আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাইপলাইনের সংযোগসুত্র

বিকট মেসবাড়িটার সামনে দোরগোড়ায় একটা রক্তাক্ত কাপড়ের টুকরো পড়ে রয়েছে। দেখে বোঝার উপায় নেই তা পরিধেয় কোন বস্তু কী পতাকা না কি দুয়ের সম্মিলনে দোঁ-আশলা বস্ত্রসঙ্কর। পতাকা এবং পরিধেয় এর মাঝে মেলবন্ধন গড়ে তুলেছে ক্ষীণ হয়ে আসা রক্তের প্রবাহ এবং শুকিয়ে যাওয়া খয়েরী দাগ। ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠার দরকার নেই আজ কারো। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন।

সারা সপ্তাহ কাজ করে গতরাত্রে তাস পিটিয়ে এবং দিশি মদ গিলে অথবা দেশের বাড়িতে তারবিহীন কথোপকথনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিছু আবেগী, কিছু বৈষয়িক আলাপ শেষ করে ঘুমুচ্ছে তারা চুটিয়ে। কারো চোখের কোণে জল ছিলো, কারো ছিলো না, কারো জুয়ায় জেতা টাকা জাল ছিলো কারো ছিলো না, সস্তা মদের একটা বোতল ভেঙে আগুন তরল গড়িয়ে গিয়েছিলো সদর দরজা পর্যন্ত। তার সাথে এক ফোঁটা; হলেও হতে পারে অশ্রু মিশে ছিলো, তবে গতকাল রাতে কোনরকম রক্তারক্তি হয়নি। ঘুম ভেঙে মেসের বাসিন্দারা লোহিতকণিকা যুক্ত বস্ত্র/পতাকা/ বা বস্তাটি দেখলে ক্ষণিকের জন্যে থমকে যেতে পারে, রক্তের উৎস খুঁজতে বের হতে পারে অথবা আবার হাই তুলে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঘুমোতে যেতে পারে, যদি এই জন্মচিহ্নবঞ্চিত জারজ কাপড়ের টুকরোটিকে কেউ নিজের মনে করে তুলে না নেয়। অবশ্য তুলে নেবার মত মানুষের অভাব নেই।

ভোরের আলো এখনও ফোটেনি ঠিকমত। শীতকালের রাতগুলো বড় দীর্ঘ হয়। শীত কখনও চাবুক হয়ে বাস্তুহারা মানুষকে সারারাত নিপীড়ন করে ভোরে ওঠার শক্তি রহিত করে দেয়, আবার কাউকে কম্বলের ভেতর ওম গুঁজে দিয়ে ঘুমের লালিত্যে লালন করে। চোখ মেলে কেউ দেখে কুয়াশার আপাত বায়বীয় শরীর লৌহকঠিন হয়ে চেপে ধরেছে, কেউ জানলার ফাঁক দিয়ে ভিটামিন ডি'র আলোকআদর উপভোগ করে। রক্তাক্ত বস্ত্রখন্ডটির জীবনের খন্ডিত অধ্যায় এই মেসবাড়ি অথবা পাশের অট্টালিকা অথবা বস্তির অধিবাসীদের মধ্যে কেমন প্রভাব ফেলবে আদৌ তা প্রভাববিস্তারী হবে কী না শীতে কাবু স্বয়ং স্থবির সময়ও সংশয়ে।

সকালবেলায় এখানকার সম্ভাব্য আগমনপঞ্জিতে রয়েছে পেপারঅলা, ময়লার ঝুড়ি সংগ্রহকারী ছোকড়া এবং গৃহপরিচারীকা। তাদের আগমনের সময় প্রায় অভিন্ন বলে কোন একদিন সকলে একযোগে উপস্থিত হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। খবরের কাগজ বিপননকারী যুবকের ফুটপাত থেকে কেনা মোটা কাপড়ের গেঞ্জিটি দিনকতক হল হারিয়ে গেছে। এই শীতে মুফতে একটা পোষাক বা পোষাকসদৃশ্য বস্তু পেলে সে বর্তে যাবে! ময়লার ঝুড়ি নিয়ে আসা ছেলেটি কিছুদিন আগেই একটা জাম্পার উপহার পেয়েছে ভাগাড় থেকে। তবুও তাদের একত্র উপস্থিতিতে বচসার সৃষ্টি হতে পারে, কারণ আবর্জনা সংগ্রাহক ছেলেটি পুরোনো মোটা কাপড় বিক্রীর নতুন একটা কাজ পেয়েছে।

