আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাহ, আজ আমি একটুও কাঁদবো না । সমুদ্র গুপ্ত গেছে, বাবু ফরিদী গেছে- আজ গেল হুমায়ুন আহমেদ । সবাই জুলাই মাসকেই বেঁছে নিলেন । তবুও আমি কাঁদবো না । কাঁদলেই কি তাদেরকে ফিরে পাবো?

নিপুণ লেখনীর শানিত গর্জন / লিখব আজ নিপুণ কথন [ ছবিতে বাংলাদেশের প্রধান কবি প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানের পাশে দাঁড়িয়ে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করছেন সব্যসাচী লেখক ও সত্তরের দশকের কবি কবি বাবু ফরিদী । ] আমি কাঁদবো না । হ্যাঁ, এমনটিই ভেবেছিলাম আজ । সারাটা দিন কাটিয়েছি বাংলা একাডেমীতে, কাজে । রাতে ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাইদেরকে নিয়ে কার্জনে বসেছিলাম আমরা ক'জন ।

উদ্দেশ্যঃ পরিচয়পর্ব এবং ইফতার পার্টি । সেখানেও হেসে হেসে বক্তব্য দিয়েছি, সবাইকে হাসিয়েছি । অনেকটা জোড় করেই হেসেছি । হেসেছি বাবা হারানোর শোক ভুলে থাকতে । কাউকে বুঝতে দিতে চাইনি যে, আমার জীবনের সবচেয়ে শোকের দিনটি আমি এই মুহূর্তে পার করছি ।

কিন্তু হায়! তখন কে জানত যে আমার জন্য আরও একটি কষ্টের সংবাদ অপেক্ষা করছে? হুমায়ূন আহমেদ যে আমার খুব একটা প্রিয় লেখক ছিলেন- তা নয় । হিমুর জন্য সুন্দরীদের পাগল হয়ে যাওয়ার বিষয়টা আজও আজগুবি লাগে, তবু তাঁর কল্পনাশক্তির সাথে হারিয়ে যেতে আমার ভালো লাগতো । রুমে ফেরার পথে ফেসবুকে তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে খুব কষ্ট পেলাম । দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাসিক হিসেবে তাঁর চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছিনা । আমি মনে করি, তাঁর আরও কিছু দেয়ার ছিল আমাদেরকে ।

আরও কিছু সময় আমাদের পাশে থাকা উচিৎ ছিল... দেখতে দেখতে একটি দুটি করে চার-চারটি বছর চলে গেল । আজ আমার বাবার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী । ২০০৮ সালের এই দিনে আমি হারিয়েছিলাম আমার বাবাকে- যে ছিল আমার সবকিছু । বাবা চলে যাওয়ার পর আর কোন কিছু হারানোর ভয় আমার ভেতরে কাজ করেনা । সবচেয়ে দামি জিনিস হারিয়ে ফেলেছি, যা ক্ষতি হবার হয়েই তো গেছে- আর ভয় কি? সেদিন ভেবেছিলাম, আমার জীবনটা বুঝি এখানেই শেষ; আর কিছু হবার নেই ।

বাবাকে ছাড়া কোনদিন কিছু বুঝিনি । সেই বাবা যখন কোন কিছু না বলে হঠাৎ চলে গেল, আমি চোখে সবকিছু আঁধার দেখতে শুরু করলাম । একটা কথাও বাবা বলে যেতে পারেনি, কারণ মৃত্যুর সময় আমি বা মা কেউ পাশে ছিলাম না, পরে পৌঁছেছি । এমনকি বাবার মৃত্যুর কারণটাও আমাদের কাছে একরকম রহস্য । সেদিনকার কথা খুব মনে পড়ে ।

