আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: কাজীবাড়ির মামদো ভূত এবং প্রোফেসর আশরাফির গোলাপি রঙের টিনের ট্রাঙ্ক

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ শ্যামল, মানে প্রোফেসর আশরাফি, এখনও সিআইএ-র নজর এড়াতে আত্মগোপন করে আছে। কাজেই, যখন ওকে নরসিংদী যাওয়ার দাওয়াত দিলাম তখন ও ছদ্মবেশেই নরসিংদী গেল! তানিয়া এবং ওর বাবা অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক কেও দাওয়াত দিলাম। গতকালই তানিয়াকে ফোন করে সব বলেছি।

সকালবেলা ও ওর কিয়া স্পোর্টেজটা নিয়ে উত্তরায় পৌঁছে শ্যামলকে তুলে নেবে। আমরা মিট করব কমলাপুল রেল স্টেশনের কাছে শিমূল মিঞার বিখ্যাত ‘নীলকন্ঠ কেবিন’-এ। তানিয়া সাত রঙা চায়ের ওই বিখ্যাত কেবিনটি চেনে। ফারহান ও শান্তও নরসিংদী যাচ্ছে। আমার স্ত্রী লায়লা নরসিংদীর মহিষাশুরায় করাতি গ্রামের কাজীবাড়ির মেয়ে।

তবে দীর্ঘকাল কাজীবাড়ি পরিত্যক্ত বলেই কখনও যাওয়া হয়নি। লায়লার মুখেই শুনেছি: করাতি গ্রামের পুবেই নাকি মেঘনা নদী। নদীর পাড়ে রয়েছে মুসলিম আমলের ভাঙাচোরা প্রাচীন দূর্গ। আর কাজী বাড়ির পিছনে খইবাবলা, জিওল আর ঘোড়ানিমের জঙ্গলে রয়েছে বুনো অর্কিডে ঢাকা প্রাচীন এক মাজার। থাকি মনিপুরী পাড়ায়।

সকাল আটটার মধ্যেই কমলাপুরে শিমূল মিঞার ‘নীলকন্ঠ কেবিনে’ পৌঁছলাম। দৈনিক সমকাল কিনে ভিতরে ঢুকলাম। ছিমছাম কেবিন। ভিড় তেমন নেই। ভিতরে ঢুকে দেখি ওরা এখনও আসেনি।

চেয়ারে বসলাম। লায়লা নংসিংদীতে ওর এক চাচাতো ভাইয়ের কাছে ফোন করছে। গতকাল রাত থেকে ট্রাই করেও পায়নি। এখন লাইন পেল মনে হল। একটু পর ফোন অফ করে লায়লা ক্ষুব্দকন্ঠে বলল, ফারুক আমাদের মহিষাশুরায় যেতে নিষেধ করল।

মামদো ভূতের ভয়ে নাকি লোকজন কাজীবাড়ি যায় না। আসলে সম্পত্তি গ্রাস করার ধান্দা আর কী । তবে ফারুক বলল কীর্তন মিঞা নামে এক লোক নাকি কাজীবাড়িতে থাকে। ওহ্ । দৈনিক সমকাল-এর পাতা ওল্টাই।

তৃতীয় পাতায় একটি সংবাদে চোখ আটকে গেল। নরসিংদী কলেজের অধ্যাপক মনোরঞ্জন রায়ের বাড়িতে দুধর্ষ ডাকাতি । মনোরঞ্জন রায় আমার আর শ্যামলের বন্ধু। যশোরে একই কলেজে পড়তাম। ব্যাপারটা লায়লাকে বলতে যাব- বাইরে কাওয়াসাকি নিনজা টু ফাইভ জিরোর প্রচন্ড গর্জন শোনা গেল।

শান্ত ধানমন্ডী লেকে ওর বাইকটা হারানোর পর শ্যামল ওকে একটা নীল রঙের গর্জিয়াস কাওয়াসাকি নিনজা টু ফাইভ জিরো গিফট করেছে। ও ইন্দিরা রোড থেকে ফারহানকে তুলে আনল। কাঁধে ব্যাকপ্যাক আর হাতে হেলমেট নিয়ে শান্ত আর ফারহান কেবিনে ঢুকল। বললাম, ওরা এখনও আসেনি। বোস তোমরা।

একটু আগে তানিয়াকে ফোন করেছি। ওরা মালিবাগ ক্রস করছে। আন্টি কেমন আছেন? শান্ত জিজ্ঞেস করল। সাদা শার্ট পরেছে। নীচে নীল গেঞ্জি।

আর ঘিরে রঙের থ্রিকোয়াটার্স। লায়লা বলল, ভালো বাবা। বসো। চা খাও। তানিয়ারা এল।

ওর বাবা অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক-এর হাতেও একটা পত্রিকায় দেখলাম। অধ্যাপকের পরনে খদ্দেরের পায়জামা-পাঞ্জাবি। আমি জিজ্ঞেস করলাম,কি ব্যাপার। শ্যামল কই? তানিয়া হেসে বলল, স্যার, গাড়িতে। আত্মগোপনে আছেন বলে এলেন না।

