আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নগর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজয়ের পর

নগর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজয়ের পর ফকির ইলিয়াস ========================================== কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে নিউইয়র্কে প্রায়ই আমার কথা হয়। মতবিনিময় হয় বিভিন্ন প্রসঙ্গে। তার সঙ্গে মতামত শেয়ার করি। ১৫ জুন ২০১৩ শনিবার তার আয়োজনে ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’র ত্রৈমাসিক অনুষ্ঠানটি ছিল। সাড়ে তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠান শেষ করে কবির সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম।

ঐদিনই বাংলাদেশে চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চারটিতেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। কবিকে বললাম, ‘শহীদ ভাই- একটা প্রশ্ন করতে চাই। যদি আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামাত তথা ১৮ দলীয় জোট জিতে আসে, তবে কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, রায় অব্যাহত থাকবে?’ কবি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমার মনে হয় না বিএনপি জোট ক্ষমতায় এলে এই রায় কিংবা বিচার প্রক্রিয়া পুরোপুরি বাতিল করে দেবে।

তবে দ- কমিয়ে দিয়ে কাজটা তাদের মতো করে শেষ করবে। ’ কবি আরো বললেন, ‘বিচার বিভাগের প্রতি সম্মান দেখিয়েই বিএনপি পুরো সব কিছু বাতিল করবে না বলেই আমার বিশ্বাস। ’ তার উত্তর আমি শুনলাম। আমার মনে পড়লো, জাতির জনক হত্যাকা-ের রায় অসমাপ্ত রেখেই আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছিল। বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসে।

তারা ফারুক-রশীদ খুনি চক্রকে জেল থেকে ছেড়ে দেয়নি। ছেড়ে দেবার সাহস করতে পারেনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর বিচারকাজ পুরো শেষ করে রায় কার্যকর করা হয়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রেক্ষাপট কি সেরকম? নাÑ আমার মনে হয় না। মনে না হবার অনেক কারণ রয়েছে।

তার কিছু আমি এখানে তুলে ধরতে চাই। ১। আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোট জিতে ক্ষমতায় যাবার আগেই প্রাথমিক শর্ত হবে জামাত নেতাদের ছেড়ে দিতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করতে হবে। ২।

বিএনপির উদীয়মান নেতা তারেক রহমান যেহেতু জামাতের প্রতি উদারপন্থী, তাই তিনি সে পথেই অগ্রসর হবেন। ৩। জামাতের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের ব্যবসায়িক যে উচ্চ পর্যায়ের অবস্থান রয়েছে, এর খাতিরেই বিএনপির সিংহভাগ সিনিয়র নেতা জামাতের বড় নেতাদের নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন। ৪। ডানপন্থী ইসলামি দলগুলো চাইবে মহাজোট সরকারের প্রতি তাদের ক্ষোভের পুরো প্রতিশোধ নিতে।

কারণ আরো হতে পারে। এসব বিষয় যে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা জানেন না, তা কিন্তু নয়। তারপরও তারা কেন উদাসীনতা দেখালেন, কিংবা দেখাচ্ছেন তা কারোই বোধগম্য নয়। চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে মারাত্মকভাবে। আমি একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে ১৪ জুনই ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম, সিলেট রাজশাহী ও বরিশালে বিএনপি প্রার্থীরা জিতবেন।

আমার ক্ষীণ আশা ছিল খুলনায় তালুকদার আব্দুল খালেক জিততে পারেন। তাও শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে যায়। নির্বাচনের পর অনেকে অনেকভাবে বিশ্লেষণ করছেন। তা তারা করতেই পারেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন চার প্রার্থী তাদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতার জন্য হেরেছেন।

তা-ই যদি হয়, ঐ ব্যর্থ ব্যক্তিদের আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিলো কেন? দলে আর যোগ্য নেতা ছিলেন না? আওয়ামী লীগ যে ক্ষমতাসীন হিসেবে অনেক ভুল করছে, সেই সিগনাল চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনেই এসেছিল। আওয়ামী লীগ তা পাত্তা দেয়নি। শোধরায়নি। কেন শোধরায়নি? তারপর কুমিল্লায় তাদের পরাজয় হলো। স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি তৃণমূল মানুষের আস্থা-অনাস্থার প্লাটফর্ম হয়, তাহলে মহাজোট তথা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে উঠছেÑ তা শীর্ষ ক্ষমতাবানরা বুঝে ওঠেননি কেন? প্রতিটি দলের অভ্যন্তরীণ জরিপ কর্তৃপক্ষ থাকে।

যারা দলকে তৃণমূলে অবস্থানের গোপন খবর দেয়। আওয়ামী লীগের দলপ্রধান শেখ হাসিনার সেই গ্রুপটি কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছিল কিংবা ঘুমাচ্ছে? অথবা তারা যথাদায়িত্ব পালন করেননি। কোনটা মেনে নেবে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। আওয়ামী লীগের এই সিরিয়ালি হেরে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। তার অন্যতম হচ্ছে- শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিকে সামাল দিতে না পারা, দলের কিছু উঠতি নেতার চরম দুর্নীতির মহড়া, বিভিন্ন স্তরে দখলের রাজনীতি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু দুর্নীতির মারপ্যাঁচ, রেলের কালো বিড়ালের নগ্ন উৎপাত, বিভিন্ন স্থানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বিরোধী দল দমনে উৎপীড়ন নীতিসহ আরো বেশ কিছু কাজ।

