আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রোদ এসে ছায়া হয়ে যায়

যা লিখি, হয়ত কিছুই লিখি না। যা লিখব হয়ত অনেককিছুই লিখব। আসল কথা হলো, গল্প ছাড়া কিছুই লিখতে পারি না # দুপুরের রোদের বিশ্রামের যাওয়ার সময়টি আজ খুব কাছ থেকে দেখতে থাকি। তিনটা পার হয়ে যাচ্ছে। জানালার গ্রিলে চুমু দিয়ে ঢুকে যাওয়া রোদ এখন চেয়ারে গা এলিয়ে দিচ্ছে।

অথচ কিছুক্ষণ আগে দোর্দন্ড প্রতাপে সমস্ত টেবিল জুড়ে আদর বিলিয়ে যাচ্ছিল। আজ কোনো ব্যাচ আর পড়তে আসবে না। কিছুক্ষণ আগে না করে দিয়েছি ছাত্রদের। আজ শুধু রোদের বিশ্রাম দেখব। ভেতরের ঘর থেকে সেলিনার কাজের টুকটাক শব্দ এখন কমে আসছে।

নিঃস্তব্ধ দুপুর। নিঃস্তব্ধতা ভাঙ্গে সেলিনার কথায়। আজ তোমার ব্যাচ আসেনি? নাহ,আজ ইচ্ছে করছিল না পড়াতে। সেলিনা এসে বসে রোদ ছোঁয়া চেয়ারে। বাঁকাভাবে মুখে রোদ পড়ে এসে পড়ে।

মনে হয় ছায়া দিয়ে কেটে দু ভাগ হয়ে যাওয়া মুখ। অচেনা লাগে আবার চেনাও লাগে। ওর ছায়াটাও আমার চেনা। কোনো রহস্য নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।

রুম্মানের কথা ভাবছ? হেসে ফেলে আমি। সেলিনাও বুঝে ফেলছে আমার রহস্যগুলো। দুজনের কিছুই জানার বাকি নেই আর। তোমার তো খুশি হবার কথা। মন খারাপ করছ কেন? নাহ,মন খারাপ করছি না।

একবার ভাবছি দেখা করতে যাব। এতক্ষণ বেশ নির্লিপ্ত সুরে কথা বলছিল সেলিনা। এবার কিছুটা আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করে, সত্যি যাবে? তোমাকে চিনবে? আমি আবার উদাস হয়ে যাই। টেবিলের দিকে তাকাই। দুপুর দু’টার দিকেও টেবিলে রোদ ছিল।

এখন নেই। কিছুক্ষণ আগেও চেয়ার জুড়ে রোদ আয়েশ করছিল, এখন সেখানে বসে আছে সেলিনা। ঠিক কত বছর আগে এখানে শেষ দেখা হয়েছিল রুম্মানের সাথে? দশ বছর নাকি বারো বছর? এই চেয়ারে বসেই বলেছিলাম, ভালো থাকিস, অনেক ভালো। রুম্মান কিছু বলেনি। চুপ করে উঠে চলে গিয়েছিল।

সেই রুম্মান দেশের বাইরে গেল, দেশে ফিরে এল কিন্তু একবারের জন্য আর এই শহরমুখো হয় নি। আজ এতদিন পর পেপারে ওর খবর দেখে খুব দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে। সেলিনার প্রশ্ন খুব বেশি অযৌক্তিক না। নাও চিনতে পারে। বিখ্যাত হয়ে গেলে মানুষ সব ভুলে যায়।

রুম্মান যে ভুলে যায় নি তার নিশ্চয়তা কী? শৈশবের ধুলোবালি মাখা রাস্তায় ফুটবল খেলতে খেলতে পরিচয়। মারামারি করতে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে বন্ধুত্ব। কৈশোরে গল্পের বই এর পাতায় একসাথে ঘুরে বেড়ানো। স্কুলে মানিকজোড় হিসেবে খ্যাত হয়ে কলেজ জীবন শুরু করা। সেই বন্ধু যখন দেশে ফিরে জানাতে পারল না, সে তো ভুলে যেতেই পারে।