ছদ্মবেশে আছেন। গ্রামে গিয়ে একেবারে ছদ্মবেশ খুলবেন। অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক মেয়েকে বললেন, আমাদের সায়েনটিস্ট মোশায় শ্রীমঙ্গলে নীলকন্ঠ চা খেতে পাননি। যা তো, তাতা। চা হলে, ওনাকে এক কাপ দিয়ে আয়।

তারপর আমরা চা’টা খেয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম শ্যামল তানিয়ার গাড়িতে বাদামি রঙের বোরখা পরে বসে আছে। মাথাও ঢাকা। ওর কোলের ওপর গোলাপি রঙের একটা ছোট্ট ট্রাঙ্ক। আমি মাথা নেড়ে হাসলাম।

শ্যামল আজও পাগলই রয়ে গেল। গাড়ির জানলা দিয়ে ওকে দৈনিক সমকাল দিয়ে বললাম, নরসিংদীতে অধ্যাপক মনোরঞ্জন রায়ের দুধর্ষ ডাকাতি। রিড ইট। গাড়িতে উঠলাম। শুক্কুরবার।

রাস্তা ফাঁকা। রূপগঞ্জ পৌঁছে ডাইনে টার্ন নিয়ে বারোটার আগেই মহিষাশুরা পৌঁছে গেলাম। চারিদিকে তাকিয়ে লায়লা বলল, জায়গাটা অনেক বদলে গেছে। একটা তালগাছের পাশ দিয়ে একটা কালীমন্দির আর বটগাছ ছিল। যাও তো সামনের ওই চা স্টলে খোঁজ নিয়ে এসো।

আমি গাড়ি থামিয়ে নেমে এলাম। এই ঝাঁঝাঁ দুপুরে কড়ুই গাছের নীচে চায়ের দোকানটি ফাঁকা। বেঞ্চির নীচে একটি লাল রঙের রোয়া ওঠা কুকুর লেজ গুটিয়ে শুয়ে ছিল। বেঞ্চির ওপরে একজন বৃদ্ধ বসে পান সাজাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, ও চাচা, কাজীবাড়ি কোন দিকে? বৃদ্ধের পান সাজানো বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।

তারপর বলল, আপনে কাজী বাড়ি যাইবেন? কন কী। কাজীবাড়ি অখনে কেউ থাকে না। সাপখোপ আর মামদো ভূতের আখরা। আমার নাম মোল্লা ছায়েদুল্লা। বাড়ি এই করাতি গ্রামেই বাবা।

সারেরা ঐ বাড়ি যাইয়েন না । গেলে বিপদে পড়বেন। সত্য কইতাছি। মামদোভূত শব্দটি এই নিয়ে দ্বিতীয়বার শুনলাম। তবে ভাবলাম, এই বৃদ্ধের তো সম্পত্তিতে লোভ থাকার কথা নয়।

তাহলে? বললাম, কেউ থাকে না কে বলল? কীর্তন মিঞা না কে বলে থাকে। আরে সেই কীর্তন মিঞাই তো মামদোভুত দুধকলা দিয়া পুষে। গ্রামের হকলেই জানে। আইচ্ছা গেলে যান। আমার কী।

আমার কপালে কুঞ্চন। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এরা বাংলাদেশের সেই শ্রেণির-যারা আজও কুসংস্কার আঁকড়ে আছে। বিরক্ত হয়ে বললাম, আহা, সে আমরা বুঝব। এখন বলেন কাজীবাড়ি কোনদিকে।

বৃদ্ধ বলল, সোজা গিয়া বড় একখান বটগাছ পাইবেন। হের পর কালীমন্দির, পানা পুকুর। পুকুরের বাম দিক দিয়া পাকা রাস্তা। যাইতে যাইতে মেঘনা নদী হাতের বামে পড়ব ... বিরক্ত হয়ে গাড়ির কাছে ফিরে এলাম। শান্ত আর তানিয়াকে নির্দেশ দিয়ে গাড়িতে উঠলাম।

পরিত্যক্ত বাড়িতে জিন-ভূত থাকলেও থাকতে পারে, তাই বলে মামদো ভূত! লায়লা বলল, আমার এখন যেন চেনা চেনা লাগে। পূজার সময় ঐ কালীমন্দিরে প্রাসাদ খেয়ে পুকুরে হাত ধুতাম। পুকুরের পাশ দিয়ে সরু পিচের রাস্তা। দু’পাশে ইপিল ইপিল, আকাশমনি, খেজুর আর ইউক্যালিপটাস গাছ; ঝলমলে রোদের শষ্য-প্রান্তর। হালকা ফিরোজা রঙের আকাশ।

বাঁ পাশে ক্ষেতখামারে ওধারে চিকচিকে মেঘনা নদী। রিয়ার ভিউ মিররে দেখি শান্তর নীল কাওয়াসাকি। তার পিছনে তানিয়ার কিয়া স্পোর্টেজ। সব মিলিয়ে আমরা সাত জন। আমার আর তানিয়ার গাড়িতে রান্নাবান্নার সব সরঞ্জামই আছে ।

