আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেয়ে তোমার প্রশ্রয়ী বাহু মেলে রাখো বিষণ্ণ একা, দুঃখি কবির সম্মুখে

কবিতা কবিতা কবিতা মেয়ে তোমার প্রশ্রয়ী বাহু মেলে রাখো বিষণ্ণ একা, দুঃখি কবির সম্মুখে (ক) "যারা এরই মাঝে কবিতায় আত্মসমর্পণ করেছেন এবং ভালোভাবেই করেছেন তাঁরা যেন কবিতা না ছাড়েন। " তরুণ লিখিয়েদের প্রতি মহত্তম কবি শার্ল বোদলেয়ারের এই পরামর্শ দিয়েই আমি বলছিঃ যাদের আছে কবিখ্যাতির গোপন, সমাজ-পরিবারসিদ্ধ নয়, এমন সোনাজ্বলা অভিলাষ; বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের কথা বলতে পারলে আমার বেশ ভালো লাগতো; তাঁরা কেনো কবিতা লিখবে? কেনো করবে শিল্পের নানান শাখা-প্রশাখার উচ্চমার্গীয় চর্চা? এই বিধান, এ-দণ্ড কে দিলো; কে স্থির করলো তাঁদের উপর? তাঁরা যাচ্ছে কেনো, আত্মহত্যা করতে, স্বেচ্ছায়। একি আত্মহত্যা নয়? আমাদের মধ্যে কে না জানি, নিঃস্তব্দ রাতে চন্দ্রের জ্যোৎস্না-বীর্য-প্লাবনের মতো আত্মহত্যার সুড়সুড়ি কার জীবন-যোনীর মধ্যে না ঢুকেছে, অন্তত একটিবার? শিল্পিরাই পারেন আত্মহত্যার শিল্পিত রজ্জুর পরে রজ্জুর মালা গাঁথতে। আত্মহত্যার একান্ত গরিমা তাঁদের, যারা আত্মহত্যার গোপনীয়তাকে প্রকাশ্যে সংবর্ধিত করেন। একজন কবি কতোটা একা, কতোটা স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষীভরা তাঁর চারপাশ? আত্মহত্যা করতে যাওয়া পথিকের কে বা কারা থাকে এমন স্বজন-বান্ধব, একচাবুক বিজলীর ঝলকানি আর অনন্তের গহ্বরে ডুবে থাকা বিবশ অন্ধকার ছাড়া? (খ) মনে থাকুক, আন্তরিক সততা বিবর্জিতগণ যতো বড় কিছু হোক না কেনো, তাঁদের দ্বারা কবি হওয়া অসম্ভব।

কবির জন্য চাই খাদ্য ও পানীয়, আর মাতাল হবার জন্য চাই নেশার সমস্ত উপাদান, উপকরণ। যেমন মদ, মাংসের যন্ত্র, আরো বিবিধ প্রয়োজনীয় স্বপ্নবর্জ্য! কবির দরকার একান্ত একটি ঘর, যেখানে সে নেংটা ঘুমাতে পারে, নেংটা বসে কবিতা পড়তে/ লিখতে পারে। অথবা নেংটা না হয়ে যেমন ইচ্ছা তাঁর তেমন করতে পারে। উপর্যুক্ত বিষয়বস্তুর জন্য চাই একজন শ্রমিকের সমস্তদিনের গাধার-খাটুনি, যা স্বপ্নচারী কবি বা শিল্পীর ব্যয় করেছেন দিন সূচীত হবার আগেই...। কবিতা কি ঐশী বাণী? না কি তা ধরা দেয় অনায়াসে, অভাব আর অপমানের মতো? না, কবিতা ঐশী বাণী নয়, কবিতা অভাব আর অপমানের মতো সহজলভ্য নয়।

কবিতার জন্য দরকার নিবিড় ধ্যান, যা গৌতম বুদ্ধের বোধিপ্রাপ্তির সাধনার চেয়ে কম গুরুত্বের নয়। তবে এমন সাধনার মূল্যশোধ করবে কারা? আছে কি সমাজ, রাষ্ট্রের কবি ও কবিতা বোঝার মতো শিল্পমনস্ক হৃদয়? নেই, তবে? ওহে তরুণ, তোমাকে কবি হতে হলে যেতে হবে_ সমুদয় সংশয়, সংকট, অপমান আর ক্ষরণকে মেনে, নিষিদ্ধ, গুপ্ত সুন্দরের কাছে, তাঁর ডাক নাম কবিতা। ওহে তরুণ-তরুণী, কবি হবে? তবে প্রস্তুত হও...। (গ) আমি, কবিকে আরেকটু প্রকাশ করতে চাই। প্রকাশ করার জন্য, ধরা যাক একটি বিল্ডিং এর গড়ে ওঠার কথা।

