আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১৮ তে বেড়ে উঠা, ১৮ তে নাগরিক, ১৮ তে রক্ত দিয়ে একটি দেহে প্রাণ দিক

রক্ত কি? মানব দেহের অন্যতম প্রধান ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে রক্ত। ইহা এক প্রকার তরল যোজক কলা, যার মধ্যে শতকরা ৫৫ ভাগ জলীয় অংশ যা রক্তরস বা প্লাজমা নামে পরিচিত এবং বাকি শতকরা ৪৫ ভাগ কণা যা লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা, অনুচক্রিকা নামে পরিচিত। রক্তের কাজ রক্ত বাহিত হয় শিরা বা ধমনীর মধ্য দিয়ে। দেহের প্রতিটি টিস্যুতে পৌঁছে দেয় খাবার ও অক্সিজেন। টিস্যুর বৃদ্ধি ও ক্ষয়রোধের জন্য এ খাবার ও অক্সিজেন অপরিহার্য।

এছাড়া দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হরমোন রক্তের মাধ্যমেই পৌঁছে যায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, নিশ্চিত করে ঐ অঙ্গের কর্মক্ষমতাকে। রক্ত শরীরের বর্জ্যগুলো বের করে দেয়। কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে ফুসফুসে বয়ে আনে দেহের বাইরে বের করে দেয়ার জন্য। বাড়তি উপাদানগুলোকে পরিবহন করে নিয়ে যায় কিডনিতে, যাতে দেহের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। দেহের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে রক্ত সাহায্য করে।

দেহের অন্যান্য তরল পদার্থগুলোর ভারসাম্য বজায় রাখতেও সহায়তা করে। যখন দেহ রোগাক্রান্ত হয়, তখন রক্তই প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে জীবাণুর বিরুদ্ধে। দেহের অভ্যন্তরস্থ এসিড এবং ক্ষারের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখাও রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মানুষের শরীরে রক্তের পরিমাণ প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ প্রতিটি পুরুষের দেহে দৈহিক ওজনে কেজি প্রতি ৭৬ মিলি লিটার ও মহিলাদের দেহে কেজি প্রতি ৬৬ মিলি লিটার রক্ত থাকতে পারে। কিন্তু সংবহন প্রণালীতে পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন ওজনের কেজি প্রতি ৫০ মিলি লিটার।

বাকি রক্ত পুরুষ ও মহিলার ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত। রক্তের গ্রুপ মানুষের রক্তের লোহিতকণিকার প্লাজমামেমব্রেনের বাইরের দিকে দুই প্রকারের অ্যাগ্লুটিনোজেন (Agglutinogen) পাওয়া যায়। এদেরকে অ্যাগ্নুটিনোজেন A বা এন্টিজেন A এবং অ্যাগ্নুটিনোজেন B বা এন্টিজেন B বলে। একই সাথে প্লাজমায় দুই প্রকারের অ্যাগ্লুটিনিন (Agglutinin) পাওয়া যায়। এদেরকে অ্যাগ্লুটিনিন a বা এন্টিবডি a এবং অ্যাগ্লুটিনিন b বা এন্টিবডি b বলে।

প্রতিটি এন্টিবডি শুধু নির্দিষ্ট এন্টিজেনের সাথে বিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম। অর্থাৎ এন্টিবডি a শুধু এন্টিজেন A এর সাথে এবং এন্টিবডি b শুধু এন্টিজেন B এর সাথে প্রতিক্রিয়া করে। এভাবে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির উপস্থিতির ভিত্তিতে সমগ্র মানব জাতির রক্তকে প্রধানত ৪ টি গ্রুপে ভাগ করা যায়। যথাঃ- A, B, O এবং AB. রক্তের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এন্টিজেন হলো রেসাস এন্টিজেন বা রেসাস ফ্যাক্টর যাকে সংক্ষেপে Rh Factor নামে অভিহিত করা হয়। রেসাস ম্যাকাসাস প্রজাতির বাঁদরের রক্তের লোহিত কণার আবরণে এক বিশেষ ধরণের যৌগ থাকে।

