আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দ্বিধা, আজকে তোমায় দিলাম ছুটি (প্রাপ্তমনস্কের গল্প)

‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর; মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর। ঠিক এই মুহূর্তে আপনারা যাকে মতিঝিল লোকাল বাস-স্ট্যান্ডে ক্লান্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছেন তিনি জাহিদ সাহেব। কর্ম-দিবসের দিনগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই এই সময়ে জীবনকে শাপ-শাপান্ত করতে করতে বাসের অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি । জাহিদ সাহেব এমন কোন বিশেষ ব্যক্তি নন যাকে নিয়ে একটা গল্প তৈরি হতে পারে। জাহিদ সাহেবের প্রধান বিশেষত্বই হচ্ছে আলাদা করে তার কোন বিশেষত্ব নেই।

তিনি নটা-পাঁচটার সরকারি চাকুরে। ঘুষ না খাওয়ার চেষ্টা করেন, তবে কোন কাজ শেষে খুশি হয়ে কেউ কিছু দিলে, তিনি সামান্য অপরাধ-বোধ এবং অনেকখানি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সমেত বঙ্গবন্ধুর ছবি খচিত কাগজের টুকরোগুলো পকেটে পোরেন। প্রত্যাশিত বিলম্ব সংঘটিত হওয়ার পরে বাস এলে তিনি প্রতিদিনকার মতো সেটাতে চেপে বসেন। যদিও সি এন জিতে যাওয়ার সামর্থ্য তিনি রাখেন তবুও লোকাল বাসে দশ টাকার ভাড়া, দর কষাকষি করে আট টাকায় আনতে পেরে তিনি অত্যন্ত তৃপ্তি বোধ করেন। বাস চলতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই পাশ থেকে একটা মিনি ট্রাক, জাহিদ সাহেবের বাসের ডান পাশ থেকে বিপজ্জনকভাবে ওভার-টেক করার জন্য তেড়ে আসে।

বাস ড্রাইভার দক্ষতার সাথে পরিস্থিতি সামলে নেয়ার পর তার মুখের দক্ষতারও প্রমাণ রাখেন। মিনি ট্রাক ড্রাইভারের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেন, ‘ঐ খানকির পোলা, রাস্তা কি তোর বাপের নাকি মাঙ্গের বেটা? ’ জাহিদ সাহেবের মধ্যবিত্ত কানে এই অশালীন এবং আক্রমণাত্মক শব্দগুলো সাময়িক অস্বস্তির সৃষ্টি করে। মহিলা এবং শিশুদের সামনে এমন ভাষা ব্যবহার করার জন্য ড্রাইভারকে একটু গরম কথা শুনিয়ে দিতে মনে চাইলেও তিনি নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। পরবর্তী স্টপেজে, বাসে বেশ কয়েকজন নতুন যাত্রী পুরনো যাত্রী দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় এবং একজন বৃদ্ধ লোক জাহিদ সাহেবের পাশে এসে দাঁড়ান। বৃদ্ধ লোকটির আচরণে তাকে কিছুটা অসুস্থ বলে মনে হয়।

জাহিদ সাহেব দ্বিধান্বিত হয়ে ভাবতে থাকেন তার আসনটি তিনি ছেড়ে দেবেন কিনা। পরক্ষণেই তার মনে হয় আসনটি ছেড়ে দেয়ার জন্য আজ তিনি একটু বেশীই ক্লান্ত, হয়তোবা অন্য কেউ ঐ বৃদ্ধ লোকটির জন্য আসন ছেড়ে দেবে। এরকম ভাবতে ভাবতে অন্য কারও মানবতার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে তিনি আশ্বস্ত বোধ করেন। যাত্রার পরবর্তী অংশটুকুতে ঐ বৃদ্ধ লোকটির কথা তার আর একবারও মনে পরে না। জীবনের রূপক এই বাস যাত্রায়, যাত্রী ওঠানামার পালাবদলে ত্রিশ বছর বয়সী একজন রমণী জাহিদ সাহেবের পাশে এসে দাঁড়ান।

