থাকত, এই কুঠিটিকে বলা হত সদর কুঠি বা কনসার্ণ। সদর কুঠিতে অবস্থিত পরিচালনা বোর্ড প্রতি কুঠিতে একজন ম্যানেজার বা অধ্যক্ষ নিয়োগ করত।

তাঁকে বলা হত বড় সাহেব এবং তার সহকারিকে বলা হত ছোট সাহেব। এই পদ দুইটি সর্বদা শ্বেতকায় লোকদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। বাকি পদগুলো ছিল দেশীয় লোকদের জন্য। ছোট সাহেবের পর যার সর্বোচ্চ পদমর্যাদা ছিল, তাঁকে বলা হত দেওয়ান বা নায়েব। অনেক ক্ষেত্রে এই পদটিও একজন ইংরেজ বা শ্বেতকায় ব্যক্তি দখল করত।

দেওয়ানের আবার একাধিক সহযোগী থাকত। এসব সহযোগী প্রজা ও অন্যান্য নিম্নপদস্থ কর্মচারীর সাথে সাহেবদের যোগাযোগ রক্ষা করত। তাদের প্রধান কাজ ছিল হিসাবপত্রের নানা কাজ করা। দেশীয় কর্মচারীদের মাঝে এরাই সর্বাপেক্ষা লাভবান হত। কারণ হিসাবে গরমিল, সই জালকরণ, ঘুষ গ্রহণ ও সুদের কারবারি করে এরা প্রজাদের কাছ থেকে প্রভূত অর্থোপার্জন করত।

(১১) এরপর ছিল পর্যায়ক্রমে গোমস্তা, আমিন, সরকার, তহসিলদার, মাহুত, সহিস, বরকন্দাজ, ওজনদার, পেয়াদা, জমাদার, তাগিদগীর, চৌকিদার, মালি প্রভৃতি অসংখ্য নিম্নপদের কর্মচারী। এমনকি যারা পানি, জ্বালানি, দুধ, দৈ, মুরগি, মাংস, ডিম সরবরাহ করত বা সাহেবের ছাগল-ভেড়া চরাত, তারাও ছিল তকমাধারী। বেতনের ক্ষেত্রে, দেশি দেওয়ানের বেতন ছিল মাসে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ১৭ টাকা পেত গোমস্তা। আমিনের কাজ ছিল জমির সীমানা বের করা ও মাপজোক করা।

সে বেতন পেত ১৪ টাকা। সরকার ও তহসিলদারের বেতন ছিল ১১ টাকা। মাহুত ও সহিস পেত ৭ টাকা। বাকি কর্মচারীরা কোন বেতন পেত না, তবু তারা চাকরি করত এবং এলাকায় নিম্ন আয়ের লোকদের মাঝে তারাই ছিল অবস্থাসম্পন্ন। কারণ তারা সাধারণ মানুষকে ভীষণভাবে শোষণ করত।

নীল পরিমাপের জন্য ওজনদার এবং রায়তদের কাজে তাগিদ দেবার জন্য তাগিদগীর ছিল। তাগিদগীর যথাসময়ে নীলবীজ ও দাদন গ্রহনের জন্য কৃষক প্রজাদের সংবাদ পৌঁছে দিত এবং বৃষ্টির পর কোন জমিতে নীল বুনতে হবে, তা জমিতে 'দাগ' মেরে নির্দিষ্ট করে দিত(১২)। পুলিশের কাজ করত পেয়াদা। কাউকে ধরে আনা এবং শাস্তি প্রদান করা তার কাজ ছিল। সম্ভবত গোমস্তার পর পেয়াদাই সবচেয়ে জুলুমবাজ কর্মচারী ছিল(১৩)।

কুলি ও মজুরদের কাজ দেখাশোনা করত জমাদার। সহরত ও ইস্তেহার ইত্যাদি জারি করত চৌকিদার। বরকন্দাজ ছিল কুঠির লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান। এরা সবাই সাধারণ মানুষের কাছে ভীষণভাবে ঘৃণ্য ছিল(১৪)(১৫)। মজার ব্যাপার হল, এসব কর্মচারির অধিকাংশই মুসলিম সমাজ থেকে আগত ছিল, যদিও তুলনামূলক উচ্চ পদগুলো ছিল হিন্দুদের দখলে।

