আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিউ ইয়র্কের রাস্তায় পানের পিক

নিউ ইয়র্কের রাস্তায় যত্রতত্র বিশেষ করে কুইনস্‌ কাউন্টির দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী অধ্যুষিত বাণিজ্যিক এলাকা জ্যাকসন হাইটসের দক্ষিণ এশীয় মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংলগ্ন রাস্তাঘাট ও তার আশপাশে পানের পিক ফেলে পরিবেশ নোংরা করা বিষয়ে নিউ ইয়র্কের টাইমসে সমপ্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন নিয়ে নিউ ইয়র্কে দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। রিপোর্টার নিকোলাস হার্সন-এর লেখা ‘অন জ্যাকসন হাইটস সাইডওয়াকস, এ ট্রিটস মেসি আফ্‌টারম্যাথ’ শিরোনামের এ রিপোর্টটি গত ১৩ই আগস্ট নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশের পর থেকেই জ্যাকসন হাইটস এলাকার দক্ষিণ এশীয় মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক, কর্মচারী, সাধারণ ক্রেতা সহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে এ এলাকায় কেনাকাটা, ভ্রমণ ও আড্ডা দিতে আসা দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে জ্যাকসন হাইটস এলাকার দক্ষিণ এশীয় আমেরিকানদের নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী ও ব্যবসা সংগঠন, সংবাদকর্মী ও সাংবাদিক সংগঠন, দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের নিয়ে কর্মরত এনজিও, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ এবং এ এলাকার সিটি কাউন্সিল মেম্বার অফিসে কথা বলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। ‘নতুন অভিবাসীদের সচেতন হওয়ার জন্য এ ধরনের প্রতিবেদন ভূমিকা রাখবে’ বলে কেউ কেউ মনে করলেও অনেকেই মনে করেন ‘পানের পিক ফেলার প্রবণতা জ্যাকসন হাইটস এলাকায় এখনও আছে তবে এর মাত্রা এমন নয় যে নিউ ইয়র্ক টাইমসে এ নিয়ে রিপোর্ট করতে পারে’, তাই ‘এটি একটি রিপোর্ট করার জন্যই রিপোর্ট’। তাছাড়া ৭৩তম স্ট্রিট জুড়ে সিটির পক্ষ থেকে বর্তমানে সৌন্দর্য বর্ধণের যে কর্মসূচি চলছে, তার সঙ্গেও এ প্রতিবেদনটি সংগতিপূর্ণ নয়।

