আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাতিয়া-নিঝুম দ্বীপ, আমি তোমাদের ভালোবাসি ২০০৪ সাল থেকে

২০০৪ সাল। অফিস থেকে ট্যুরের জন্য তিনটি যায়গা সিলেক্ট করা হয়েছে। চট্টগ্রাম, নোয়াখালি আর ভোলা। আমার ভাগ্যে পড়েছে চট্টগ্রাম। যায়গাটা আমি ভীষণ ভালোবাসি বলেই ফুরফুরে মেজাজে আছি, মুখ হাসি হাসি।

কলিগ রাশিদ ভাই-যার ভাগ্যে নোয়াখালি পড়েছে, রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে আমার কাছে এলেন। নোয়াখালি জেলায় কাজ হলে হাতিয়া যেতে হবে, লঞ্চে পার হতে হবে বিশাল মেঘনার মোহনা আর তা প্রায় আড়াই ঘন্টার পথ। সাঁতার না জানা রাশিদ ভাইয়ের মুখ আমশি। তাঁর অবস্থা দেখে আমি নোয়াখালির সাথে চিটাগাং এক্সচেঞ্জ করলাম। এবার রাশিদ ভাইয়ের মুখে হাসি আর আমার মুখ আমশি।

অফিসের পয়সায় চিটাগাং ঘুরার সুযোগ মিস হয়ে গেলো। যাক, নোয়াখালিই সই। মাইজদীতে দুইদিন কাজ করার পর এলো হাতিয়া যাবার সময়। তখন জুলাই মাস, আকাশ স্বাভাবিক নয়। যেদিন অফিস টিমের আমরা হাতিয়ার উদ্দেশ্যে সি ট্রাকে উঠলাম, সেদিন তিন নাম্বার সিগন্যাল।

চেয়ারম্যানঘাট থেকে সি ট্রাক ছেড়ে গিয়ে যখন কুলহীন মেঘনায় পড়লো, তখন বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। মোহনা ভীষণ উত্তাল। রোলিং হচ্ছে সিট্রাকে। মনে মনে বললাম, “রাশিদ ভাই, কেন ধরা খাওয়াইলেন আমাকে”। দীর্ঘ দুই ঘন্টার জার্নির পর পৌঁছালাম ঘাটে।

হালকা জিমন্যাস্ট ব্যালেন্স দেখিয়ে সিট্রাক থেকে নামলাম হাতিয়ার মাটিতে। একদিকে সাধারণ গ্রামের পরিচিত দৃশ্য আর আরেকদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মেঘনার মোহনা। উত্তাল নদীর পানি সশব্দে বাড়ি খাচ্ছে পাড়ের মাটিতে। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেলো হাতিয়াকে। হাতিয়ার কিছুটা বর্ণনা দিয়ে দেয়া ভালো হবে।

বাংলাদেশের ভেতর নদীর মোহনা যেখানে সাগরে মিশেছে সেখানে কয়েকটি দ্বীপ আছে। এর ভেতর হাতিয়া অন্যতম। হাতিয়া নোয়াখালি জেলার একটা উপজেলা, যার আকৃতি লম্বাটে আর নোয়াখালি থেকে এখানে যাতায়াতের জন্য বিআইডব্লিউটিএ’র দুটি সি-ট্রাকই ভরসা। ট্রলারেও যাতায়াত করা যায় তবে তা স্থানীয় বাসিন্দারাও শীতের শান্ত সময়টা ছাড়া ট্রলারে আসতে সাহস করেনা। সি-ট্রাক জোয়ার ভাটার সময় মেনে চলাচল করে।

দ্বীপের আকার লম্বালম্বিভাবে ৬০ কিলোমিটার আর প্রস্থে ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার। আমাদের গন্তব্য ওছখালি যা কিনা উপজেলা হাতিয়ার সদর; যেখানে উপজেলা পরিষদ, হাসপাতাল, এলজিইডি, সরকারী বড় কলেজ সব কিছুই আছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমরা উঠলাম। বাহ, কি চমৎকার হাসপাতাল। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যত হাসপাতাল আমি দেখেছি, তার ভেতর সৌন্দের্যের দিক দিয়ে হাতিয়ারটা অন্যতম।

