আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিব : অনার্য দ্রাবিড় দেবতা

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ 'শিব- এর কোনও সত্তা নেই, কিন্তু তিনি সকল জীবে বিরাজমান। ' প্রাচীন ভারতে আর্যদের আগমনের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ। তার আগে ভারতবর্ষ অনার্য দ্রাবিড়জাতি অধ্যূষিত ছিল; যারা আর্যপূর্ব ভারতবর্ষে এক উন্নত নগরসভ্যতা গড়ে তুলেছিল।

২৬০০ খ্রিস্টপূর্বের সিন্ধুসভ্যতার সমৃদ্ধ নগরগুলি দ্রাবিড় জাতিরই বিস্ময়কর কীর্তি। পরবর্তীকালে যে নগরগুলি যাযাবর আর্যরা ধ্বংস করে দিয়েছিল। কেবল উন্নত নগর নির্মাণই নয়, দ্রাবিড় জাতির ধর্মীয় চেতনাও ছিল আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ। অনার্য দ্রাবিড়রা ছিল রহস্যপ্রবণ; অর্থাৎ, মিস্টিক। তাদের সাধন মার্গ ছিল যোগ।

দেবদেবীর কল্পনাতেও তারা সূক্ষ্ম ধর্মবোধের পরিচয় দিয়েছে। দ্রাবিড়দের প্রধান দেবতা ছিলেন শিব। সুতরাং, শিব হলেন অন্যতম অনার্য দ্রাবিড় দেবতা। যে কারণে সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে শিব-এর সর্ম্পক রয়েছে। এ প্রসঙ্গে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘মোহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত একটি সীলে ত্রিমুখ, দ্বিশৃঙ্গ, যোগাসনে উপবিষ্ট ও পশুবেষ্টিত যে মূর্তিটি অঙ্কিত দেখা যায় সেটিকে পৌরাণিক শিব পশুপতির আদিরূপ হিসাবে অনুমান করা হয়।

’ (ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট । পৃষ্ঠা, ১৪৩) ভারতবর্ষে আগমনের পর আর্যরা যাযাবর বৃত্তি ত্যাগ করে পাঞ্জাবের সমতল ভূমিতে বসতি স্থাপন করে। এরও কয়েক ’শ বছর পরে আর্য জাতির ধর্মীয় ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছিল তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ- এ। বেদ সব মিলিয়ে চারটি। ঋগে¦দ, যজুবেদ, সামবেদ এবং অর্থববেদ।

পরবর্তীকালে বেদের সংকলন করেছিলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস। চারটি বেদের মধ্যে ঋগে¦দই হল সবচে প্রাচীন। ঋগে¦দ এর রচনাকাল: খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৯০০ অব্দ। বেদের উল্লেখযোগ্য দেবতারা হলেন: অগ্নি, বরুণ, মিত্র, মরুৎগণ, বৃহস্পতি, পুষন, রুদ্র এবং বিষ্ণ। বর্তমানে অবশ্য একমাত্র বিষ্ণু ব্যতীত কেউই ভারতবর্ষে পূজিত হন না।

বিষ্ণু অবশ্য টিকে রয়েছেন অবতার তত্ত্বের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, রাম এবং কৃষ্ণ এঁরা দুজনই বিষ্ণুর অবতার। তবে বেদে অনার্য শিব- এর উল্লেখ নেই, থাকার কথাও নয়। অবশ্য অনেকেই বৈদিক দেবতা রুদ্রকে শিব- এর সঙ্গে তুলনা করেন। পরে অবশ্য শিব আর্য দেবমন্ডলীতে স্থান করে নেন।

তবে সেটি সহজে হয়নি। দীর্ঘকালীন আর্য-অনার্য ধর্মীয় মতার্দশের প্রবল ঘাতপ্রতিঘাতের পরই তা সম্ভব হয়েছে। এবারে তাহলে বলি কেমন করে সেটি সম্ভব হল। আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে। উত্তর ভারতের মধ্য দিয়ে গঙ্গা নদী বয়ে চলেছে ।

আর্যরা ক্রমশ গঙ্গার তীর ঘেঁষে পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরই এক পর্যায়ে আর্যরা উত্তর ভারতের নাম দেয়: ‘আর্যাবর্ত। ’ অর্থাৎ, ‘আর্যদের বাসভূমি’। সে যাই হোক। নগর গড়ে তোলার জন্য পানির সরবরাহ অনিবার্য।

