আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ছেলেদের লেখক হতে আলাদা কোনো পরিবেশ লাগেনি: আয়েশা ফয়েজ (হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীবের মা )

কবি হতে চেয়েছিলাম... আমার ছেলেদের লেখক হতে আলাদা কোনো পরিবেশ লাগেনি; একান্ত সাক্ষাৎকারে আয়েশা ফয়েজ for details: Click This Link ঢাকা, শুক্রবার ৩ আগষ্ট ২০১২, ১৯ শ্রাবণ ১৪১৯, ১৪ রমজান ১৪৩৩ //শিলালিপি //kalerkantho একান্ত সাক্ষাৎকারে আয়েশা ফয়েজআমার ছেলেদের লেখক হতে আলাদা কোনো পরিবেশ লাগেনি দেশের শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতিজগতের তিন নক্ষত্র হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব। তিন ছেলে বিখ্যাত হওয়ার আগে মা আয়েশা ফয়েজকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কেননা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েছে এই শহীদ পরিবার। পুলিশ অফিসার স্বামী ফয়জুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর আয়েশা ফয়েজের জীবনসংগ্রামের কথা, তিন ছেলের লেখক হয়ে ওঠার খণ্ডস্মৃতি এবং আত্মজীবনী লেখার পটভূমি উঠে এসেছে একান্ত সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তায়েব মিল্লাত হোসেন [২০০৮ সালের কথা।

তখনো গণমাধ্যমে আমাদের বন্ধুমহলের অবস্থান তেমন শক্ত হয়নি। আবার পেশার চাপে বৈষয়িক জ্ঞানও পেকে ওঠেনি। কর্মস্থলে পেশাগত দায়িত্বের বাইরে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে এটা-ওটা করার চেষ্টা লেগেই ছিল। সেই সূত্রে 'ঢাকা ত্রৈমাসিক' নামে একটা পত্রিকা বের করার প্রস্তুতি চলছে। প্রথম সংখ্যাটা হবে ঢাকা নগরের বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের মানুষের স্মৃতি নিয়ে 'ঢাকার স্মৃতি সংখ্যা'।

দেশের শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি জগতের তিন নক্ষত্র হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীবের মা আয়েশা ফয়েজের ঢাকার স্মৃতিও রেখেছিলাম এই সূচিতে। এ রত্নগর্ভার স্মৃতি সংগ্রহের দায়িত্ব বর্তায় আমার কাঁধে। আমার ব্যক্তিগত আগ্রহও কম ছিল না। কারণ ওই বছর একুশে বইমেলায় আয়েশা ফয়েজের আত্মজীবনী 'জীবন যে রকম' বের হয়। যার জন্য একটি পত্রিকার হয়ে এ আত্মজীবনী রচনার পটভূমি জানতে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারও নিতে হয় আমাকে।

তাই দুই ঘরানার বিষয় নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে পল্লবীর ২৪/৪ নম্বর বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। মনে পড়ে, তখনকার দোতলা বাড়ির সামনে একচিলতে খালি জায়গা। এখানে বসেই শীতের সকালে রোদের ওম নিচ্ছিলেন আয়েশা ফয়েজ। তাঁর পাশে আমার বসার ব্যবস্থা করলেন শাহীন ভাই (আহসান হাবীব)। দুপুর-অব্দি চলল আলাপচারিতার মতো করে আমাদের সাক্ষাৎকার।

যার প্রকাশ-অপ্রকাশ সবটুকুই আমার একান্ত সংগ্রহে ছিল। বন্ধুপ্রতিম নওশাদ জামিল আর অনেক দিনের চেনা মাসুদ ভাইয়ের (মাসুদ হাসান, শিলালিপি সম্পাদক) সাদর আহ্বানে এবার পুরোটাই পাঠকের দরবারে পেশ করা হলো। ] তায়েব মিল্লাত হোসেন : ১৯৭১ সালে আপনার স্বামী ফয়জুর রহমান আহমেদ পিরোজপুর মহকুমার সাব-ডিভিশনাল অফিসার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি হিসেবে পুলিশের অস্ত্রভাণ্ডার থেকে ২০০ রাইফেল স্থানীয় জনগণকে তিনি দিয়ে দেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে হত্যা করে ৫ মে।