সেলিনার ছায়া যেমন চেনা ততটাই অচেনা এখন রুম্মান আসল অবয়ব। কী ভাবছ? চুপ করে গেলে কেন? নাহ, ভাবছি এমনিতেই তো ঢাকা যাব। বইমেলা শুরু হয়েছে। আর এখন বন্ধু বড় লেখক। এই ফাকে যদি দেখা হয়ে যায় মন্দ কী? তোমার বন্ধু অনেক ভালো লেখে।

অদ্ভুত টান আছে লেখায়। একেবারে ভেতরে ঢুকে যায়, তারপর একটা আবেশ রেখে যায় তবু কি জানি একটা রহস্য থেকে যায়। রুম্মানের লেখার ব্যাপারে কোনো কথা উঠলে আমি চুপ হয়ে যাই। এই তো সেদিন আমার এক ছাত্র বলছিল লেখক রুম্মান নাকি আপনার বাল্যবন্ধু? আমি ছাত্রদের সামনে খুব গম্ভীর। অবশ্য এমনিতেও অতটা হাসিখুশি নই।

ছাত্রের কথা শুনে হেসে ফেলি। উত্তর দেই, তাতে কী হয়েছে? সত্যি স্যার? সত্যি? আমি স্বভাবসুলভ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলাম। তাকে পড়তে বলে চুপ করে উঠে গিয়েছিলাম। এখন সেলিনার কথা শুনে ছাত্রের কথা মনে হলো। বয়সে অনেক তফাত হলেও উচ্ছ্বাস প্রকাশের ভঙ্গি এক-ই রকম।

সেলিনাকে জিজ্ঞেস করি, তুমিও কী গর্বিত? তোমার স্বামী বিখ্যাত এক লেখকের বাল্যবন্ধু বলে? রোদের বুঝি তখন আবার শখ হয় একটু বিশ্রাম নেবার। প্রায় পুরো মুখ এবার ঢেকে যায় ছায়ায়। ছায়ার ভেতরে হাসে সেলিনা। এবার আর আগের মতো চেনা মনে হয় না। ভাবতে বসে যাই, স্বামী হিসেবে কী এমন আছে গর্ব করার? নেই তো কিছু নেই।

বরং একজন সফল লেখকের বন্ধু হিসেবে গর্ব করাটাই শ্রেয়তর। আর আমি এক গাধা বন্ধুর লেখাটাই কখনো পড়িনি। কেন পড়িনি? নিজের কাছে এর উত্তর নেই। একসময় আমি লিখতাম প্রচুর লিখতাম। এমনকি রুম্মানের আগে আমিই লেখালেখি শুরু করেছিলাম।

কাঁচা হাতে কত প্রেমপত্র লিখে দিয়েছিলাম রুম্মান কে। এদিক দিয়ে আমাদের দু বন্ধুর মাঝে ভীষণ পার্থক্য ছিল। মেয়ে দেখলেই আমি কুঁকড়ে যেতাম। সেখানে রুম্মান ছিল সপ্রভিত। একদিন রুম্মান বলেছিল, তুই লেখালেখি থামাইস না।

একদিন বড় লেখক হবি। এখন সময়ের পথে চরিত্র পাল্টে গেছে দেখে আমার অভিমান? রুম্মানের তো লেখক হবার কোনো কথাই ছিল না। একজন মানুষ কিভাবে লেখক হয়ে ওঠে? একটা উত্তর জানি, সারাজীবন অজানা ভয়ে নিজস্ব সীমার ভেতরে কাটিয়ে দিয়ে কেউ লেখক হতে পারে না। আমি হতে পারি নি, আদৌ হতে চেয়েছিলাম কি’না তাও জানি না। সেলিনাকে কখনো দেখানো হয় নি আমার ছিঁড়ে যাওয়া পান্ডুলিপিগুলো।

হঠাৎ করে খুব ইচ্ছে করে সেলিনাকে লেখাগুলো দেখাতে। আবার চুপ হয়ে গেলে? একটু কাজ আছে, তুমি ঘুমোতে যাও। সেলিনা লক্ষী মেয়ের মতো উঠে চলে গেল। আমি জানতাম সে চলে যাবে। আজ পর্যন্ত নিয়মের ব্যতয় ঘটেনি।

