আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘এর মধ্যেও বেঁচে আছি, এটাই আশ্চর্য’

মাসের শুরুতেই ২ হাজার ৯০০ টাকা বাড়িভাড়া দেওয়ার পর হাসনা বেগমের হাতে থাকে শুধু একটি একশ টাকার নোট। সাভারের আশুলিয়ার পোশাক প্যাকেজিং কারখানা আর্টিস্টিক ডিজাইন লিমিটেডে ‘হেলপার’ হিসাবে কাজ করে সব মিলিয়ে তার আয় হয় ৩ হাজার টাকা। হাসনার স্বামী রফিকুল ইসলামও একই এলাকার ‘দ্যাটস ইট প্যাকেজিং লিমিটেড’ এ অপারেটরের কাজ করেন। তার মাসিক আয় ৩ হাজার ৮ শ’ টাকা। অন্য সহকর্মীদের মতো হাসনা-রফিক দম্পতিও মাসের শুরুতেই ১৮শ’ টাকা দিয়ে এক বস্তা চাল কিনে রাখেন, যাতে পরের ৩০টি দিন খেয়ে বাঁচার নিশ্চয়তাটুকু অন্তত থাকে।

এরপর রান্নার জন্য ৬ শ’ টাকার জ্বালানি কাঠের ব্যবস্থা করে ৮শ টাকা তাদের হাতে রাখতে হয় স্কুলগামী ছেলের জন্য। হাসনা-রফিকের বাকি দুই ছেলে মেয়ের এখনো স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। সারা মাসের কাপড়, চিকিৎসা, যাতায়াতসহ নিত্যদিনের বিভিন্ন খরচ মেটানোর জন্য শেষ পর্যন্ত পাঁচ সদস্যের এই পরিবারের হাতে থাকে মাত্র ৭শ’ টাকা। ভাতের সঙ্গে একটি তরকারি কিংবা শুধু আলুভর্তা দিয়েও যদি দৈনন্দিন খাবারের চাহিদা মেটানো হয়, তাহলেও এই টাকায় একটি পরিবারের মাসের শেষ দিন পর্যন্ত চলে না। সামান্য আলুভর্তার জন্য যে পেঁয়াজ, মরিচ, লবণ, তেল লাগে তার বাজারমূল্য যথাক্রমে ৩০, ৬০, ২৫ এবং ১৩৫ টাকা কেজি।

আর এক কেজি আলু কিনতেও ২৪ টাকা খরচ হয়। “এর মধ্যেও আমরা যে বেঁচে আছি এইটাই আশ্চর্যের”, সাত ফুট বাই সাত ফুট একটি কামরায় কাঠের চৌকিতে বসে বললেন রফিক। পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে এই ঘরেই থাকতে হয় তাকে। আশুলিয়ার বাংলাবাজার এলাকায় যে কামরাটিতে রফিক থাকেন, তা ওই সারির সবচেয়ে বড় ঘর। ছোট ঘরগুলোর আয়তন ৫ ফুট বাই ৫ ফুট।

মাত্র ১৫ শতাংশ জমির ওপর তিন সারিতে ৪২টি ঘর বানানো হয়েছে এখানে, যার চাল-বেড়া সবই টিনের। এই ছোট্ট জায়গার প্রায় দেড়শ বাসিন্দার জন্য টয়লেট রয়েছে ১২টি, প্রতিটি সারিতে পাশাপাশি ১২টি করে মাটির চুলা আছে রান্নার জন্য। আর গোসলের জন্য নির্দিষ্ট করা আছে তিনটি জায়গা। স্বল্প বেতনে এমনই দুর্দশাগ্রস্ত জীবন যাপন করছেন দেশের প্রায় ৫ হাজার পোশাক কারখানার ৩৫ লাখ শ্রমিক, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই যাদের শ্রমের ফসল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২২ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ১৮ বিলিয়ন ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে।