আওয়ামী লীগ কে শত্রু কে মিত্র তা চিনতে অতীতে যেমন ভুল করেছে, এই মেয়াদেও তা করেছে। জাতীয় পার্টির সঙ্গে ঐক্য করেও একক নিরঙ্কুশতার কারণে এরশাদ ও তার দলকে পাত্তা দেয়া হয়নি। যার ফলে এবারের সিটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোট পড়েছে আওয়ামী বিরোধী বাক্সে। এখন যে বিষয়টি সামনে আসছে, তা হলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে তো? ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা এ নিয়ে সংশয়বাদী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গেলো ১৮ জুন ২০১৩। জ্যাসন বার্ক লিখিত এই সংবাদটির শিরোনাম ছিল- ‘ভায়োলেন্স এন্ড প্রোটেস্টস কুড ডিরেল বাংলাদেশ ইলেকশনস।

’ ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে অবিচল থাকলেও বিক্ষোভ ও সহিংসতার কারণে বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা বেড়েই চলেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসে রাজপথে সহিংসতা এবং আগামীতে বিরোধী দলের আন্দোলনের কারণে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ বিশৃৃঙ্খলার মধ্যে পড়তে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা গওহর রিজভী গার্ডিয়ানকে বলেছেন, আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ সঠিকপথে রয়েছে। সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিছু বাধা-বিপত্তি থাকলেও সংবিধানসম্মতভাবে সময়মতো নির্বাচন হবে।

তবে তত্ত্বাবাবধায়ক সরকার পুনর্বহালে বিএনপির দাবির বিষয়টি উল্লেখ করে গার্ডিয়ান বলেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এখনো অনেক বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা রিজভী বলেন, নির্বাচনকালীন সব নির্বাহী ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তর করা হবে এবং তারা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। কিন্তু এটা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে যথেষ্ট নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এরপর মূল ‘লড়াই’ শুরু হতে পারে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে। এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিতে পারে।

সেগুলো হলো- ইসলামি দলগুলোর ভূমিকা, চলমান মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের বিচার এবং তরুণ ভোটারদের সংগঠিত হওয়া। ইসলামি দলগুলোর মধ্যে জামাতে ইসলামী সবচেয়ে বড় এবং তারা বিএনপির দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তদের অধিকাংশই এ দলের নেতা। জামাতে ইসলামীর বাইরে হেফাজতে ইসলাম নামে নতুন একটি ইসলামপন্থী শক্তি দেখা দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ঐ প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে গেলো ৫ মে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের তা-বের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে।

অন্যদিকে জামাতও যে নতুন পরিকল্পনা করছে, তা উঠে এসেছে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাকের কথায়। গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, রাজপথে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকার সবারই আছে। সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে সব পক্ষের এ বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে ওঠার মধ্যেই বিপদের সঙ্কেত দেখছে গার্ডিয়ান। তাদের প্রতিবেদনের সমাপ্তি টানা হয়েছে এভাবে- ‘মনে হচ্ছে, শুধু একটি বিষয়ে সবাই একমত- তা হলো সংগ্রাম; রাজপথেই যার জয় বা পরাজয় নির্ধারিত হবে। ’ শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন- যদি তত্ত্বাবধায়ক দাবি বহাল থাকে তবে হয়তো নির্বাচনই হবে না।

এ কথাকে অশনি সংকেত বলে বিবেচনা করছে বিএনপি। তারা বলছে, আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী কায়দায় ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চায়। সবমিলিয়ে দেশে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের প্রতি গণমানুষের আস্থা কেন এমনভাবে কমে গেলো, তা ক্ষমতাসীনদের ভাবা দরকার। অর্থমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন- মনে হচ্ছে এদেশের মানুষ একেক টার্মে দুই প্রধান দলকে ক্ষমতায় বসাবে। তার অর্থ হলো, আগামী ইলেকশনে বিএনপি জোটই ক্ষমতায় আসছে।

এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনলাম। তিনি বলেছেন- জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় থাকবো, না দিলে নাই। আমি ভেবে পাই না, এই চরম দুর্যোগকালীন আওয়ামী লীগ কেন দলের মেধাসম্পন্ন, কর্মঠ, ত্যাগী নেতাদের কাছে ডাকছে না? কেন অতীতের মনোমালিন্য ভুলে গিয়ে রাজনীতির মাঠের চৌকস নেতাদের মূল্যায়ন করছে না? দেখার বিষয় হচ্ছে, আগামী কয়েক মাসের সমস্যাগুলো সরকার কিভাবে মোকাবেলা করে। যে কথাটি বলে রাখি দেশের তৃণমূল পর্যায়ের অবস্থান নির্ণয়ে আওয়ামী লীগ যদি চরমভাবে ব্যর্থ হয়, তবে এর মাশুল তাদের দিতে হবে খুব চড়ামূল্যে। যা দেশের গণতন্ত্রকামী, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষদের আরো হতাশ করে তুলবে।

আর এই প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে নেবে অনেক বাঘা বাঘা রাজনীতিকদের দিক থেকে। ------------------------------------------------------------------ দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ : শনিবার, ২২ জুন ২০১৩ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।