আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলার লোকগুরু মীননাথ ও তাঁর জ্যোস্না-জাগান পরব

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ ‘কেন বাণী তব নাহি শুনি নাথ হে / অন্ধজনে নয়নে দিলে অন্ধকারে ফেলিলে। ’ রবীন্দ্রনাথে এই অবিস্মরণীয় চরণে আড়াই হাজার বছরের ওয়েষ্টার্ন মেটাফিজিক্স-এর সারৎসার বর্ণিত হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বিবর্তনবাদের গূঢ় ইঙ্গিত।

শিরোনাম ভিন্ন বলে এই রবীন্দ্রশ্লোকের বিস্তারিত ব্যাখার অবকাশ এই পোস্টে নেই, তবে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের পরিবর্তে যে ‘নাথ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেই ‘নাথ’ শব্দটি কে কেন্দ্র করে মধ্যযুগের বাংলায় নাথপন্থিগণ এক বিশাল ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এই পোস্টটি বাঙালির সেই গভীর ধর্মীয় কৃতিই স্মরণ করবে ... নাথধর্মের ব্যাপ্তি খ্রিস্টীয় ৭ম থেকে একাদশ- দ্বাদশ শতক; এবং ভক্তরা নাথধর্মটিকে ভারতবর্ষজুড়ে গ্রহন করেছিল। যদিও নাথধর্মের উত্থান হয়েছিল বাংলায়! কেননা, নাথধর্মের প্রবর্তক মীননাথ বাঙালি ছিলেন। ‘কৌলজ্ঞান’ নামে প্রাচীন এক গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে ... মীননাথ চন্দ্রদ্বীপ এর অধিবাসী ছিলেন। চন্দ্রদ্বীপ হল বরিশাল এর প্রাচীন নাম।

তার মানে, বাংলার অন্যতম এক লোকগুরুর জন্ম- বরিশাল। যে কারণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন,‘বাঙালির ইহা একটি গৌরবময় বিষয় যে একজন বাঙালি গোটা ভারতবর্ষকে একটি ধর্মমত দিয়াছিলেন। ’ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন যে মীননাথ- এর সময়কাল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক। নীহাররঞ্জন অবশ্য ১০ম থেকে ১২ শতক বলে মত দিয়েছেন । (দেখুন: বাঙালির ইতিহাস।

পৃষ্ঠা। ৫৩১) ফরাসি পন্ডিত সিলভাঁ লেভী অবশ্য লিখেছেন: মীননাথ ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে যান। এই মতটি দ্বারা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত হয়। মীননাথ অবশ্য মৎস্যেন্দ্রনাথ, মচ্ছিন্দ্রনাথ নামেও পরিচিত ছিলেন। মীননাথ বলতেন, ‘মানুষের দুঃখ শোকের কারণ অপক্ক দেহ।

যোগরূপ অগ্নিদ্বারা এই দেহকে পক্ক করে সিদ্ধদেহ বা দিব্যদেহের অধিকারী হয়ে সিদ্ধি বা শিবত্ব বা অমরত্ম লাভ করা যায়। ’ মীননাথ এর শিষদের বলা হত- নাথযোগী। কবি আল মাহমুদ- এর একটি কবিতায় যেন নাথযোগীদের ছবি ফুটে উঠেছে। আল মাহমুদ লিখেছেন: মধ্য যুগের এক যুবক গোস্বামী দেহেই পেতে চায় পথের নির্দেশ। (সোনালি কাবিন) কেবল ধর্ম নয়, বাংলা সাহিত্যেও মীননাথ এর অবদান অসামান্য।

ঐতিহাসিকদের মতে, মীননাথ বাংলা ভাষার আদি কবিদের অন্যতম । তিনি ‘বাহ্যান্তর-বোধিচিত্ত বঙ্গোপদেশ ’ শিরোনামে একটি বই লিখেছিলেন। তাঁর ভাষাই বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন। তাছাড়া নাথধর্মকে কেন্দ্র করে নাথসাহিত্য গড়ে উঠেছিল। আমরা ‘গোরক্ষবিজয়’ এবং ‘ময়নামতীর গান’- এর কথা শুনেছি।

এসব কাব্য নাথসাহিত্যের অর্ন্তগত। (পরবর্তী একটি পোস্টে নাথসাহিত্য নিয়ে আলোচনা করব। ) নাথসাহিত্যের সঙ্গে চর্যাপদের সর্ম্পকও গভীর। এ প্রসঙ্গে শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা’ বইতে লিখেছেন: ‘ নাথসাহিত্য ও চর্যাপদ এই উভয় ধারাতেই সিদ্ধদিগের কয়েকটি সাধারণ নাম পাওয়া যায়। এই ঘটনা দ্বারা দু’য়ের মধ্যে যে সর্ম্পক ছিল তা প্রমানিত হয়।