এমন একটা সময়ে ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে আপনার অবস্থা কী? আয়েশা ফয়েজ : যুদ্ধের সময় জীবনের ওপর দিয়া ঝড়-তুফান গেছে। পিরোজপুরে মিলিটারির হাত থেকে বাঁচতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে পালিয়ে থেকেছি। শেষে আব্বা আমাদের মোহনগঞ্জে নিয়া এলেন। স্বাধীনতার পরে প্রথমে পিরোজপুরে গেলাম কাজলের (হুমায়ূন আহমেদ) বাবার কবর দেখতে। কবরটা ছিল রাধানগর নদীর পারে।

ইকবাল (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) তার বাবার কবর খুঁড়ে ডেডবডি বের করে। ডেডবডি পিরোজপুরে আনা হয়। সেখানে জানাজার পর মাটি দেওয়া হয়। তায়েব মিল্লাত হোসেন : আপনি নাকি মামলা করেছিলেন...। আয়েশা ফয়েজ : তখন পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে প্রমাণসহ ১২টা কেস হইছিল।

একটা ছিল আমার। কাজলের বাবার হত্যাকারী কর্নেল আতিক রশীদ ও মেজর এজাজের বিরুদ্ধে কেস করছিলাম। তারা দাঁড়াইয়া থাইকা আমাদের বাড়িঘর লুট করাইছে। তারাই কাজলের বাবারে গুলি কইরা মারছে। কিন্তু কিছুই হয়নি।

সরকার সবারে ছেড়ে দিল। সব সরকারের কাছে আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে যাব। তায়েব মিল্লাত হোসেন : সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় আসেন কবে? কোথায় উঠেছিলেন? আয়েশা ফয়েজ : ১৯৭২ সালে প্রথম ঢাকায় আসি। সে সময় সন্তানদের নিয়ে অনেকটা উদ্বাস্তু-জীবন গেছে। পিরোজপুরের ঘরবাড়ি আগেই লুট করছিল।

আমার টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি কিছু ছিল না, ছিল বই। বইগুলো আলমারি খুলে নিয়ে গেছে, যার যা খুশি। স্বাধীনতার পরে শহীদ পরিবার হিসেবে মোহাম্মদপুরে বাড়ি দিল সরকার। তিন দিন পর সেই বাড়িতে রক্ষীবাহিনী এসে হাজির। আমার মতো মানুষরে উচ্ছেদ করতে ট্রাকভর্তি অস্ত্রশস্ত্র আনছে! সুবেদার মেজর হাফিজ আমাদের বাসার পর্দাটর্দা ছিঁড়া ফেলল।

অশালীনভাবে আমাদের উচ্ছেদ করল। এ সময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়াইল আহমদ ছফা। রক্ষীবাহিনীর অন্যায়ের প্রতিবাদে কেরোসিন ঢাইলা নিজের গায়ে আগুন ধরাইয়া দেওয়ার হুমকি দিল সে। পাশের বাসাতেই থাকতেন ডা. মনোয়ার হোসেন। রাতে তাঁর বাড়িতে রইলাম।

পরের দিন একটা বাসা খুঁজে সেই ভাড়া বাসায় উঠে গেলাম। আহমদ ছফা সরকারি বাড়ি পাওয়ার জন্য তখনো চেষ্টা করছিল। তার উদ্যোগেই কাজ হলো। কয়েক দিন পর মনোয়ার হোসেন আমার বাসায় এলেন। বললেন, 'আমি আপনাকে নিতে এসেছি।

রক্ষীবাহিনীর হেড নুরুজ্জামান আপনাকে সালাম দিছেন। ' আমি যেতে চাইলাম না। ডাক্তার সাহেব আমাকে বোঝালেন, 'এখন মান-অভিমানের সময় নয়। আমারও বাবা মারা গেছে অল্প বয়সে। কত ঝামেলা গেছে আমার ওপর দিয়া।

বাচ্চাকাচ্চাদের দিকে চাইয়া আপনি মাথা ঠাণ্ডা রাখেন। ' রক্ষীবাহিনীর প্রধান ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি ভদ্রভাবে বলাতে ওই বাসারই ওপরতলায় কিছুদিন রইলাম। এরপর আবার ওপরতলা নিয়া লাগল। এ আসে, সে আসে বাড়ির দাবি নিয়া।