নীলচাষের প্রাথমিক অসুবিধা ও প্রতিকার লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বহু হিন্দু সরকারি কর্মচারীকে এদেশের জমির মালিক করে দেন। এরা নিজ জমিদারি সীমার মাঝে ছোটখাটো রাজা-বাদশার মত ক্ষমতা ভোগ করত। এরা জমি তো বটেই, প্রজার জানমাল, এমনকি তাঁদের ইজ্জত-সম্ভ্রমের মালিকও ছিল(১৬)। ইংরেজরা এদেশে এসে এই ভূস্বামী শ্রেণীটিকে তাঁদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে দেখতে পেল। কারণ, তারা যদি জমি কিনেও নিত, তবুও প্রজারা ওই ভূস্বামীদের অধীনে থাকত।

ফলে জমিদারের অধীন প্রজাকে দিয়ে নীলকররা ইচ্ছেমত কাজ করিয়ে নিতে পারত না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধিগণ প্রভাব বিস্তার করে ১৮১৯ সালে অষ্টম আইন(Eighth regulation of 1819) বলবৎ করেন। এই আইনে জমিদার নিজের ভূমির ভেতর 'পত্তনি তালুক' দেবার সুযোগ পায় এবং কিছু দিনের মাঝেই জমিদাররা অধিক মুনাফার আশায়, আবার কোথাও অত্যাচার বা জুলুমের ভয়ে নীলকরদের কাছে বড় বড় পত্তনি দিতে শুরু করে। কিন্তু তবুও ইংরেজদের সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয় নি। কারণ পত্তনি ব্যবস্থায় জমিদারকে উচ্চহারে সেলামি ও খাজনা দিতে হত, বিনিময়ে পাঁচ বছরের জন্য জমিস্বত্ব এবং দৈনিক মজুরির বিনিময়ে প্রজার সেবা পাওয়া যেত, যা ছিল অত্যন্ত খরচসাধ্য।

তাই খরচ কমাতে নীলকরদের বাঁকুড়া, বীরভূম, সিংভূম, ধানভূম, মানভূম প্রভৃতি দূরবর্তী এলাকা থেকে শ্রমিক এনে কাজ করাতে হত। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কুঠিয়ালরা জমিদারি হস্তগত করার চেষ্টা করতে থাকে। তাঁদের সর্বতোভাবে সাহায্য করেন মুৎসুদ্দি ও চাকুরেগণ। এদের মাঝে প্রসন্নকুমার ঘোষণা করেন, 'আলস্য, অনভিজ্ঞতা ও ঋণের জন্য দেশীয় জমিদারগন জমি পত্তনি দিতে উদগ্রীব হন, কারণ ইহাতে তাহারা জমিদারি চালাইবার ভার হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন এবং জমি পত্তনিদানের মত একটি নিশ্চিত আয়ের সাহায্যে রাজধানী কিংবা কোন একটা বড় শহরে বাস করিতে পারেন। এবং ইহাই রায়তদের জন্যে কল্যাণকর।

'(১৭) এভাবে ভেতরে বাইরে চেষ্টার ফলে ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়ার সনদে চতুর্থ আইনের(fourth regulation of 1833) দ্বারা বাংলাদেশে ইংরেজদের জমি ও জমিদারি ক্রয়ের সুযোগ প্রদান করা হয়। অনেক জমিদার অধিক মূল্য পেয়ে, কেউবা দুর্ধর্ষ নীলকর বা ম্যাজিস্ট্রেটের হুমকি পেয়ে জমিদারি বিক্রি করে চলে যায়। যারা এর আগে পত্তনি বন্দোবস্ত দিয়েছিল, তারা আর কখনো তালুক বা জমিদারি ফেরত পায়নি। অনেক জমিদার পাশের জমিদারের সাথে শত্রুতা করে জব্দ করার জন্য নীলকরদের ডেকে আনত। কিন্তু পরবর্তীতে নীলকররা উভয়ের জমিই গ্রাস করে নিত।

এভাবে বাংলার সর্ববৃহৎ নীল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান 'বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি' কেবল চুয়াডাঙ্গা, ঝিনেদা, রানাঘাট ও যশোর থেকেই ৫৯৪টি গ্রামের জমিদারি ক্রয় করে। এই বিশাল জমিদারি থেকে তারা ব্রিটিশ সরকারকে রাজস্ব দিত মাত্র ৩ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা, যেখানে কেবল চুয়াডাঙ্গা ও রানাঘাট এলাকায় এরা ১৮ লক্ষ মূলধন খাটাত। মূলতঃ এই ভাবে ইংরেজগণ অধিকাংশ জমিদারি ক্রয় করে বাংলায় জেঁকে বসে ও নীল চাষ শুরু করে। (১৮) কুঠি স্থাপন ও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নীলকুঠি ১৮১৫ সালের মাঝে সারা বাংলাদেশে প্রায় সমস্ত অঞ্চলে নীল ব্যবসা প্রসার লাভ করে ও নীলকুঠি স্থাপিত হয়। এর পেছনে তিনটি কারণ বিদ্যমান - কোম্পানির আগ্রাসী বানিজ্য নীতি, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের উদ্যোগ এবং দেশি মুৎসুদ্দিদের প্রয়াস।