’ অর্থাৎ নাথধর্ম ও চর্যাপদ এর মধ্যে সর্ম্পক গভীর । চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়ের অর্থাৎ চর্যাপদের টীকায় মীননাথের নামে একটি কবিতা উল্লেখ রয়েছে- কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট। কর্ম্ম কুরঙ্গ সমাধিক পাঠ। কমল বিকসিল কহিহ ণ জমরা। কমল মধু পিবিবি ধোকে ন ভোমরা।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর বাংলা অনুবাদ করেছেন- কহেন গুরু পরমার্থের বাট। কর্মের রঙ্গ সমাধির পাট। কমল বিকশিত, কহিও না জোংড়াকে (শামুককে) কমল মধু পান করিতে ক্লান্ত হয় না ভোমরা। গুরুর নির্দেশে সহজিয়া বৌদ্ধ সাধক পরমার্থ লাভ করেন। এই পদে পরমার্থকে কমলমধু বলা হয়েছে।

যে কমল মধু গুরু শিক্ষা দেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা গোপাল হালদার মনে করেন, নাথযোগী ও সিদ্ধাচার্যদের কথা বাংলা সাহিত্যের জন্মকথার সঙ্গে জড়িত। অবহট্টের নতুন ঐতিহ্য তাঁরাই তৈরি করেন। (‘আর্যদের মুখের ভাষা ছিল প্রাকৃত। সেই প্রাকৃত আবার উত্তর ভারতের এক -একটা অংশে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এক-একটা নাম নিয়েছিল।

পূর্ব ভারতে যে-প্রাকৃত প্রচলিত ছিল, তার নাম দেওয়া হয়েছে মাগধী প্রাকৃত। বঙ্গ অঞ্চলের প্রাকৃতকে মহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন গৌড়ী প্রাকৃত। এই প্রাকৃত ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে- রূপ নেয়, তার নাম দেওয়া হয় অপভ্রংস। অপভ্রংসের পরের পর্যায়ে তার নাম হয় অবহট্ট। মোটামুটি সেই ভাষার নমুনাই আমরা দেখতে পাই চর্যাপদে।

(গোলাম মুরশিদ। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি। পৃষ্ঠ; ২৩) গোপাল হালদার আরও মনে করেন যে, নাথযোগীদের ভাবলোক ছিল আর্যদের ভাবলোক থেকে পৃথক। সরল জীবন ছিল তাদের লক্ষ্য। বাংলা সাহিত্যের জন্মের সঙ্গে জড়িত এই সম্প্রদায়টি ছিল স্বাধীনচেতা।

এদের চিন্তায় সাধারণ মানুষের স্থান ছিল উর্ধ্বে। আসলে নাথধর্মের চূড়ান্ত বিকাশের সময়ই চর্যাপদ লেখা হয়। নাথধর্ম বাংলার বৌদ্ধদের সহজযানী মতবাদ থেকে উদ্ভূত। যে দর্শনের মূলকথা হল ‘সৃষ্টির আদি ও অকৃত্রিম উৎপত্তিস্থল একমাত্র শূন্য। এই শূন্য মহাসুখ এবং আনন্দস্বরূপ।

এই শূন্য ঘনীভূত হয়ে প্রথমে শব্দরূপে দেখা দেন পরে শব্দ হতে পুনরায় ঘনীভূত হয়ে দেবতা রূপ গ্রহন করেন। ’ নাথদের উপাস্য ছিলেন নিরঞ্জন বা শূন্য। তবে নাথযোগীদের সাধনা ছিল দেহকে কেন্দ্র করে। মনে থাকার কথা-মীননাথ বলতেন, ‘মানুষের দুঃখ শোকের কারণ অপক্ক দেহ। যোগরূপ অগ্নিদ্বারা এই দেহকে পক্ক করে সিদ্ধদেহ বা দিব্যদেহের অধিকারী হয়ে সিদ্ধি বা শিবত্ব বা অমরত্ম লাভ করা যায়।

’ বাংলার বৌদ্ধ সহজযানীরা মনে করতেন ... দেহবা বা কায়সাধনই একমাত্র সত্য। রস-রসায়নের সাহায্যে কায়সিদ্ধি লাভ করে জড় দেহকেই সিদ্ধদেহ এবং সিদ্ধদেহকে দিব্যদেহে রুপান্তরিত সম্ভব। তবে নাথপন্থিগণ ছিলেন শিবানুসারী। শিব অনার্য দেবতা। শিবভক্তরা শিবকে অনেক নামে ডাকে।

তার মধ্যে একটি হল আদিনাথ। ড. দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, ‘ নাথধর্ম বৌদ্ধ ও শৈবধর্মের শ্রেষ্ঠ উপকরণে গঠিত। (বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য। প্রথম খন্ড) ৮ম ও ৯ম শতকের দিকে বৌদ্ধধর্ম তন্ত্র ও যোগের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, বাংলায় যোগ সাধনা দ্রাবিড় জাতির অবদান।

দ্রাবিড়রা ছিল রহস্যবাদী। যোগমার্গ ছিল তাদের সাধন মার্গ। নাথধর্মকে বলা হয়েছে The Nath tradition is a heterodox siddha tradition containing many sub-sects. সিদ্ধা শব্দটি তামিল ভাষার শব্দ। পাঠ করুন: A Siddham in Tamil means "one who is accomplished" and refers to perfected masters who, according to Hindu belief, have transcended the ahamkara (ego or I-maker) দ্রাবিড় শব্দ দিয়ে দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কার তামিল ভাষা ও জাতিকে বোঝানো হয়। সুতরাং, দ্রাবিড় সভ্যতার সঙ্গে যোগ এর সর্ম্পক যে গভীর সেটা বোঝা যায়।