সবকিছু আমার চোখের সামনে এখনও জ্যান্ত ভাসে । কানে সেই কথাগুলো এখনও বাজে । বাবা মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়াতে পছন্দ করত । আমি তখন মেডিক্যাল ভর্তির কোচিং করতাম । কোচিং বললে ভুল হবে, একজন মেডিক্যালের ছাত্রের কাছে ব্যাচে পড়তাম ।

সেদিন তাঁর দাওয়াত ছিল আমাদের বাসায় । সকালের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ভেতরেই বাবা কোর্টের কাজ সেরে, বাজার করে এনে নিজ হাতে মুরগি, ইলিশ মাছ, ডিম রান্না করে (বাবার হাতের রান্নাও ছিল অসাধারণ) নিজেই আপ্যায়ন করলো স্যারকে । আমি জহির ভাইকে (স্যার) নিয়ে বাসায় এলাম দুপুর ১ টার দিকে । বাবা স্যারকে জিজ্ঞেস করলো আমার পড়ালেখা কেমন চলে; স্যার জানালো, "নিপুণ তো ভালো ছেলে, অনেক চেষ্টা করে । ভালোই করছে, তাছাড়া নটরডেম থেকে পড়েছে- ওকে নিয়ে তো আমরা এবার খুব আশাবাদী ।

" কথাটি শুনে বাবা খুব খুশি হলেন, একটা পাথর তাঁর বুকের ওপর থেকে সড়ে গেল যেন । তারপর বাবা ও স্যারের মাঝে আমার ছোটবেলার স্মৃতি নিয়ে অনেক কথা হল । খাওয়া শেষে আমি আর স্যার আমার রুমে এসে কিছুক্ষণ বসলাম । বাইরে তখনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি । একটু বিকেল হলে স্যার চলে যেতে উদ্যত হল ।

বাবাকে একথা জানাতেই বাবা স্যারকে চা-বিস্কুট করে এনে দিল (মা তখন চেম্বারে) ; চলে যাবার সময় বাবা স্যারের বাইসাইকেল উঁচু করে তুলে নিয়ে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিল । স্যার বিব্রত হলেন এবং বললেন, "আরেহ কি করেন! আমি আপনার ছেলের বয়সী, আর আপনি সম্মানী মানুষ, গুরুজন । আপনি কেন আমার সাইকেল টেনে কষ্ট করছেন আর আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন?" বাবর সহজ উত্তর, "আরেহ ধুর! তাতে কি হইছে? আমি ওসব কিছু মনে করিনা । আমাদের বাসার উঠোনটা একটু বেশিই পিচ্ছিল, আপনার তো অভ্যাস নেই, পিছলে ওরে যেতে পারেন । তাই..." স্যার বিদায় নিয়ে রওনা দিলেন, আমিও আমার সাইকেলে তাঁর পিছু নিলাম- উদ্দেশ্য তাঁকে কোচিং পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া ।

ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে । তখনও আকাশ থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ঝরছেই । আমার আগমনবার্তা পেয়ে বাবা নিজে এসে গেট খুলে দিল, আমি ভিতরে ঢুকলাম । মা তখন সন্ধ্যা দিচ্ছে । উঠোন থেকে আমাদের ঘরের উচ্চতা একটু বেশী, আমার সাইকেলটা ঘরে উঠাতে কষ্ট হতো ।

তাই বরাবরের মতো সেদিনও বাবাই সাইকেলটা উঁচু করে ঘরে তুলল । তারপর গেট আটকে চলে যেতে যেতে বলল, "আজ সারাদিন তোর একটুও পড়া হয়নাই । এখন আর বের হওয়ার দরকার নাই । ঘরে বসে পড় । আমি একটু বিল্টুকে (*ঐ ছেলেটা) দেখিয়ে দিয়ে আসি ।

আজ আর দেরী করবো না, তাড়াতাড়ি ফিরবো । " আমি অনেক চেষ্টা করেও কেন জানি পড়ায় মন বসাতে পারছিলাম না । ৮ টা ৩০ মিনিটের দিকে মাকে বললাম, "মা, খিদা লাগছে । খাব । " মা খেতে দিল ।

