আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আবে জমজমের পানি.......ছোটগল্প

বিজ্ঞানী কলিন্স পড়ে চাঁদে যাওয়ার দোয়া। আমি ইমরান মাঝি দেখো ছইয়ের মধ্যে শোয়া মক্কাশরীফে আবে জমজমের পাড়ে বসে বউয়ের মৃত্যু কামনা করে বসিরউল্লা। বলে-‌ইয়া আল্লা আগামী দু'একদিনের মধ্যে যেন কুলসুমের রক্তবমী হয়া মৃত্যু হয়, -আমিন। ' কিন্তু হাজিদের ভিরের মধ্যে সে একটা কুকুর দেখে, বড় জিব্বা বের করে সে জমজমের পাড়ে ঘুরপাক খায়, সে কিছু করবে বলে মাঝে মাঝে পা উঁচায়। জিব্বায় কামড় দেয় বসিরউল্লা।

মুনাজাত ছেড়ে দিয়ে সে হুইস হুইস করে কুকুর তারায়। এমন সময় তাকে যেন কে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। এমনই যে সে ধাক্কা। হঠাৎ উঠে না দাঁড়ালে সে হয়তো জমজমের ভেতর ঝপ্পর করে পড়ে যেতে পারতো। সে দেখে যে বড় ভাইয়ের মেয়ে মরজিনা তার সামনে দাঁড়ানো।

সে মরজিনার চোখের দিকে তাকায়। তার চোখ পিট পিট করে । মরজিনা জিব্বা দিয়ে ঠোট বিজিয়ে বলে আপনেরে আমি সারা গ্রাম খুঁজছি, চাচির অবস্থা ভালো না । বাড়ি চলেন। বসিরউল্লা হাত উচিয়ে একবার আর মোড়া ভাঙে ।

জমজমের কালো কুচকুচে জলের দিকে তাকায়, ভাঙা সিড়িটা তার নজরে পরে । নজরে পরে এই করা দুপুর বেলা বড় আম গাছটা থেকে একটা মরা পাতা ছুটে গিয়ে নিচের দিকে পড়ে। মরজিনা আবার বলে বাড়ি চলেন জেডা হঠাৎ বসিরউল্লা দ্রুত পায়ে হাঁটা দেয়। সে এদিক ওদিক তাকায় না। সে পায়ের জোর আরও বৃদ্ধি করে ।

অবশেষে জমজমের পারে ঘুরতে থাকা সেই কুকুটার মতই খিচ্ছা দৌড় দেয়। সামনের চষাখেত, মোল্লাদের সুপাড়ি বাগান, দক্ষিনের পাকা রাস্তা, মনাদের উঠান পেরিয়ে সটখাট পথে সে যখন বাড়ি এসে পৌছায়, তখন তার জিব্বাটাও ঐ কুকুটার মত বেরিয়ে আসতে চায়, তখন তার বউটা আগের মতই মাগো মা, চিৎকার করে। আজ দুইদিন হলো তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তাকে চোরের মত হাত ঝুলিয়ে রেখেছে ওরা। সামনের হেলানচির উপর ধপাস করে বসে বসিরউল্লা ।

বসে হে হে করে হাপায়। সে হাটুর উপর লুঙি উঠিয়ে বসে। করুন চোখে আকাশের দিকে তাকায়। মুখটা যেন তার বাকা হয়ে আসেতে চায়, মাথাটা এতো ভারি লাগে যে তা মনে হয় ইঁদুরে কেটে দেয়া নারকেলের মতই খুলে পড়বে কোলের মধ্যে। আচমকা একটা হলকা বাতাস আসে, তার সঙে আসে ঘরের ভেতর থেকে একটা মহিলার করুন আর্তনাদ আল্লা... আল্লা গো।

বসিরউল্লা কান খারা করে। মহিলাদের গুনগুন শব্দ তার কানে মাছির বেনবেনানির মত আসে। দরজার পর্দা সড়িয়ে একজন বৃদ্ধ মহিলা আসে। সে বলে, ‌বচির আইছিস বাবা,' মহিলার চোখ মুখ শান্ত, যেন বাড়িতে কোন সমস্যা নেই যেন বসিরের সাথে একটু খোশ গল্প করার জন্য তিনি তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। বসির অবাক হয়ে যায়।

মহিলা মাথার কাপড় আরও একটু টান দিয়ে বলে আমরা মৌলুভির কাছ থেকে তাবিজ আনাছি, চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লা আল্লা কর। তয় তুমি একটু হাজিসাবগো বাড়ি যাও, আমার নাম কইরা হেরে বলবা খালায় একটু আবে জমজমের পানি চাইছে। আবে জমজম শুইনা বসিরে মন কেমন কেমন কইরা ওঠে ।

