আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধরণীতলা

Nothing to put forward - nothing at all. এক একটা দিনই খারাপ যায়। এখানে বদলী হয়ে এসেছে প্রায় আঠার মাস হলো। এ পর্যন্ত কোন হ্যাপা পোহাতে হয় নি। না খুন, না ডাকাতি, না চুরি- ছিনতাই। খুন বাদে বাকিগুলো যে হয় নি তা নয়।

হয়েছে। তবে সংখ্যায় একেবারেই নগণ্য। অন্যান্য যেসব অঞ্চলে তার চাকরি করতে হয়েছে সেসব জায়গার কোনটাতেই সে আরামে থাকতে পারে নি। আজ ডাকাতি তো কাল রেপ কেস। পরশু হত্যা আর গুম দুটোই একসাথে।

সে আশ্চর্য হয়ে যায় যখন ভাবে সে কোন জায়গায় যাবার কয়েক মাসের মধ্যেই ক্রাইম খুব কমে আসে। কেন কমে আসে? এটা ঠিক সে নিজেও জানে না। আল্লাহ তায়ালা এমন একটা শরীর তাকে দিয়েছেন যা দেখে খুব কম মানুষই স্বাভাবিক থাকতে পারে। ভয় না দেখাতে চাইলেও লোকজন ভয় পায়। সাথে আছে একজোড়া দুর্দান্ত গোঁফ।

মোট কথায় দারোগা হিসাবে তার চেহারা তার হয়ে কথা বলতে পারে। তার সাব-অর্ডিনেটরা মাঝে মাঝে বলে, মজিদ স্যার কড়া লোক। টাইট ক্যামনে দেওন লাগে তার জানা আছে। মজিদের কানে এইসব কথা আসে। তার শুনতে ভালোই লাগে।

যে গুন তার নেই তাই যদি মানুষ তার উপর আরোপ করতে চায় তাহলে বিরোধিতা করে ফায়দা কি। শুনে যাওয়াই ভালো। সে বেশির ভাগ সময়ই ঝিম মেরে থাকে। লোকে ভাবে, মজিদ দারোগা কম কথার মানুষ। কথা কম বলে কাজ বেশি করে।

কথা বইল্ল্যা লাভ কি, শইল্ল্যে মলা দিলেই কাম বেশি হয়। লোকে ভুল ভাবে। পেশায় সে পুলিশ হলেও নিজেকে সে একজন দার্শনিক মনে করে। একজন গোয়েন্দাও। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সাবজেক্ট ছিলো ফিলোসফি।

আর নেশা ছিলো গোয়েন্দা গল্প পড়া। তখন সে আন্দাজই করতে পারে নি, আজ বাদে কাল তার পুলিশ হতে হবে যে পেশায় তার পঠিত প্রতিটা গল্পই কোন না কোনভাবে তাকে সাহায্য করবে। ধরণীতলাই ছিলো ব্যতিক্রম। হেহায়েত শান্ত একটা উপজেলা। উপজেলা বললে যতটুকু জেলা নামের আবহে উঠে আসে ততটা জাঁক বা জমক কোনটাই ধরণীতলার নেই।

গ্রামই বলা চলে। গ্রাম বা শহর যেটাই হোক মজিদ দারোগার কোন আপত্তি নেই। তাকে শাস্তি দেবার জন্যই যে ধরণীতলার মতো একটা অজপাড়াগাঁয়ে বদলী করা হয়েছে এটা মজিদ খুব ভালো করেই জানে। আজিমগঞ্জে থাকাকালীন সে একটা কেস পেয়ে গিয়েছিলো। রেপ কেস।

স্যাডিস্টদের মতো মেয়েটাকে ফালি-ফালি করে ফেলা হয়েছিলো ব্লেড বা ক্ষুর বা এধরণের ধারালো কোন কিছু দিয়ে। মেয়েটা ছিলো একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক। তার পিতা একজন আইনজীবী। ফলে জানাশোনা অনেক। উপর থেকে চাপ আসতে লাগলো মজিদের উপর।

