আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'"অরুণ" মুমূর্ষুর রক্তের সন্ধানদাতা

মানবিক দায় ও বোধহীন শিক্ষা মানুষকে প্রশিক্ষিত কুকুরে পরিণত করে....আইস্ট্যাইন। বরিশালের পলাশপুর এলাকার ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে টাঙানো রক্তের গ্রুপের তালিকা। অরুণ কুমার দাস। পেশায় ওষুধ কম্পানির আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক। চাকরির পাশাপাশি আত্মনিয়োগ করেছেন মানবতার সেবায়।

স্বেচ্ছায় অসহায় ও দরিদ্র মুমূর্ষু মানুষকে বিনা মূল্যে রক্ত সরবরাহ করে আসছেন। একান্ত প্রয়োজনের সময় রক্তের জোগান ও সন্ধান দিয়ে একাধিক মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর বেঁচে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। পৃথিবীর আলো-বাতাস উপভোগের সুযোগ করে দিয়েছেন। কেউ বিপদে পড়ে স্মরণ করলেই হলো। খবর পাওয়া মাত্র সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

সে সুবাদে অরুণ কুমার নামটি আজ বরিশাল নগরবাসীর মুখে মুখে। ঠোটস্থ তাঁর সেল ফোন নম্বরটিও। বরিশাল শহরের সহাস্রাধিক ব্যক্তির রক্তের গ্রুপসহ তাদের নাম অরুণ কুমারের মুখস্থ। দীর্ঘদিন ধরে এই সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে শহরবাসী তাঁকে 'মুমূর্ষুর রক্তের সন্ধানদাতা' খেতাব দিয়েছেন। আত্মতৃপ্তিতেই সেবার শপথ : এসএসসির ফল প্রকাশের পর অরুণ ও তাঁর বন্ধু আঁখি তাঁদের জমানো ৮০০ টাকা তুলে দেন প্রতিবেশী হতদরিদ্র কামাল মিয়ার হাতে।

উদ্দেশ্য, দরিদ্র কামাল যেন ওই টাকায় পান-বিড়ির দোকান দিয়ে স্বচ্ছল হতে পারে। হয়েছেও তাই। এতে মুগ্ধ অরুণ শপথ নেন মুমূর্ষু মানুষের সেবা করার। সে লক্ষ্যে একই আদর্শে উদ্বুদ্ধ বন্ধুদের নিয়ে অরুণ নব্বই দশকের শুরুর দিকে বরিশাল নগরীর দপ্তরখানার প্রগতি পাঠাগারে আয়োজন করেন- 'স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি। ' উদ্যোগটি ভালো লাগে স্থানীয় সবার কাছে।

বন্ধু ও বড়দের সহায়তায় চলতে থাকে তাঁর এই মহতী কার্যক্রম। লেখাপড়ার পাশাপাশি অসহায় রোগীদের রক্ত দিয়ে সেবা করায় সবার কাছে পরিচিতি পান রক্তের জোগানদাতা হিসেবে। ১৯৯৫ সালে তিনি এলাকার বড় ও ছোট ভাইদের নিয়ে গড়ে তোলেন 'আশ্রয়' নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। যাদের জন্য সব : বরিশালে শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে প্রায় প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসেন অসংখ্য মুমূর্ষু রোগী। বিভিন্নজনের কাছ থেকে জেনে তাদের মধ্যে অনেক রোগীর স্বজনরা যোগাযোগ করতে থাকে অরুণের সঙ্গে।

তাদের বেশিরভাগই আর্থিকভাবে অসচ্ছল। বরিশালে কোনো মুমূর্ষু রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলেই সবার আগে চোখের সামনে ভেসে ওঠে অরুণের মুখ। এমনকি বরিশালের আশপাশের এলাকাগুলোতেও অনেক মানুষ রক্তের প্রয়োজন হলেই ছুটে আসেন তাঁর কাছে। শেবাচিম হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে বেশ কিছু চিকিৎসকের শেষ ভরসাও এই অরুণ। এ ছাড়া প্রতিদিন বরিশালের কোনো না কোনো থ্যালাসেমিয়া রোগীর রক্তের ব্যবস্থা করছেন তিনি।

প্রায় ১৫ জন থ্যালাসেমিয়া রোগীর নিয়মিত রক্তের জোগান দেন এই যুবক। মনোবল হারাননি : পাঁচ-ছয় বছর ভালোই চলছিল অরুণের সংগঠনের কার্যক্রম। তবে সংগঠনের সদস্যরা জীবিকার তাগিদে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় একসময় অচল হয়ে পড়ে সংগঠনের কার্যক্রম। তবে মনোবল হারাননি। ২০১০ সালে কয়েক বন্ধু মিলে গঠন করেন 'সহযোগ' নামের আরেক রক্তদান সংগঠন।