তার পেটের মধ্যে একটা মোচর দেয়, ডান দিকের পাটা অবশ হয়ে আসতে চায়, কিন্তু বসির লুঙি ঠিক করে সোজা হয়ে বসে, বুড়ির দিকে তিক্ষè দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, হেই পানি দিয়া কি হইবো খালা, ঘরে ভেতর থেকে আবার সেই করুন শব্দটা আসে আল্লা... আল্লাগো বসির কান খারা করে, বুড়ি মুখের পানটা নিচের দিকে চেপে ধরে মুখ বন্ধ করে রাখে এক মুহুর্ত। ঘারটা একটু কাৎও বুঝি করে সে। কেননা শব্দটা মিলিয়ে গেল সে আবার বলে যাও। তাড়াড়ারি আইসো বেশি দেরি হইলে তাবিজ আবার কাজ করবে না। বসিরউাল্লা মাথা কাত করে বেশ শান্ত ভাবেই হাঁটা দেয়।

বুড়ি পর্দা পেরিয়ে আবার ভেতরে ডুকে যায়। কিন্তু সে বাড়ির দরজা পযর্ন্ত পৌছাতে না পৌছাতেই বড় ভাইয়ের মেয়ে মরজিনাকে আবার দেখা যায়, এবার সে ছুটতে ছুটতে আসে, আপনের যাইতে হইবো না জেডা। সকাল বেলাই রত্তন গেছিল... হেগবাড়ি পানি নাই । পানি আনতে মোকছেদপুরে বড় হাজিসাবগো বাড়ি মোটর সাইকেল নিয়া গেছে মেজকাকু। তারপর ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার জমজমের পাড়ে আসে বসিরউল্লা।

এবার সে বসে সিড়িগুলো ভেঙে যাওয়া ঘাটলাটার উপর, যে ঘাটলা দিয়ে একসময় হয়তো রাজকুমারী সখিগন সমেত মেমে যেত দীঘির জলে, দীঘির পশ্চিম পাড়ে এখনো একটা ভাঙা দালানের অস্তিত্ব্য অবশিষ্ট আছে। বসিরউল্লা ভাবে এই দীঘির নাম কেন যে লোকে জমজম রাখলো তা ঠিকঠাক বুঝতে পানেনি গ্রামের কেউ। তবে সে শুনেছে অনেক অনেক বছর আগে একবার পুকুরের জল নাকি হঠাৎ একরাতে সম্পূর্ন সুকিয়ে যায়,শূন্য দীঘি দেখে রাজা বিষন্ন হয়, চিন্তায় তার মুকুট পরে যায়, রানি কাঁদতে থাকে, রাজকন্যা করুন গান শুরু করে, মাস গিয়ে বছর পুরাইলেও যখন পুকুরে জল আসে না, তখন সেই অলক্ষি রাজ্য থেকে একে একে লোক সরে যেতে থাকে পাশের রাজ্যে, তখন অলৌকিক ভাবেই একদিন দুপুর বেলা একবুজুরগোকে লোকে দীঘির মধ্যখানে দেখতে পায় । রাজা ছুটে আসে, মন্ত্রি দৌড় দেয় রাজকন্যা গোড়ার পিঠে ওঠে। আশ পাশের সাত রাজ্য থেকে মুহুর্তে হাজার হাজার লোক আসে ঘটনা দেখতে।

কেউ কেউ বলে এই হাজার হাজার লোক আসলে মানুষ ছিল না, কেননা তারা মৌলভির সঙেই আসে এবং তার সঙেই বিদায় হয়। যাইহোক। সেই জুববা পড়া মৌলভি পুকুরে মাঝখান থেকে তার পরিচয় দেয়। আমি মক্কা মদিনা থেকে আসছি। আমাকে স্বরন করছে আপনাদের এলাকার একজন।

তার নাম আমি বলতে চাই না। তারপর সে পকেট থেকে একটা বোতল বের করে, এবং প্রায় নাচতে নাচতে সমস্ত পুকুরে তলায় পানি ছিটায়। এই ঘটনার পর দিন সকালে উঠে লোকেরা দেখে যে দিঘিতে পানি কল করতেছে। তারপর কে যেন বলে এ বোতলে নাকি জমজমের পানি ছিল। আর কে যে এই দিঘির নাম জমজমদিঘী রাখে তা আর কেউই বলতে পারে না।