তাছাড়া সে নিজেও আগ্রহী ছিলো কেসটা নিয়ে। কিন্তু সময় করতে পারছিলো না নানান ঝামেলায়। চাপ আসাতে তার সুবিধাই হলো। অন্য কাজগুলো অন্যদের উপর ছেড়ে দিয়ে নিজে ব্যস্ত হয়ে গেলো কেসটা নিয়ে। খুব পরিকল্পিত একটা হত্যাকা-।

ক্লু নেই বললেই চলে। তবে সে লেগে থাকলো। একে একে সম্ভাব্য সকলের সাথে বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চললো। শেষমেশ একটা সিদ্ধান্তের কাছাকাছি যখন পৌঁছানো গেল তখন তার হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো বদলীর আদেশ। কেসটা তার ভেতরে একটা নেশার ঘোর তৈরি করে দিয়েছিলো।

একটা মাস সে স্ত্রী-পুত্র কাউকে সময় দেয় নি। তাড়িত মানুষের মতো ঘুরেছে। তাকে বদলী করা হলেও, সে নতুন কর্মস্থলে গেল না। মেডিক্যাল লিভের ব্যবস্থা করে গোপনে কাজটা চালিয়ে যেতে থাকলো। তার বদলে ঐ থানায় যাকে দেয়া হয়েছিলো সেই বেচারাও নতুন।

আদর্শ আছে। মজিদ তার সাথে দেখা করলো বাসায় গিয়ে। সব ঘটনা খুলে বললো। জবাবে আশ্বাস পেলো যে, যেভাবেই হোক অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হবেই। আশ্বাস পেয়ে তবেই মজিদ এখানে এই অজপাড়াগায়ে এসেছিলো।

ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ করতো সেই অফিসারের সাথে। যেহেতু এখানে সময় অঢেল, কাজ নেই বললেই চলে তাই ঐ কেস নিয়েই ভাবার সুযোগ পেলো। একদিন সকালে নতুন অফিসারের সাথে যোগাযোগ করতে গিয়ে জানা গেল তাকেও বদলী করা হয়েছে এক প্রত্যন্ত থানায়। কয়েকদিন পরেই অফিসার তাকে ফোন করে জানালো, অপরাধী নাকি মোটরবাইক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়েছে। কোমরের নিচের অংশটা প্রায় বিকল হয়ে গেছে।

চার পাঁচ দিন মৃত্যুর সাথে লড়ে মরেই শেষে মরেই গেছে। মজিদ জানতে চাইলো, কীভাবে ঘটলো এটা? ধুর মিয়া, বুঝেন না, মটর সাইকেল গুয়ার ভিতরে ঢুইক্যা গেছিলো। হা, হা, হা। কুত্তারে কুত্তায় চুদে মিয়া। আরও কোন কুত্তা মনে অয় গুয়ার ভিত্যরে, বুঝেন না? হা, হা, হা।

এতবড় কুত্তাটা কে? এই প্রশ্নটা অফিসারকে জিজ্ঞেস করার সাহস পায় নি মজিদ। ঐ অফিসার তার ব্যাচেরই তবে বয়সে খানিকটা ছোট। স্বাভাবিকভাবেই তার কাছ থেকে কিছুটা সম্মান মজিদ প্রত্যাশা করেছিলো। হয়তো পেয়েও ছিলো। আসলে প্রত্যেকের সম্মান প্রদর্শনের আলাদা আলাদা তরিকা আছে।

বার বার মিয়া, গুয়া, কুক্তা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা সত্বেও মজিদ বেশ বুঝতে পারে ছেলেটা তাকে আলাদাভাবেই দেখে। এখনো মাঝে মাঝে কথাবার্তা হয় ফোনে। বিভিন্ন ধরণের কাজে একে অপরের সাতে মত বিনিময় করে। ভালোই লাগে মজিদের। একটা বন্ধু তো পাওয়া গেলো।

ছোটবেলা থেকেই শারীরীক আকৃতির কারণে সে বন্ধু পায় নি। সম্ভ্রম পেয়েছে। নৈকট্য পায় নি। দূরত্ব পেয়েছে। ছেলেটার সহজ সরল ব্যবহার, আদর্শবাদীতা এবং লোকাল ল্যাংগুয়েজের প্রতি টান তাকে মুগ্ধ করেছে।