আমি খেতে খেতে সেট ম্যাক্সে স্পাইডারম্যান দেখতে লাগলাম- বিক্ষিপ্ত মনটাকে শান্ত করার চেষ্টা । রাত পৌনে দশটার দিকে বাবার মোবাইল থেকে আমারটায় ফোন এলো । ফোন রিসিভ করতেই ওপার থেকে বিল্টুর মার কণ্ঠ- "দেবু, তাড়াতাড়ি আসো! তোমার বাবা জানি কেমন করতেছে..." মাকে জানালাম । মা শুনেই গেট খুলে দৌড় দিল ঐ বাসার দিকে । আমি রেডি হয়ে সাইকেল নিয়ে বের হলাম ।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বাবা আমাকে একটা সুযোগ দেবে, আরেকটিবার হসপিটালে ভর্তি করার সুযোগ দেবে, কিছুদিন পড় আবার সুস্থ হয়ে উঠবে । কিন্তু তা আর হল না । বাবা আমাদেরকে কষ্ট দিল না একটুও, নিজেও ভুগল না । ঐ বাসার সামনে যেতেই দেখি অনেক মানুষ । মা উপর তলায় চিৎকার করে কাঁদছে ।

( প্রসঙ্গতঃ এই বাসার পিচ্চি ছেলেটি (*) বাবার কথা ছাড়া একটি কাজও করতে চাইতো না । ওর মাকে বাবা আপন বোনের চোখে দেখত, সব ধরনের সহায়তা করতো । পরোপকারে বাবা আবার খুব বেশী উৎসাহী ছিল । তাই, ওর বাবা-মায়ের অনুরোধে বাবা ওকে পড়াতে ও গাইড দিতে ওদের বাসায় মাঝে মাঝে যেত । কখনও আমাদেরকে নিয়ে, কখনও একা ।

) খুবই সংকীর্ণ কাঠের সিড়ি পেরিয়ে উপরে গিয়ে দেখি গিয়ে দেখি বাবা মেঝেতে পড়ে আছে! কেউ তাঁকে তুলছে না! পাশেই এলাকার নার্স কাকি দাঁড়িয়ে, তিনিও যেন আশা ছেড়ে দিয়েছেন! বিল্টুর মা কাকি বললেন, বাবাকে নাকি আম খেতে দিয়েছিলেন । আম খেতে গিয়েই নাকি নিচে পড়ে গিয়েছেন । আমি বাবার বগলে হাত দিয়ে দেখলাম তখনও কিছুটা গরম । মুখের এক কোনায় আর বুকের এক অংশে পড়ে গিয়ে থেঁতলে যাওয়ার মতো দাগ । আমার চিৎকারে আশেপাশের সবাই ছুঁটে এলো ।

বাবাকে নিচে নামিয়ে রিক্সায় করে পাড়ার দুই কাকা রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ পড়েই আমার ফোনে অ্যাম্বুলেন্স এলো । বাবাকে তাতে নিয়ে আমরা হসপিটালের দিকে ছুঁটলাম । কপাল এতই খারাপ, প্রথম যে হসপিটালটা পড়ে সেটায় রাত ১০ টার সময়েই একজন ডাক্তারও পেলাম না! (আজও এই হসপিটালের সামনে দিয়ে আমি যে কয়বার যাই, ঘৃণায় থুতু ফেলতে ফেলতে যাই । ) ব্রিজ পার হয়ে ওপাড়ের সদর হাসপাতালে গেলাম । আমি নেমে পাশের ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে ছুটলাম, খালি পায়ে ।