স্টোভ, হাঁড়িপাতিল, চাল-ডাল, তেল- নুন- মরিচ -লবণ। তানিয়া নিয়েছে চার্জার, টর্চলাইট, মোমবাতি, চার কেস মিনারেল ওয়াটার, ওয়াটার পিউরিফায়ার আর ম্যালামাইনের আস্ত ডিনার সেট। আজ রাতেই বারবিকিউ হতে পারে। যদি না মামদো ভূত নাড়কেল গাছ বেয়ে নেমে এসে ঘায় মটকায়। লুঙ্গি তুলে একটা লোক আসছিল।

লুঙ্গিটা খয়েরি রঙের, বার্মিজ। মাথায় রঙীন টুপি। লোকটার গায়ে রং ফরসা। ঘন জোড়া ভ্রুঁ। দাড়ি তে মেহেদি মাখা।

পরনে নীল পাঞ্জাবি। পায়ে পাম্প শু। হর্ন দিতেই সে থামল। এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে হেসে বলল, আমার নাম কাহার চিস্তি হজুর। বহরম পীরের মাজারের খাদেম।

বলুন কি খেদমত করতে পারি? কাজীবাড়ি কোনদিকে? আয়, হায়। কয় কী। কাজীবাড়ি যাইব। আশতাগফিরুল্লা। ঐ ইবলিশের বাইত যাইয়েন না স্যার।

এ বাড়িত একপাল মামদো ভূতে ছাড়া কেউ থাকে না। বাংলাদ্যাশের সক্কলে জানে। আমার বাড়ি মেঘনার ঐ পারে চর দিঘলদি স্যার । তাই কছম খোদার- কাজীবাড়ি যাইয়েন না। দাদাবাড়ির বদনাম শুনে লায়লার ফরসা মুখটি গনগনে হয়ে উঠল।

বলল, ভূত থাকে না জিন থাকে- সে আমরা বুঝব। তুমি চল তো। কাজীবাড়ি ঐ সামনেই । এখন মনে পড়েছে। প্রচন্ড জোরে হর্ন বাজালাম।

কাহার চিস্তি লাফিয়ে উঠে। শান্তও দেখলাম শাঁই করে কাওয়াসাকি নিয়ে এগিয়ে গেল। পিছনের সিটে ফারহান। জিন্সের ওপর গ্রামীণচেকের ফতুয়া পরেছে। আমাদের দিকে হাত নাড়ল।

লায়লা বলল, লোকটা ভন্ড। বহরম পীরের মাজার কাজীবাড়ির পিছনে খইবাবলা, জিওল আর ঘোড়ানিমের জঙ্গলে। বুনো অর্কিড ঢাকা। দিনের বেলায় কোলাব্যাঙের ডাকত । তবে পরিত্যক্ত বলে ছোটবেলায় মাজারে খাদেম দেখিনি।

আরও কিছু পরে খেঁজুরবনের ভিতরে পুরনো বাড়ির বিশাল কালচে দেয়াল চোখে পড়ল। লায়লা বলল, হ্যাঁ। এটাই, এখানেই গাড়ি পার্ক কর। আমি প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে পড়েছি। বিশাল প্রবেশদ্বার দেখে মুগ্ধ হলাম।

বুঝলাম এক সময় প্রবেশদ্বারের ওপরে কাঠ ছিল। গাড়ি থেকে নেমে এলাম। কাক-পাখি ডাকলেও। চারধার কী নির্জন। লায়লা বলেছিল: কাজীবাড়ির দীঘি অনেক প্রাচীন ।

চারিদকে তাকিয়ে বললাম, কোথায় তোমার দীঘি? দেখবে। আগে ভিতরে চল । সারপ্রাইস আছে। বলে, লায়লা হাসল। যদিও লায়লা হাসে কদাচিৎ।

শান্ত আগেই প্রবেশদ্বারের মুখে কাওয়াসাকিটা পার্ক করেছে। এখন শান্ত আর ফারহান ছবি তুলছে। তানিয়াও গাড়ি থামিয়েছে। ওর বাবা অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক নামলেন আগে। তারপর বোরখা -পরা শ্যামল।

হাতে সেই গোলাপি রঙের ফুল আঁকা ট্রাঙ্ক। বেশি বাড়াবাড়ি করছে শ্যামল। ট্রাঙ্কের আবার কি দরকার। জিন্স কামিজ পরা তানিয়া গাড়ি থেকে নেমেই চারিদিকে তাকিয়ে ছবি তুলতে তুলতে ‘অসাম’ ‘অসাম’ শুরু করে দিল। প্রবেশ পথের পর এবড়োখেবড়ো ঘাসের জমি।

একদিকটা জঙ্গলের মত। বুনো অর্কিডে ভরা। বাঁ পাশে একটা শিশু গাছ দেখিয়ে তানিয়া জিজ্ঞেস করে, ওই গাছটার কী নাম বাবা? অধ্যাপক বললেন, শিশুগাছ মা। মনে রাখবি। শিশুগাছের ছাল সেদ্ধ করে খেলে মেদ কমে।