অবশ্য কারখানার অর্ডার বেশি থাকলে ওভারটাইম করে হাসনা-রফিক পরিবারের মাসিক আয় কখনো কখনো ১১ হাজার টাকা পর্যন্তও পৌঁছায়। “আমাদের ছেলেমেয়ের তো মাছ-মাংস খাওয়ার সুযোগ হয় না। এক কেজি ডালের দামও ১১৫ টাকা, এক ডজন ডিম ১২০ টাকা। আমরা ঈদ ছাড়া কোনো আত্মীয়-স্বজনকেও দাওয়াত দিতে পারি না,” বলছিলেন মাহমুদা। তিনি একজন সুপারভাইজারের স্ত্রী যার মাসিক আয় ১০ হাজার টাকা।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওভারটাইমসহ একজন পোশাক শ্রমিকের মাসিক আয় গড়ে ৬ হাজার টাকা। তার দাবি, মাসে ৩ হাজার টাকা আয় করে এমন কর্মীর সংখ্যা মোট শ্রমিকের ১০ শতাংশের বেশি নয়। আর এদের অধিকাংশই নতুন শ্রমিক। অবশ্য এর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন পোশাক শ্রমিকরা। রফিকের সহকর্মী ও প্রতিবেশী চামেলী বলেন, “আমাদের ঘরগুলো দেখেন, পাশাপাশি একই রকম দেখায়।

আমাদের অবস্থাও একইরকম। আপনি আমাকে দেখেই সব কারখানার শ্রমিকের অবস্থা বুঝে নিতে পারবেন। ” বাংলা বাজারে ‘ভোলা খাবার ঘর’ নামে একটি দোকান চালন জাকির। গত চার বছর ধরে মুদি দোকানের সঙ্গে এই খাবারের ব্যবসাও চালাচ্ছেন। তবে অনেক শ্রমিক বাকি শোধ না করে চলে যাওয়ায় এ পর্যন্ত তার পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন জাকির।

তার দোকানের ক্রেতাদের সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় বললেন, “এরা তো দুর্গন্ধ খুপরির মধ্যে কয়েদীর মতো থাকে, আপনি তো দেখলেনই। ” বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হলেও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের (আইটিইউসি) হিসাব অনুযায়ী, এ দেশের পোশাক শ্রমিকরাই বিশ্বে সবচেয়ে কম মজুরি পান। ইন্সটিটিউট ফর গ্লোবাল লেবার অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (আইজিএলএইচআর) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে শ্রমিকদের মাসিক মজুরি বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। বাংলাদেশে যেখানে শ্রমিকরা গড়ে প্রতি ঘণ্টায় ০.২১ ডলার আয় করেন, সেখানে ভারতে মজুরির হার ঘণ্টায় ০.৫৫ থেকে ০.৬৮ ডলার। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মালয়শিয়া ও চীনে এই হার যথাক্রমে ০.৪৬, ০.৩৭, ০.৭৩ ও ০.৯৩ ডলার।

এমনকি কলাম্বিয়া, হুন্ডুরাস ও গুয়াতেমালার মতো দেশেও শ্রমিকরা প্রতি ঘণ্টায় যথাক্রমে ১.২০ ডলার, ১.০২ ডলার এবং ১.২১ ডলার পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে এই হার যথাক্রমে ৮.২৫ থেকে ১৪ ডলার এবং ৭.৫৮ থেকে ৯.১১ ডলার। অবশ্য বিজিএমইএ সভাপতি মহিউদ্দিন বলছেন, “শ্রম যতদিন সস্তা থাকবে, ততোদিনই এ দেশে পোশাক শিল্প টিকে থাকবে। ” এ কারণেই ৩ হাজার টাকা থেকে ৯ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিদ্যমান মজুরি কাঠামোর উন্নয়নের বিষয়টি মালিকপক্ষ বা সরকারের বিবেচনায় আসছে না। মজুরি এই পর্যায়ে আনতেও ২০০৬ সাল থেকে দুই দফায় আন্দোলনে যেতে হয় শ্রমিকদের।

বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ২০০৬ সাল পর্যন্ত শ্রমিকদের মজুরি ছিল মাসে ৩০০ থেকে ৯০০ টাকা। ২০১০ সাল পর্যন্ত ছিল ১ হাজার ৬৬২ টাকা পর্যন্ত। নব্বইয়ের দশকে গার্মেন্ট খাতের মুনাফা কখনোই ২৫ শতাংশের চেয়ে কম হযনি বলে জানান তিনি। সর্বশেষ ন্যূনতম ৫ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে ১১ জুন থেকে টানা পাঁচ দিন শ্রমিক অসন্তোষ চলে আশুলিয়ায়। শ্রমিকরা বলছেন, বছর দুয়েক আগে সর্বশেষ মজুরি কাঠামোর বাস্তবায়ন শুরুর পর পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বছরে দুইবার বাড়িভাড়া বৃদ্ধি এবং এর সঙ্গে বার্ষিক ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি যোগ হয়ে তাদের জীবযাপন আরো কঠিন করে তুলেছে।

অবশ্য বিজিএমইএ, সরকার ও বিরোধী দল শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ খুঁজে পেয়েছে বারবার। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেছেন, এই মুহূর্তে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর কোনো কারণ তিনি দেখেন না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের ইন্ধন রয়েছে। আর বিরোধী দল সরাসরি আঙুল তুলেছে ভারতের দিকে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মনজুরুল আহসান খান বলেন, “স্বার্থান্বেষী মহল যেহেতু সবখানেই নিজেদের স্বার্থ খুঁজে বেড়ায়, সেহেতু ধরলাম, এই খাতে তারাই ষড়যন্ত্র করছে এবং তারা বাইরের দেশের।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ পাচ্ছে কি করে?” এই বাম নেতার মতে, “শ্রমিকদের বর্তমান দুরবস্থার জন্যই তারা (স্বার্থান্বেষী মহল) সুযোগটা পাচ্ছে। ন্যূনতম মজুরির একটি কাঠামো থাকলেও ২৫ শতাংশ কারখানায়ও তা বাস্তবায়ন হয়নি। জমে থাকা ক্ষোভের কারণেই শ্রমিকরা প্রতিবাদী হয়ে উঠছে। ” “তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনের ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু মধ্যস্ততার চেষ্টা করলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়”, বলেন মনজুরুল আহসান খান। আশুলিয়ায় শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কারখানায় ৮ ঘণ্টা কাজ করার পর অনেক শ্রমিক ইদানিং বাড়তি আয়ের জন্য রিকশা চালানো, ফল কিংবা মাছ ফেরি করার কাজ বেছে নিচ্ছেন।

আর খরচ কমাতে আরো কিছু ‘অমানবিক’ উপায় তাদের বেছে নিতে হচ্ছে, যেমন মা তার শিশুকে এবং অনেক স্বামী তার স্ত্রীকে কাজের খোঁজে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। পোশাক শ্রমিক বাবা-মায়ের অনেক শিশুরই পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই। অন্তরালের চিত্র যখন এ রকম, তখন গণমাধ্যমে সম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের ছবিতে আন্দোলনকারীদের দেখা যায় লাঠি হাতে সহিংস ভঙ্গিতে। আর সুবিধাপ্রাপ্ত গার্মেন্ট মালিকরা বিশ্বমন্দা, গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে বেতন বৃদ্ধির বিরোধিতা করেন গণমাধ্যমের সামনে।

প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাইমার্ক, টেসকো, টমি হিলফিগার, আজদা, ওয়াল মার্ট, এইচঅ্যান্ডএম, জারা, ক্যারেফোর, গ্যাপ, মেট্রো, জেসিপেনি, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, কহ’ল এবং লেভিস্ত্রসের মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের দাম না বাড়িয়েও শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিত করার বিষয়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের চাপ দিতে পারে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক কয়েকটি অধিকার সংগঠনের সুপারিশ অনুযায়ী গার্ডিয়ানের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম জীবন মান নিশ্চিত করতে ১২ হাজার ৬০০ টাকা প্রয়োজন (৯৮.৮ পাউন্ড, ১৫৪ ডলার)। এ খাতের বার্ষিক আয়ের তিন শতাংশ বেতন বাবদ খরচ করলেই এটা বাস্তবায়ন সম্ভব। তবে বিজিএমইএ সভাপতি মহিউদ্দিনের দাবি, ৩ শতাংশ মুনাফাই মালিকরা করতে পারেন না। প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন ইমরান হোসেন ও মামুনুর রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক এইখানে মুল নিউজ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।