ছবির মতো লাল ইটের হাসপাতাল আর কোয়ার্টার। একপাশে টলটলে পানির পুকুর আর তার দুইপাশে দুটি শান বাঁধানো ঘাট। ছোট্ট একটা মাঠও আছে। ডক্টর্স কোয়ার্টারের তিনতলায় যে রুমে আমি উঠলাম, তার ছাদে বসেই সারাদিন কাটিয়ে দেয়া যায়। উঠেছিতো ঠিক আছে, কিন্তু খাবো কোথায়? লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো হাসপাতালের পাশেই ভালো একটা হোটেল আছে নাম ‘হুমায়ুনের হোটেল’।

গেলাম ওখানে। হুমায়ুন নামের মধ্যবয়সী লোকটাই চালায় হোটেল। খুবই আন্তরিক আর পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। ভাই হুমায়ুন নিজেই আমাদের বললেন কি একটা মাছ আছে সকালে সাগর থেকে ধরে আনা তাজা মাছ, সেটা খেতে। আমরাও সবাই রাজী, দেখা যাক খেয়ে।

খেলাম সে মাছ আর সেই রান্না। আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা, জীবনে অনেক খাওয়া খেয়েছি কিন্তু এমন মজার খাবার আমি সারা জীবনে কমই খেয়েছি, নাহ্‌ বরং খাইনি বললেই ঠিক হবে বোধ হয়। পরবর্তি প্রতিটি বেলা হুমায়ুনের হোটেল হয়ে ঊঠলো আমাদের ফুড ডেস্টিনেশন। অন্য কোথাও খেয়ে জিভটাকে আফসোস করাতে চাইনি। হুমায়ুনের হোটেলের স্মৃতি আমার কাছে বিশেষ কিছু।

এ গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা রইলো। ওছখালিতে আমাদের কাজ চলছিলো জোরেশোরে। বৃহষ্পতিবার রাতটা ফ্রি। আমার সাথে ডাক্তারদের ভেতর আছেন রিফাত ভাই। ইতিমধ্যে কাজের ফাঁকে আমাদের সাথে পরিচয় আর খাতির হয়ে গেছে এলজিইডি’র একজন ইঞ্জিনিয়ার যার নাম সম্ভবত মহসিন ভাই (ভদ্রলোক এতোটাই আন্তরিক আর এতো সাহায্য আমাদের করেছেন যে, নামটা ভুলে যাওয়াটা খুব অন্যায় হলো)।

রাতের বেলায় তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন কোয়ার্টারে, যেখানে ভরপুর ব্রিজ খেলা চলছে। আমরাও বসলাম কিছুক্ষণ। এরই ফাঁকে আলাপ হলো নিঝুম দ্বীপ সম্বন্ধে। রিফাত ভাই আর আমি এক বাক্যে রাজি যাবার জন্য। রুমে ফিরে এসে বাকীদের অফার করলাম যাবার জন্য।

কেউ যেতে চাইলোনা, ঘুমাবে সবাই। আমি আর রিফাত ভাই ডিটারমাইন্ড, আমরা যাবোই। ওছখালি থেকে নিঝুম দ্বীপ যাবার রাস্তাটা বেশ দূর, প্রায় চল্লিশ কিলো আর রাস্তার কন্ডিশনও খুব খারাপ। বেবী ট্যাক্সি কিংবা স্থানীয় লক্কর মার্কা জিপ ছাড়া উপায় নেই। খুব ভোরেই মহসিন ভাই এসে হাজির তার বাইক নিয়ে।

বললেন, “আপনারা দুইজন উঠতে পারলে বাইক নিয়ে জাহাজমারা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। ওখান থেকে ট্রলারে যাব”। আমরা উঠে পড়লাম তাঁর পিছনে। প্রায় পুরো রাস্তারই সুরকি উঠে গেছে সাথে বড় বড় খাদ। এর ভেতর দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলছে আমাদের মোটর সাইকেল।

প্রায় এক ঘন্টা পর আমরা পৌছালাম জাহাজমারা বাজার। বাজারের ভেতর একটা বড় হোটেলে ঢুকে নাস্তা করতে বসলাম আমরা তিনজন। পেটে বেশ খিদা ছিলো। পরোটা-ভাজি-ডিম-চা খেলাম আয়েশ করে আর পেট পুরে। খাবারের মান? গতানুগতিক।