নানাভাবে বেইজ্জত করছে দেখে সরকারি বাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাবর রোডেই বাসা ভাড়া নিলাম। এর পরও অনেকে সরকারি বাড়ির চেষ্টা করতে লাগল। সরকারি বাড়ির শখ তত দিনে আমার মিটে গেছে। তাই আমি তাদের মানা করি। তারা বিরক্ত হয়ে বলে, 'সরকার শহীদ পরিবারের সম্মানে বাড়ি দিছে।

আপনি নেবেন না কেন?' তারা আমার সইটই জোর করে নিয়ে যায়। ওই সময়কার আইজি বলেছিলেন, 'আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন, সরকার থেকে আপনাকে বাড়ি দেওয়া হবে। ' সরকারি কোনো বাড়ি আমাদের জন্য রেডি হইলেই অন্য কোনো শহীদ পরিবার আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করত, আমি তাদের দিয়ে দিতাম। আমার ছেলেরাও বলত, অনেকেই তো সরকারি বাড়ি পায়নি। সেসব শহীদ পরিবার সরকারি বাড়ি ছাড়া টিকে থাকতে পারলে আমরা পারব না কেন! ১৯৮৮ সালে সরকার পল্লবীর এই দোতলা বাড়িটা দিছে।

অ্যালটমেন্ট আছে, কিন্তু পুরোপুরি বুঝাইয়া দেয়নি। আমার ছেলেরা কারও কাছে সমস্যার কথা কোনো দিন বলবে না। এইডা নিয়া আমিই ঝুইলা আছি (এখন সম্ভবত বাড়িটা পুরোপুরি বুঝে পেয়েছে তারা, তাই দোতলা বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি করা হয়েছে)। তায়েব মিল্লাত হোসেন : ঢাকায় যখন এলেন, তখন আপনার পরিবারে রোজগারের কেউ নেউ, তখন সংসার চলত কী করে? আয়েশা ফয়েজ : ঢাকায় আমার সব ভয়ংকর ভয়ংকর স্মৃতি। এখনো বসে বসে ভাবি, কিভাবে তখন সময় গেছে।

আমার বাবা এবং তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী আমার ছোট ভাই নজরুল ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের একটি দলের হাতে মারা যান। পাকিস্তানি মিলিটারিরা বাবাকে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হতে বাধ্য করেছিল। সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল, তারা গা-ঢাকা দিল। বাবা গা-ঢাকা দিলেন না। তিনি তাদের কোনো সহযোগিতা করেননি, বরং অসংখ্য মানুষকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন, অনেককে মুক্তিযুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেছেন; তাঁদের কেউ কেউ মুক্তিবাহিনীতে যোগও দিয়েছেন।

তিনি কেন গা-ঢাকা দেবেন? আমি বাবাকে কাছ থেকে দেখেছি। তাই জানি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য তাঁর মনে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমার বাবা, ভাই মারা গেছেন, সব অন্ধকার। ঢাকায় এসে প্রথমে দেখা করেছিলাম পুলিশের আইজি খালেক সাহেবের সঙ্গে। তিনি বললেন, 'আপনার স্বামী ভালো মানুষ ছিলেন।

জানি, উনি ১০ টাকাও আপনাদের জন্য রেখে যাননি। আপনি চিন্তা করবেন না; পেনশন, গ্রুপ ইনস্যুরেন্সের টাকা যেন তাড়াতাড়ি পেয়ে যান তার ব্যবস্থা করব। ' তখনই দুই হাজার টাকার একটা চেক দেওয়া হলো। পেনশনের টাকা তোলার জন্য কাগজপত্র নিয়ে আবার গেলাম। এবার কাজলের আব্বার পরিচিত একজন এআইজি তাঁর অধস্তন অফিসারকে ডেকে আমার সব বুঝিয়ে দিলেন।

পরে সেই অধস্তন অফিসারের কাছে গিয়েছি, তিনি কাগজপত্রে চোখ বুলানোর আগেই রাগে ফেটে পড়লেন। বললেন, 'আপনার বেশি ক্ষমতা হয়েছে? ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবেন? ভাবেন ওপরওয়ালারা বললেই কাজ হবে? মনে রাখবেন, টাকা এত সহজে পাওয়া যায় না। ' একটা ফাইল হাতে তুলে বললেন, 'এই দেখেন, পাঁচ বছর আগে মারা গেছে, এখনো টাকাপয়সা পায় নাই। টাকাপয়সা পাওয়া এত সোজা না। টাকা যদি চান তাহলে এখানে এসে কান্নাকাটি করবেন, খরচাপাতি করবেন।