তানিয়া আমার বউ লায়লার কোমরের দিকে তাকালো। ক্লালো ব্লাউজ আর বেগুনি জামদানি শাড়ি পরা লায়লা পঞ্চান্নতে পৌঁছে ভালো মুটিয়েছে। তবে তানিয়ার দৃষ্টিটা ভাগ্যিস খেয়াল করেনি। কয়েক পা এগিয়েই দীঘিটা দেখলাম। বিশাল।

কালো রঙের অসম্ভব টলটলে পানি। দীঘির চারধারে নাড়িকেল গাছ। চার দিকে চারটে ঘাট। তানিয়া আর শান্ত ফারহান এদিকার দীঘির ঘাটে পৌঁছে ছবি তুলছে। দীঘি ঘিরে তিনদিকে সাদা রঙের দোতলা দালান।

লায়লা কেন বলল সারপ্রাইস আছে- এবার বুঝতে পারছি। কাজীবাড়িটি আসলে ব্যতিক্রমী এক জমিদার বাড়ি। কেননা, দীঘির জায়গায় পাকা চাতাল থাকার কথা। আর দীঘি থাকার কথা বাড়ির পিছনে বা সামনে। লায়লা বলল, এই দীঘির নাম রায়দীঘি।

বাবার মুখে শুনেছি, দীঘি কাটিয়েছেন জমিদার কৃষ্ণধন রায়। আমার এক উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ কাজী বেলায়েৎ আহমদ এই জমিদার কৃষ্ণধন রায়ের কাথ থেকে বাড়িটা কিনে নিয়েছিলেন। একতলার অলিন্দে স্তম্ভ । স্তম্ভে চিনিটিকরির কাজ। বেশ অবাক হলাম।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাড়িটি নির্মিত বলে মনে হল। দোতলার বারান্দায় লোহার গ্রিল। তাতে ফুলেল মোটিফ। সিঁড়ির ঠিক ওপরেই ঘুলঘুলি। অধ্যাপক বললেন, আশ্চর্য! এমন বাড়ি বিরান ।

ভাবলেও অবাক লাগে। আপা, এই বাড়িটিকে যাদুঘর বানালে কেমন হয়? লায়লা একটি এনজিওর পরিচালক। যে কারণে লায়লা বলল, এমন দূর্গম জায়গায় কে আসবে ভাই? আমার ইচ্ছা ভিটেমাটি না হলেও আমার বাবার অংশের জমিজমা বিক্রি করে গ্রামের অভাবী মেয়েদের আর্থিক সহায়তা দেব। শ্যামল দেখি চারিদিকে তাকচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি রে শ্যামল বোরখা খুলবি না? শ্যামল কী বলতে যাবে - চিনিটিকরির স্তম্ভের ওপাশ থেকে এক শীর্ণ কালো বৃদ্ধ বেরিয়ে এল।

বৃদ্ধের পরনের সাদা পাঞ্জাবি আর সবুজ লুঙ্গি। মাথায় ছোট ছোট করে ছাঁটা পাকা চুল। মাথায় কাপড়ের টুপি। বৃদ্ধ বলল, সেলাম হৈজুর। লায়লা জিজ্ঞেস করল, তুমি? আমি কীর্তন মিঞা বেগম সাহেবা।

আমি অবাক হলাম। এই বুড়ো মামদোভুত পুষে? চায়ের দোকানের বৃদ্ধ মোল্লা ছায়েদুল্লা তো তাই বলল। লায়লাকে বললাম, কি, চেন নাকি? লায়লা বলল, মনে পড়ছে না। অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক বললেন, সে কী! আপনি এ বাড়ির মেয়ে আর একে চেনেন না। বাতাসে অধ্যাপকের খদ্দেরের পায়জামা পাঞ্জাবি উড়ছিল।

লায়লা বলল, আসলে আমার খুব ছোটবেলা কেটেছে এখানে। বাবা চট্টগ্রামে চাকরি করতেন। পরে বাবা নরসিংদী শহরে বাড়ি করলেন। আমি পড়াশোনা করেছি নরসিংদী শহরেই। ক্লাস এইটে পড়ার সময় শেষবার করাতি এসেছিলাম।

দাদীর মৃত্যুর সময়। তখন একে দেখিনি। আমি বেগম ছাহেবা ছৈদ মাঝির পুত। বাড়ি ছিল মেঘনার হেই পাড়ে বাক্সলিপুর। বাড়িঘর নদীতে ভাঙছে।

কী করুম। বুড়া মানুষ। এইহানে থাকতাছি আইজ তিন বছর। অখন আমারে চিনছেন নি? লায়লা বলল, না। যাক।

শোন কীর্তন মিঞা । আমরা এখানে কয়েকদিন থাকব। বাজার সদাই করে দিতে পারবে? পারুম। পাকশাকও কইরা দিমু। সমস্যা কী।

একতলার ঘরে দরজা জানলা ভাঙা দেখলাম। ওখানে থাকা যাবে না। দোতলার ঘরের কি অবস্থা? থাকা যাবে? জ্বে। যাইব। লায়লা বলল, তাহলে অন্তত পাঁচটা ঘর সাফসুতরো করে দাও।

চাদর-বালিশ সব আমরাই এনেছি। ওপরে উঠতে যাব। দেখি শ্যামল নেই। কই গেল ও। তানিয়ারা এখন দীঘির পাড় থেকে ছাদে।