কখনো কোনো প্রতিবাদ নেই। মাঝে মাঝে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে তুমি পুতুল হয়ে থেকো না, আমার পুতুলের কোনো শখ নেই। রুম্মানের লেখক হিসেবে সফলতা কিংবা বানিজ্যিক সফলতার কারণ না ধরতে পারলেও এটা জানি ওর সফল হবার কথাই ছিল। এক নিমিষে সবাইকে আপন করে নিতে পারত, হাসি-তামাশায় মাতিয়ে রাখত সবাইকে। দেখতে ছিল ভীষণ সুদর্শন।

সে জায়গায় আমি ছিলাম একেবারে উল্টো; স্বভাবে এবং চেহারায়। লজ্জা পেয়ে যাই। ওর সাথে নিজের তুলনা করছি কেন? বন্ধু সফল হয়েছে, আমার তো খুশি হওয়ার কথা। এখন পুরো ঘরটাই ছায়াময়। ছায়ার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলি।

বুঝতে পারি না কেন এমন মনে হচ্ছে। আমি তো কখনো লেখক হতে চাই নি, আমি তো কখনো সফল মানুষ হতেও চাই নি। এখন এই মফস্বলের স্কুলে মাস্টারি করছি। ভালো আছি, সুখে আছি। অথচ বন্ধুর আনন্দে আনন্দিত হতে পারছি না।

হয়ত সে হারিয়ে যাওয়া কেউ, তবু বন্ধু তো! রোদের বিশ্রামকে অপ্রার্থিত মনে হয় এখন। রোদকে কাছে ডাকতে ইচ্ছে করছে। রোদের আলোয় বিভ্রান্তি দূর হয়? মাথার ভেতর দ্রিম করে শব্দ হয়। কে যেন বলে, আজকেই ঢাকা যা। এই কে একজন টা মাঝে মাঝেই আমার সাথে কথা বলে সেই শৈশব থেকেই।

আমি তার কথা বাধ্য হয়ে শুনি। সে আমাকে আমার অনেক ইচ্ছে হত্যা করে ফেলতে বলে। আমি করে ফেলি। বুঝতে পারি, আজকেই আমি ঢাকা যাচ্ছি। রুম্মানের সাথে দেখা করতে।

বন্ধু রুম্মান না, লেখক রুম্মান। নাকি নিজেকেই খুঁজতে যাচ্ছি? # আমি ছুটছি কিংবা দাঁড়িয়ে আছি। ভিড়, মানুষের ভিড়। টিএসসির চত্বর থেকে মানুষের ভিড়। আড্ডায় মশগুল মানুষ, সিগারেটে ডুবে থাকা মানুষ, বই হাতে ছুটন্ত মানুষ, আমার মতো নিঃসঙ্গ মানুষ।

খুঁজি, পরিচিত মুখ খুঁজি। কেউ নেই, থাকার কথাও না। এই নিয়ে চারবারের মতো এলাম। মা আমাকে কোথাও যেতে দিত না,কাছে কাছে রাখত। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই এই অবস্থা।

সড়ক দূর্ঘটনা। মা’র বড় ভয়। রুম্মান যখন চলে এলো তখন আমি যেতে চাইলে মা কান্নাকাটি শুরু করল। আমি কিভাবে আসি? আমার কানের কাছে সেই কন্ঠস্বর ফিসফিসিয়ে বলেছিল, মা’কে ছেড়ে যাইস না। আমি যাই নি কোথাও।

তাই ঢাকায় আমার পরিচিত মানুষ থাকার কথা নেই। আমি একটু আগেও আমার মতো নিঃসঙ্গ মানুষ দেখেছিলাম। এখন দেখি আমার মতো কেউ নেই। একেই বুঝি বলে, হাজারো মানুষের ভিড়ে একা হয়ে যাওয়া। পৌছে যাই গেটে।

স্টলে স্টলে খুঁজি বন্ধুকে। পাই না। সেই সুদর্শন চেনা চেহারা কোথাও চোখে পড়ে না। স্টলে দেখি বন্ধুর বই, “ রোদ এসে ছায়া হয়ে যায়” কী আশ্চর্য! আসার আগে তো এই রোদ ছায়ার খেলাতেই মেতে ছিলাম। ও লিখল কিভাবে।

বিস্ময়বোধ খুব দ্রুত ঈর্ষাতে পরিণত হয়ে যায়। আবার লজ্জা পেয়ে যাই, নিজের কাছে কুঁকড়ে যাই। আমার বাবা লেখালেখি করতেন। মা’র একদম পছন্দ ছিল না। লেখার জন্য মা’র প্রতি একদম যত্ন নিতে পারব না।