১৭৯৫ সাল থেকে যেসব নীল কারবারি ও ব্যবসায়ী এদেশে কুঠি স্থাপন করে কারবারি শুরু করেন, তাঁদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন - ১৭৯৫ সালে মিঃ সি. ডব্লিউ. শেরিফ জোড়াদহে ১৭৯৬ সালে মিঃ জন রিভস ও শেরিফ যৌথ মালিকানায় সিন্দুরিয়ায় ১৭৯৬ সালে মিঃ টাপট মহম্মদশাহীতে ১৮০০ সালে মিঃ ফারগুসন ও মে সাহেব যৌথ মালিকানায় যথাক্রমে দহকোলা ও আলমপুরে ১৮০০ সালে মিঃ টেলর মহেশপুরে ১৮০১ সালে মিঃ বার্কার সাহেব চুয়াডাঙ্গার নিশ্চিন্তপুরে ১৮০১ সালে মিঃ অ্যান্ডারসন যশোরের বারিন্দি ও বারুই পাড়ায়(১৯) ১৮০৫ থেকে ১৮১৫ সালের মাঝে যারা নীল কুঠি স্থাপন করেন- মিঃ টেলর ও ন্যুডশন - মিরপুরে মিঃ রিজেট - ন'হাটায় মার্টিন কোম্পানির ম্যানেজার মিঃ স্টিভেনসন - কুষ্টিয়ার আমবাগানে মিঃ জেনকিনস ও ম্যাকেঞ্জি - ঝিকরগাছায় মিঃ ওয়াটস - গোস্বামী দুর্গায় মিঃ ডেভরেল - ঝিনেদার পার্শ্ববর্তি হাজরাপুরে(২০) দেশি জমিদার ও মুৎসুদ্দিদের মাঝে অনেকেই ইংরেজ কুঠিয়ালদের দেখাদেখি নিজ এলাকায় নীল ব্যবসা শুরু করেন। তাঁদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ক'জন হলেন - জমিদার অবনীমোহন বসুঃ ইনি প্রজা পীড়নের জন্য কুখ্যাত ছিলেন। তার সদর কুঠি ঘোড়াখালিতে অবস্থিত ছিল। তিনিই দেশীয় জমিদারদের মাঝে সর্বপ্রথম ইংরেজ ম্যানেজার রাখেন। হরিচরণ সাহাঃ চুয়াডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী শ্রীকোল বোয়ালিয়ার মহাজন।

ইনি একটি ছোটখাটো নীলকুঠি স্থাপন করে নীলের ব্যবসা শুরু করেন এবং সেই বছরই একটি কুঠি থেকে সর্বোচ্চ নীল উৎপাদনের রেকর্ড করেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কালিপ্রসন্ন সরকারঃ ইনি চাকরি ছেড়ে আর. এস. পাউরান-এর কাছ থেকে মদনধারী সদর কুঠি কিনে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। রাজা প্রমথভূষণঃ নলডাঙ্গার রাজা। এদেশীয় রাজাদের মাঝে সর্বপ্রথম নীলচাষ শুরু করেন তিনি। তার অত্যাচার এতই জঘন্য ছিল যে কৃষকেরা সেটা নিয়ে গানও বেঁধেছিল- 'আহা একটুখানি চাঁদেরে ভাই মাঠ করেছে আলো, বেলে দাড়ি নীল বুনিলাম নীল হল না ভাল।

বাবুর ঘোড়া জোড়া জোড়া নীল দেখিতে যায়, নীল দেখিতে পেয়ে বাবুর ব্যর্থ হাসি পায়। ব্যর্থ হাসি, মুখে বাঁশি, চাঁদ খাঁর বাড়ি চাঁদ খাঁ চাঁদ খাঁ বসে কর কি? তোমার পুত্র মার খাচ্ছে নলডাঙ্গার কাছারি। আর মেরো না আর মেরো না ফুলো বেতের বাড়ি, কাল পরশু দিয়ে যাব দাদনের কড়ি, নীল বুনিব নলে গাবো আসবো তাড়াতাড়ি। '(২১) এছাড়া আচার্য মথুরনাথ(সাধুহাটির জমিদার), রঘুপতি মজুমদার(পথহাটির দিকপতি), শ্রীহরি রায়(চণ্ডীপুরের জমিদার), আশুতোষ গাঙ্গুলি(পোতাহাটির নায়েব) প্রভৃতি নীল চাষ করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। এখানে বলে নেওয়া ভাল, নীল বিদ্রোহের শুরু হয় চুয়াডাঙ্গার চূর্ণী বা মাথাভাঙ্গার তীরবর্তী কতগুলো গ্রাম থেকে।