উদ্দেশ্য জহির ভাইয়ের পরিচিত কোন ভালো ডাক্তার আছে কিনা আনতে যে বাবাকে বাঁচাতে পারে । গেটে এক ভদ্রলোককে পেলাম, দেখে মনে হল তিনি ডাক্তার । আমি জানতে চাইলাম, "স্যার, আপনি কি ডাক্তার?" তিনি বললেন, "হ্যাঁ, কেন?" আমি আকুতি মিনতি করে বললাম, "স্যার, আমার বাবা সদর হাসপাতালে ভর্তি; আর ওখানেও ডাক্তার নেই । স্যার আপনি প্লিজ আমার সাথে চলেন, আমার বাবাকে বাঁচান স্যার!" জবাবে সেই মহান(!), মানবসেবক (!) ডাক্তার আমাকে জানালেন, "কি যে বলনা! এভাবেই হুট হাট করে কি যাওয়া যায় নাকি? আমার চেম্বার আছে, পি,এস আছে । তাঁর সাথে যোগাযোগ করে আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নাও ।

তারপর যেতে পারি । " রাত তখন ১০ টা । ওদিকে বাবার সময় নেই । খুব কষ্ট পেলাম ডাক্তারের কথায় । সেই থেকে ডাক্তারদের প্রতি আমার একটা ঘৃণা, তাদের পেশাদারিত্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পশুটার প্রতি ঘৃণা ।

ভগবানকে ধন্যবাদ যে তিনি আমাকে মেডিক্যালে চান্স দেন নি । হসপিটালে ফিরে দেখি কান্নার রোল পড়ে গেছে । আমাদের সাথে যারা যারা এসেছিল তারা তো কাঁদছেই, হসপিটালের নার্স, ডাক্তার, ওয়ার্ডবয়সহ সবাই কাঁদছে! এই প্রথম বুঝতে পারলাম বাবা মানুষের কতটা কাছের মানুষ ছিল, আর কত জায়গায় তাঁর কত শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু, ভক্ত ছিল! এই প্রথম বুঝতে পারলাম বাবা নেই, আমি একা! আম্বুলেস টান দিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো । আমার অনুরোধ কেউ শুনল না, আর কোন হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল না । বাবা নাকি আর নেই! পোস্টমর্টেম করা হলনা, ঐ মুহূর্তে আসলে কাটা ছেরা করার মতো মানসিক অবস্থাও ছিলনা ।

আজ খুব আফসোস হয়! বাবার মৃত্যুর আসল কারণ জানতে ইচ্ছে হয় । পাড়ায় গিয়ে দেখি গোটা পাড়ার লোক আমাদের বাসার সামনে । এমনকি পাশের পাড়া থেকেও অনেকেই এসেছে বাবাকে শেষবারের মতো একবার দেখতে । সবার চোখে পানি, সবাই কাঁদছে । তাদের এত প্রিয় মানুষটা এভাবে চলে যাবে কেউ যেন মেনে নিতেই পারছেনা ।

আমার তখন আর মাথার ঠিক নেই, শুধুই চিৎকার করে কাঁদছি! কিছুক্ষণ পর বাবাকে বাড়ির উঠানে শোয়ান হল । আমার প্রচণ্ড রাগ হল ভগবানের প্রতি, তাঁর বিচারের প্রতি সৃষ্টি হল অনাস্থা । ছুঁটে গেলাম উঠোনের কালই মন্দিরের মূর্তি ভাঙতে । যা মানুষটা সাড়া জীবন শুধু পরের জন্য করেই গেল, একটা খারাপ কাজও করলনা- সেই মানুষকে এত আগেই চলে যেতে হল এটা তাঁর কেমন বিচার? আমি এই বিচার মানি না, আমি এই প্রতিমা মানিনা । সব মিথ্যে, বাবা ছাড়া আমার সব কিছু অন্ধকার ।

দুইজন মিলে আমাকে টেনে ধরতে পারেনা, আমি মন্দিরের বাঁশের খুঁটি ধরে ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করলাম । খুঁটি ভেঙে গেল । কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারলাম না । ধর্মভীরুরা আমাকে যেতে দিল না । সাড়া রাত নির্ঘুম কাটল, কাঁদতে কাঁদতে কাটল ।