শ্রমিকের শরীর থেকে ঝরে পড়া ক্লেদে, ইট, সিমেন্ট, লোহা, আর বালি-পাথরের আবর্জনায়, যখন গড়ে ওঠে একটি বিল্ডিং, ওই গড়ে ওঠার সময়টিতে বড় ঘিনঘিনে নোংরা লাগে আমার। বিল্ডিংয়ের উৎপাদন প্রক্রিয়াও যেনো এক তরল মল আর পাথুরে খেলা, যা খেলছে অসহায় পশুর মতো_ শ্রমিকের পোশাকে হারিয়ে যাওয়া একপাল মানুষ! এ-খেলা হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে বড় ভয়ঙ্কর। নিষ্ঠুর খেলাটি পান করে শ্রমিকের ঘাম, রক্ত, এমনকি জীবনও। অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই- গড়ে ওঠার এ-খেলা, খেলার প্রনালী সুন্দর নয়, জঘন্য। অপার্থিব সৌন্দর্যের চূড়ান্ত দৃশ্যটি ধরা পড়ে তখন_ যখন ভূমিকম্পে বা অন্য কোনো বিপর্যয়ে হুড়মুড়শব্দে ভেঙে পড়ে বিশাল বিল্ডিং!-- অমন অজর সুন্দর সংগঠিত হতে দেখেছি আমরা, টেলিভিশনের পর্দায়।

যে দৃশ্যটি দেখেছেন অনেকেই- ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে আমেরিকায়। যখন তীরের ফলার থেকেও ধারালো গতি নিয়ে-- একজোড়া পাখির মতো টুইনটাওয়ারের বুকে ঢুকে গিয়েছিলো-- মানুষের ছুঁড়া বিমান। আর ওই বিমান-বুকে ঢুকে পরার আনন্দে-- বিল্ডিংদ্বয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে লাফিয়ে পড়েছিলো শূন্যে!- আহ! কী আশ্চর্য সুন্দর, এমন সুন্দরের কথা কি করে ভুলি? এই না-ভোলার দৃশ্যর তুলনা শুধু কবির ভেতর বাহির অন্তরলোকের বিপর্যস্ত সৌন্দর্যের, সৃষ্টি ও ধ্বংসের। এরকম প্রলয় আর ভবিষ্যৎশূন্য, চূড়ান্ত জীবনঘাতি ব্যাধিকে কে বা কারা রাখে ( কবি ছাড়া) ভালোবাসার অভিলাষ? মেয়ে, তুমি? আমরা জানি-- প্রথম থেকে মেয়েরাই সর্বত্যাজ্য কবিকে করেছে আহবান,-- কবির বিষণ্ণ- দুঃখমালার দিকে অন্য এক অস্তিত্ব আর আশ্রয়ের প্রসারিত হাতে- উজ্জ্বল দীপশিখা নিয়ে দাঁড়িয়ে। (ঘ) ফরাশী কবি ভেরলেন ছিলেন ঘরজামাই।

তাঁর কাজ ছিলো, বৌকে ভালোবাসা আর কবিতা লিখা। স্বপ্নবাজ কবি ভেরলেনের ঘরজামাই জীবন বেশ ভালোই চলছিলো, কিন্তু এখানে মনে রাখা দরকার-- কবি হওয়া ছাড়া কবির জন্য অন্য কোনো আগামী কোনোভাবেই নিশ্চিত নয়;- প্রেমের মতোই অনিশ্চিত। তাই তো আমরা দেখলাম- সুনিশ্চিত খাদ্য আর পানীয় আর গোলাপির সুন্দর দেহ আর আয়েশি বিছানা হুমকির মুখে রেখে উন্মাদ প্রায়, ছুটে ছিলো মাতাল, আরেক সিংহ আত্মা কবি র‌্যাঁবোর মায়াবি কুঞ্জটিকা-তটে। এই র‌্যাঁবো হলো নতুন এক সভ্যতা- আমি বলি র‌্যাঁবো মানে গভীরতর আগুনের লেলিহান জিহ্বাটির নাম। স্বপ্নকাঙ্গাল, বাস্তবতা জর্জরিত এমন এক জীবনের অধিকারী, এই ভূ-খণ্ডে জন্ম নেয়া কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

