আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কত লক্ষ মসজিদ হলে তবে তোমার নামাজ পড়ার জায়গা হবে?

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!! মসজিদ নিয়ে এটা আমার তৃতীয় লেখা। যে পরিবর্তন বা জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আগের পোস্টগুলো লেখা হয়েছিল তার কিছুই হয়নি। লেখাগুলো তেমন পঠিতও হয়নি। তারপরেও এদেশের সামাজিক মূল্যবোধ বিবেচনায় মানুষের এমন আচরণ আমাকে হতাশ করেনি। বাড়িয়ে বলছিনা, আমি কখনই হতাশ হইনা।

কিন্তু আজ তীব্র একটি হতাশা এবং দুঃখবোধ নিয়ে এ লেখাটি লিখছি। সাধারণ মানুষের আবহমান আচরণ এবং এর বহিঃপ্রকাশ আমাকে হতাশ করেনা। কিন্তু মানুষের মুল্যবোধ গড়া যাদের কাজ রাষ্ট্র বা সমাজের সেই অংশটি যখন বাস্তব সত্যকে এড়িয়ে যান, তা প্রকাশে ভয় পান, তখন হতাশ না হয়ে আর কিইবা করার আছে। আমাদের দেশের নিকট অতীতে নির্মাণ করা মসজিদগুলোর জন্ম ইতিহাস জানার জন্য কোন বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। গত দু’দশকে দেশের সর্বত্র চলছে মসজিদ নির্মাণের প্রতিযোগিতা।

মাঝারী আকারের একটি গ্রামে আট-দশটি পর্যন্ত মসজিদ দেখা যায়। একেবারে পাশপাশি অবস্থিত মসজিদের সংখ্যাও বিরল নয়। রাস্তার এপারে একটি মসজিদ অপরপারে একটি মসজিদ অহরহ দেখা যায়। এই মসজিদগুলোর বেশিরভাগই নির্মিত সরকারি খাস অথবা বিরোধপূর্ণ ভূমিতে। নির্মাণকাজের টাকা সংগ্রহ করা হয় বা হয়েছে রাজপথে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে।

অথচ এতসব প্রচেষ্টার মাধ্যমে নির্মিত মসজিদগুলোর সামাজিক বা ধর্মীয় প্রয়োজন নিয়ে সবসময়েই প্রশ্ন থেকে যায়। শুক্রবার জুমা’র নামাজ ব্যতিত এসব মসজিদে এক কাতারেরও বেশি মুসল্লী হয়না। বেশিরভাগ সময়ই এগুলো খালি পড়ে থাকে। গত পরশু এমনি একটি অতি প্রয়োজনীয় (???) মসজিদ নির্মাণকে কেন্দ্র করে জামায়াতের ইন্ধনে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলা পল্লীতে শনিবার হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, মারপিট, লুটপাট, বাসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, শ্লীলতাহানীর ও ব্যাপক সহিংস্র ঘটনা ঘটেছে। দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার রিপোর্টমতে হামলায় আক্রান্তরা ঘটনাটিকে একাত্তরের হানাদার বাহিনীর হামলার চেয়েও বর্বর ও নির্মম বলে উল্লেখ করেছেন।

রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয় ১৪৪ ধারা জারি ও প্রায় ২ শতাধিক পুলিশ, ২ প্লাটুন বিজিবি ও ২ গাড়ি র্যা ব সদস্য মোতায়েন করার পরও শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কয়েক দফায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বসতবাড়ির ওপর হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর, মারপিট, লুটপাট, শ্লীলতাহানী ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো হয়। এসব ঘটনায় ১৬ জন আহত হয়েছেন। গ্রেফতার করা হয়েছে ৮ জনকে। হামলার শিকার লোকজনদের অভিযোগ জেলা জামায়াতের সাবেক আমির ও চিরিরবন্দর উপজেলা চেয়ারম্যানের উস্কানিমূলক বক্তব্যের পরই তাদের ও তাদের বসতবাড়ির ওপর হামলা হয়েছে। দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ জামাল উদ্দীন আহমেদ এ বিষয়ে জনকন্ঠকে জানান, চিরিরবন্দর উপজেলার ৬ নং অমরপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের বলাইবাজার এলাকায় একটি অস্থায়ী মসজিদঘর ছিল।

ওই মসজিদের জমির মালিক চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন কলেজের প্রফেসর হামিদা খাতুন তাঁর নিজ অর্থায়নে তা পাকাকরণের জন্য উদ্যোগ নেন। গত সপ্তাহে মসজিদ ঘরের স্থানে পাকা নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর করা হয়। কিন্তু মসজিদঘর থেকে ২শ’ গজ দূরে অনেক আগে থেকে একটি কালী মন্দির রয়েছে। ওই এলাকায় মুসলমানের চেয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতি অনেক বেশি। এ কারণেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মসজিদ ঘরটি ৫শ’ গজ দূরে নির্মাণ করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ১ সপ্তাহ থেকে ঘটনাস্থলে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। শুক্রবার এই মসজিদঘর নির্মাণকে কেন্দ্র করে চিরিরবন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান এবং জেলা জামায়াতের সাবেক আমির আফতাব উদ্দীন মোল্লা উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি সৃষ্টি করেন। জনকন্ঠের সংবাদটি বিশ্লেষণ করলে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় এলাকাটি একটি হিন্দু প্রধান এলাকা। যে স্থানে মসজিদটি নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল তার পাশেই একটি কালি মন্দির অবস্থিত। হিন্দু সম্প্রদায় যদি ঐ স্থানে মসজিদ নির্মাণ না করে আরেকটু দুরে তা নির্মাণের প্রস্তাব দিয়ে থাকে তবে তা অন্যায় বা অযৌক্তিক নয়।