মাইকিং হল শহর জুড়ে । সকালেও অনেকেই দেখতে এলো । খবর পেয়ে আমার স্কুলের স্যার-ম্যাডামরা এলেন । ১০ টার দিকে বাবার লাশ নিয়ে পিকআপ যোগে (বাবার ইচ্ছে ছিল তাঁর শেষযাত্রায় যেন অনেক ফুল থাকে, কিছুটা ফুল ম্যানেজ করা গিয়েছিল । কে এই দায়িত্বটা পালন করেছিল মনে নেই ।

) বাবার কর্মস্থল হাইকোর্টে গেলাম । সেখানে দুদিনের শোকদিবস পালিত হয়েছিল, আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল । মেয়র, ডিসি, এস পি এসে পুস্পারঘ নিবেদন করলো । সর্বস্তরের জনগণ এসে শেষ শ্রদ্ধা জানালো । একজন সাধারণ মক্কেলকে বলতে শুনলাম, "আল্লাহ! এ তুমি কি করলা আল্লাহ? এখন আমার মামলা কে লড়বে আল্লাহ?" তাঁর কান্না শুনে পাশে আরেকজন জিজ্ঞেস করলো, "কাঁদেন ক্যান? উকিল তো আরও আছে!" তিনি বললেন, ""অন্য উকিল আর উনি এক না ।

অন্য উকিল যেই জায়গা ২০০ টাকার কমে নেয়না, উনি সেইখানে মাত্র ৪০ টাকা নিত, আমার অবস্থা খারাপ দেখে , আর বলতো- বাস ভাড়া আছে তো? না থাকলে টাকা লাগবেনা । আপনি শুধু আমার ছেলের জন্যে দোয়া কইরেন । ও যাতে মানুষ হয় । " আমার কান্না আরও বেড়ে গেল । আমি তখন বাবার লাশের পাশে! এখনও বাবার নাম্বারে অনেকেই ফোন করে বাবার সাথে কথা বলতে চায়! তারা জানেনা, তাদের প্রিয় মানুষটি আর নেই! আজও দেশের যেখানেই যাই, বাবু ফরিদীর ছেলে পরিচয় দিলে সবাই খুব আদর করে, বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে, বাবার প্রসঙ্গা করে ।

মানুষ তো আর কিছু নিয়ে যেতে পারেনা, মৃত্যুর পড় এই সুনাম আর শুভকামনাটাই তাঁর সাথে যায় । এই হিসেবে আমি খুবই ভাগ্যবান এমন একজন বাবা পেয়ে! বাবা মারা যাওয়ার পর শোক দিবস পালিত হল কমপক্ষে দশ জায়গায় । সবাই বাবাকে নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করলো, অনেক আশ্বাস দিল আমাদেরকে । তার কিছুই বলতে গেলে আমরা পাইনি । একটা সংগঠনের উদ্যোগে ফরিদপুরে "বাবু ফরিদী পদক" প্রবর্তিত হয়েছিল, জানিনা এখনও দেয়া হয় কিনা! পত্রিকায়ও লেখালেখি হয়েছে কিছু ।

বাবার কবিবন্ধু তপন বাগচী গতবার প্রথম আলোতে একটি লেখা লিখেছিলেন বাবাকে নিয়ে । এবার আর কেউ লিখেনি । সব থেকে ছেলের, বন্ধুদের যেন কিছু করার নেই! তাদের যেন কিছুই এসে যায়নি! আজ রাতে আমার ঘুম আসবে না । কাল সারাদিনও একইভাবে কাটবে । শুধু কালকের দিন না, প্রতিটা দিন আমার এভাবেই যায় ।