লাভ মন্দ না। রক্তের প্রবাহ থেমে গিয়ে কাপড়টিকে তা আরো পুরু করায় এর বাজারী দর নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের মধ্যকার বিবাদ শুরু হলে গৃহপরিচারিকাটি লাস্যময়ী ভঙ্গীতে যুবকের দিকে তাকিয়ে বালকটিকে কানমলা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে মেসবাসীর ঘুম ভাঙালে তখন একটা সত্যিকারের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বটে! কিন্তু কেউ আসছে না। কেউ জাগছে না। শীতটা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে বলতে হবে! -তাদের তিনজনের কেউ আসবে না তো? নিশ্চিত? -হ্যাঁ।

-মেসের কেউ জেগে উঠলে? -উঠবে না। -গেঞ্জিটা তাহলে ওভাবেই পড়ে থাকছে? -থাকুক না কিছুক্ষণ, কিছুদিন, অথবা কিছুযুগ! -রক্তের কেজি কত করে যাচ্ছে এখন? -খুবই সস্তা। এর জন্যেই তো মিশ্র তরলের সমণ্বয়ে নতুন ধরণের পোষাক বানাতে হল। প্রস্তুতপ্রক্রিয়া শুনতে চান? -তার আগে বল এটা আমাদের গদিয়ানের গায়ে লাগবে তো ঠিকমত? -প্রস্তুতপ্রণালী না শুনলে বুঝবেন কী করে! -আচ্ছা বল। -প্রথমে গদাধরবাহিনীকে দিয়ে অত্যুৎসাহী সংবাদসংগ্রহকারীদের পিটিয়ে রক্তসহ পোষাক সংগ্রহ করুন।

তারপর তা প্রক্রিয়াজাত করুন সংশ্লিষ্ট দূরদর্শননিয়ন্তার মুখনিঃসৃত বাণীর সাথে নির্গত থকথকে থুথুর সাথে। ভালোমত শুকিয়ে নেয়ার পর পেটোয়াদলের সরবরাহকৃত প্রতিবাদকারীদের অস্থিচূর্ণ ছিটিয়ে দিয়ে পরিবেশন করুন। তবে সাবধানে থাকবেন, তাদের শুভাকাঙ্খীদের অশ্রূ যেন লেগে না থাকে। -সবকিছু ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন হয়েছে তো? -হ্যাঁ, তবে নতুন নির্দেশ অনুযায়ী যদৃচ্ছ নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতির মাধ্যমে কিছু অশ্রূ এবং অন্যান্য তরলের সমণ্বয়ে পোষাকটিকে আরো টেকসই করতে বলা হয়েছে। সেজন্যেই একটা যথেচ্ছ মেসবাড়িকে বেছে নিয়ে বসবাসকারীদের যাবতীয় রাত্রতরলের সাথে পোষাকটির একটি সংযোগ ঘটানোর ব্যবস্থা হয়েছে।

এত শীত...এত রাত... এত ঘুম! গেঞ্জিটা পড়ে আছে একা ঊর্ধতনদের খায়েশ মেটাতে। চোখ নেই, চোখের স্মৃতি এবং শরীর গলে মিশে সেঁটে আছে তার সাথে। সে মনে করতে চায় না কার শরীরে ছিলো প্রথমে। মনে করতে চায়না সেই রক্তাক্ত উপাখ্যান। গতকালরাতে কে বা কারা তাকে মেসবাড়িটার সামনে এনে রেখেছে সে জানে, বলার উপায় নেই, কেন এনেছে তা আর জানতে চায় না।