এই বই বের করবার কাজে বের হয়েই বাবা মারা গেলেন। বাবা আমাকে বলেছিলেন, কখনো কাউকে ঈর্ষা করবি না। আমি ঈর্ষা করছি। মা আমাকে বলেছিলেন কখনো লেখালেখি করবি না। আমি মা’র কাছ থেকে লুকিয়ে লেখালেখি করেছি।

আমি ভালো সন্তান হতে পারি নি। আমি ভালো বন্ধু হতে পারি নি। আমি কী ভালো স্বামী হতে পেরেছি? ভাই, এমনে রাস্তা আটকায়ে দাঁড়ায় আছেন কেন? বই নিলে নেন, নাইলে যান। লোকটার কথা শুনে বুঝতে পারি, আমি ভালো সামাজিক মানুষ হতে পারি নি। আমি আসলে কী হয়েছি? প্রতিবার মেলায় এলে কিছু বই কেনা হয়।

এবার বের হওয়ার সময় লক্ষ্য করি আমার হাত খালি। আমি বাড়ির পথে রওনা হয়েছি। কিছুক্ষণ আগে এই পথ দিয়ে এসেছি, তারপরো অচেনা মনে হয়। সমস্ত জীবন যে পথে হেঁটেছি তাকেও চিনতে পারি না। আমার মগজে থাকা ঠিকানার পথ ধরে বাড়ি ফিরি।

মনে কোনো ঠিকানা খুঁজে পাই না। পুতুল চাই না, নিজেই আবার পুতুল হয়ে পুতুলের কাছে ফিরছি বাড়ি। # বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যায়। রিকশা থেকে নেমে চেনা বাড়িটাকে কেমন অচেনা মনে হয়। সেদিনের মতো রোদ।

বন্ধুর বই কিনে আনলেই পারতাম। সেলিনা খুশি হতো। আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করি সেলিনাকে খুশি করার মতো কোনো কাজ আমি কখনো করিনি। আমি খুব সম্ভবত ভালো স্বামীও হতে পারি নি। ঘরের ভেতর থেকে হাসির শব্দ শুনতে পাই।

কে এলো? বাড়ির উঠোনে দাঁড়ালে আমার ছাত্র পড়ানোর ঘরটি দেখা যায়। এখন রোদ বিশ্রামে যাচ্ছে। তাই বেশ অন্ধকার অন্ধকার ছায়া। কন্ঠ শুনতে পাই আবার। এবার চিনে ফেলি।

আনন্দ নাকি কষ্টের একটা তীক্ষ্ণ অনুভূতি শরীর বেয়ে নেমে যায়। রুম্মানের কন্ঠস্বর। এতদিন আসে নি। আর আমি যখন দেখা করতে গেলাম, তখন এসে হাজির! আমি মনে মনে ঠিক করতে থাকি এতদিন পর বন্ধুকে কী বলব? জড়িয়ে ধরব নাকি শুধু হাসব? নাকি কপট রাগ দেখাব? আমি হাসতে জানি না, রাগ দেখাতে জানি না, জড়িয়েও ধরতে জানি না। তাই হয়ত শুধু মুচকি হাসি দিয়ে বলব, তুই চলে এসেছিস? যেন গতকালকে দেখা হয়েছিল, যেন ওর এখানে থাকা খুব স্বাভাবিক।

খলখল হাসির শব্দ শুনি। মেয়ে মানুষের কন্ঠ। এমন করে কে হাসে? সেলিনা? ওর হাসি এত সুন্দর! আমি এবার ঢোকার প্রস্তুতি নেই। তখন ছায়ার ভেতর দেখি দু’টো মানুষের চারটি হয়ে একসাথে মিলে যাচ্ছে, কানের ভেতর শুনি নিঃস্তব্ধতার অসহ্য শব্দ। এই দু’দিন আগেই যে ছায়াতে সবকিছু চেনা মনে হয়েছিল এখন সেই ছায়া বাদে আর সবকিছু অচেনা মনে হতে থাকে।

আমি এবার নিশ্চিতভাবে জেনে যাই, আমি কখনো ভালো স্বামী হতে পারি নি। আমি চিরকাল রোদ হতে চেয়ে কেবল ছায়া হয়ে বেঁচে আছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।