যদিও শারীরীক আকৃতিতে মজিদের তুলনায় নেহাতই মামুলি একটা মানুষ কিন্তু ব্যবহারেই বোঝা যায়, এটাকে সে পাত্তা দেয় না। একদিন কথাচ্ছলে বলেও ফেলেছিলো, আফনের লগে মিয়া একদিন মাইর লাগন দরকার। দেহন দরকার আফনের খালি শইলড্যাই আছে নাহি শইল্যের ভিত্যরে কিছু মশল্ল্যাও আছে, বুঝেন না মিয়া? হা, হা, হা। স্যারের শরীর খারাপ নাকি? আব্দুল কনস্টেবল মজিদ দারোগাকে প্রশ্ন করে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে না।

অনেকক্ষণ ধরেই সে খেয়াল করছে মজিদ স্যার কিছুটা আনমনা। একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে চলেছে। এমনটা সাধারণত হয় না। দিনে তিন বা চারটা সিগারেট মজিদ খায়। আবার মাঝে মাঝে খায়ও না।

সে নিজেই বলে যে তার সিগারেটের অভ্যাস তার নেই। খেলে খেলো না খেলে নেই। না। এক কথার উত্তর। দাঁড়িয়ে থেকেও কোন লাভ হবে না।

এর বেশি কিছু মজিদ স্যার বলবে না এটা আব্দুল মতিন ভালোকরেই জানে। তারপরও সে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখ সেঁটে থাকে নিজের বুটজোড়ার দিকে। সাহস সঞ্চয়ের শেষ চেষ্টাটা চালাবে কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মজিদই সুযোগ করে দেয়।

কি বিষয় আব্দুল মতিন? কিছু কইবা নাহি? ছুডি দরহার? ছুডি তুমার গুয়ার ভিত্যরে তুইল্যা রাইখ্যা দেও? আব্দুল মতিন আগাগোড়া কেঁপে ওঠে। সে ভেবে পায় না কীভাবে লোকটা জানলো যে তার ছুটি দরকার? বিস্মিত হওয়ার মতো বিষয়। তারচেয়ে বেশি বিস্মিত হতে হয় মজিদের ভাষায়। বইয়ের ভাষায় কথা বলে সে অভ্যস্ত। এরকম গ্রাম্য ভাষায় কথা বলতে কেউ কখনো শোনে নি।

আব্দুল মতিন কাঁপতে কাঁপতে পেছন ফেরে। চলে যেতে উদ্যত হয়। হেই চুদির ভাই, তরে যাইতে কইছি নাহি? আব্দুল মতিন স্থির হয়ে পড়ে। ছেলেবেলায় দাদি তাকে যে গল্পগুলো শোনাতো সেগুলোতে সে শুনতো একজন মানুষের শরীরে অন্য কারো আত্মা নাকি ঢুকে পড়তে পারে। স্যারের শরীরে অন্য কারো আত্মা ঢুকে গেলো নাকি সে ঠাহর করতে পারে না।

আল্লাহ, তোমার দুনিয়ায় কত কিছুই যে ঘটে! আব্দুল মতিন আবার মজিদের সামনে এসে দাঁড়ায়। কতদিনের ছুটি দরকার তোমার? স্যার, দুই দিনের? একটু সময় নিয়ে আব্দুল মতিন উত্তর দেয়। কবে কবে? স্যার, কাল-পরশু। ঠিক আছে, যাও। দরখাস্তটা আমার টেবিলে রেখে দিও।

আব্দুর মতিন চলে যাবার পরে মজিদ একটু ইতস্তত করে ফোনটা তোলে। ভাবে তার ফোন করা উচিৎ হবে কিনা। আরেকবার ভাবে দেখাই যাক না। সে ঐ অফিসারকে ডায়াল করে। পরপর দুই বার ডায়াল করেও অফিসারকে পাওয়া যায় না।

