আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অষ্ট্রেলিয়া-আমেরিকার জন্য আদিবাসী টার্মটা সত্যি হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য নয়।(আদিবাসী বিতর্ক-২)

জনারণ্যে নির্জনতায় আক্রান্ত। নির্জনতাই বেশী পছন্দ, নিজের ভেতরে ডুবে থাকতেই ভাল লাগে। কিছুটা নার্সিসিস্টও। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী আদিবাসি হতে হলে প্রাক-উপনিবেশ আমল থেকে অবিচ্ছিনভাবে কোন এলাকায় বসবাস থাকতে হবে। এবার আমরা দেখি প্রাক-উপনিবেশ আমল বলতে আসলে কি বুঝায় ? খুবই সংক্ষিপ্তাকারে ব্যাপারটাকে এখানে তুলে ধরছি।

পনেরশ শতাব্দীতে ইউরোপিয়ান নাগরিক কলম্বাস যখন আমেরিকা আবিষ্কার করেন তারই ধারবাহিকতায় সেখানের পুর্বথেকেই বসবাসকারী রেড ইন্ডিয়ানদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ইউরোপিয়ানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। আর আদি বাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ানরা সেখানে কালক্রমে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে, এখন তারা বলতে গেলে নিশ্চিহ্নই বলা যায়। তাই সেখানে আদিবাসি ব্যাপারটার যৌক্তিকতা রয়েছে। ঠিক একই ভাবে অষ্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড এর আদিবাসি মাউরিরা ইংল্যান্ডের শেতাঙ্গদের কাছে তাদের স্বাধীনতা ও ভূমি হারিয়ে কালক্রমে সংখ্যালঘুতে পরিনত হয়েছে। তাই সেখানেও আদিবাসি ইস্যুটি জীবন্ত।

আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদেরকে হটিয়ে এবং নিশ্চিহ্ন করে ইউরোপিয়ান শেতাঙ্গরা দুটি মহাদেশেররই নিয়ন্ত্রন নিয়ে নিয়েছে আজ কয়েকশ বছর হলো। ঠিক একই ভাবে ল্যাটিন আমেরিকাতেও স্প্যানিশ, ডাচ ও পর্তুগীজরা কালক্রমে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এবং জনসংখ্যার সংখ্যাগুরু অংশে পরিনত হয়েছে। ইউরোপিয়ানরা আমেরিকায় বা অষ্ট্রেলিয়ার যেটা করতে পেরেছে সেটা এশিয়ায় করতে সক্ষম হয়নি। তাই এখানে আদিবাসি ইস্যুটিও ধোপে টিকে না। সতেরশ শতাব্দীতে ইউরোপিয়ানরা ভারতীয় উপমহাদেশের নিয়ন্ত্রন নিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু এখানকার আদি অধিবাসীদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হয়নি এখানকার জনসংখ্যার সংখ্যাধিক্য ও জনসচেতনতার কারনে।

তাই ভারতীয় উপমহাদেশ বলি আর মিডলইষ্ট বলি আর দুরপ্রাচ্য চীন-জাপান বলি কোথাও এখানকার আদি অধিবাসীদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হয়নি ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদিরা। ব্যাতিক্রম শুধু অষ্ট্রেলিয়া। তাই এশিয়ায় আদিবাসি ধারনাটা অবান্তর। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের অপরাধ হালকা করার্থেই আদিবাসী টার্মটাকে নতুন মোড়কে তুলে এনেছে। তারা দেখাতে চাচ্ছে তারা কতটা মহান যে তারা আদিবাসীদের কত মর্যাদা দেয়।

তাদের কার্যক্রম আদিবাসীদের ভুমি ও স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে তাদেরকে খাচায় পোষা জন্তুতে পরিনত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা সাম্রাজ্যবাদিদের তৈরি "আদিবাসী ও দখলকারী" অবস্থা নয়। এখানে কেউই দখলকারী নয়। এখানে হাজার হাজার বছর থেকে বাঙ্গালীরা বসবাস করে আসছে। তার সাথে সাথে আরও ক্ষুদ্র নৃ-জাতি বা উপজাতিসত্বাও আছে।