কিন্তু বউয়ের জন্য বড় হাজিসাবগো বাড়িও যদি পানি না পাওয়া যায়। তবে তো এই পানিও খাওয়ানো যাইতে পারে। বসিরউল্লা অনেক দিনে পুরনো দিঘিটার পানির দিকে তাকায়, অযত্ন আর অবহেলায় আগাছা জমে বিভিন্ন গাছের পাতা পচে, সে পানি এখন কাকের পিঠের মত দেখতে। এইটা কে এখন আর দীগি বলা যায় না, বলা যায় মজাকুকুর । বসিউল্লা লুঙির জোচ থেকে বিড়ি বের করে।

কিন্ত মেজ আর খুজে পায় না। তখন বিড়ি কানে গুছে দীঘির উত্তর পাড় ধরে সে ধির লয়ে হাঁটতে থাকে। আর ভাবে, তার বউটা যদি মরে যায়। মানুষের বাচ্ছা হওয়াটা এমন কেন, এমন কেন! দুদিন ধরে একটা মানুষকে টানিয়ে রাখতে হয়, এই তো গত বছর তাদের গরুর বাছুর হলো। সে তো কাছেই ছিল তার তো মনে হয়নি গরুটার খুব কষ্ট হচ্ছে।

আর তার নয়া বউটা আজ দুদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছে। মানুষের বাচ্ছা হওয়াটা এমন কেন? এমনও তো হতে পারতো যে এই দীঘির জলে বেটা আর বেটি আমবস্যা পুনির্মা রাতে গোসল করবে, শুধু গোসল করবে তারা সাতার দিবে, তারা একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরবে। বড় জোর তারা দুজন দুজন কে একটা করে কামড় দিতে পারে। তারপর সাত দিন সাত রাইত পর আবার পূর্নিমারাতে তারা দীঘির পারে এসে দাঁড়ালো, তারা বাচ্ছার কান্না শুনতে পাবে, কোথায় যেন শিশু বাচ্ছা কাঁদে। তারপর তারা তন্নতন্ন করে খুজবে কেবল খুজবে এবং সুবহে সাদেরকের দিকে শাপলাপাতার উপর একটা বাচ্ছা খুজে পাবে, এবং হাসি মুখে তাকে কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে।

কেন মাছেদের বাচ্ছা জলের মধ্যে হতে পারলে মানুষের পারবে না কেন? হঠাৎ একটা গাছের সঙে ধক্কা খেতে গিয়ে বসিরউল্লা থমকে দাড়ায়, আর তার সম্বিত ফিরে আসে, তার দুপুর বেলা দেখা স্বপ্নের কথা মনে পরে। সে চঞ্চল হয়ে ওঠে। লুঙি খুলে আবার জোর করে পড়ে। সে আকাশের দিকে তাকায়। তার কেন জানি মনে হয়, দুপুরে দেখা স্বপ্নের তাবির হচ্ছে জমজমের পানি খাওয়ালেই তার বউটা মারা যাবে।

ফলে সে উল্টো দিকে ঘোরে এবং দুপুরের মতই আবার খিচ্ছা দৌড় দেয় ও বড় বাস্তা পেরিয়ে সটখাট পথে সে বাড়ির দাওয়ায় এসে ধপাস করে পরে এবং সে উচ্ছসরে ডাকে চাচি ওচাচি। কিন্তু তার কন্ঠে তেমন জোরছিল না কন্ঠেছিল কেমন ভয় মিশ্রিত শিতলতা। সেই বৃদ্ধ মহিলা পর্দা সরিয়ে পান চাবাতে চাবাতে তার সামনে আসে। মহিলা নিজেই বলে পানি পাইছে তুই চিন্তা করিস না, ব্যথা বাড়ছে, আল্লার রহমত হইলে আইজ রাইতের মইধ্যেই খালাশ হইবো। আল্লা আল্লা কর।

বৃদ্ধা আঁচল দিয়ে বসিরউল্লার মুখ মুছিয়ে দেয়। যা বাজরে গিয়াগুইরা আয়, পুরুষ মানুষ এতো ভাইঙা পরলে চলে। বসিরউলল্লা কিছু বলে না। সে কেবল মহিলার দিকে করুন চোখ তাকায়। তখন ভিতর থেকে সেই করুন স্বরটা আবার আসে আল্লা আল্লা গো।

মুখের পান চেপে ধরে মহিলা। আর বসিরউলল্লা কান খারা করে তার কান হয়তো নতুন মানুষের কণ্ঠ শুনেতে চায়, শুনতে চায় পুরান মানুষীর হাসির ঝংকার। ২৭/৪/২০১০ (অপ্রকাশিত) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।