রাস্তায় পানের পিক ফেলে পরিবেশ নোংরা করার বিষয়টি এ প্রতিবেদনের মূল ফোকাস হলেও প্রতিবেদনটি আবর্তিত হয়েছে মূলত জ্যাকসন হাইটসের ৭৩তম স্ট্রিট ও ৩৭তম এভিনউয়ের কর্নারে অবস্থিত পাকিস্তানি মালিকানাধীন রেস্তোরাঁ ‘কাবাব কিং’-এর ভেতরে ছোট্টপরিসরে গড়ে ওঠা পাকিস্তানি ইমিগ্রান্ট মোহাম্মদ ইউসুফের পানের দোকান ‘শান এ পান দরবার’কে ঘিরে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ ইউসুফ নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন- তার দোকানের পান খাওয়ার জন্য নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন সিটি থেকে শুধু দক্ষিণ এশীয় নয়, বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর ক্রেতারা ভিড় করেন। তিনি প্রতিদিন গড়ে ২০০ জন ক্রেতার কাছে পান বিক্রি করেন, যার সংখ্যা উইকেন্ডের দিনগুলোতে দ্বিগুণ হয়ে থাকে এবং তার ৯৫ ভাগ ক্রেতাই পাকিস্তানি বংশোদভূত অভিবাসী। তবে তার দোকান থেকে পান খেয়ে ক্রেতারা রাস্তাঘাটে পানের পিক ফেলে পরিবেশ নোংরা করার যে অভিযোগ তা তিনি অস্বীকার করেন। রিপোর্টে মোহাম্মদ ইউসুফকে বাংলাদেশী নেটিভ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু গত সন্ধ্যায় মোহাম্মদ ইউসুফের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে জানা গেছে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টারের সঙ্গে মোহাম্মদ ইউসুফের কথাই হয়নি, বরং রিপোর্টার কথা বলে গেছে দোকানের এক কর্মচারীর সঙ্গে। তিনি নিজে পাকিস্তানি আমেরিকান, নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টার ঠিকমতো না জেনেই তাকে বাংলাদেশী বলে উল্লেখ করেছেন। প্রতিবেদনটিতে পৌডেল নামে এক নেপালী ইন্টারনেট রেডিও প্রতিষ্ঠানের মালিকের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়, এ এলাকায় পানের পিক রাস্তাঘাটে আনাচে কানাচে এমনভাবে সবসময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে যে এগুলোকে রাস্তায় জমে থাকা রক্তের ছোপের মতো মনে হয়, যা আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় বেশির ভাগ বাংলাদেশী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অধ্যুষিত এ অঞ্চলে সরজমিনে ঘুরেফিরে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে- পরিস্থিতি এমনটা কখনওই ছিল না, যদিও কেউ কেউ ভুল করে মাঝে মাঝে পানের পিক রাস্তায় ফেলে। কিন্তু তা নিকটস্থ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত পরিচ্ছন্নতার অংশ হিসেবে প্রতিদিনই পরিষ্কার করে থাকে।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ ইউসুফ এ প্রতিনিধিকে জানান, টাইমসের ওই রিপোর্টের বেশির ভাগ তথ্যই মনগড়া, কারণ এ এলাকায় রক্তের দাগের মতো ছোপ ছোপ পানের পিক ফেলার কিংবা অপরিষ্কার রাখার কোন সুযোগ নেই। কেননা সড়ক জুড়ে সিটির উদ্যোগে বিউটিফিকেশনের কাজ চলছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকা কি করে এমন রিপোর্ট প্রকাশ করলো তা ভাবতে অবাক লাগে। কথা বলার জন্য টাইমসের রিপোর্টে উল্লিখিত নেপালি ব্যবসায়ী পৌডেলকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ফোনে পাওয়া যায়নি। এ প্রতিবেদনটির বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে জ্যাকসন হাইটস এলাকার একজন ইমাম বলেন, আমি নিজে এখনও রিপোর্টটি পড়ে দেখিনি, তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অঙ্গ।

তাই এ বিষয়ে আমাদের বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর আরও সতর্ক হওয়া উচিত। নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সামাজিক সংগঠন জালালাবাদ এসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি বলেন, নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকায় এ ধরনের রিপোর্ট দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটির জন্য বিব্রতকর, তবে আমাদের নিজেদেরও আরও বেশি নাগরিক দায়িত্ব জ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে। আমরা নতুন ইমিগ্র্যান্টদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য ইমেইলের মাধ্যমে শিগগিরই একটি ইনফরমেটিভ ক্যাম্পেইন শুরু করবো। এ ছাড়া নিউ ইয়র্কে বাংলা মিডিয়ার বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী ও সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জানান, সচেতন ও সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার মানসে বাংলা মিডিয়াগুলো এ সব বিষয়ে ইতিপূর্বে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তবে তারা মনে করেন, এ সব বিষয়ে লেখালেখির জন্য মূলধারার কমিউনিটি সংবাদপত্রগুলোই যথেষ্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকায় এ ধরনের রিপোর্ট এমন এক সময়ে ছাপা হলো যখন আসন্ন নির্বাচনে নিউ ইয়র্ক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি পদে দু’জন এশিয়ান আমেরিকান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন- বিষয়টি লক্ষ্য করার মতো।

অপরদিকে জ্যাকসন হাইটসের ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানি আমেরিকান ব্যবসায়ীরা এ প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায়, রাস্তায় পানের পিক বা থুতু না ফেলা বিষয়ে নতুন ইমিগ্র্যান্টদের সচেতন করা, সিটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সব স্থানে প্রয়োজনীয় সাইনবোর্ড টাঙানো, এবং এ বিষয়ে বর্তমান প্রচলিত আইন অমান্যকারীদের ২০০ ডলার জরিমানার বিষয়গুলো আরও শক্তভাবে প্রয়োগ করার ওপর জোর দেন। তারা মনে করেন, শক্তিশালী কমিউনিটি বিনির্মাণে কমিউনিটির সবল দুর্বল সব দিকই আলোচনায় উঠে আসা উচিত, এ বিষয়ে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। বরং কিভাবে তা প্রশমন করা যায় তার বাস্তব সম্মত আইডিয়া নিয়ে সিটি প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করাই এখন সময়ের দাবি। এ বিষয়ে ‘ইন্ডিয়ান মার্চেন্ট এসোসিয়েশন অব জ্যাকসন হাইটস’-এর সভাপতি শিবচরণ দাস এ প্রতিনিধিকে বলেন, তার সংগঠনের পক্ষ থেকে এ বিষয়গুলোর বাস্তবসম্মত সমাধানের জন্য বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবসহ নিউ ইয়র্কে আজ বুধবার জ্যাকসন হাইটসের ‘ডাইনিং প্যালেস’ রেস্তরাঁয় তারা এ এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে বসবেন। এ ৈবৈঠকে সিটির দায়িত্বশীল প্রতিনিধি ছাড়াও কংগ্রেসম্যান জোসেফ ক্রাউলি এবং নিউ ইয়র্ক সিটি কাউন্সিল স্পিকার ক্রিস্টিন কুইন উপস্থিত থাকবেন।