তৃতীয় বারে মজিদ সফল হয়। হ্যালো, আরিফুল্লা কইতাছি। কে কন? মজিদ চোখ বন্ধ করে চিনতে চেষ্টা করে স্বরটা আরিফুল্লারই তো? তাহলে প্রথম বাক্যেই কেন কোন গালাগাল দিলো না? একটু ভেবে সে বলে, আমি মজিদ, আরিফ সাহেব, কেমন আছেন? আরে মজিদ ভাই, কী অবস্থা আফনের? খবর টবর নেওন কি ভুইল্যা গেলেন নাহি মিয়া? নারে ভাই ভুলি নাই। প্রতিদিন ফোন করে আপনাকে বিরক্ত করার কোন মানে হয়? কেমন আছেন বলেন? কি কন মিয়া, আফনে ফোন করলে আমি বিরক্ত হমু? হালার আমার মাথার মইধ্যে কি গুবর ঢুকছে নাহি মিয়া। এক আফনের লগে কথা কইয়াই এট্টু সুখ।

আর সব চুতিয়া কা বাচ্চা। খালি ধান্দার আলাপ। হালার পুতাইনের গুয়ার মইধ্যে যে কিতা হান্দাইছে কেডা জানে। কন মিয়া ভাই, কী খবর? বউ-বাচ্চার খবর কী? আছে। ভালোই।

ব্যস্ত নাকি, আরিফ? না, না কুনু কাজ-কাম নাই। আমার মত কামলারে আইন্যা ফালছে এই আকাইম্যার জাগাত। দিন কাডে না মিয়াভাই। কুনু কাজ কাম নাই। আফনের কাজ কাম ক্যামনে চলে? হ্যাঁ, ভালোই চলছিলো।

আজ সকালেই একটা হাঙ্গামা এসে জুটেছে। কি হাঙ্গামা মিয়াভাই। মজিদ খেয়াল করে আজ বার বার মিয়াভাই শব্দটা উচ্চারিত হচ্ছে আরিফের মুখ থেকে। ব্যাপার কি? সে ধরতে পারে না। কোন কারণ অবশ্যই আছে।

যাই হোক এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করা উচিৎ হবে না। সে সোজা ঘটনায় চলে যায়। মার্ডার কেস। মোস্ট প্রবাবলি রেপ কেসও। মেয়েটা এলাকার না।

চেহারা দেখে ভালোই মনে হয়। সারারাত বৃষ্টিতে ভেজার কারণে শরীর, বিশেষত মুখটা বেশ ফুলে গিয়েছিলো। তারপরও মেয়েটাকে আমার খুব চেনা মনে হচ্ছিল। কোথায় যেন দেখেছি। কোনভাবেই মনে করতে পারছি না।

এদিকে মিডিয়া চলে এসেছে। মেডিক্যাল প্রসেসের জন্য লাশ পাঠানো হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়াও চালাচ্ছি। কিন্তু মেয়েটাকে কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছি না। কি বিপদ বলেন তো? মাইয়্যার বয়স কত? এরাউন্ড টুয়েন্টি ফাইভ।

বয়সডা খারাপ। মাইয়্যারে কই দেখছেন ক্যামনে কমু। চিন্তা কইরা দেহেন কিছু বাইর কর্তে পারেন নি। একটা বুদ্ধি দিবার পারি, নিবেন? আরিফের কথা শুনে হঠাৎ করেই মজিদের হাসি পেয়ে যায়। সে হেসেই ফ্যালে, বলেন? খুনীরে আগে ধরেন, হেই সব কইবো।

মজিদ আকাশ থেকে পড়ে। খুনী কে সেটা তো আগে জানতে হবে। প্রমাণ বের করতে হবে। তারপর তো তাকে গ্রেপ্তার করা। তাই না? এটা তো অনেক সময় সাপেক্ষ।

আফনে মিয়া খালি বইয়ের ভাষায় কতা কইন। গ্রেপ্তার কর্তে কইছে কেডা। ধইরা আনেন। গুয়ার মইধ্যে দুইডা লাগাইলে কথার ছেইর ছুডবো। বুঝেন না? আফনের ডুহা উচিৎ আছিল ইস্কুলে আর নাইলে কলেজে।