এরকম অবরুদ্ধ অবস্থায় অনুভব করল নতুন তরলের উপস্থিতি। সদ্য চাকরি হারানো এক যুবকের কান্না, মায়ের সাথে কথা বলার সময়। সেই অশ্রূ এবং এরকম আরো কিছু, অশ্রুসমষ্টি সুষম গনতান্ত্রিক উপায়ে দশ শতাংশ কমিশনে বানানো সুদৃঢ় পাইপলাইনের মাধ্যমে আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে তার শরীরে সমাপতিত হবে। অশ্রুকণাসমূহ বৃষ্টিতে ভিজে যায় না কেন! আক্ষেপ করে পোষাকটির মন। সমঝদার পোষাক।

সে বুঝতে পেরেছে ইতিমধ্যে তার গন্তব্যস্থল কোথায় হবে। কিন্তু অজস্র অশ্রুকণা, জানেনা সে ঠিকানা। জানেনা এক কুইন্টাল রক্ত ঝরিয়ে কয়েক মিলিগ্রাম অশ্রু বকশিশ পাওয়া বোকা লোকগুলো, কীভাবে বিকিয়ে যাচ্ছে তাদের নয়ননীড়। তারা তাস পিটিয়ে আর দিশি মদ গিলে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। অথবা ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে তাদের কেউ।

মদের বোতল একটা ভেঙে গেলেও সেটা এই পোষাকের সন্নিকটে আসেনি। দশ শতাংশ কমিশনভোক্তার নির্দেশে তৈরী পাইপলাইনের কাঠামো মজবুত। -পোষাকের কথা তো শুনলাম। পাইপলাইনের কি অবস্থা? -খুবই চমৎকার। এমন মন্ত্রণা দেয়া হয়েছে যাতে অযাচিত কোন বস্তু না আসে।

পোষাক এবং পাইপলাইনের মধ্যে সংযোগ অত্যন্ত সুসংগত। মেসবাড়িটা থেকে ফেরত এলে পরে এটার আরো উন্নতি করব বলচি মাইরি। কেউ কোন ভ্যান্তারা অথবা বেগড়বাই করলে যথাযথ মমতা দেকানো হবে বুয়েচেন? -তোমার কথার খোলনলচে এরকম পাল্টে গেল কেন হঠাৎ? বলি হয়েচে টা কী? -হে হে, আপনারওতো পাল্টালো। পাল্টাতে হয় বুঝলেন। সময়মত পাল্টাতে হয়।

এই যেমণ ধরুন পোষাকটার রঙও কিন্তু পাল্টাবে। লাল থেকে একসময় গোলাপী হয়ে যাবে। গোলাপী থেকে আবার লাল হবে। মেহেদী রঙা দাড়ির সেলোয়ার হবে। হয় হয় বুঝলেন? দাড়িরও সেলোয়ার হয়, বাড়িও হাওয়া হয়।

-তা যা বলেছো! একদম তাজা বলেছো! কিন্তু এই শীতের মধ্যে মেঘ করল কেন হঠাৎ? মেঘ... সাগরের জল বাস্পীভুত হয়ে জন্ম এই মেঘের। মেঘ জানে না উচ্চপদস্থ ফরমায়েশ আর খায়েশ। মেঘ জানে না আটচল্লিশ ঘন্টার হিসেব নিকেশ। এই মেঘ থেকে শুধু নোনাজল ঝরে। আর সবাইকে ভিজিয়ে দিতে চায়।

কিন্তু কে ভিজবে এই শীতে? মেঘের অভিমান হয়। মেঘ কাঁদে... -হালনাগাদ খবর বল। -প্রবল বর্ষণ। এই মুহূর্তে পাইপলাইনের সাথে সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না পোষাকের। আটচল্লিশ ঘন্টার অনেক বেশিই লাগবে।