সে কারণেই, আর্যরা গঙ্গার তীরে নগর নির্মান করে। এর ফলে খ্রিস্টীয় ষষ্ট শতকের মধ্যেই পশ্চিমের কাশ্মীর থেকে পূবের বিহার (প্রাচীন মগধ) অবধি উত্তর ভারতে সব মিলিয়ে ষোলটি বৃহৎ নগর গড়ে ওঠে । বৌদ্ধসাহিত্যে এই ষোলটি মহাজনপদকে ‘ষোড়শ মহাজনপদ’ বলা হয়েছে। ভারতবর্ষে আগমনের এক হাজার বছরের মধ্যেই আর্যরা তাদের উন্নত ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষার প্রভাবে স্থানীয় অনার্য দ্রাবিড় ভাষা অপসারিত করে। পক্ষান্তরে দ্রাবিড়রা তাদের রহস্যবাদী নিগূঢ় ধর্মীয় চিন্তার মাধ্যমের বাস্তববাদী আর্য মনকে প্রভাবিত করে।

আর্যরা উত্তর ভারতের নাম ‘আর্যবর্ত’ রেখেছিল বটে তবে উত্তর ভারতের অধিকাংশ জনগনই ছিল অনার্য দ্রাবিড় । কাজেই দ্রাবিড়দের জীবনধারার মাধ্যমে আর্যরা প্রভাবিত হতে থাকে। এ ভাবে এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। যে সংস্কৃতিকে বলা হয়: ‘আর্যদ্রাবিড় মিশ্র সংস্কৃতি’ । এই মিশ্র সংস্কৃতি সম্বন্ধে রণজিৎ কর লিখেছেন, ‘আর্যরা হিন্দুকুশ পবর্তমালার গিরিপথ দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে।

তারও বহু আগে এখানে বসতি গড়েছিল দ্রাবিড় প্রভৃতি জাতি। প্রকৃতার্থে এরাই ছিল ভূমিজ সন্তান। কৃষিকর্ম তাদের প্রধানতম জীবিকা হওয়ায় ভারতবর্ষের জলবায়ূ প্রকৃতি সম্বন্ধে ছিল ব্যাপক ধারণা। এরা প্রকৃতিকেই সবকিছুর নিয়ন্তা ভাবত। এ জন্য প্রকৃতিকে পূজা করা ছিল তাদের ধর্মাচারের মূল বৈশিষ্ট্য।

তারা বিশ্বাস করত প্রকৃতি বিরূপ হয়ে শস্যহানি ঘটায়, নানাবিধ উপদ্রপ সৃষ্টি করে। পূজা দিয়ে প্রকৃতির কোপদৃষ্টি এড়ানো যায়। কৃষির সঙ্গে সর্ম্পকিত থাকায় এসব সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। (এই বক্তব্য বাংলা সম্বন্ধেও প্রযোজ্য) আর্য আগমনের পর হতে এরা অনার্য অভিধায় অভিহিত। কিন্তু সমাজ বিকাশের দ্বান্দিক পরিনতিতে নবাগত আর্যরা আদিবাসী অনার্যদের বেশিদিন দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি।

ক্রমে তারা একদেহে লীন হয়ে ভারতভূমে গড়ে তুলে এক মিশ্র সংস্কৃতি-নাম সনাতন বা হিন্দুধর্ম। (সনাতন ধর্ম: মত ও মতান্তর পৃষ্ঠা, ২২) আর্যদ্রাবিড় মিশ্র সংস্কৃতিতে ধর্মীয় ভাবনায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। যেমন, ওই সময় ভারতবর্ষের অধিবাসীদের মন থেকে অধিকাংশ বৈদিক দেবতারা অপসৃত হন। তার বদলে ভারতবর্ষের সমাজে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর কে নিয়ে ‘ত্রিমূর্তি’ ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়। এই মহেশ্বরই হলেন অনার্য দেবতা শিব।

যিনি পরবর্তীকালে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতার আসন লাভ করেন। বিভিন্ন পুরাণে ও শাস্ত্রে যেসব গুণাবলী শিব- এর ওপর আরোপিত হয়েছে তা অন্য কোনও দেবতার ওপর আরোপিত হয়নি। শিবকে বলা হয়- ঈশ্বর, মহেশ্বর, পরমেশ্বর, অথবা মহাদেব। তবে ‘ত্রিমূর্তি’ কল্পনায় শিবকে অহেতুক প্রলয়ের দেবতা বলা হয়েছে। ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টির দেবতা; বিষ্ণু জগৎ পালন করেন এবং মহেশ্বর প্রলয়ের দেবতা।