এদিকে নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট বিষয়ে এ প্রতিনিধির কাছে লিখিত প্রতিক্রিয়ায় নিউ ইয়র্কে দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের হাউজিং সুবিধা নিয়ে কর্মরত এনজিও ‘ছায়া সিডিসি’র নির্বাহী পরিচালক সীমা আগনানী বলেন, ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটি নিয়ে এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়, এর আগে চায়না টাউন এবং আরও বেশ কিছু ঘনবসতিপূর্ণ নেইবারহুডের প্রাতিবেশিক পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কথা উঠেছে। এসবের পাশাপাশি সিটির অর্থনীতিতে জ্যাকসন হাইটসের বাণিজ্যিক অবদানের কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। কিন্তু সে তুলনায় আমার মনে হয় এ এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে সিটির পক্ষ থেকে সম্পদের বরাদ্দ অপ্রতুল- এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। কেননা খুব শিগগিরই এ এলাকা মানহাটনের গ্র্যান্ড সেন্ট্রালের মতো ব্যস্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের ইমিগ্রেশন সুবিধা, মানবাধিকার ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এবং দক্ষিণ এশীয়ার বাঙালিদের দ্বারা পরিচালিত এনজিও ‘ড্রাম’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মনামী মৌলিক বলেন, এ ধরনের রিপোর্ট একদিকে যেমন বিব্রতকর তেমনি অন্যদিকে কমিউনিটির জাগরণের জন্যও সহায়ক।

কিন্তু পাশাপাশি এ-ও মনে রাখতে হবে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নিউ ইয়র্কে দক্ষিণ এশীয়রা অনেক ভাল ভাল কাজ করছে। ইমিগ্রেশন বিষয়ক আইনি সহায়তা, মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকার, আনডকুমেন্টেড শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার অধিকার, ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষিণ এশীয়রা অনেক কাজ করছে, আমরা এই সব বিষয়ে রিসার্চ করছি, রিপোর্ট প্রকাশ করছি, আমাদের গবেষণা নিয়ে ওয়াশিংটনে কংগ্রেসে শুনানি হচ্ছে- কিন্তু দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটির এসব পজিটিভ অর্জনের বিষয়ে প্রতিবেদন না করে নিউ ইয়র্ক টাইমস ছোটখাটো নেগেটিভ দিকগুলোকে তুলে ধরছে- তা সত্যিই দুঃখজনক। এদিকে অবকাশ উদযাপনে নিউ ইয়র্কের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে স্থানীয় সিটি কাউন্সিলম্যান ড্যানিয়েল ড্রম-এর মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি, তবে তার অফিস থেকে জানানো হয় যে, এই এলাকার সার্বিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে এবং পরিস্থিতির আরও উন্নয়নে কাউন্সিলম্যানের ব্যক্তিগত আগ্রহ রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের মার্কিন আদমশুমারির হিসেবে নিউ ইয়র্ক সিটিতে এশিয়ান-আমেরিকানের সংখ্যা সিটির মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৩ ভাগ। নিউ ইয়র্ক সিটিতে বসবাসকারী মোট এশিয়ান আমেরিকানের শতকরা ২৯ ভাগই দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত, এ সংখ্যা প্রায় তিন লাখ।

আর নিউ ইয়র্ক সিটির কুইনস্‌ কাউন্টি হচ্ছে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক বহুমাত্রিক সংস্কৃতির মানুষের আবাসস্থল, এবং ওখানকার জ্যাকসন হাইটস হচ্ছে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশী আমেরিকানদের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র। তথ্যসূত্রঃdeshebideshe.com  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।