সংগঠনের উদ্যোগে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডবাসীর রক্তের গ্রুপ বোর্ডে ছক তৈরি করে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ঝুলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। চার ও পাঁচ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় এ কার্যক্রম চলছে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের পাশে : বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্র বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়কে ফার্নিচারের দোকান 'ছালাম স্টিল হাউস'। জোসনা আক্তার এই ব্যবসা সামলাচ্ছেন। পাশাপাশি হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণা হচ্ছে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত দুটি সন্তান।

বড় ছেলে সাইফুল খান অপু বিএম কলেজে অর্থনীতি বিভাগে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। ১৯৯৭ সালে শিশু অবস্থায় তিনি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হন। তাঁর ছোট ভাই জোবায়ের খান তপুও এই রোগে আক্রান্ত হয় ২০০০ সালের দিকে। অসুস্থ দুটি সন্তান নিয়ে স্বামী আবদুস ছালাম ও জোসনা আক্তারের মুখের হাসি হারিয়ে গেছে। এ অবস্থায় বিপর্যস্ত পরিবারটির পাশে এসে দাঁড়ান অরুণ।

নিয়মিত রক্তের জোগান পেয়ে এখন স্বস্তিতে গোটা পরিবার। জোসনা আক্তার বলেন, 'অপুর জন্য তিন মাস পর পর রক্তের প্রয়োজন হতো। রক্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে সমস্যা হতো। একপর্যায়ে পরিচয় হয় অরুণ দাদার সঙ্গে। তিনি বিনা মূল্যে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে দুই ছেলের জন্য প্রতি দুই মাসে তিন ব্যাগ করে রক্ত সংগ্রহ করে দেন।

বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে গিয়ে আরো বেশ কয়েকজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। তারাও আমার কাছ থেকে অরুণ দাদার ঠিকানা নিয়ে রক্ত সংগ্রহ করছেন। ' পেয়েছেন সম্মান : সংগঠন গড়ার কয়েক বছর পর রক্তদান কর্মসূচিতে বরিশালে সর্বোচ্চসংখ্যক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের রেকর্ড গড়েন অরুণ কুমার দাস। বরিশালের দপ্তরখানা সড়কের প্রগতি পাঠাগার চত্বরে আয়োজিত ওই রক্তদান কর্মসূচিতে এক দিনে সর্বোচ্চ সংগ্রহ হয়েছিল ২৫১ ব্যাগ রক্ত। এ ছাড়া ১৯৯৬ সালে সর্বোচ্চ ১০ ব্যাগ রক্তদাতার কৃতিত্বস্বরূপ পান সন্ধানী বরিশাল শাখার বিশেষ পুরস্কার।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্সসহ এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন এই পরোপকারী তরুণ। চাকরির পাশাপাশি মহতী উদ্যোগটি শত কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্যেও পরিবার ও বন্ধুদের সহোযোগিতায় বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে। অরুণ বলেন, 'মাঝরাতেও কেউ এসে রক্তের জন্য সহায়তা চাইলে পরিবারের সদস্যরা আমাকে ডেকে দেন। তারা কখনো বিরক্ত হয় না; বরং উৎসাহ জোগায়। তারাই আমার অনুপ্রেরণা।

' সংশ্লিষ্টদের কথা : বরিশাল সিটি করপোরেশনের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাইনুল হোসেন চিশতি বলেন, এলাকায় যাঁর যখন রক্তের প্রয়োজন হয়, তাঁরা সবাই অরুণ দাদার কাছ থেকে রক্তের গ্রুপ ও ফোন নম্বর জেনে নেন। এমনকি তাঁর নিজের হাতে গড়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'সহযোগ'-এর মাধ্যমে এলাকার অন্তত ২০০ নারী-পুরুষের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে দিয়েছেন। বরিশাল সদর হাসপাতালের চর্ম বিশেষজ্ঞ ডা. প্রদীপ কুমার বণিক ও শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার বাসুদেব কুমার দাস বলেন, 'চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের রক্তের প্রয়োজন পড়লে তাদের আমরা অরুণের কাছে পাঠাই। যেহেতু অনেক ব্যক্তির রক্তের গ্রুপ অরুণের জানা, তাই তিনি অল্প সময়েই রোগীদের রক্ত সংগ্রহ করে দেন। ' কালের কণ্ঠ  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.