সবাই ই এখানকার আলো-জলে বেড়ে উঠেছে। এর ভেতর কেউ কেউ মাইগ্রেট করে পার্শবর্তী ভারত বা মায়ানমার থেকে এসেছে আবার কেউ কেউ ভারত বা মায়ানমারে চলেও গেছে। যখন এ আসা-যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে তখন এই পুরো অঞ্চল একই শাষনাধীন এলাকা ছিলো বা একই দেশ ছিলো। তাই এটা সাধারন মাইগ্রেশনের পর্যায়েই পড়ে । এখানে কোন অস্বাভাবিকতা নেই।

সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালীদের সাথে বাংলাদেশের এই ছোট্ট ভু-খন্ডে আরও অনেক ক্ষুদ্র জাতিস্বত্বা বিদ্যমান। এই ক্ষুদ্র জাতিস্বত্বার অধিকারীরা যেমন পাহাড়ে বসবাস করে তেমনি সমতলেও অনেক ক্ষুদ্র জাতিস্বত্বার মানুষের বাস। বাংলাদেশের এই ক্ষুদ্র নৃ-জাতি বা উপজাতিসত্বা হলো - চাকমা • সাঁওতাল • মনিপুরী • রাখাইন • মুরং • খাসিয়া • গারো • হাজং • মারমা • মগ • পাংখো • রাজবংশী • খুমি • ত্রিপুরা • কুকি • চক • হাদুই • লুসাই • হদি • বাওয়ালী • ওঁরাও • তনচংগা • বনযোগী • মৌয়ালী। এঁদের অনেকেরই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে বসবাস। আবার সাঁওতাল, গারো, রাখাইন, বাওয়ালী, মৌয়ালী, হাজংদের বাস বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল এর সমতলে।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এইদেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমিতে সকল নাগরিকের পুর্ন ও সমান অধিকার আছে। তাই নতুন করে কাউকে অধিকার দেবার কথা আসতে পারে না। এখানে কেউ কারও চাইতে ছোট বা বড় নয়। একজন পাহাড়ীর যেমন বাংলাদেশের যেকোন জায়গায় বসবাস করার অধিকার রয়েছে ঠিক তেমনি একজন সমতলের বাঙ্গালীরও পাহাড় সহ যেকোন জায়গায় বসবাসের অধিকার রয়েছে। এখানে কোন রকম ডিসক্রিমেনেশন সংবিধান স্বীকার করে না।

সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি মহিলাদের অধিকার যেমন সংবিধান স্পেশালি কনসিডার করে তেমনি পিছিয়ে পড়া উপজাতি বা ক্ষুদ্র-নৃতাত্বিক জনগোষ্টির জন্যই আমাদের সংবিধান যথেষ্ট উদার। তবে কোনভাবেই সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠির অধিকার ক্ষুন্ন করে নয়। ১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির হাত ধরে শান্তি বাহিনীর জন্ম ও হিংসাত্মক কার্যক্রমের ভিতর দেয়েই পাহাড়ে রক্তপাত আর সন্ত্রাসের সূত্রপাত হয়েছিলো। শান্তিবাহিনীর চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, হত্যা, লুন্ঠন, মুক্তিপন আদায়, অস্র চোরাচালান থেকে উপজাতি, বাঙালী কিংবা বিদেশী কেউই রেহাই পায়নি। আর তারা এটা করেছে বহির্শক্তির সহয়তায়।