সম্ভাব্য কোন দুর্যোগ এড়ানোর জন্য বাস ড্রাইভার আচমকা ব্রেক চাপলে, রমণীটি তাল সামলাতে না পেরে জাহিদ সাহেবের উপর কিছুটা ঝুঁকে পড়েন এবং কিছুটা শারীরিক স্পর্শও সংঘটিত হয়। জাহিদ সাহেবের জন্য এটা কোন নতুন ঘটনা নয়; যাত্রাপথে প্রতিদিনই এরকম অসংখ্য মহিলা বা রমণীর সাথেই তার এমন অভিজ্ঞতা হয় এবং বরাবরই তিনি এসব ঘটনা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে নির্বিকার থাকেন। কিন্তু আজও যদি জাহিদ সাহেব নির্বিকার থাকতেন তবে হয়তো এই গল্পটাই সৃষ্টি হতো না। জাহিদ সাহেব একটু অস্বস্তি নিয়ে বুঝতে পারেন তিনি পার্শ্ববর্তী রমণীর কাছ থেকে ভেসে আসা ঘ্রাণ অনুভব করতে পারছেন এবং ঘ্রাণটা তাকে কয়েক বছর পেছনে নিয়ে যাচ্ছে; তার মনে পড়ছে রেহানার কথা। রেহানা তার জীবন থেকে গত কোন নাম নয়, এমনকি আজ সকালেও তিনি ঘুম থেকে উঠে রেহানার মুখই দেখেছেন।

কিন্তু এখন তার মনে পড়ছে বিয়ের ঠিক পরপরই রেহানার শরীর থেকে যে মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসত সেটার কথা। তবে কি রেহানার শরীর থেকে ঐ মিষ্টি ঘ্রাণটা বিদায় নিয়েছে নাকি রোজকার জীবন-যুদ্ধ তার ঘ্রাণশক্তি হরণ করেছে? জাহিদ সাহেবের অস্বস্তি আরও বৃদ্ধি পায় যখন তিনি তার ভ্রমণ সঙ্গিনীর গালে একটি ছোট্ট কালো তিল আবিষ্কার করেন। রেহানার শরীরের কোথাও তিল আছে কিনা, সেটা তিনি মনে করার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না। এক ছাদের নিচে দশ বছর কাটানোর পরও রেহানার শরীরের ভূগোলের ওপর এতো কম দখল থাকায় তিনি মনে মনে লজ্জিত বোধ করেন। তার কাছে হঠাৎ করেই রেহানাকে কোন অনাবিষ্কৃত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড বলে মনে হয়, যার ওপর দিয়ে তিনি বহুদিন ধরে হেটে গেছেন কিন্তু চিনে উঠতে পারেন নি।

সময়ের নিয়মে পাশের রমণীটি বাস থেকে নেমে গেলেও রেহানার চিন্তায় জাহিদ সাহেব আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। বাস থেকে নেমে জাহিদ সাহেবের বাসা দশ মিনিটের হাঁটা পথ। ঘরে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ বলে তিনি সাধারণত এই সময়টা একটা সিগারেট খেতে খেতেই পারি দেন। আজকে সিগারেট ধরিয়ে ঘোরগ্রস্তের মতো হাটতে থাকেন তিনি। তার রেহানার সাথে শুরুর দিকের দিনগুলোর কথা মনে পরে।

প্রেম করে বিয়ে হয়নি তাদের, কিন্তু বিয়ের পর মায়াবী চেহারা আর মিষ্টি কণ্ঠের রেহানার প্রেমে পড়তে খুব বেশি সময়ও লাগে নি জাহিদ সাহেবের। কি দারুণ মাদকতাময় সময় ছিল তখন। বন্ধুসঙ্গ-পাগল আর দড়িছেঁড়া গরুর মতো বাউণ্ডুলে জাহিদ সাহেব কত সহজেই না ঘরকুনো হয়ে গেছিলেন। এখনো তিনি ঘরে ফেরেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তবে সেটা রেহানার সঙ্গ পাওয়ার লোভে নয় বরং তিনি ফেরেন, কারণ তাকে ফিরতে হয়। ঘরে ফিরে পাকা গৃহস্থের মতোই জাহিদ সাহেব স্ত্রী রেহানা এবং তার একমাত্র সন্তানের সাথে স্বাভাবিক মিথস্ক্রিয়া সম্পন্ন করেন।

তবে সেসবের সাথে আমাদের গল্পের যোগ খুব সামান্যই, তাই আমরা সরাসরি চলে যেতে পারি বারান্দায়, যেখানে জাহিদ সাহেব একাকী জটিল কিছু হিসেবনিকেশ কষে চলেছেন। তিনি ভাবতে থাকেন রেহানার সাথে তার দূরত্ব ঠিক কতোটা। সারাদিনে তো অনেক কথাই হয় রেহানার সাথে; সংসার নিয়ে, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বৃদ্ধি নিয়ে। কিন্তু নিজেদের নিয়ে? নাহ তিনি মনে করতে পারেন না। সপ্তাহে বা মাসে তাদের দুজনের মধ্যে নিয়মিত শারীরিক যোগাযোগও হয়, তবে জাহিদ সাহেব বুঝতে পারেন, ওসব তিন-বেলা আহার সাড়ার মতোই অভ্যাস-জনিত সঙ্গম; ভালোবাসার প্রকাশ সেখানে সামান্যই।