যাই হোক। বাংলায় শৈবপন্থিদের ( তার মানে শিবভক্তদের) ওপর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রভাবেই নাথধর্মের উত্থান ঘটেছিল। তখন একবার বলেছি- নাথধর্মটিকে ভারতবর্ষের মানুষ গ্রহন করেছিল। কি এর কারণ? ভারতবর্ষজুড়ে নাথধর্মের জনপ্রিয়তার কারণও শিব। কেননা শিব আর্যদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে একটি বিরাট লোকশক্তি।

যোগ দর্শন প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন: ‘যোগ আদিম অস্ট্রিক (নিষাদ)- কিরাত মনন -উদ্ভূত। ’ (বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব: ; পৃষ্ঠা,৪১) তবে পরবর্তী পর্যায়ে যোগ আরও পরিশ্রুত হয়েছে। যোগের মূলে অনার্য দেবতা শিব। যোগের উদ্দেশ্য কায়ার মাধ্যমের সিদ্ধিলাভ বা শিবত্ব লাভ। আনোয়ারুল করিম লিখেছেন: ‘নাথযোগীদের মাথায় থাকত জটা।

সর্বাঙ্গে ছাইভস্ম, কানে কড়ি ও কুন্ডল, গলায় সুতা, বাহুতে রুদ্রাক্ষ, হাতে ত্রিশূল, পায়ে নূপুর, কাঁধে ঝুলি ও কাথাঁ। এদের কুলবৃক্ষ ছিল বকুল; প্রধান আহার্য কচুশাক। ’(বাংলাপিডিয়া। ) নাথসাহিত্যে 'গোরক্ষ বিজয়' একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। এই কাব্যে শিব- এর বর্ননা এরকম - মুন্ডে আর হাড়ে তুমি কেনে পৈর মালা ঝলমল করে গায়ে ভস্ম ঝুলি ছালা।

পুনরপি যোগী হৈব কর্ণে কড়ি দিয়া। নাথযোগীরা যে তাদের দেবতার বেশ ধারণ করতেন সেটা বোঝা যায়। সে যাই হোক। নাথধর্ম গুরুপন্থি। নাথযোগীরা গুরুর কাছে তিন দিন দীক্ষা নিতেন।

প্রথম দিন গুরু শিষ্যের চুল কেটে দিতেন। পরের দিন তার কানে কুন্ডুল পরিয়ে দিতেন। তৃতীয় দিনের দীক্ষা ছিল উপদেশী। তখন নানা পূজা-অর্চনা হত। সে সময় সারারাত দীপ জ্বলত ও নানা অনুষ্ঠান হত।

এর নাম ‘জ্যো¯œা-জাগান। ’ বিয়ের ক্ষেত্রে নাথপন্থিরা সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বীদের অনুসরণ করত। নাথসমাজে বাল্যবিহাব ছিল তবে বিধবাবিবাহের প্রচলন ছিল না। নাথধর্মের অনুসারীদের কবর দেওয়া হত। তবে সংকারের ক্ষেত্রে নিয়মকানুন অনেকটা সনাতন ধর্মালম্বীদের মতো।

বাংলায় নাথধর্মটি টিকে থাকতে পারেনি। একাদশ শতকের পরে ধর্মটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের উত্থান এর এক কারণ। একাদশ শতকে ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনরা বাংলার ক্ষমতা দখল করে নেয়। সেনরা নাথযোগীদের ধর্মহীন আখ্যা দিয়ে নির্মম ভাবে পীড়ন করেছিল।

এরপর নাথযোগীরা হয়ে গেল যুগী। এদের বৃত্তি হল কাপড় বোনা। তবে নাথধর্ম বিলুপ্ত হলেও নাথধর্মের বিশ্বাস বাঙালির বিশ্বাসের জগতে আজও রয়ে গেছে, বিশেষ করে- আজকের হিন্দুধর্মে। প্রথমে বুদ্ধ ও পরে শিবকে কেন্দ্র করে যে নাথধর্মের উত্থান সেটি বাঙালি হিন্দু সমাজে পরবর্তীকালে শিব এর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শেষ হয়। বাংলায় নাথধর্মের সামাজিক অবদানের কথাও কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলে থাকেন।

ষোড়শ শতকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব মঠের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীচৈতন্যদেব বাংলায় যে ভক্তিবাদী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তার মূল প্রেরণা একমাত্র সুফিবাদের মধ্যে নিহিত ছিল না। সেই প্রেমবাদী ভাববিপ্লবের অন্যতম প্রেরণা ছিল বাংলার নার্থধর্মটির মানবতাবাদী চেতনা। তথ্যনির্দেশ: ড. আর এম দেবনাথ; সিন্ধু থেকে হিন্দু। আজহার ইসলাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্য যুগ) বাংলাপিডিয়া ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.