পুলাপাইন পড়াইতাইন আর বই পড়তাইন। আরিফের চোখ ফাঁকি দেয়া সহজ না। এ পর্যন্ত কেউ এটা ধরতে পারে নি যে মজিদ দারোগা আসলে একজন দার্শনিক। নিতান্তই অলস মানুষ। শুয়ে থাকতে ভালোবাসে।

তবে কর্তব্যপরায়ন। ফলে হাতের কাজ কখনো ফেলে রাখে না। সবাই ভাবে কি সিনসিয়ার দ্যাখো মানুষটা। আসলে তাদের ধারণা ঠিক না। এটা ঠিক বলেছেন আপনি।

ঠিক আছে ওটাই করবো। ক্যামনে করবেন? হাজার হাজার মাইনষ্যের মইধ্যে ক্যামনে বুঝবেন খুনী কেডা? তরিকা কোনডা নিবেন? বাদুড়ের লগে খাতির মিয়াভাই? বাদুড়রাই সব খবর জানে। মজিদ বোঝে বাদুড় এখানে একটা সিম্বল। আরিফ নিজেকে যতটা গ্রাম্য দাবী করে ততটা গ্রাম্য সে না। তার স্টাইলটাই হচ্ছে সারল্যের ভান ধরে থাকা।

একেক জনের তরিকা একেক রকম। রাইতের বাদুড় বুঝ্যেননি মিয়াভাই? বুঝেছি। দেখা যাক কদ্দুর কি করতে পারি। আপনাকে জানাবো। তো ভালো থাকবেন আরিফ।

জ্বী মিয়াভাই আসসালামু আলাইকুম। ওয়ালাইকুমুস সালাম। মজিদ ফোন রেখে দ্যায়। রাতের বাদুড়দের সাথে তার পরিচয় নেই। সে নিজে যে তরিকায় বিশ্বাস করে তাতে রাতের বাদুড়দের সাথে যোগাযোগ থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

স্যার, দুই জন সাংবাদিক আসছে। একজন নতুন কনস্টেবল এসে জানিয়ে গেল। পাঠিয়ে দাও। স্যার আসবো? একসাথেই দুই জন জিজ্ঞেস করলো। মজিদ ছেলে দুটোর মুখের দিকে তাকালো।

বয়স তিরিশের কাছাকাছি হবে দুজনেরই। সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানানোয় দুজনেই ভেতরে এলো। চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করতে বসলো। স্যার আমরা... বলতে হবে না। বুঝেছি।

মিডিয়ার লোক। জ্বী। মেয়েটার বিষয়ে জানতে চাইছেন তো? জ্বী। আমি এখনো কিছু বলতে পারছি না। মেয়েটাকে কেউ চিনতে পারে নি।

মেডিক্যাল ইনভেস্টিগেশনের জন্য লাশ পাঠানো হয়েছে। এটুকু আপনারাও জানেন। না, মানে কোন মানে নাই। দুজনেই বুঝতে পারে আর বসে থাকার কোন মানে হয় না। মজিদ দারোগার মুখ থেকে আর কোন কথা বের করা যাবে না।

এই দশাসই লোকটার সামনে বসে থাকতেই তাদের কেমন যেন লাগতে শুরু করেছে। ঠিক আছে তাহলে, যাই স্যার। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ছেলেটা বললো এবং দুজনেই একসাথে চলে যেতে উদ্যত হলো। মজিদ হাতের ইশারায় তাদের বসে থাকতে বললো। কম বয়স্ক ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় কাজ করেন আপনি? সাপ্তাহিত ধরণীবার্তা, স্যার।

নাম কী আপনার? কামরুল হাসান। পড়াশোনা কতদূর? মজিদ জানে ঠিক জায়গায় আঘাত করেছে সে। হাবভাব দেখেই বোঝা যায় পড়াশোনা বেশি না। এই ছেলেটার নামে বেশ কয়েকটা অভিযোগও এসেছে থানায়। বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে লোকজনের কাছ থেকে টাকা আদায় করে।