খিদা থাকায় বোধ হয় ভালো লেগেছে বেশী। আকাশে সেদিন রোদের দেখা নেই। আর আমরা যখন নাস্তা শেষে বের হলাম তখন ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মহসিন ভাই বললেন, “কাদার ভেতর মোটরসাইকেল যাবেনা, এখান থেকে হেঁটে ঘাটে যেতে হবে, প্রায় দুই কিলো হবে ঘাট”। আমরা প্যান্ট গুটিয়ে কাদামাখা পথে নেমে পড়লাম।

দুই কিলো বললেও আমার আর রিফাত ভাইয়ের কাছে তা তিন-সাড়ে তিনের কম মনে হলোনা। ঘাটে গিয়ে দেখি চমৎকার পরিবেশ। অন্য ঘাটের মতো পরচিত কোলাহল নেই। শান্ত আর সাথে অনেক গাছ গাছালিতে ঢাকা। দু’একটা দোকান আছে, যার একটি ছাড়া সবগুলোর ঝাঁপ ফালানো।

বৃষ্টি পড়ছে গুঁড়ি গুঁড়ি আর সাথে মোটামুটি দমকা বাতাস। একটা ছোট্ট ট্রলার বাঁধা আছে আর কিছুই নেই। আমি মহসিন ভাইকে বললাম- ‘এইটাই যাবে নাকি নিঝুম দ্বীপ?’ ‘মনে হয়না, আরো বড় ট্রলার আসার তো কথা’। ট্রলার ছাড়ার নির্দিষ্ট সময় চলে আসছে, কিন্তু আর তো ট্রলার দেখা যাচ্ছেনা। সামনে কুল কিনারাহীন বিস্তৃত মেঘনা।

এর ভেতর বৃষ্টি পড়ে চমৎকার একটা দৃশ্য তৈরী হয়েছে। ঢেউ এখান থেকে অতটা বোঝা যাচ্ছেনা, তবে উত্তাল বলে মনে হচ্ছেনা। একটু পরেই জানা গেলো এ ট্রলারই পাড়ি দেবে বিশাল মোহনা, যাবে নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার। আমার পক্ষে এ ট্রলারে যাওয়া সম্ভব না। আমি রিফাত ভাইকে বললাম তা।

রিফাত ভাই মোটামুটি সাহসী মানুষ। তিনিও দেখি চুপ মেরে আছেন। মহসিন ভাই আমাদের আশ্বস্ত করে চলেছেন-“ভয় পাবেন না। এরা দক্ষ মাঝি আর নদীও অতোটা উত্তাল না”। আমি হালে পানি পাচ্ছিনা।

কিভাবে সম্ভব এই ছোট ট্রলারে দেড় ঘন্টা পথ পাড়ি দেয়া। আমাদের অবস্থা দেখে স্থানীয় কয়েকজন ‘সাহস’ দিলেন-“আরে ভাই ব্যাপার না। নদীতো ঠান্ডাই আছে”। ওদের সাপোর্ট পেয়ে রিফাত ভাই এবার সতেজ হলেন-“আরে চলো। সবাইতো যাচ্ছে, ব্যাপার না”।

মন বলছিলো এতো কাছে এসেও নিঝুম দ্বীপ না দেখে ফিরে যাবো? অনুরোধে গলে গেলাম। আল্লাহর নাম নিয়ে আমরা তিনিজন উঠে পড়লাম ছোট্ট সে ট্রলারে, সাথে উঠলো আরো বিশ-পঁচিশ জন স্থানীয় লোক। উঠলাম তো ঠিকই, তবে তা ছিলো আমার জীবনের ভয়াবহতম অভিজ্ঞতার মাত্র শুরু। ঘাট থেকে ছেড়ে আসার পর ট্রলার যখন বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছে, বৃষ্টি তখন কখনও বাড়ছে কখনও কমছে। মনুষ্য বোঝাই ট্রলারের কিনারা পানির লেভেলের বেশ কাছাকাছি ঘেঁষে চলছে।

বৃষ্টির সাথে গতিশীল বাতাস ঝাপ্টা দিয়ে যাচ্ছে গায়ে। ঘাটের মানুষজন যখন অনেক ছোট হয়ে এসেছে, তখন শুরু হলো ঢেউয়ের তান্ডব। এ যেন ট্রলারটাকে নিয়ে রোলার কোস্টার খেলা। একবার ইয়া উঁচুতে উঠে তো আরেকবার দেখি আমরা পাশের ঢেউটারও নীচে নেমে গেছি। কখনও সামনে পিছনে রোলিং করে তো কখনও সাইডে রোলিং হয়।