কারণ এসব এলাকায় সর্বোচ্চ মানের নীল উৎপন্ন হত, তাই বেশি বেশি উৎপাদনের আশায় নীলকরেরা অত্যাচারও বেশি করত। এই কারণে এখানকার প্রধান একটি কুঠির বর্ণনা দেয়া হল। সিন্দুরিয়া সদর কুঠিঃ সাবেক চুয়াডাঙ্গা মহকুমাকে নীলকররা ৬টি সদর কুঠিতে ভাগ করে - ১.সিন্দুরিয়া সদর কুঠি ২.নিশ্চিন্তপুর সদর কুঠি ৩.চণ্ডীপুর সদর কুঠি ৪.খাল বোয়ালিয়া সদর কুঠি ৫.লোকনাথপুর সদর কুঠি ৬.কাঁচিকাটা সদর কুঠি এদের মাঝে সিন্দুরিয়া সদর কুঠি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও উৎপাদনশীল ছিল। মোট ১৬ হাজার ৬শ ৫২ বিঘা জমিতে বছরে ১০০০ মণ নীল উৎপাদিত হত। চাষি ও কর্মচারীর মোট সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ২৬ হাজার ৩শ ৬৮ জন।

সিন্দুরিয়া নীলকুঠির প্রথম মালিক ছিলেন জেমস আইভান মে। ১৭৯৩ সালে তিনি কুঠি নির্মাণে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণে তাঁকে ফিরে যেতে হয়(২২)। এর পরে মিঃ জন রিভস দায়িত্ব নেন, কিন্তু তিনিও কুঠি নির্মাণে ব্যর্থ হন(২৩)। তিনি স্থান পরিবর্তন করে কুঠিটি মর্তুজাপুর এবং হিঙ্গের পাড়া গ্রামের মাঝে নিয়ে আসেন।

মিঃ শেরিফ কুঠির মালিকানার অংশীদার হন। কুঠির ম্যানেজার হিসেবে মিঃ জর্জ ম্যাকনেয়ার দায়িত্ব পান। কুঠির দক্ষিণাংশ তখন সম্পূর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ ছিল(২৪)। পরে এখানে কর্মচারীদের জন্য একটি দালানবাড়ি স্থাপন করা হয়। সিন্দুরিয়া সদর কুঠিতে একেবারে শুরুতেই প্রজা বিদ্রোহ দেখা দেয়।

উৎপাদন বন্ধ হবার উপক্রম হয়। ক্ষতির আশঙ্কা দেখে রিভস কারবার ম্যাকনেয়ার ও শেরিফের কাছে বিক্রি করে ইংল্যান্ডে চলে যান। আশ্চর্যের কথা, ঠিক তখন থেকেই ম্যাকনেয়ার কারবারে লাভ করতে থাকেন। অনেকে বলেন, শেরিফ ও ম্যাকনেয়ারের ষড়যন্ত্র করে এই কুঠিতে বিদ্রোহ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তো ম্যাকনেয়ার বহুসংখ্যক কর্মচারী ছাঁটাই করেন, চাষিদের নতুন চুক্তির আওতায় আনেন, সেই সাথে পেয়াদার সংখ্যা বৃদ্ধি করেন।

ফলে ১৮৫৮-৫৯ সালে চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে তার কুঠি সর্বোচ্চ নীল উৎপাদন করে। কুঠিতে পূর্বেই ৮ কক্ষবিশিষ্ট সুরম্য প্রাসাদ, নীল হাউস, সেরেস্তার কাজ চালানোর জন্য কাছারি, নাচমহল, গোরস্থান, মৃত্যুকূপ, ঘোড়দৌড়ের মাঠ এবং কর্মচারীদের বাসস্থান তৈরি করা ছিল। তিনি নতুন করে সচিবালয়(২৫), পিলখানা, গুটিপোকা চাষের জন্য দালান, হাতিশাল তৈরি করেন এবং ১৮৬৩ সালে কুঠিতে পুকুর খনন করেন। তিনি চাষিদের কাছারি ঘরে ডেকে এনে নির্যাতন চালাতেন। প্রায়ই চাষির মেয়ে বা স্ত্রীকে ডেকে নেওয়া হত সাহেবের গুপ্তকক্ষে(২৬)।