আমি আর অধ্যাপক গাড়ি থেকে মালপত্র নিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। বেশ প্রশস্ত বারান্দা। ওপারে কাঠের কারুকাজ। কয়েকটি ঘরে খাট-পালঙ্ক আছে। বুঝলাম, মামদো ভূতের ভয়ে চুরি-টুরি হয়নি।

কীর্তন মিঞা কাজে লেগে গেল। বৃদ্ধ হলেও কর্মঠ। একটা ঘরে টেবিল-চেয়ার আছে। চেয়ারগুলি টেনে বারান্দায় নিয়ে এলাম। এক ফাঁকে ছাদ উঠলাম।

তানিয়ারা ছাদে নেই দেখলাম। ছাদের রেলিং ছোট। মাঝখানে লম্বা তার। একটা লুঙ্গি ঝুলছিল। কীর্তন মিঞার? বাড়ির পিছনে গাছাপালার জঙ্গল।

লায়লা বলেছিল দিনের বেলায় কোলাব্যাঙের ডাকত। এখন ঝিঁঝিঁ পোকা। বুনো অর্কিড আছে অবশ্য আছে। একটি দালানও দেখলাম। মাজার? নীচে নেমে কীর্তন মিঞা কে বাজারের টাকা দিলাম।

শ্যামল দেখলাম, একটা ঘর গুছিয়ে নিয়েছে। বোরখা খুলে পালঙ্কে উঠে বসে মিনারেল ওয়াটার খাচ্ছে। পালঙ্কের ওপর ফুল আঁকা সেই গোলাপি ট্যাঙ্ক। বললাম, ট্রাঙ্কে কি আছে রে? এএমজিডি বা অ্যান্টি ম্যাটার জেনারেটর ডিভাইস। অনেক দিন ধরে কাজ করছি।

এখন কাজ প্রায় শেষ। ওর কথাটা ঠিক বুঝলাম না। দিনটা চমৎকার কাটল। দীঘিতে গোছল সেরে খেতে বসলাম। কাচকি মাছের পাতুরি, কালোজিরা ভর্তা, চালতার আচার, মাষকালাইয়ের ডাল, টক দই।

কীর্তন মিঞার রান্না চমৎকার। খাওয়ার পর লায়লা বলল, রাতে বারবিকিউ হবে। ভেন্যু: রায় দীঘির ঘাট। কীর্তন মিঞা কে বাজারের টাকা দিলাম। তানিয়া মাটির তৈজষপত্র কিনবে।

তানিয়াও ওর সঙ্গে বাজারে গেল। লায়লা দুঃস্থ মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গ্রামে গেল। ওর সঙ্গে শান্ত আর অধ্যাপক। আমি শ্যামল, আর ফারহান গেলাম নদীর দিকে। প্রবেশদ্বারের পরে খেঁজুর গাছের ফাঁক দিয়েই নদী দেখা যায়।

ওখানেই পুরনো দূর্গটা। অনেকটা মুন্সিগঞ্জের ইদ্রাকপুর দূর্গের মতোই। ওটা সপ্তদশ শতকে মুগল সুবেদার মীর জুমলার তৈরি। এটা কার? দূর্গের প্রবেশদ্বারের ওপর প্যারাপেটে অলঙ্করণ। ভিতরে খোলা জায়গায় গরুছাগল চড়ছে।

খোলা জায়গাটি দেয়াল বা প্রাচীর ঘেরা। অনেক জায়গায় প্রাচীর মাটিতে ডেবে গেছে। তবে প্রশস্ত সিঁড়ি আজও অক্ষত আছে। উঠে দেখি প্রাচীরে পা ঝুলিয়ে কাহার চিস্তি বসে আখ খাচ্ছে। টুপি খুলে রেখেছে নদীর বাতাসে উড়িয়ে নেবে বলে।

আমাদের দেখে টুপ করে নেমে পড়ল। সালাম দিয়ে বলল, ছারেরা ভালো আছেন? আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ। ভালো। কিন্তু কই কাজীবাড়িতে মামদো ভূতে তো ধরল না? তেনেরা কি দিনের বেলায় আসেন ছার ? তেনারা রাতে বেলা আসেন। আচ্ছা, দেখা যাক।

ফারহান লোকটার ছবি তুলল। আমরা হাঁটতে লাগলাম। শ্যামল দেখলাম ওর এলজি অপটিমাসে ব্ল টুথ দিয়ে ছবিটা ট্রান্সফার করে নিল। ওকে কেমন চিন্তিত দেখাল। সন্ধ্যের পর তুমুল পূর্ণিমা।

কীর্তন মিঞা রায়দীঘির ঘাটে ইটের ফাঁকে লাকড়ি জ্বালিয়ে তার ওপর হাঁড়ি বসিয়েছে। আইটেম মুগের ডালের খিচুরি, নারকেল দুধে হাঁসের মাংস, আর লায়লার স্পেশাল কাশ্মীরি আচার । শ্যামল দেখলাম হাতে একটা ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে দীঘির পাড়ে কী সব দেখছে। ত ঢেকি স্বর্গে গেলেও তো ধান ভানে। ঘাটের ওপর বসে তুমুল আড্ডা জমেছে।