শান্তিবাহিনী কর্তৃক একের পর এক গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞের প্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পুর্ন ভেঙ্গে পড়ে, ঐ অঞ্চলে সবধরনের আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৪ থেকে ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি বলবৎ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শান্তিবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয় প্রায় ত্রিশ হাজারের বেশী বাঙালী এবং ১২ হাজার সাধারন উপজাতি। তারা সেখানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। তারই বাস্তবতায় ১৯৭৬ সালে সরকার পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে বাধ্য হয়। সেনাবাহীনি আগে সেখানে যায় নি, বরং ভেঙ্গে পড়া আইন-শৃঙ্খলার রাশ টেনে ধরার জন্যই সেখানে তারা সরকারের সিদ্ধান্তে গিয়েছিলো।

যেকোন দেশেই এরকম পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি দেশের ভিতরের সকল রাজনৈতিক পক্ষ মেনে নেয়নি, এমনকি পার্বত্য এলাকার সংখ্যগরিষ্ঠ চাকমারা ছাড়া অন্য জাতিসত্বার অধিকারীরাও চাকমা নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা হবার ভয়ে শান্তিচুক্তিকে ভালভাবে নিতে পারেনি। তারপরও ঐ অঞ্চলের শান্তি স্থাপনের সার্থে মন্দের ভাল হিসেবে সেনাবাহিনীসহ সচেতন সকল পক্ষ তাকে সমর্থন করেছিলো। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে উপজাতি টার্মটারই ব্যবহার হয়েছিলো। আজ সন্তু লারমারা যতই নিজেদেরকে আদিবাসি বলে পরিচয় দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তা তখন তাঁরা ভুলে ছিলেন।

আর আজ সুশীলতার চাদর পরে যাঁরা সুশীল আতশি কাঁচ দিয়ে আদিবাসি খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাদের কে বলি আপনারা বুঝতে অক্ষম আপনারা কোন আগুন জ্বালাতে চলেছেন। আপনাদেরকে বলব আপনারা এদেশটাকে সাম্রাজ্যবাদিদের হাতের মুঠোয় তুলে দেবেন না। তারা আপনাদেরকে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থসিদ্ধির তালে আছে। আপনারা না বুঝে তাদের ধোঁয়ায় বাতাস দিয়ে আগুন তৈরি করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের আয়তন মাত্র ৫৫০০০ বর্গমাইল আর পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন তার দশভাগের একভাগ (৫০০০ বর্গমাইল)।

আমাদের এই জনসংখ্যাভারক্রান্ত দেশের প্রতিটি প্রান্তের ভূমির সঠিক ও সুব্যবহারই এদেশটাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। আদিবাসি দিবসে সরকারের প্রতিমন্ত্রির মর্যাদা ভোগ করে সরকারকেই সন্তু লারমা হুমকি দিয়েছেন লড়াই নাকি আবার শুরু হবে। সন্তু লারমাদেরকে একটা কথাই বলি : বেশী টানলে কিন্তু দড়ি ছিড়ে যায়। আপনারা যে আবার লড়াই করার কথা বলছেন, শ্রীলংকা্র তামিল গেরিলাদের বর্তমান অবস্থার কথা একটুও কি আমাদেরকে শিক্ষা দেয় নি ? সন্তু লারমাদেরকে বাস্তবতার মাটিতে পা রাখতে হবে, তানা হলে তাদের উত্তরপুরুষ তাদের এ হঠকারিতার খেশারত দিবে। আর বাস্তবতা বুঝাতে হবে সুশীলতার চাদর পরে থাকাদেরও।

আদিবাসী ইস্যুতে সরকারের অবস্থান এবং তারই সাথে রোহিংগা ইস্যুতেও সরকার যে অবস্থান নিয়েছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, ভৌগলিক অখন্ডতা ও বিশ্ব-রাজনৈতিক কুটকৌশলজনিত বাস্তবতায় সম্পুর্ন সঠিক ও বাস্তবধর্মী। এসংক্রান্ত পূর্বের পোষ্ট (পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা উপজাতি নাকি আদিবাসী Click This Link) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।