সেখানে কত কিশোরী, কত নারী যে তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। সাহেব তার লালসা মেটানোর পর তার কর্মচারীদের অনেকে গিয়ে সেই মৃতপ্রায় মেয়েটিকে আবার ধর্ষণ করত। চাষি ভাগ্যবান হলে জীবন্ত অবস্থায় তার স্ত্রীকে, তার মেয়েকে ফেরত পেত। নইলে পুরো পরিবারকে খুন করে ফেলে দেওয়া হত মৃত্যুকূপে। ম্যাকনেয়ারের মানসিকতায় বিকৃতি ছিল প্রচণ্ড(২৭)।

তিনি ১৮৫২ সালে দুর্গাপুর, আটলে, খাড়াগোদা ও সিন্দুরিয়া অঞ্চলের সমস্ত খেজুর গাছ ও বাগান উৎপাটিত করে নীল আবাদের জন্য জোরপূর্বক জমি তৈরি করেন। পরবর্তীতে তার পাশবিক আচরণ এই অঞ্চলে নীল বিদ্রোহের অন্যতম প্রভাবক হয়ে ওঠে। ব্যবসা উঠে যাবার পর ১৯১০ সালে শ্রীমতী বিশ্বাস নামক এক খৃস্টান মহিলা এই কুঠি ক্রয় করেন। তার বংশধরেরা দেশ ভাগের সময় আতাউর রহমান এবং আব্দুর রহিম এই দুই ভাইয়ের কাছে কুঠি বিক্রি করে চলে যান। বর্তমানে কুঠির প্রাসাদগুলো বিলুপ্ত, সেগুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।

পীড়ন ও বিদ্রোহের সূচনাঃ নীলচাষে শোষণ ১৮৩৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে আইনবলে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়। যে সব কর্মচারী সেখানে রবার চাষে ক্রীতদাসদের ওপর নৃশংস অত্যাচার চালাতে অভ্যস্ত ছিল, তাঁদের বঙ্গদেশে এনে নীলকর বানিয়ে দেওয়া হয়। তারা এখানে এসে নীল ব্যবসায়ী, মহাজন, জমিদার এমনকি অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ দখল করে। তাই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারি হয়ে তারা এদেশের সাধারণ কৃষকের ওপর যে সীমাহীন অত্যাচার চালায়, তার সমতুল্য মর্মান্তিক ঘটনা আজো বিরল। নীলকরদের সামনে প্রজারা ছিল অসহায়।

আইন-আদালত তো দূরের কথা, তাঁদের সাথে নবাব-বাদশাদেরই সংস্রব ছিল না। এমতাবস্থায় তারা নিরুপায় হয়ে দাদনী চুক্তিপত্রে টিপসই দিত এবং নীল চাষ করতে বাধ্য হত। দাদনী চুক্তিপত্র বা একরারনামা ছিল একটুকরা সাদা কাগজ, যার ওপরে প্রথমে কৃষকের টিপসই নেওয়া হত, তারপর গোমস্তাকে দিয়ে ইচ্ছেমত শর্তাদি লিখিয়ে নেয়া হত। এসম্পর্কে এক ইংরেজ লেখক বলেন, 'The cold, hard and sorbid who can plough up grain fields, kidnap recusant rayets, confine them in dark holes, beat and starve them into submission, which things have sometimes been done, can give no moral guarantee of his capability of filling up a blank paper and turning it to his precuniary profit.'(২৮) এই চুক্তিপত্রে কৃষকের সকল উৎকৃষ্ট জমির কথা লেখা থাকত, কিন্তু সে তা জানতে পারত না। সারা বছর সার-মাটি দিয়ে, লাঙল চষে, বৈশাখ মাসে মাঠে ধানের বীজ নিয়ে গিয়ে কৃষক দেখত তার জমিতে খুঁটি গেঁড়ে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ এই জমিতে নীল চাষ করতে হবে।