‘প্রলয়ের তমোগুণে রুদ্রমূর্তিতে বিশ্বসংসার হরণ করেন বলে ইনি ‘হর’। অবশ্য অনেকেই শিব-এর এই অভিধা মেনে নেননি। সে যাইই হোক। আর্যরা অনার্য দ্রাবিড় জাতির প্রধানতম দেবতা শিবকে গ্রহন করতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিল। (উল্লেখ্য, অনার্য দ্রাবিড় জাতি বৈদিক দেবতা বিষ্ণুকে গ্রহন করেনি।

অবশ্য অন্যভাবে গ্রহন করেছিল: যেমন, রাম ও কৃষ্ণ কে বিষ্ণুর অবতার মনে করে বৈদিক দেবতা বিষ্ণুকে গ্রহন করেছিল। ) অনার্য দ্রাবিড় জাতির প্রধানতম দেবতা শিব শব্দটির অর্থ শুভ; মঙ্গলময়। (আমরা বাংলায় যে "শুভ" বলি; তাই উত্তর ভারতীয় উচ্চারণে "শিব" হয়েছে। ) ... সর্বভারতীয় দেবতা হিসেবে শিব- এর প্রতিষ্ঠা মূলত আর্যদের ওপর অনার্যদের বিশাল এক বিজয়। শিব- এর অনেক নাম।

যেমন: নীলকন্ঠ, পশুপতি, ভৈরব, ত্রিমুখ, নটরাজ ইত্যাদি। নৃত্যবিদ্যার উদ্ভাবক বলেই শিব কে বলা হয় নটরাজ । শিব এর অন্য নাম হল মহাকাল; বিরূপনেত্র (চোখ) বলে ‘বিরুপাক্ষ’; ত্রিনয়ন বলে ‘ত্রিলোচন’;মৃত্যুঞ্জয়ী বলে ‘মৃত্যুঞ্জয়’; অগ্নিনেত্রে কামদাহ বলে ‘স্মরহর’; পিনাক এঁর ধনু, তাই ইনি ‘পিনাকী’; মাথায় জটাজুট বলে ‘কপর্দী’; ডমরু এঁর প্রিয় বাদ্য। শিব এর ধাম (অর্থাৎ বসতি ) হিমালয়ের কৈলাশ শৃঙ্গ। শিব-এর বাহন ষাঁড়; যার নাম নন্দী।

যোগীদের কন্ঠের রুদ্রাক্ষের মালাও শিব এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এবার শিব- এর ছবিটি আঁকা যাক। মাথায় জটাজুট, তার মানে জটা ধরা চুল, হাতে ত্রিশূল, পরনে পশুচামড়ার পোশাক, কপালে তৃতীয় নয়ন, কন্ঠ নীল । (একদা আদিসমুদ্রের উপরিতলে বিষ ছড়িয়ে পড়েছিল; শিব সেই বিষ পান করে নীলকন্ঠ হয়েছেন। ) এই উপকথাটি কাদের? আর্যদের না দ্রাবিড়দের? আজ এই প্রশ্নের উত্তর সহজে মিলবে না ।

কেবল ইতিহাসের ধূসর লগ্নে উত্থিত অনার্য দেবতা শিব আজও ভারতবর্ষজুড়ে রয়েছেন স্বমহিমায়। তখন একবার বলেছি বৈদিক দেবতা রুদ্রর সঙ্গে অনেকে শিব এর সঙ্গে তুলনা করেন। সেই প্রলঙ্করী বৈদিক দেবতা রুদ্র ছিলেন গোবাদি পশুর প্রাণহন্তারক যম। অথচ পরবর্তী অনার্য শিবকে বলা হয়েছে- ‘পশুপতি’; অর্থাৎ পশুদের পালন করেন যিনি। এতে করে যুদ্ধংদেহী আর্যদের তুলনায় অনার্য স্পর্শকাতর হৃদয়টিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তবে পুরাণে শিব- এর রুদ্র রূপের বর্ণনা রয়েছে। আমরা অনেকেই ‘দক্ষযজ্ঞ’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। শিব দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়েছিলেন। ভারতীয় পুরাণ মতে, জীবের সৃষ্টা হলেন দশ প্রজাপতি। এদের মধ্যে একজন হলেন দক্ষ।