সবচেয়ে ভয়াবহ হয় যেটা মিক্স রোলিং। আমরা আল্লাহকে ডাকছি আর তিনজনই মুখ চোখ শক্ত করে বসে আছি। সবচেয়ে ভয়ংকর অবস্থা হয় তখন, যখন প্রচন্ড গতিতে ঢেউ ট্রলারের ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের বডিতে এসে ধাক্কা দেয়। মনে হয় এই বুঝি ভেঙে গিয়ে ডুবে গেলাম সবাই। ধাক্কা সামলাতে মাঝিও হিমশিম খাচ্ছিলো।

আমি, রিফাত ভাই আর মহসিন ভাই একজন আরেকজনকে ধরে বসে আছি। তখন আশপাশে কোন নৌকাও নেই আর দৃষ্টসীমার অনেক বাইরে রেখার মতো দেখা যাচ্ছে হাতিয়ার ভুখন্ড। চারিদিকে শুধু পানি আর অবাধ্য সব ঢেউ। মৃত্যুভয় আর জীবনের মায়া কি জিনিস তা সেদিনের চেয়ে আর কখনও ভালো বুঝতে পারিনি। তবে এত ঝঞ্ঝার পরও স্থানীয় লোকেরা নির্বিকার মুখে বসে আছে।

একজন মহিলাকে বোধ হয় ছাতির নীচে পান বানাতেও ব্যস্ত দেখলাম। এবার আস্তে আস্তে নিঝুম দ্বীপের ভুখন্ড এগিয়ে আসতে লাগলো। চোখে দেখা দিলো নিঝুম দ্বীপেরর বিশাল কেওড়া বনের সারি। পাড়ের যত কাছে আসছি, ঢেউ ততো কমে আসছিলো। আমরাও ততক্ষণে গলায় কিছুটা পানি ফিরে পেয়েছি।

এরই মধ্যে মহসিন ভাই বললেন, “ওই যে দূরে তাকিয়ে দেখুন, সবুজ রেখার মতো যে দ্বীপটা দেখা যাচ্ছে তা হলো মনপুরা, আর এদিকটায় দেখুন, এখানেই মেঘনার শেষ আর সাগর শুরু। ওইদিকে যা দেখছেন তা বঙ্গোপসাগর”। প্রথমবারের মতো ভালো করে তাকালাম চারিদিকে। ওই যে দূরে অথৈ পানির বুকে যেন ভেসে আছে একটা মোটা সবুজ দাগ, ওই তাহলে মনপুরা। একদিকে তাকালে বনের সারি, আরেকদিকে কূলহীন সমূদ্র আর আরেকদিকে পানির বুকে একাকী দাঁড়িয়ে মনপুরা।

আহ্‌, এ যেন এক অপার্থিব সৌন্দর্য। দেড় ঘন্টার পথ বলে শুনেছিলাম, তবে মনে হয় দুই ঘন্টার কম লাগেনি আমাদের। কিছুক্ষণের ভেতর ট্রলার বনের পাশে চলে এলো। ঢুকে পড়লো ছোট্ট একটা চ্যানেলে। আমরা তিনজন উঠে দাঁড়িয়ে দেখছি প্রথম দেখা সে সৌন্দর্য।

স্থানীয়রা নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু পরেই চ্যানেলের একটা পাড়ে এসে ঠেকলো যুদ্ধ জয় করে আসা ট্রলার। জীবীত অবস্থায় মাটিতে আসতে পেরে কৃতজ্ঞতা জানালাম তাঁকে, যাঁর হাতে আমাদের প্রাণ। তবে এখনও আমি ভাবি, কোন কৃতজ্ঞতাই সেদিনের সে বেঁচে যাওয়ার বিনিময়ে যথেষ্ট নয়। স্থানীয়দের নির্বিকার থাকাটা খুব আশ্চর্য করেছিলো আমাকে।

নামার সময় কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, আপনাদের কি মনে হয়নি ট্রলার ডুবে যেতে পারে?’ ‘হ মনে হইছে, কতোই তো ডুবে’। ‘আপনারা এতো নিশ্চিন্ত ছিলেন কিভাবে?’ ‘হেইশুম চিন্তা কইর্যা কি হইবো কন, আল্লাহর হাতে হাওলা। ওইহানে মউত লেখা থাকলে কেউ ঠেকাইতে পারবো?’। এ যে দেখি অদ্ভুত ফিলোসফি। (চলবে) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।