সন্ধ্যাবেলা তাগিদগীর এসে জানিয়ে যেত কৃষক যেন ভোরে গিয়ে নীলের বীজ ও দাদনের টাকা নিয়ে আসে। অন্যথা হলে তাঁকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হত। প্রশ্ন উঠতে পারে, যেখানে দাদনের টাকা ও বীজ দেওয়া হত, সেখানে নীল চাষে ক্ষতি কোথায়? প্রথমতঃ, নীল ছাড়া অন্য কোন শস্য চাষ করার জন্য জমি চাষির হাতে থাকত না। দ্বিতীয়তঃ, সোজা কথায় বলা যায়, ৩৩ শতাংশ বা এক বিঘা নীল চাষ করে চাষির খরচ হত ৩ টাকা। আর আয় হত ১ টাকা।

ফলাফল? প্রতি বিঘায় ক্ষতি ২ টাকা। অন্য কোন জমিতে ধান পাট চাষের জন্য অনুমতি না থাকায় কৃষক এই ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ করতে পারত না। তাঁকে টাকা ধার করতে হত। এভাবে কৃষকের পিঠে ঋণের বোঝা ক্রমে ক্রমে আরও বাড়ত। অন্যদিকে নীলকরের হিসাব করলে দেখা যায়, ১৮৪০ সাল পর্যন্ত প্রতি টাকায় ১০ আঁটি নীলের দর ছিল।

১০ বাণ্ডিলে নীল থাকত আড়াই সের। ২৩০ টাকা মণ দরে আড়াই সের নীলের দাম ছিল ১৩ টাকা ৬ আনা। চাষিকে ১ টাকা দিয়ে নীলকরের লাভ হত ১২ টাকা ৬ আনা! ১৮৪০ সালের পর তীব্র আন্দোলনের মুখে টাকায় ৪ বাণ্ডিল মূল্য নির্ধারিত হয়। এতে চাষি পেত ২ টাকা আর নীলকরের লাভ থাকত ১১ টাকা ৬ আনা, বা মণে ১৯৪ টাকা। জেমস ওয়াটস তার বইয়ে নীল ব্যবসার মুনাফা দেখিয়েছেন পুরো ১০০ শতাংশ(২৯)।

'Indian Field' পত্রিকায় প্রকাশিত এক হিসাবে দেখানো হয়, যে পরিমান নীলের জন্য চাষি পায় ২০০ টাকা, তা থেকে নীলকর পায় ১৯৫০ টাকার রং। যদি রং প্রস্তুতের জন্য আরও ২০০ টাকা খরচ হয়, তবু তার লাভ থাকে ১৭৫০ টাকা(৩০)। বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাশলি ইডেন নীল কমিশনের কাছে তামাক ও নীলচাষের তুলনামূলক একটা হিসাব দাখিল করেন। তা থেকে দেখা যায়ঃ নীল উৎপাদনে ব্যয় খাজনা ০৩ টাকা ৮ মাসে লাঙলের খরচ ০৮ টাকা সার ০১ টাকা বীজ ১০ আনা নিড়ানি ০৪ আনা গাছ কাটা ০৮ আনা ---------------------------------------------- মোট খরচ ১৩ টাকা ৬ আনা উৎপন্ন নীলের বিক্রয়মূল্য ০৪ টাকা --------------------------------------------- অতএব, ক্ষতি ৯ টাকা ৬ আনা একই জমিতে তামাক উৎপাদনের ব্যয় খাজনা ০৩ টাকা লাঙল ০৮ টাকা নিড়ানি ০৬ টাকা সার ০১ টাকা সেচ ০১ টাকা অন্যান্য ০৫ টাকা ---------------------------------------------- মোট খরচ ২৪ টাকা উৎপন্ন তামাকের বিক্রয়মূল্য ৩৫ টাকা ---------------------------------------------- অতএব, লাভ ১১ টাকা অ্যাশলি ইডেন তার মন্তব্যে লিখেছেন, 'রায়েত নিজের জমিতে স্বাধীনভাবে তামাক চাষ করতে পারলে সে যা লাভ করতে পারত তার সাথে নীলচাষের জন্য তার যা ক্ষতি হয়েছে, তা যদি যোগ করা হয়, তাহলেও রায়তের ক্ষতি থাকে ২০ টাকা ৬ আনা। ১৮৫৮ সালে তামাকের মূল্য ছিল ১৮ টাকা।

এই মূল্য ধরলে তামাক চাষে প্রজার লাভ হতে পারত ১০১ টাকা ১৪ আনা'(৩১)। এছাড়া আরও নানাভাবে অত্যাচার করা হত। নীলকররা কৃষকের জমি মেপে সে অনুযায়ী দাদনের টাকা দিত। কিন্তু যে মাপদণ্ড দিয়ে মাপা হত, তা প্রকৃত মাপের চেয়ে অনেক দীর্ঘ ছিল। চাষির ১১ বিঘা মাপদণ্ডে দেখাত ৭ বিঘা(৩২)।