দক্ষ একবার রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন। সবাইকে তিনি নেমতন্ন করলেও কী কারণে কন্যা সতী ও জামাতা শিবকে নেমতন্ন করেননি । সতী নারদের কাছে পিতার এই যজ্ঞের কথা জানতে পারলেন; এরপর শিব- এর অনুমতি নিয়ে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন ঠিকই তবে সেখানে শিব এর নিন্দা শুনে ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। অপমানে সতী যোগাসনে দেহত্যাগ করেন। শিব প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ পেলেন।

এবং দ্রুত যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন। ভীষণ ক্রোধে শিব যজ্ঞ তছনছ করলেন এবং দক্ষের মুন্ডচ্ছেদ করলেন। তারপর সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয়নৃত্য আরম্ভ করলেন। এতে পৃথিবী ধ্বংসের সম্মূখীন হয়। তখন নারায়ণ সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খন্ড খন্ড করেন।

শিব এতে শান্ত হন। কাজেই শিব- এর তান্ডব অকারণ নয়। সেটি তাঁর বিরহক্ষুব্দ প্রেমময় রূপেরই প্রকাশ। সতী তো দেহত্যগ করেন। তারপর? তারপর পর্বতরাজ হিমালয়ের স্ত্রী মেনকার গর্ভে সতী আবার জন্মলাভ করেন।

পর্বতরাজ হিমালয় কন্যা বলে সতীর নতুন নাম হয়-পার্বতী। অবশ্য পার্বতীর আরও নাম আছে। যেমন: উমা, মহামায়া, চন্ডী, চামুন্ডা, ভগবতী, কালী, আদ্যাশক্তি ও গৌরী। সে যাই হোক। শিবকে আবার পতি হিসেবে পাওয়ার জন্য পার্বতী তপস্যা করতে থাকেন ।

তপস্যা সার্থক হল। পাবর্তী শিবকে পতি হিসেবে লাভ করলেন। এরপর শিব তাঁর শরীরের অর্ধেকই পার্বতীকে দান করলেন। পাবর্তী হলেন শক্তি দেবীর স্বগুণ স্বরূপ। পার্বতীকে অর্ধেক দেহ দান করার কারণেই শিবকে বলা হয় ‘অর্ধনারীশ্বর’।

বিশিষ্ট ধর্মতাত্ত্বিক ইলেন গোল্ডবার্গ এই ‘অর্ধনারীশ্বর’ শব্দটি ইংরেজি করেছেন: ‘দ্য লর্ড হু ইজ হাফ ওম্যান। ’ সে যাই হোক। শিব- এর সঙ্গে বিবাহের পর পার্বতী দীর্ঘদিন সন্তানের জননী হতে পারেননি। তখন বিষ্ণুর প্রীতিলাভ করার জন্য পার্বতী পুণ্যকব্রত পালন করেন। এক বছর পুণ্যকব্রত পালন পালন করার পর বিষ্ণু পার্বতীকে পুত্রলাভের বর দেন।

এই পুত্রই গনেশ। গনেশ ও সর্বভারর্তীয় জনপ্রিয় একজন দেবতা। যে কোনও কাজের শুরুতে গনেশ পূজা করা হয়। শিবপার্বতীর অন্য পুত্রের নাম কার্তিক। কন্যারা হলেন মনসা ও লক্ষ্মী।

শিব এবং শক্তির (শিব এর স্ত্রী শক্তি) উপাসনা যে শাস্ত্র দ্বারা বিস্তার করা হয়েছে, তাকে তন্ত্র বলে। সব মিলিয়ে ১৯২ টি তন্ত্র আছে। তার মধ্যে ৬৪টিই বাংলার। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে। শিব শক্তি লাভ করেছেন পাবর্তীর শক্তি থেকে।

তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্বীকৃত। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্য হল-শক্তির সাধনা করে শিবত্ব লাভ তথা শক্তিমান হওয়া। তন্ত্র নারীকেন্দ্রিক শক্তির আরাধনা হলেও তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে। আবার অনার্য দেবতা শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি।