কাছাকাছি বিপরীত দুটোর ধর্মের উপাসনালয় থাকলে ভবিষ্যতে ধর্মীয় সংহতি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ পুজার সময়েই ঢাক-ঢোলের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নামাজ পড়ার সময়ে ঢোলের বাজনার কারণে নামাজের ব্যাঘাত হচ্ছে এমন ছুতায় মন্দিরে বা ঐ সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ হতে পারে এমন আশংকা করাটা অমূলক নয়। সংবাদটি বিশ্লেষণে আরেকটি বিষয় পরিস্কার যে উদ্ভুত সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা চলছিল। প্রশাসনও এ বিষয়ে অবহিত ছিল।

অবহিত ছিল বলেই ১৪৪ ধারা জারি ও প্রায় ২ শতাধিক পুলিশ, ২ প্লাটুন বিজিবি ও ২ গাড়ি র্যা ব সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। নিরাপত্তা বাহিনীর এমন উপস্থিতির পরেও কীভাবে এমন বর্বর আক্রমণ সম্ভব হয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে। এখানে ধর্মীয় অনুভুতিতে উস্কানি দিয়ে জামাত এমন ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রশাসনের ব্যর্থতাকে ঢেকে রাখার কোন সুযোগ নেই। ধর্ম ব্যবসায়ী জামাততো প্রতিক্ষণে এ সুযোগের অপেক্ষায় থাকবেই। সরকারের কাজ হচ্ছে তাদের দমন করে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

প্রশাসনিক ক্ষমতা সরকারের হাতে। এ ক্ষমতা থাকা সত্তেও সরকার যদি ক্রমাগত তার জনগণকে এমন নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হতে থাকে তবে শেষ পর্যন্ত দোষটা তার ঘাড়েই পড়বে। ক্রমাগত শব্দটার ব্যবহার এ কারণে করা হল যে, এমন ঘটনাগুলো কোন বিচ্ছিন্ন বিষয়। গত কয়েকমাস ধরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর এমন অহরহ হামলার ঘটনা ঘটছে। সরকার যদি প্রথম অবস্থায়ই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত তাহলে এ বর্বর ঘটনাগুলো আর ক্রমাগত ঘটতনা।

এসব বর্বর ঘটনাগুলো উপস্থাপনে আমাদের মিডিয়ার ব্যর্থতাও লক্ষণীয়। বেশিরভাগ ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিশ্লেষণ বা প্রতিবেদন ব্যতিরেকে এটিকে মসজিদ নির্মাণ কেন্দ্র করে দু’দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষ হিসেবে প্রচার করেছে। অথচ সংঘর্ষটা ছিল পুরো একতরফা। প্রিন্টিং মিডিয়াতেও সংবাদটি তেমন গুরুত্ব পায়নি। সর্বাধিক পঠিত বলে নিজেদের জাহির করা প্রথম আলো বা ইত্তেফাকে এ নিউজটি কোন গুরুত্ব পায়নি।

জনকন্ঠ, সংবাদ পত্রিকায় সংবাদটি গুরুত্ব সহকারে স্থান পেলেও সাধারণ পাঠকদের কাছে এই পত্রিকাগুলোর প্রচার এখন খুবই কম। অনলাইন মিডিয়া বিডি নিউজে সংবাদটি স্থান পেলেও এর প্রচার ইন্টারেনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর পূর্বেও ঠিক এমনভাবে হাটহাজারী বা সাতক্ষীরাতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবরগুলো আমাদের মিডিয়া সযতনে এড়িয়ে গিয়েছিল। আমাদের মিডিয়ার এ ধরণের আচরণ খুবই রহস্যময়। সুদুর ফিলিস্তিন বা প্রতিবেশি কোন দেশে সাম্প্রদায়িক/জাতিগত/সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটলে আমাদের ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্টিং মিডিয়াতে প্রতিবেদন/বিশ্লেষণের হুলস্থুল পড়ে যায়।

টকশোগুলোতে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়। সংবাদপত্রগুলো দিনের পর দিন সম্পাদকীয়/উপ-সম্পাদকীয় লেখা হয়। ফেসবুক/ব্লগে মায়াকান্নার রোল পড়ে যায়। সরকার/বিরোধীদলের শীর্ষ নেতারা উষ্মা প্রকাশ করে বিবৃতি দেন। অথচ নিজের দেশে, নিজের নাগরিকদের উপর এমন জঘন্য আচরণের খবর আমাদের মিডিয়া, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সযতনে এড়িয়ে চলছেন।

তাদের আচরণে মনে হয় তারা এটাই প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন যে, দেশে সম্প্রীতির নহর বয়ে যাচ্ছে। মিডিয়া কি কারণে এমনটা করছে? সরকারের প্রচ্ছন্ন ইংগিতে? নাকি বহিঃবিশ্বের কাছে দেশের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হবে এই ভয়ে? যে কারণেই হোক, মিডিয়ার এ আচরণ কোন অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। মিডিয়ার কাজ হচ্ছে সত্য প্রচার করে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা। কিন্তু সত্য হচ্ছে এই যে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে আমাদের মিডিয়া সত্যপ্রচারের ধারেকাছেও নেই। খবরগুলো তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই সযতনে এড়িয়ে চলছেন।

স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মিডিয়ার এ আচরণ সত্যি লজ্জার। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।