এক রকম চাঁদাবাজিই বলা চলে। লোকজন ভয়ও পায় এদের কেননা কোন গোমর ফাঁস করে দেয় বলা তো যায় না। কিন্তু গোমরহীন লোকও তো আছে। পড়াশোনা কতদূর, বলছেন না কেন? সাংবাদিকতার উপরে কোন প্রশিক্ষণ আছে? ছেলেটা ঢোক গিললো। পাশের ছেলেটা সম্ভবত জেলা সদর থেকে এসেছে।

সেও একটু ঘাবড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তারমানে তারও গোমড় আছে। ছোট ছেলেটা ক্রমাগত ঢোক গিলে যাচ্ছে। একটার পর একটা। মাঝে মাঝে বেশ বড় করে ঢোক গিলছে।

মজিদ ভেবে পায় না, পেশাদারিত্ব বিষয়টাই মানুষের মন থেকে উঠে যাচ্ছে নাকি? ঠিক আছে আপনারা যান। আর শোনেন, আপনার বিরুদ্ধে আমার কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। এমন কোন কাজ করবেন না যাতে আপনার নিজের ক্ষতি হতে পারে। ছেলেদুটো একরকম পালিয়েই গেল বলা চলে। মজিদ ঘড়ি দেখলো।

রাত সাড়ে বারোটা। সারাটা দিন নানা ঝামেলা গেছে। একটা টানা ঘুম দিতে পারলে বেশ ভালো লাগতো। কিন্তু ঘুমানোর সময় এখন না। আরো কাজ বাকি রয়ে গেছে।

লোহা গরম থাকতেই তাতে আঘাত করতে হয়। খুন করার পরে মানসিক সমস্যায় ভোগে না এমন খুনী নেই। এটা মজিদের বিশ্বাস। সে একজন কনস্টেবলকে পাঠালো ড্রাইভারের কাছে। জীপ রেডি করতে হবে।

চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই ফোনটা বেজে উঠলো। নিশ্চয়ই মিডিয়ার লোক। কিন্তু তার কাছে তো নতুন কোন তথ্য নেই। তাহলে কি সে ফোনটা ধরবে না? না ধরলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবে সে। একটু ইতস্তত করে ফোনটা তুলল সে।

হ্যালো। মিয়াভাই আমি আরিফ। হ্যাঁ আরিফ। বলেন। মিয়াভাই কি আমার উফরে রাগ করছেন নাহি? আরে না, না।

কেন বলেন তো? মিয়াভাই আমার এক ফুদ্দর বড়ভাই আছিলো। নাম ছিলো আফনের নামে। আব্দুল মজিদ। মিয়াভাই ডাকতাম তারে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সে শহীদ হইছিলো।

কাইল রাইতে মিয়াভাইরে স্বপ্নে দেখলাম। ভাই আমারে কইলো, আরিফ আমার শইল্যে তিনডা গুলি হান্দাইয়া দিছিলো। দুইডা গুলি পাইছি। আরেকটা পাই না। দেখছাইন তর পিস্তলের মইধ্যে লুকাইছে নাহি বদমাইশটা।

আমি কি উত্তর দিমু মিয়াভাই। খালি কান্দন আহে। কতা কইতাম পারি না। শ্বাস ফেলতাম পারি না। আমার ভাইডারে মাইরা ফেলছ্যিল মিয়াভাই।

আফনে সাবদানে থাইক্যেন। মজিদ টের পায় আরিফের গলার স্বর আর্দ্র। কণ্ঠ কাঁপছে। এমনটা আরিফের কাছে প্রত্যাশা করে নি সে। রাফ ব্যবহারের ছদ্মবেশে সে আসলে মজিদের মতই একজন আবেগী মানুষ।

একারণেই আজ তাকে বার বার মিয়াভাই সম্বোধন করছে আরিফ। ছেলেটার একটা টান জন্মে গেছে তার প্রতি। মজিদও একটু আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তুমি চিন্তা করো না, আরিফ। আমি খুব সাবধানী লোক।