শিব কে কেন অর্ধনারীশ্বর রূপে দেখা যায় সেটি একটু আগেই উল্লেখ করেছি। সৃষ্টির রক্ষক হিসেবে তাঁর প্রতীক লিঙ্গ অর্থাৎ প্রজনন চিহ্ন। এই প্রতীকের সঙ্গে যোনি অর্থাৎ স্ত্রীশক্তি সংযুক্ত হয়ে তিনি পূজিত হন। লিঙ্গপূজা আর্যপূর্ব দ্রাবিড় ধর্মীয় ঐতিহ্য। যে কারণে বলা হয়েছে: Some believe that linga-worship was a feature of indigenous Indian religion. যে কারণে শিবলিঙ্গ নির্মাণ করে পূজা করার ঐতিহ্যটিও সুপ্রাচীন।

শিবলিঙ্গ নির্মানে নর্মদা নদীর মসৃণ ডিম্বাকৃতির পাথরই উপযোগী। অর্থববেদের একটি শ্লোকে একটি স্তম্ভের প্রশংসার উল্লেখ রয়েছে। এই শ্লোকটিই সম্ভাব্য লিঙ্গপূজার সূত্রপাত। এমনটি অনেক গবেষকই মনে করেন। এখানেই বলে রাখি যে, আমরা যাকে হিন্দু ধর্ম বলি, সেটি প্রধান পাঁচটি ধারায় বিভক্ত।

বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, সৌর ও গাণপত্য। একে পঞ্চোপসনা বলা হয়। পঞ্চোপসনার মূলকথা হল -প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজস্ব উপাস্য দেবতাই মূখ্য, কিন্তু বাকিগুলিও পরিত্যাগ করার নয়। নিজেদের ধর্মেকর্মে তাদের স্থান দিতে হবে। আর্ন্তসম্প্রদায়ে বিভক্ত ভারতবর্ষে শিব- এর বিপুল জনপ্রিয়তার মূলেও এই তত্ত্বটি নিহিত।

সে যাই হোক। আমরা শিব- এর প্রথম উল্লেখ পাই রামায়ণে (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৩০০) এরপর মহাভারতে (খ্রিস্টপূর্ব ৭০০- খ্রিস্টাব্দ ১০০) শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও (৩০০ খ্রিস্টপূর্ব) শিব এর উল্লেখ রয়েছে। শিব কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে যে ধর্মটি তার নাম শৈব ধর্ম। শৈবরা বেশ কটি উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত । যেমন: পশুপাত।

এটি একটি অতি প্রাচীন ধারা। বর্তমানে এই ধারাটি বিলুপ্ত । শৈবসিদ্ধান্ত সম্প্রদায়টি দক্ষিণ ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বীরশৈব সম্প্রদায়টি দক্ষিণ ভারতের আকেটি শৈব সম্প্রদায়। শৈবদের পবিত্র গ্রন্থ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, যার কথা একটু আগে উল্লেখ করেছি।

। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে শিবকে ‘অল রিয়েলিটি’ বা পরম বাস্তব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শৈব ধর্মটি একেশ্বরবাদী এবং ভক্তিবাদী। ধর্মটির ব্যবহারিক দিক হল চর্যা, ক্রিয়া, যোগ ও জ্ঞান। শৈবধর্মের মূলভিত্তি হল কপিল প্রবর্তিত সাংখ্য দর্শন।

এটি অনার্য দর্শন। তবে বৈদিক বেদান্তের দ্বৈতবাদী এবং অদ্বৈতবাদী মতও শৈবধর্মে গুরুত্ব পেয়েছে। একজন শিবভক্তের চেতনায় শিব অনন্য গুণের অধিকারী। সত্যই শিব, সুন্দরই শিব। শিব সম্বন্ধে এভাবেই শিবভক্তরা তাদের প্রবল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে থাকেন।

শিব- এর কোনও সত্তা নেই, কিন্তু তিনি সকল জীবে বিরাজমান। শিব অদৃশ্য, কিন্তু সর্বত্র দৃশ্য। মহাভারতে যুধিষ্ঠির কে ভীষ্ম বলছেন: ‘শিব ব্রহ্মা বিষ্ণু ও ইন্দ্রের সৃষ্টা এবং তাদের ঈশ্বরও বটে। তাঁকে ব্রহ্মা থেকে পিশাচ সকলেই পূজা করে। প্রকৃতি ও পুরুষে সর্বত্র বিরাজমান শিব।