চুক্তিপত্রের স্ট্যাম্পের দাম দিত কৃষক। নীলগাছ কুঠিতে পৌঁছে দেবার ভাড়া দিত কৃষক। দেরি হলে পেয়াদার দল এসে কৃষকের খাসি-মুর্গি-ছাগল ধরে নিয়ে যেত, আম-কাঁঠাল-লিচুর গাছ কেটে তছনছ করে দিত। নীলক্ষেতে যে ঘাস জন্মাত, তার ওপরেও কৃষকের কোন অধিকার ছিল না। ভুলে গরু ছাগল ছুটে ক্ষেতে গেলে পাহারাদার সেগুলো ধরে জব্দ করে ফেলত।

পরে ৮ আনা ঘুষ দিয়ে তাঁদের ছুটিয়ে আনতে হত(৩৩)। সরকারও এই অত্যাচারে মদদ দেয়। ১৮৩০ সালে আইন জারি হয়, যারা নীলচুক্তি ভঙ্গ করবে, তাঁদের ফৌজদারি আইনে সোপর্দ করা যাবে ও সম্পত্তি ক্রোক করা যাবে। এভাবে একে একে কৃষক তার সমস্ত জমি হারিয়ে, নীলচাষে লোকসান দিয়ে, অর্থকারী ফসল-গবাদিপশু-গাছপালা হারিয়ে নিরন্ন, বিবস্ত্র ও অসহায় হয়ে যেত মহাজনের কাছে। কিন্তু মহাজনের পুরো ঋণ শোধান তো দূরের কথা, সুদের টাকাও তাঁর দেবার সামর্থ্য হত না।

একদিন দেখা যেত আদালতের ডিক্রিবলে মহাজন তার ভিটেমাটি, পৈতৃক জমি দখল করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে পথে। আর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাই একদিন রুখে দাঁড়ালো কৃষকেরা। নীল বিদ্রোহের শুরু ও কয়েকটি ঘটনা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ অসহযোগ আন্দোলনে পরিণত হয় ১৮৫৮ সালে এবং বিদ্রোহ হয়ে বেরিয়ে আসে ১৮৫৯ সালের এপ্রিল মে মাসে। এর আগেও চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার। যেমন Calcutta Review পত্রিকায় বলা হয়েছে, সর্বপ্রথম ১৮৪৪ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারি নীলকুঠিতে মানুষ খেপে ওঠে এবং আগুনে কুঠিটিকে ভস্মীভূত করে(৩৪)।

এভাবে যেখানেই নেতৃত্ব ও সংগঠন গড়ে ওঠে, সেখানেই শুরু হয় প্রতিবাদ, বিদ্রোহ। নীল বিদ্রোহের পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো হলঃ ক. নীলকরদের নির্দিষ্ট উচ্চহার বা বর্ধিত খাজনা দিতে এবং জমি বন্দোবস্ত গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ খ. সাদা কাগজের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি গ. নীলবীজ ও দাদনের টাকা গ্রহণে অস্বীকৃতি ঘ. অত্যাচার থামাতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ ঙ. সংবাদপত্র, নাটক, লোকগান, ছড়া ইত্যাদির মাধ্যমে নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা ও প্রচার করা চ. দলবেঁধে নীলচাষ বন্ধ করা ছ. নীলগাছ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলে অন্য ফসল বোনা জ. লাঠিয়াল বাহিনী সংগঠন এবং নীলকরদের পেয়াদা ও পাহারাদারদের পর্যুদস্তকরণ ঝ. সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঞ. সবশেষে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই এবং নীলকরদের উচ্ছেদ ঠিক কোথায় প্রথম বিদ্রোহের সূচনা তা নিয়ে নানা মত বিদ্যমান। অধিকাংশই মনে করেন যে, চূর্ণী নদীর তীরবর্তী চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের খাল বোয়ালিয়া ও আসাননগর কুঠিতে সর্বপ্রথম এই বিদ্রোহ শুরু হয়। কারো মতে চৌগাছা কুঠিতে এর সূত্রপাত। বাকল্যান্ড সাহেবের মতে, উত্তরবঙ্গে এই বিদ্রোহ শুরু হয়।