আড্ডার বিষয়: প্রাচীন দরদালানের ভূত। এবং এই বাড়ির ভূত-প্রেত ঠিক কোথায় থাকতে পারে। রান্নার ফাঁকে লায়লা বলল, আজ দুপুরে কাহার চিস্তির সেই সাবধানবাণী। মামদো ভূতের কথা। শ্যামল এল।

শান্ত বলল, স্যার, আন্টি বললেন যে আগে এই বাড়িটা ছিল জমিদার কৃষ্ণধন রায়ের। জমিদারবাড়ি যখন- তখন মাটির নীচে গুপ্তধন নেই তো। শ্যামল বলল, এই ডিভাইস দিয়ে আমি সেটাই দেখছিলাম। রায়দীঘির নীচে একটি পাকা ঘর আছে বলে মনে হল। টানেলও আছে একটা।

তবে মাটির অনেক তলে মনে হল। আমরা থমকে গেলাম। তবে খাওয়ার পর লোকাল খিরসা পরিবেশন করতেই হইচই পড়ে গেল। শ্যামল দেখলাম দুই পাতিল উড়িয়ে দিল। যখন ঘুমুতে এলাম তখন রাত একটা ... রাতে কী সের শব্দে ঘুম ভাঙল।

উঠে দেখি কে যেন দরজা ধাক্কাচ্ছে। বিছানা থেকে খুলে দেখি অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক। খালি গা লুঙ্গি পরা। ভদ্রলোক আমাদের পাশের ঘরেই ঘুমাচ্ছিলেন। বললাম, কি হয়েছে? তানিয়া কী যেন দেখে ভয় পেয়েছে।

এখুনি আসুন। ও ছাদে। আমি দৌড়ে গেলাম। লায়লা শাড়ি ঠিক করছিল। সিঁড়িতে দেখি শ্যামল।

পায়জামা আর নীল গেঞ্জি পরা। ছাদের রেলিংয়ে তানিয়া হেলান বসে আছে। সাদা নাইটি পরা। বিধস্ত চেহারা। পাশে চশমাটা পড়ে আছে।

ওর পাশে শান্ত আর ফরহান। ফারহানের হাতে মিনারেল ওয়াটারের একটা বোতল। লায়লা এল। শ্যামল তানিয়ার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। কি হয়েছে তানিয়া? নীচে মামদো ভূত দেখলাম স্যার।

অধ্যাপক বললেন, আহা, তাতা । কী ভাবে বুঝলি যে মামদো ভূত? তুই আগে কখনও মামদো ভূত দেখিছিস? তানিয়া ঝাঁঝ দেখিয়ে বলল, কেন, তুমিই তো বলেছো মামদো ভূতের মাথায় শিং থাকে। লায়লা জিজ্ঞেস করল, এত রাতে ছাদে কি করছিলে তুমি? মামদো ভুতে ছবি তুলতে এসেছিলাম আন্টি। তারপর দেখি ওই শিশু গাছের ওপাশ থেকে ওটা বেরুলো । মা গোঃ কী গ্রিসলি! মাথায় শিং।

মিশমিশে কালো। ভয়ে আমার হাত পা অবশ হয়ে এল। ধপাস করে এখানে পড়ে যাই। তারপর কী করে যে ফারহানকে ফোন করি। ভাগ্যিস ওর মোবাইল অন ছিল।

লায়লা বলল, বুঝেছি। এবার চল তো, আমার ঘরে । মোশতাক তুমি অধ্যাপক সাহেবের ঘরে শোও । তানিয়া আমার সঙ্গে শোবে। ঘর থেকে বালিশ নিয়ে অধ্যাপক -এর ঘরে এলাম।

চার্জারের আলোয় দেখলাম: বিশাল পালঙ্ক। নীল চাদর বিছানো। অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন। বিরাট পন্ডিত ব্যক্তি।

তিনি পালঙ্কে সটান হয়ে শুয়ে আমাকে হেলুসিনেশন থিউরি বোঝাতে লাগলেন । আসলে মামদো ভূত বলে কিছু নেই। তানিয়ার হেলুসিনেশন হয়েছে। আমি চার্জার অফ করে বিছানায় শুয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কি এখন হেলুসিনেশন হচ্ছে? না। আপনি কি আতরের গন্ধ পাচ্ছেন? পাচ্ছি।

এর ব্যাখ্যা কী দিবেন? এর ব্যাখা হল, জানালার ওপাশে কেউ আতরের শিশি রেখে গেছে। জানালার পিছনে ঘন জঙ্গল। বুনো অর্কিডে ঢাকা মাজার। অবাক হয়ে বললাম, কেন? যেন আমরা ভয় পাই। কাজী বাড়ির প্রোপার্টির ওপর অনেকের চোখ।

এখন ঘুমান তো। অনেক রাত হয়েছে। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল যখন। মোবাইলে দেখি, আটটা বাজে। ঘরে অধ্যাপক নেই।

উঠে বারান্দায় এলাম। ঝকঝকে রোদ। দীঘির টলটলে জল। রেলিংয়ে কয়েকটি কবুতর বাকুম বাকুম করছিল। কাছে যেতেই উড়ে পালাল।