অবচিক্ষণতার পর্যায়ে পড়ে এমন কোন স্টেপ আমি নেবো না। আফনে মিয়া দার্শনিক মানুষ। দুনিয়ার হাল হকিকত বুঝেন নি? মিয়াভাই, আমারে একটা কথা দিবেন? কী কথা? সমস্যা দেখলে আমারে ডাক দিবেন। ডাকলেই কি তুমি আসতে পারবে, আরিফ? তোমার কাজ আছে না? ঠিক আছে তারপরও কথা দিচ্ছি সমস্যা দেখলে তোমাকে ডাকবো। মিয়াভাই বলো এই ডিপার্টমেন্ট আপনার জন্য না।

আপনার উচিৎ ছিলো মেধার সাথে মানানসই একটা প্রফেশন সিলেক্ট করা। যাই হোক, ভালো থাকবেন। আসলে আমি আপনাকে বড় ভাইয়ের মতোই দেখি তো তাই নেহাৎ ব্যক্তিগত কিছু কথা বলে আপনাকে বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না। এসব কি বলছো, আরিফ।

বিরক্ত হবো কেন। আমার তো খুব ভালো লাগছে এটা জেনে যে, তুমি আমাকে বড় ভাইয়ের মতো দ্যাখো। আসলে আমিও তোমাকে খুব ¯েœহ করি। তো ভাই ভালো থেকো। আর চিন্তা করো না।

সব আল্লাহর ইচ্ছা। আরিফ যে আবেগবশত তার ভাষাভঙ্গি পরিবর্তন করে ফেলেছে এটা মজিদের নজর এড়ায় না। হঠাৎ এমনটা কেন হতে পারে? নানান কারণেই হতে পারে। দর্শনশাস্ত্র যারা অধ্যয়ন করে তারা জানে হেগেল যে ডায়ালেকটিক্যাল প্রসেসের কথা বলেছিলেন, তাতে থিসিস এবং এন্টিথিসিসের একটি সংমিশ্রণের বিষয় ছিলো। তারমানে থিসিস একসময় এন্টিথিসিসের সাথে নতুন একটা ট্রেন্ড তৈরি করে।

এগুলো যে সব সময় আইডিয়া বা প্রথার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয়। মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য- অন্তত এটাই মজিদের ধারণা। কিন্তু এই বিষয়টা নিয়ে ভাবার মতো যথেষ্ট সময় মজিদের হাতে নেই। তার হাতে এখন অনেক কাজ। লাইনটা কেটে দিয়েই মজিদ রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।

সে চাইছে না এই মুহূর্তে তাকে আবেগ কাবু করে ফেলুক। হাতের কাজটা আগে শেষ করা দরকার। দ্রুত সে জীপে উঠলো। ড্রাইভারকে বাজারে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসলো। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে আজও।

গতরাতের মতোই। এই বৃষ্টিতে একটা অসহায় মেয়ের শরীর সারারাত ভিজেছে ভেবে তার খুব কষ্ট হলো। আজ রাতের মতো গতরাতেও যদি একবার সে বাজারের দিকে যেতো তাহলে কি মেয়েটাকে বাঁচানো সম্ভব হতো? কী সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে। জগতের কত কিছুই দেখার বাকি ছিলো। আর মেয়েটাকে এত চেনা চেনা কেন লাগছিলো এটা সে বুঝতে পারছে না।

একসময় অবশ্যই বোঝা যাবে। মনে পড়বে কোথায় মেয়েটাকে দেখেছে সে। আরিফ হয়তো ভাবতে পারে মজিদের চারিত্রিক ত্রুটি আছে। সব মেয়েকেই তার চেনা চেনা মনে হয়। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারটা তা না।

জীপের ছাদে তুমুল বৃষ্টি। ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যাটস এন্ড ডগস। লায়ন এন্ড টাইগারও হতে পারে। বৃষ্টির এই তোড়ের সাথে বিড়াল বা কুকুরের যুদ্ধের যে সামঞ্জস্য তার চেয়ে বাঘ-সিংহের সামঞ্জস্য বেশি মনে হচ্ছে। ড্রাইভার খুব ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে।

সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটাই যেন ঋণ শোধ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। একজন মৃত মানুষের প্রতি শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য হয়তো এটা। প্রকৃতির পক্ষ থেকে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.