বড় সাহেবদের কাছে গিয়ে কোনো লাভ নেই। ' পেনশনের টাকা তোলার জন্য ঘোরাঘুরি শুরু হলো। আমার সঙ্গে থাকে ইকবাল, না হয় ছোট ভাই রুহুল। কাজলকে নেওয়া যায় না, এসব বৈষয়িক দায়িত্ব থেকে কেমন করে যেন পিছলে বের হয়ে যায়। এক অফিস থেকে আরেক অফিস, এক অফিসার থেকে আরেক অফিসার।

এভাবে ঘুরে ঘুরে কত রকমের মানুষ যে দেখলাম। হুমায়ূনের নাম নিয়াও ঝামেলা হইল। ওর বাবা প্রথমে নাম রাখছিলেন শামসুর রহমান। সেই নামটাই ছিল ওর বাবার অফিসের কাগজপত্রে। কিন্তু পরে আবার নাম রাখে হুমায়ূন আহমেদ।

এসব ঝামেলা শেষে একসময় পেনশন পাইলাম। মাসে ১৪২ টাকা। ২০০ টাকা দিত আরেকটা কী যেন, এই ছিল আয়। ঢাকায় মানুষের অনেক খারাপ ব্যবহার পেয়েছি। টাকাপয়সার জন্য যার কাছে গেছি, সে-ই খারাপ ব্যবহার করছে।

কাজলের বাবার পেনশনের দুই হাজার টাকা তুলতে গেলে ৫০০ টাকা ঘুষ দিতে হতো। তবে প্রতিবেশী ডা. মনোয়ার হোসেন ওই সময়ে আমার অনেক উপকার করছেন। তায়েব মিল্লাত হোসেন : পেনশনের বাইরে আর কোনো আয় ছিল না? আপনি নিজে কোনো কাজ করতেন? আয়েশা ফয়েজ : আমি সেলাই করতাম। প্রচুর সেলাই করতাম। একটা সমিতি থেকে ১০০ থেকে ১২০টি কম্বল দিত।

সেগুলো কেটে বাচ্চাদের শীতের পোশাক বানাইতাম। দিনে নানা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতাম, রাতে সেলাই করতাম। সেলাইকাজ করে যখন যা পেতাম সংসারে খরচ করতাম। ইকবাল টিউশনি করত, টিভিতে প্রোগ্রাম করত, কিভাবে টাকাপয়সা ম্যানেজ করা যায় সেই চেষ্টা করত। ইকবাল যখন পাস করে আমেরিকা গেল, তখন আমাদের একটু দাঁড়ানোর জায়গা হয়েছে।

পরের বছর হুমায়ূন গেল। তারা টাকা দিতে আরম্ভ করল। ইকবাল তো ১৮ বছর দেশের বাইরে ছিল। হুমায়ূন ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করেছে। তখন টাকাপয়সার কষ্ট কমে গেছে।

মনের কষ্ট ছাড়া আর কোনো কষ্ট ছিল না। ওই সময় হুমায়ূনের বিয়ে বহুদিন পরে আমাদের আনন্দ এনে দিয়েছিল। দুঃখ-কষ্ট ভুলে একটা নতুন জীবন শুরু করেছিলাম। আমার ছেলেমেয়েরা নিজেদের চেষ্টায় নিজেরা দাঁড়াইছে। ওরা কোনো দিন প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়েনি।

ওরা স্বার্থপর না। হুমায়ূন তো ভাইবোনের জন্য যতটুকু ওর সামর্থ্য ছিল করছে। বাবা না থাকার কষ্টটা ভোলানোর জন্য ভাইবোনকে ঘোরানো-বেড়ানো সবই করছে। তায়েব মিল্লাত হোসেন : একাত্তর-পরবর্তী সময়ে আপনার সন্তানদের জীবনচিত্র কেমন ছিল? এ নিয়ে একটু বলুন। আয়েশা ফয়েজ : তখন দেশের মধ্যে খুব অরাজকতা।