এই কবির সমস্ত গ্লানি আর ব্যার্থতাকে নিজের অস্তিত্বে আপন করে নিয়ে- প্রশ্রয়ী হাত আর প্রশান্তির কালো- মেঘমালা-চুল বাড়িয়ে দিয়েছিলো--- এক বাঙালী কন্যা। জীবনের প্রতিটা বাঁকে পোড় খাওয়া মানুষ, শুদ্ধ প্রেমিকা--- তসলিমা নাসরিন তাঁর নাম। এরকম উদাহরণ সহস্র পাওয়া যাবে সাহিত্যের ভূবন ঘেঁটে। আরো একজন মেয়ে, যার কথা মনে পড়ছে আমার,সে আছে চট্টগ্রামে। তাঁর নাম মেঘদ্যুতি! উন্মুখ সে, পাগলিনী প্রেমিকা, নিজেকে বিসর্জন দিতে।

স্বপ্নকে বেঁচে থাকার পাথেয় বানাতে গিয়ে যে নিজেই স্বপ্নের ভোগ হয়ে যায়, এমন একজন কবির কাছে। এ থেকে কি প্রতিয়মান হয়? মেয়েদের, নারীদের অবচেতনে বেজেছে কি-- মহান কবি শার্ল বোদলেয়ারের প্রিয় সেই অমোঘবাণী? “কোনো প্রসিদ্ধ আইনজ্ঞের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সফল গাধাদের বৌ হওয়ার চেয়ে কবির দাসী হওয়া গৌরবের”। তা না হলে কেনো, নিষিদ্ধ সুন্দর, অনিশ্চিত জীবন ভালোবেসে যাবে তাঁরা? আর এমন নারীকে দেখে- শিল্পমনস্ক জ্ঞানীসমাজ, বলুন, কে না জানাবেন- ওই সুন্দরের পদতলে চুম্বনসিক্ত উষ্ণ-অভিবাদন? ওহে কন্যা, ভগ্নি, ওহে জননী, প্রেমিকা আমার- তুমি কি জানো চিরজাগ্রত কবির এক বিন্দু মানবিক প্রশান্তির ধাত্রী হবার একমাত্র উত্তারাধিকারী তুমি, হ্যাঁ শুধুই তুমি...। (ঙ) দেখলাম, গলিত লাশের মতো জনপ্রিয় লম্পটদের ঘিরে ঘুরপাক খাওয়া জনগণ যেন মলের মাছি। কেউ, কোন তরুণ-তরুণী যেন অতি কিছু, বিশেষ করে কবি বা শিল্পি হতে গিয়ে-- উপর্যুক্ত লাশ বা মলের মাছি না হয়ে যান...।

চরম নির্জনেও কবি একা কবিতা সৃষ্টি করবেন, কবি হবার অভিলাষে, বিচিত্র উপায়ে জীবন খরচ করবেন, এটাই তাঁর প্রকৃতি। আমি মনে করি, আমার এ- মনে করা কারো কাছে প্রশ্নসাপেক্ষ হতে পারে, তা নিশ্চিত জেনেই প্রকাশ করছি আমার মনোভাবঃ আজকের দিনে-- দিকেদিকে বেড়ে গেলো দেখছি- কবি ও কবিতা নামের উৎপাত, এই সমস্ত কবি ও কবিতা চাকচিক্যে ধরা দিতে গিয়ে হচ্ছে পণ্য-- আর পণ্য আরো একটু গ্রাহক-সুলভ হতে গিয়ে তথাকথিত পাঠকের রুচির সমান নিম্ন-মাঝারি কুরুচিপূর্ন ভাড়োক্তি হয়ে উঠেছে...। এ- থেকে দূরে থেকে, মুক্তির উপায় অবশ্যই দেখাবেন, শিল্পের প্রেমিক, শুদ্ধ কবিরা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.