-তা লাগুক। কীই বা এসে যায়। -আপনি বুঝতে পারছেন না, এই আটচল্লিশ ঘন্টা সেই আটচল্লিশ ঘন্টা না। আমাদের বর্তমান গদীনসীন এবং সম্ভাব্য গদীধারী সবার জন্যে পোষাক প্রস্তুত করতে হবে। কান্না, ঘাম, রক্ত সব লাগবে।

এমন বৃষ্টিতে সব ধুয়ে মুছে গেলে চলবে? -ও একটা ব্যবস্থা করা যাবে। আপাতত তুমি পতিত, দুর্যোগকবলিত। রক্তের শ্রেণীও আলাদা। সস্তা রক্ত না। তবে অশ্রূ নেই তোমার, এ এক খামতি।

-আপনি কি বলতে চান? -আমি এখন ঘুমুবো। ওরা এখন জাগবে। তুমি জীবন্ত মারণাস্ত্র থেকে পরিধেয় বস্ত্র হওগে যাও। অথবা খবরের কাগজে জায়গা করে নাও। -আপনি...আপনি কী বলতে চাচ্ছেন? -ব্যাখ্যা করার সময় নেই।

(হয়তোবা একসময় তুমিও আমাকে এরকম বলতে পারো) গাম্ভীর্য বজায় রেখে স্বগতোক্তি করল সে। মনে মনে। -পেপার লন। ডিং! মেসবাড়িটা আরমোড়া ভাঙে। হকার কাদামাখা স্যান্ডেল দিয়ে পোষাকটি মাড়িয়ে যায়।

-ময়লা দ্যান। ডং! ছেলেটা ভুল করে বা ইচ্ছাকৃতভাবেই কিছু আবর্জনা ফেলে কাপড়টার ওপরে। গৃহপরিচারিকা অযথাই হাসে খিলখিল। পানের পিক ফেলে আনমনে পোষাকটার ওপর। শীতনিদ্রা শেষ করে মানুষগুলো ওঠে ঘুম থেকে।

-শীতকালটা বড্ড দ্রুত চলে গেল এবার। জনৈক মেসবাসির কথায় সায় দেয় বাকিরা। -এবার বৃষ্টি নামবে। এক অদ্ভুত বৃষ্টি। বুয়া খিচুড়ি পাকাও।

ভরপেট খেয়ে সবাই আবার ঘুমুবো। আপাতত অনিদৃষ্টকালের জন্যে ছুটি। ছুটির দিনে ঘুমানোই শ্রেয়। বুয়া খিলখিল করে হাসে। লোকগুলো এমন ঘুমোতে শিখেছে! অদ্ভুত বৃষ্টি নেমেছে শহরে।

শহরবাসী বর্ষণের আমেজে মৌজ করে ঘুমায়। তাই দেখতে পায় না একটা নগ্ন লোক কাঁচুমাচু মুখে দৌড়ে খুঁজে ফিরছে একটা কিছু। শহরবাসী দেখতে পায় না মেসবাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যে পোষাকটা সে চোরের মত করে লুকিয়ে নিয়ে যায়, সেখান থেকে অভিমানী মেঘের নোনাবৃষ্টিতে ধুয়ে যায় রক্ত এবং অশ্রূ। লেপটে থাকে মদ্যপের বমি, পেটমোটা চাড়াল মিডিয়া মাফিয়ার নোলার লালচ, মেসবাড়ির যাবতীয় আবর্জনা, হকারের স্যান্ডেলের ময়লা, গৃহপরিচারিকার বিদ্রুপ হাসি... -পোষাকটায় আমাকে কেতাদূরস্ত লাগছে তো? হাসি হাসি মুখ করে থাকা সর্বময় কর্তার প্রশ্নের উত্তরে না বলা যায় না! অসময়ে আবারও মেঘ জমে। অভিমানী মেঘ কখন রেগে উঠবে কে জানে! আবহাওয়া অফিস সুত্রে জানা যায়, যেকোনসময় প্রবল বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে...  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।