পাড়ার বেশির ভাগ ছেলেপেলেই উচ্ছৃঙ্খল। যখন-তখন বাসায় ঢুকে পড়ে। আমার চিন্তা, দলবলের সঙ্গে মিশে ছেলেরা না জানি কী হয়! তবে ওরা পড়াশোনা করত। আমি বলতাম, তোমরা সংসারের চিন্তা কোরো না, পড়াশোনা করো। সংসার আমি দেখব।

আমি ধর্মভীরু মানুষ। ওদের জন্য খতম-টতম পড়তাম, দোয়াটোয়া করতাম। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। কাজলের আব্বা বেঁচে থাকলেও ওরা এর বেশি আর কী করত। তাঁরও শখ ছিল ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে।

আমাদের যুগে তো পড়াশোনার গুরুত্ব অত ছিল না, আমি খুব বেশি পড়াশোনা করিনি। তিনি আমাকেও পড়াশোনা করতে বলতেন। তিনি বলতেন, 'বাচ্চারা যখন ইংরেজিতে কথা বলবে, তখন তো তোমাকে চুপ করে থাকতে হবে। ' এসব বিষয় নিয়ে মজা করতেন। তিনি পুলিশ অফিসার হলেও খুব রসিক ছিলেন।

উনি জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করতেন। আমরা, বিশেষ করে আমি বিশ্বাস করতাম না। পরে দেখলাম, যা যা বলছেন তার অনেক কিছু হইছে। হুমায়ূন সম্পর্কে বলতেন, 'অনেক বিখ্যাত হবে তোমার ছেলে! জান, রানি এলিজাবেথের ছেলে আর তোমার ছেলের জন্ম একই দিনে, একই লগ্নে। ' আমি বলতাম, কই রানি এলিজাবেথ আর কই আমি।

তিনি বলতেন, 'রানির ছেলে বিখ্যাত হবে তার বাবা-মায়ের নামে। আমার ছেলে হবে নিজের যোগ্যতায়। ' হুমায়ূনের যেকোনো দুষ্টুমির মধ্যেও বিশেষ কারণ খুঁজে পেতেন ওর বাবা। হুমায়ূন সারা দিন কই কই ঘুরত। আমি কিছু বললে ওর বাবা বলতেন, 'প্রমথনাথ বিশি এরকম ছিলেন, কাজলের ভেতরে অন্যরকম কিছু আছে।

' 'নন্দিত নরকে'র পাণ্ডুলিপি ওর আব্বাও পড়েছিলেন। দেখে বলেছেন, 'তোর হবে। ' তখন হুমায়ূন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইছে। আজকে ওরা আমার মতো সাধারণ মানুষের কাছে না আইসা ওর আব্বার কাছে আসলে কত কিছু বলতেন! কত খুশি হইতেন! তায়েব মিল্লাত হোসেন : আপনাদের বাসায় পড়াশোনা ও সাহিত্যচর্চার পরিবেশ কী আগে থেকেই ছিল? আয়েশা ফয়েজ : মুক্তিযুদ্ধের সময় শাহীন (আহসান হাবীব) তো বাচ্চা ছিল। যুদ্ধের পরে কয়েক বছরের মধ্যে সরকারি বা ভাড়া বাড়ি কয়েকবার চেঞ্জ করতে হইছে।

মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, বেইলি রোড, দিলু রোড_কত জায়গায় থাকছি! সাতটা স্কুল চেঞ্জ করে শাহীন ম্যাট্রিক পাস করছে। নিজে খুঁজে খুঁজে স্কুল বের করে ভর্তি হইত। শাহীন অনেক কষ্ট করছে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে রেশন তুলেছে, বাজার করেছে_এর মধ্যে আবার পড়াশোনা করে মানুষ হইছে! আমার সব ছেলেমেয়েই ছবি আঁকতে পারত। সবাই বই পড়ত।

ইকবালের প্রিয় লেখক ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। একদিন বাসায় এসে জানাল, মানিকসমগ্র বের হইছে, পুরো সেট ৩০০ টাকা। ৩০০ টাকা তখন অনেক টাকা। কিনতে পারবে না বলে সে হাতাইয়া আসছে। আমি ইকবালকে টাকা দিলাম।