তার মতে, আওরঙ্গবাদ মহকুমার এন্ড্রোজ কোম্পানির আঙকারা নীলকুঠির ওপরে সর্বপ্রথম আক্রমণ করার মাধ্যমে বিদ্রোহ শুরু হয়। তবে বিদ্রোহ যে বাংলাদেশে শুরু হয়, তা সম্পর্কে সবাই একমত। তবে সাধারনতঃ বলা হয় যে, অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন মালদহ জেলার কৃষকগণ এবং তার পূর্ণতা সাধন করেন উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা। আর সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন টাঙ্গাইলের কাগমারির কৃষকেরা এবং পূর্ণতা সাধন করেন চুয়াডাঙ্গা এলাকার কৃষকগণ(৩৫)। নীলবিদ্রোহের শুরুর কিছু ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

যেমন দুর্গাপুরের পিয়ারি মণ্ডলের রসিক প্রতিবাদ(৩৬), সিন্দুরিয়া নীলকুঠির গোমস্তা শীতল বিশ্বাসের হত্যা(৩৭), রব্বানি মণ্ডলের ওপরে অত্যাচার(৩৮) -এর মত ঘটনা নীল বিদ্রোহের অসহযোগ পর্যায়কে আরও বেগবান করে এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে দেয়। এই বিদ্রোহ মূলত শুরু হয় ১৮৫৯ সালে, বাস্তব রূপ পরিগ্রহন করে ১৮৬০ সালে এবং ১৮৬১ সালে প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। অসহযোগ এই আন্দোলন ঠেকাতে কুঠিয়াল ও জোতদাররা লাঠিয়াল বাহিনী নামায় ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে, ফলে ১৮৫৯ সালের শেষে বা ১৮৬০ সালের শুরুতে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহের কেন্দ্রে ছিল কৃষকদের লাঠিয়াল বাহিনী। বাহিনী গঠন ও রণকৌশল ১৮৬০ সালের এপ্রিলে 'ইন্ডিয়ান ফিল্ড' নামক মাসিক পত্রিকায় দু'জন জার্মান পাদ্রি চুয়াডাঙ্গার বিপ্লবীদের লাঠিয়াল বাহিনী সম্পর্কে লেখেন, 'অপটু কৃষক যোদ্ধাগণ নিজেদের ৬টি কোম্পানিতে বিভক্ত করেছে।

১ম কোম্পানি তীরন্দাজদের নিয়ে গঠিত। ২য় কোম্পানি গঠন করা হয় প্রাচীনকালের ডেভিডের মত ফিঙা দিয়ে গোলোক নিক্ষেপকারীদের নিয়ে। ইটওয়ালাদের নিয়ে তৃতীয় কোম্পানি। এরা পরিধেয় লুঙ্গিতে মাটির বড় বড় ঢেলা, ইট-পাটকেল বহন করে এবং ছুঁড়ে মারে। ৪র্থ কোম্পানি গঠিত বেলওয়ালাদের নিয়ে, যাদের কাজ হল নীলকরদের লাঠিয়াল বাহিনির মস্তক লক্ষ করে শক্ত কাঁচা বেল ছুঁড়ে মারা।

থালা-ওয়ালাদের নিয়ে ৫ম কোম্পানি। তারা ভাত খাবার কাঁসা ও পিতলের থালাগুলো আনুভূমিকভাবে চালাতে থাকে। এতে শত্রু নিধন যে ভালভাবেই হয় তাতে সন্দেহ নেই। ৬ষ্ঠ কোম্পানি মহিলাদের নিয়ে গঠিত হয়। তারা হাতে মাটির পোড়ান খণ্ড, মাটির বাসন ও রুটি বেলার বেলন নিয়ে আক্রমণ করে থাকে।

প্রথমে তারা লাঠিয়ালদের দিকে মাটির খণ্ড ও বাসনকোসন ছুঁড়ে মারে। এতে লাঠিয়াল যদি ভূপাতিত হয়, তখন তাঁকে বেলনপেটা করা হয়। আর যারা যুদ্ধে পটু, তাদের নিয়ে মূল কোম্পানি গঠিত। এরাই কৃষক লাঠিয়াল, এরা সম্মুখ সমরে অংশ নেয়। এই কোম্পানির অর্ধেক বল্লমধারী, অর্ধেক লাঠিধারী।

সবার সামনে থাকে বল্লমধারি, তাঁদের পর লাঠিয়ালরা, এবং তারপর বাকি পাঁচ কোম্পানি। এদের বীরত্ব কিংবদন্তিসম। একজন বল্লমধারি নাকি ১০০ জন শত্রুপক্ষীয় যোদ্ধাকে পরাজ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।