দেখি নীচে লায়লা আর অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক দাঁড়িয়ে এক বুড়ির কথা বলছে। কে এই বুড়ি? শ্যামল কে দেখলাম ওর ঘরের সামনে আর্জেটিনার জার্সি পরে চেয়ারে বসে আছে। কোলে ল্যাপটপ। পাশে তানিয়া বসে কী যেন আঁকছে। আমি চেয়ারে বসলাম।

বললাম, শান্ত আর ফারহান এখনও ওঠেনি না? শ্যামল বলল, না ওরা পিছনের জঙ্গলে গেছে। আতরের গন্ধ তাহলে ওরাও পেয়েছে। শান্ত আর ফারহান বুদ্ধিমান। বুঝলাম অভিযান শুরু হয়ে গেছে। লায়লা আর অধ্যাপক ফিরে এল।

লায়লার মুখ কালো। বললাম, কী ব্যাপার? ঐ বুড়ি কে? বুড়ির নাম জাহেরা খাতুন। ওর সঙ্গেই কাল বিকেলে কথা বলেছি। আজ গরিব মেয়েদের নিয়ে কাজীবাড়িতে মিটিং করার কথা। কেউ কাজীবাড়ি আসতে রাজি না।

বুড়ি এই কথাই বলতে এসেছিল। ধ্যাত! এই রোদের মধ্যে এখন বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হবে। কীর্তন মিঞা পরোটা, হালুয়া, বেগুনি ভাজি, ডিম পোচ নিয়ে এল। শ্যামল দেখলাম ওর অপটিমাস দিয়ে কীর্তন মিঞার ছবি তুলে নিল। শ্যামলের মুখে গভীর চিন্তার ছাপ।

নাশতার পর দেখলাম কীর্তন মিঞা চা-টাও ভালো বানায়। ভাবলাম, বুড়ো যখন এবাড়িতে থাকে তাহলে কি সে মামদো ভূত দেখেনি? শ্যামল তানিয়াকে বলল, তোমার গাড়ির চাবিটা দাও তো তানিয়া। লায়লা বলল, আজ ভর্তা ডে। ইয়াং জেনারেশন কে ভর্তা খাওয়াতে হবে। বলে লায়লা চলে গেল গ্রামে।

ওর সঙ্গে অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক । কীর্তন মিঞাকে বাজারের টাকা দিলাম। তানিয়া ওর ঘরে নিয়ে চাবি এনে দিল। শ্যামল উঠে ওর ঘরে ঢুকল। ওকে ভীষণ গম্ভীর দেখাল।

পালঙ্কের ওপর বওস গোলাপি ট্রাঙ্কটা খুলে বসল। জিনিসটার ভিতরটা টাইপ রাইটারের মত, তবে ডিসপ্লে আছে। আমি কাল রাতে তানিয়ার ব্যাপারে শ্যামল- এর মতামত জানতে চাইলাম। ও গম্ভীর কন্ঠে বলল, এখন ডিসটার্ব করিস না লিটু। ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম।

তানিয়া নদী পাড়ে যাবে বলল। দূর্গের ভিডিও করে চ্যানেল ফর্টি নাইনে জমা দিবে। আমি গেলাম ওর সঙ্গে। দুপুরে ফিরে শ্যামল কে ঘরে পেলাম না। পালঙ্কের ওপর একটা চিরকূট।

‘লিটু, আমি বাইরে আছি। কাল সকালে ফিরব। কীর্তন মিঞা জিজ্ঞেস করে, সেই ছাবে কই? বললাম, বাইরে গেছে। কাল আসবে। কীর্তন মিঞা মুখে দেখি দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল।

লায়লারা ফিরল। রোদে ফরসা মুখ লাল। খেতে বসে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। কীর্তন মিঞা লাউয়ের বিচি ও টাকি মাছের ভর্তা, কচু নারকেল ভর্তা, বেগুন টমাটো ভর্তা, পুঁটি শুঁকির ভর্তা করেছে। লায়লা খেতে খেতে বলল, গ্রামের মানুষের ব্যবহার মুগ্ধ করে।

জাহেরা খাতুন ছেলের বন্ধু সাহাপাড়ার সাধন। আমি কাজীবাড়ির মেয়ে বলে আমাদের নাড়ু আর লাড্ডু খাওয়াল। ডাব পেড়ে খাওয়াল। ঝাল ভর্তা। তানিয়ার নাক দিয়ে পানি পড়ছিল।

লায়লা বলল, আহা, তানিয়া। অত ঢং করো না। ঝাল লাগলেও খাও। ভর্তাভাজি হল বাংলার ঐতিহ্য। তোমরা খাও না বলে এসব হারিয়ে যাচ্ছে।

রাতে আর মামদো ভূতের প্রসঙ্গ তোলা হল না । অবশ্য বারবিকিউ হল। লায়লাই রাঁধল। রসুন দিয়ে ভুনা রুই মাছের পেটি, আস্ত রসুনে কই মাছের দোপেয়াঁজা, পাঙ্গাস মাছের ডিম ভুনা, লাউ দিয়ে মুগডাল, রসুনের আচার এবং খিরসা। খাওয়ার পর ঠিক হল- আজ রাতে মামদো ভূত দেখার জন্য আমরা ছাদে থাকব।