বাসায় মানিকসমগ্র আসার পর অন্যরকম এক পরিবেশ। আমি, আমার ছেলেমেয়েরা যে যেখানে যে অবস্থায় আছে, সবাই মানিকের বই পড়ছি। আমার ছেলেদের লেখক হওয়ার জন্য আলাদা কোনো পরিবেশ লাগেনি। বাচ্চারা আশপাশে খেলাধুলা করলেও তাদের লেখালেখিতে কোনো সমস্যা হয় না। তায়েব মিল্লাত হোসেন : এখনকার ঢাকার মানুষের জীবন আর আগের ঢাকার জীবনের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান? আয়েশা ফয়েজ : এখন দেখি মায়েরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়া ব্যস্ত।

আমাদের সময় এ রকম ছিল না। আমার ছেলেমেয়েদের কোনো প্রাইভেট টিউটর ছিল না। তারা প্রাইভেট টিউটর ছাড়া এমনেই ভালো রেজাল্ট করছে। মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, আমি ঘুমাইছি আর ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার ছেলেমেয়েরা সব মানুষ হইয়া গেছে। এখনকার মায়েদের মধ্যে দেখি প্রাইভেট টিউটর নেওয়ার প্রতিযোগিতা।

সকালবেলা বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে দৌড়াচ্ছে। নিজেরা স্কুলে বসে থাকে। এখনকার মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে পেরেশান। তায়েব মিল্লাত হোসেন : ছেলেমেয়েরা যখন ছোট, তখন ঢাকার কোথাও বেড়াতে যেতেন না? আয়েশা ফয়েজ : তখন ঢাকায় আমাদের তেমন কোনো বেড়ানোর জায়গা ছিল না। কোনোদিন কোনো পার্কে, জাদুঘরে বেড়াতে যাইনি।

যাত্রাবাড়ীতে ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে যেতাম। আমার এক মামা ছিলেন, উনি জীবন বীমায় চাকরি করতেন। তাঁর বাসায়ও বেড়াতে যেতাম। এখন তো একই বিল্ডিংয়ের কেউ কাউকে চিনে না। আমার সঙ্গে অনেক প্রতিবেশীর পরিচয় ছিল।

আমার সঙ্গে কারও বিরোধ ছিল না। জীবনে অনেক ভালো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হইছে। তায়েব মিল্লাত হোসেন : আপনার বই 'জীবন যে রকম' নিয়ে কিছু বলুন। আত্মজীবনী হঠাৎ করেই লিখেছেন, নাকি আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল? আয়েশা ফয়েজ : ১৯৯১ সালে আমেরিকায় ইকবালের ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সারা দিন করার কিছু থাকত না।

ইকবালের মুক্তিযুদ্ধের একটা বই কম্পোজ করে কম্পিউটারে লেখা শিখে ফেললাম। তখন ইকবাল বলল, আপনার জীবনে তো অনেক ঘটনা, সেগুলো লিখে ফেলেন। হুমায়ূনের আব্বা থাকতেই গল্প লেখতাম। সেসব বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও পুলিশের পত্রিকা 'ডিটেকটিভ'-এ ছাপাইত। পটুয়াখালীতে ঘরবাড়ি লুট হওয়ার সময় সব হারিয়ে গেছে।

হুমায়ূনের আব্বার বিভিন্ন লেখার পাণ্ডুলিপিও জ্বালাইয়া দিছে। আমেরিকায় থাইকাই বইটা লিখছিলাম। পাণ্ডুলিপি বহুদিন আমার কাছেই ছিল। হঠাৎ ইকবালের মাথায় এলো, বই ছাপি। কোনো দিন ভাবি নাই বই হবে।

ছেলেরা লেখে, আমারও বই বের হলো। আমার শরম লাগে! সবাই চাপ দিচ্ছে বাকি জীবনের ঘটনা লেখার জন্য। নতুন করে লিখতে পারব বলে মনে হয় না। তখন কম্পিউটার শিখে শখে শখে লিখছি। এখন কোনো কাজ নাই, বইটই পড়ে সময় কাটে।

আগে নাতি-নাতনিদের আমিই মানুষ করছি। আমার বইটা পড়ে শাহীনের মেয়ে এষা বলতেছে, তুমি আমাদের কথা লেখ নাই। লিখব কী, তখন তো তাদের জন্মই হয় নাই। বড় মেয়ে শেফুর মেয়ে (অপলা হায়দার) ফোন করে কাঁদছে, নানার মৃত্যুর ঘটনা পড়ে তার খুব কষ্ট হইছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.