একটা মুহূর্তও বাবাকে ভুলে থাকতে পারিনা । বাবাকে নিয়ে আমার সব স্মৃতি একে একে মনে পড়বে, আর আমি কাঁদবো । বাচ্চাদের মতো করে কাঁদবো । কিছু কিছু সময়ে কাঁদা ছাড়া উপায় থাকে না । আর কিছুই করার থাকে না ।

আমার অবস্থাও তাই । মা ফরিদপুরে, আমি ঢাকায় । আর বাবা পরপারে । একদিনের সুখের সংসার ভেঙে আজ পুরোটাই শেষ । বাবার স্বপ্নগুলো বুঝি আর পূর্ণ হলনা! রাত ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছে, আমার চোখে ঘুম নেই ।

সম্ভবত ভরেও ঘুমাতে পারবো না । বাবাকে নিয়ে আমার ১৯ বছরের স্মৃতি আমাকে কাঁদাবে । কাল সারাদিন বাইরে বের হবোনা, একা একাই কাটাব । আর, বাবাকে নিয়ে ভাবব- প্রতিদিন যেমন ভাবি! আচ্ছা, পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর কেন? কেন কাছের মানুষগুলোকে এভাবে অসময়ে চলে যেতে হয়? কেন এভাবে কাঁদতে হয়? পৃথিবীতে একজন মানুষের সবচেয়ে কাছের মানুষ তার বাবা-মা । বাবা-মা হারানোর বেদনা কারো সাথে শেয়ার করা যায়না... যার যায় শুধু সেই বোঝে ।

কত স্মৃতি, কত হাসিগান, কত কথা এসে যে মনকে নাড়া দিয়ে যায় তখন ক্ষণে ক্ষণে! না যায় ভোলা... না যায় মনে করে বসে থাকা (যার অর্থ ভেঙে পরা) ; শুধু ভুলে থাকার অভিনয় করে যেতে হয় । মানুষের একাকী থাকার নীরব কোনো মুহূর্তে কিংবা খুব কষ্টের কোনো ক্ষণে হারিয়ে যাওয়া বাবা বা মায়ের কথা বেশী মনে পড়ে, তাদেরকে তখন খুব বেশী মিস করি আমরা । তাদেরকে ছাড়া দুনিয়াটা তখন একেবারে অন্ধকার লাগে । সবকিছুতেই কেমন একটা বিষণ্ণতা ভড় করে । অর্থহীন লাগে সবকিছু ।

রাতের এই নীরবতায়, বাবার সাথে অজস্র স্মৃতিবিজড়িত এই ঘরের কোণে একাকী বসে, বাবাকে আজ খুব বেশী মিস করছি । ঘরের চারটি দেয়াল, প্রতিটি আসবাবপত্র যেন বাবার হয়ে কথা বলছে... স্মৃতিগুলোকে মনে করিয়ে দিচ্ছে । অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, এই ঘরে বাবার সব স্মৃতি সাথে নিয়ে আমার মা বছরের পর বছর একাকী এখানে কিভাবে সময় কাটায়? কেনইবা তাকে অসময়ে শাখা-সিঁদুর হারাতে হল? কী দোষ করেছিল সে যে তাকে এত কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে? এটাই কি সৃষ্টিকর্তার বিচার? যদি তাই হয়, তবে আমি বলতে ভয় করিনা- সেই স্রষ্টার ওপর আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই । কেউ যদি বলে তিনি পরীক্ষা নিচ্ছেন, আমি বলব- আমি সেই পরীক্ষার নিকুচি করি । [বাবার আত্মার শান্তিবিধানের জন্য আমি সকলের দোয়াপ্রার্থী ।

] কবি বাবু ফরিদী সম্পর্কে জানতে ও তাঁর সম্পর্কে লেখাগুলো পড়তে এই লিঙ্কগুলো দেখুনঃ । ১) Click This Link (প্রথম আলোতে বাবাকে নিয়ে লেখা) ২) Click This Link ৩) Click This Link ৪) Click This Link ৫) Click This Link ৬) Click This Link ৭) Click This Link ৮) Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।