ঋষিরা যাঁরা সত্যকে উপলব্দির আশায় যোগচর্চা করেন তারা শিবের আরাধনা করেন। ’ কবি কালিদাস এর চোখে শিব অনন্য। কবির চোখে হিমালয়ের তুষার শিব এর হাসি। অদ্বৈতবাদী বেদান্ত দর্শনের প্রবর্তক শঙ্করাচার্য ছিলেন শৈব। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে শিব মূলত পূজিত হন দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী অধ্যূষিত দক্ষিণ ভারতে।

আর বিষ্ণু পূজিত হন আর্যঅধ্যূষিত উত্তর ভারতে। তবে উত্তর ভারতের চাণক্য বা কৌটিল্যের একটি উক্তিতে সর্বভারতীয় সমাজে শিব-এর গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। চাণক্য ছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (খ্রিস্টপূর্ব ৩২১-২৯৭) মন্ত্রী। তিনি একবার বলেছেন, সংসারে চারটি মাত্র সারবস্তু আছে। কাশীবাস, সাধুজনের সঙ্গলাভ, গঙ্গা জল ও শিব পূজা।

কাশী (যেখানে বিশ্বনাথ মন্দির রয়েছে) শিব- এর লীলাভূমি। গঙ্গা হলেন শিব এর স্ত্রী। আর ধ্যানমগ্ন শিব তো একজন সর্বশ্রেষ্ঠ সাধু। এবারে শিব এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরে পোস্ট শেষ করব। ভারতবর্ষে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট থেকে খ্রিস্টীয় ষষ্ট শতক অবধি বৌদ্ধধর্মই ছিল আপামর জনসাধারণের প্রধান ধর্ম ।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই এক হাজার বছরকে বৌদ্ধযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বৌদ্ধযুগে বুদ্ধ শিব- এর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। ওই সময়ে শিব আড়ালে চলে যান; যদিও শিব একেবারে নির্বাসিত হননি। খ্রিস্টীয় ষষ্ট শতকের দিকে হীনযান-মহাযান মতভেদ, নিরেশ্বরবাদ ও তন্ত্রের প্রাধান্য, শঙ্করাচার্যের বৌদ্ধবিরোধী আন্দোলনের কারণে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয় সূচিত হয় । একই সঙ্গে সূচিত হয় পৌরানিক যুগের।

হিন্দুদের অস্টাদশ পুরাণ এই পৌরানিক যুগেই লেখা হয়েছিল। পুরাণগুলি হিন্দুধর্মের ভিত মজবুত করে। এরই প্রেক্ষাপটে আর্যধর্ম বা ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থান ঘটে। অবশ্য সেটি সহজে হয়নি। এ জন্যআর্যপূর্ব শৈব ধর্ম এবং বৌদ্ধধর্মের মধ্যে সমঝোতা করতে হয়।

এই রকম অবস্থায় শিব পুনরায় বুদ্ধের স্থান অধিকার করে নেন। বৌদ্ধধর্ম অপসৃত হয়। ভারতবর্ষের সমাজে হিন্দুধর্মের শক্ত ভিত রচিত হয়। পৌরাণিক যুগে শিব তাঁর পরিবারসহ হিন্দু মনে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেন। শিব পরিনত হন পরিপূর্ণ দেবতায় ।

পার্বতী, উমা, গঙ্গা, দূর্গা ও কালী- এঁরা শিব- এর স্ত্রীরূপে কল্পিত হন। সেই সঙ্গে শিব- এর দুই পুত্র- গনেশ এবং কার্তিক। কন্যাদের মধ্যে মনসা ও লক্ষ্মী। বাংলার লোকায়ত দেবদেবী মূলত বৌদ্ধদেরই কল্পিত। পরবর্তীকালে বৌদ্ধযুগের অবসানে এই লোকায়ত দেবদেবী শিব এর পরিবারের অর্ন্তভূক্ত হন।

তথ্যসূত্র: সুধীরচন্দ্র সরকার সংকলিত পৌরাণিক অভিধান রণজিৎ কর, সনাতন ধর্ম: মত ও মতান্তর ড. আর এম দেবনাথ, সিন্ধু থেকে হিন্দু নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট Kim Knott; Hinduism A Very Short Introduction Encyclopedia of Hinduism Encyclopedia of World Religions ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।