লায়লা আর অধ্যাপক এসব ‘সিলি কাজে’ থাকতে রাজি হলেন না। রাত একটার মতন বাজে। ছাদে পূর্ণিমার অথই ঢল। আমি, তানিয়া, শান্ত ও ফারহান নাড়িকেল গাছের ছায়ায় মিশে ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি। বেশিক্ষণ অবশ্য অপেক্ষা করতে হল না।

শিশুগাছের পাশ দিয়ে কী একটা বেঁটে মতন থলথলে বিদঘুটে জীব বেড়িয়ে এল। মাথায় শিং। মিশমিশে কালো শরীর। পরনে লেংটি। এই জীবটার ছবিই তানিয়া আজ সকালে আঁকছিল।

তানিয়া ফিসফিস করে বলল, দেখেছ, তখন বললাম না। শান্ত তানিয়ার মুখ চাপা দিল। তার কারণ দীঘির দিক থেকে আরেকটি শিংঅলা মামদো ভূত বেরিয়ে এল। ওটা দেখেই প্রথমটি উলটে মাটিতে পড়ে গেল। কি ব্যাপার? আমরা দৌড়ে নিচে নেমে এলাম।

নীচে নেমে তানিয়া চেঁচিয়ে উঠল- আরেকটা কই? যেটি পরে এল। নেই তো। মিলিয়ে গেছে। আমাদের হইচই শুনে লায়লা আর অধ্যাপক কাজী রফিকুল হক নীচে এল । আমি অচৈতন্য মামদো ভূতের মুখোশ ধরে দিলাম টান।

লায়লা বলল, আরে ! এতো সাহাপাড়ার সাধন! জাহেরা খাতুনের ছেলের বন্ধু । আমি কাজীবাড়ির মেয়ে বলে যে আমাদের নাড়ু– লাড্ডু খাওয়াল। কাজী রফিকুল হক বললেন, ঘটনা কি? ঘটনা হল জমিদার কৃষ্ণধন রায়ের গুপ্তধন। পিছনে শ্যামল কন্ঠস্বর। চমকে ফিতে তাকাই।

শ্যামল। পরনে কালো টিশার্ট আর কালো গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট। হাতে সেই গোলাপি রঙের টিনের ট্রাঙ্ক। শ্যামল বলল-এই সাধনই দিন কয়েক আগে নরসিংদীতে আমার আর লিটুর বন্ধু অধ্যাপক মনোরঞ্জন রায়ের বাড়ি ডাকাতি করেছে। আমি গতকাল নরসিংদি গিয়ে মনোরঞ্জন-এর সঙ্গে কথা বলে সব জানতে পারলাম।

জমিদার কৃষ্ণধন রায় মুন্সিগঞ্জ থেকে কয়েক ঘর সাহা পরিবারকে এই গ্রামে নিয়ে এসেছিলেন। জমিদার কৃষ্ণধন রায়ের ছিল পাগলটে স্বভাব। সোনার অলঙ্কার গড়িয়ে দীঘি খনন করিয়ে তার নীচে পুঁতে রেখেছেন। এমন একটা মিথ সাহাপাড়ায় আজও প্রচলিত। সাধন মিথটা বিশ্বাস করত।

আমাদের বন্ধু মনোরঞ্জন রায় জমিদার কৃষ্ণধন রায়ের বংশের। সাধন বিশ্বাস করত মনোরঞ্জন রায়ের কাছে গুপ্তধনের একটা নকশা আছে। নকশার জন্যই ডাকাতি করে সে। আর এ দিকে, মামদো ভূতের ভয় দেখিয়ে সবাইকে কাজীবাড়ি থেকে দূরে রাখে। আমি বললাম, ও।

এখন সব বুঝলাম। তা দ্বিতীয় মামদো ভূতট কি তুই বানালি? হুমম। কি করে? তোর ওই গোলাপি টিনের ট্রাঙ্ক- মানে অ্যান্টি মেটার জেনারেটর ডিভাইস দিয়ে? হুমম। এএমজিডি দিয়ে। দ্বিতীয়টা ছিল সাধনের এন্টি ম্যাটার।

ওটা না দেখলে সাধন অজ্ঞান হত না। মানে সে মামদো ভূত সেজে এসে মামদো ভূত দেখেই চিত। সবাই হেসে ওঠে। ফারহান বলল, ওহ্, স্যার। তাহলে সত্যি কৃষ্ণধন রায়ের গুপ্তধন পাওয়া যাবে না? শ্যামল বলল,না ।

কেন? যা মনে হয়, ওসব আগেই স্থানীয় প্রভাবশালীরা বের করে নিয়ে গেছে। মনে রেখ, গুপ্তধনের নকশা কখনও এক কপি থাকে না। বলে হাতঘড়ি দেখল শ্যামল। বিরক্ত হয়ে বলল, কী ব্যাপার এখনও পুলিশ আসছে না কেন? ওদের কখন ফোন করেছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.