অথচ এমন কতদিন দিন গেছে, যখন জাহিদ সাহেব রেহানার প্রস্ফুটিত বুকে, চুলের ঘ্রাণে তার দৈনিক দুঃখগুলো জমা দিতেন। জাহিদ সাহেব বুঝতে পারেন অনেকদিন আগেই হয়তো তার জীবনের উদ্দেশ্যগুলোর তালিকা থেকে সবার অলক্ষ্যে খসে পরা তারার মতোই রেহানা নামটি ঝরে গেছে। ঘরকন্না সামলানোর পরে শোবার ঘরে ঢুকে অবাক হয় রেহানা। রাত্রির এই সময়ে জাহিদ সাহেবের নাক ডাকার আওয়াজ শুনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তিনি, কিন্তু আজকের দিনটি তো আর দশটা সাধারণ দিনগুলোর মতো নয়; আজ সৃষ্টি হবে একটি গল্পের, আজ তাই জাহিদ সাহেব ঘুমান না, জেগে থাকেন। ঈষৎ উদ্বিগ্ন রেহানা স্বামীর পাশে বসে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কি ব্যাপার ঘুমাও নাই তুমি? তোমার কি শরীর খারাপ? ’ জাহিদ সাহেব ছোট্ট করে উত্তর দেন, ‘না।

’ অনেক কথাই রেহানাকে বলতে ইচ্ছে করে জাহিদ সাহেবের, যদিও তিনি কিছুই বলতে পারেন না। গত কয়েক বছর ধরে তার প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা দ্বিধাগুলো তার গলা চেপে ধরে। কিন্তু জাহিদ সাহেব জানেন দ্বিধার কাছে পরাজিত হওয়ার দিন আজকে নয়। সকল দ্বিধাকে দূর দ্বীপে নির্বাসনে পাঠিয়ে রেহানার হাতটি তার হাতের মধ্যে টেনে নেন জাহিদ সাহেব। তারপর বলেন, ‘রেহানা, আজ আমার খুব ভয় হচ্ছে।

তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। আমি জানি না কিভাবে এই কথাগুলো বলতে হয় কিন্তু সত্যিই আমার মনে হচ্ছে, অনেক বছর তোমার খুব কাছে থেকেও আমি তোমাকে দেখি নি। অনেক অপ্রয়োজনীয় কথার ভীরে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথাটাই বলা হয় নি। আমি তোমাকে ভালোবাসি রেহানা। ’ মধ্যবয়স্ক রেহানা অনেক দিন পরে পুরাতন একটা আবেগের মুখোমুখি হয়; প্রচণ্ড অভিমান ভর করে জাহিদ সাহেবের উপর।

কিছুক্ষণ আগেও সে ছিল পতিসেবায় নিয়োজিত এক স্ত্রী, কিন্তু জাহিদ সাহেবের কথা শুনে সে এখন পুরোদস্তুর অভিমানী প্রেমিকা, যে কিনা এইমাত্র অনেক দিন শীত-নিদ্রায় থাকা তার প্রেমিকের দেখা পেয়েছে। কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলে না। এই অসহ্য নীরবতা জাহিদ সাহেবকে অসহিষ্ণু করে তোলে। তিনি ব্যাকুল কণ্ঠে বলেন, ‘চুপ করে থেকো না রেহানা। কিছু একটা তো বল।

আমাকে কি তুমি ক্ষমা করে দিতে পার না? ’ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না রেহানা। জাহিদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন। গাঢ় চুম্বনে রেহানার ঠোঁট দুটি সিক্ত করেন জাহিদ সাহেব যেন এক চুম্বনেই কয়েক বছরের দূরত্ব ঘুচিয়ে দেবেন তিনি। এরপর কি হয় আমরা সেটা ঠিকভাবে জানি না। তবে আমরা ধারণা করতে পারি আলোআঁধারির সেই অদ্ভুত সময়ে, তৃপ্তির দুই একটা অস্ফুট শব্দে, সেদিন শুধু সঙ্গম নয়, ভালোবাসা-বাসি হয়েছিল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।