যে মানুষের রক্তের লোহিতকণায় অনুরূপ যৌগ থাকে তাদের রক্তকে Rh Positive বলা হয় এবং যাদের রক্তে এই ধরণের যৌগিক পদার্থ থাকে না তাদের রক্তকে Rh Negative বলা হয়। এসবের ভিত্তিতে রক্তের গ্রুপকে নিম্নোক্তভাবে বিভক্ত করা যায়- * A+ve * B+ve * AB+ve * O+ve * A-ve * B-ve * AB-ve * O-ve বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর রক্তের গ্রুপভিত্তিক হার: A= 22.44% B= 35.20% O= 33.97% AB= 8.39 বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর রক্তের রেসাস ফ্যাক্টর হার: Rhesus Positive = 97.44% Rhesus Negative = 2.56% সার্বজনীন রক্তগ্রুপ আমরা রক্তের লোহিত কণিকায় বিদ্যমান তিনটি এন্টিজেনের কথা জেনেছি। A, B এবং Rh. যার লোহিত কণিকায়- A এন্টিজেন আছে তার রক্তের গ্রুপ হবে A. B এন্টিজেন আছে তার রক্তের গ্রুপ হবে B. যার এদুটোই আছে তার রক্তের গ্রুপ হবে AB. যার এর কোনটিই নেই তার রক্তের গ্রুপ হবে O. একই ভাবে যার রক্তে Rh আছে তিনি Positive আর যার নেই তিনি Negative. এখন A এন্টিজেন বহনকারী রক্তের সাথে যদি B এন্টিজেন বহনকারী রক্তের সংমিশ্রণ ঘটে তবে A ব্লাডগ্রুপধারীর শরীর তা প্রত্যাখান করবে। এমনকি মারাও যেতে পারেন। B এন্টিজেন এর সাথে A এন্টিজেনের মিশ্রণেও একই প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

রক্তের গ্রুপ A এবং A আর B এবং B মিললেও সমস্যার শেষ হবে এমন কথা নেই। কেননা আরেকটি এন্টিজেন Rh রয়ে গেছে। Rh নাই অর্থাৎ Rh Negative এমন কারো রক্তের সাথে Rh আছে অর্থাৎ Rh Positive কারো রক্তের মিশ্রণ ঘটলেও নেগেটিভ রক্ত পজিটিভ রক্তকে গ্রহণ করবে না। আবার যার রক্তে A এবং B এ দুটি এন্টিজেনই রয়েছে তার শরীর A এবং B উভয় এন্টিজেনকেই গ্রহণ করবে। কিন্তু যার রক্তে কোন এন্টিজেনই নাই তার শরীর সকল এন্টিজেনকেই প্রতিহত করবে।

একইভাবে যার Rh পজিটিভ তার রক্তের সাথে যেমন পজিটিভ মিলবে তেমন ভাবে নেগেটিভও খাপ খাবে। এইজন্য AB রক্তগ্রুপকে বলা হয় সার্বজনীন গ্রহীতা এবং O রক্তগ্রুপকে বলা হয় সার্বজনীন দাতা। তবে সবসময় সঠিক গ্রুপের রক্তসঞ্চালনই নিরাপদ। অত্যন্ত জরুরী অবস্থা ছাড়া কখনোই সার্বজনীন দাতা বা সার্বজনীন গ্রহীতার ধারণার প্রয়োগ ঘটানো হয় না। রক্তের গ্রুপ কি কখনো বদলায়? ফিঙ্গার প্রিন্টের মতো রক্তের গ্রুপও কখনো বদলায় না।

পিতামাতা থেকে নির্দিষ্ট সূত্র অনুযায়ী সন্তান রক্তের গ্রুপ অর্জন করে। রক্ত পরিসঞ্চালন কি? দেহে রক্ত বা রক্তের কোন উপাদানের পরিমাণে মাত্রাতিরিক্ত ঘাটতি দেখা দিলে রক্ত পরিবহনতন্ত্রে অন্যের রক্ত বা রক্তের কোন উপাদান প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিকে রক্ত পরিসঞ্চালন বা Blood Transfusion বলে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ফ্রান্সে এবং পরে ইংল্যান্ডে মানুষ থেকে মানুষে রক্তদান প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ প্রক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতার রক্তের মধ্যে কোনরূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া না হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে গ্রহীতা অল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্যুমুখে পতিত হত। ১৯০১ সালে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী ডঃ কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার আবিষ্কার করেন ABO রক্তগ্রুপ তত্ত্ব।

মূলত এর পর থেকেই শুরু হয় নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন। রক্ত পরিসঞ্চালন : কখন এবং কেন প্রয়োজন - দূর্ঘটনাজনিত রক্তক্ষরণ : দূর্ঘটনায় আহত রোগীর জন্য দূর্ঘটনার ধরণ অনুযায়ী রক্তের প্রয়োজন হয়। - অস্ত্রোপচার : অস্ত্রোপচারের ধরণ অনুসারে রক্তের বিভিন্ন পরিমাণ চাহিদা হয়। - দগ্ধতা : আগুন পুড়া বা এসিডে ঝলসানো রোগীর জন্য প্লাজমা বা রক্তরস প্রয়োজন। - অ্যানিমিয়া : রক্তে R.B.C এর পরিমাণ কমে গেলে রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণ হিমোগ্লোবিনের অভাবে অ্যানিমিয়া রোগ হয়।

কাজেই রক্তস্বল্পতা মেটাতে রোগীর রক্ত প্রয়োজন হয়। - থ্যালাসেমিয়া : এক ধরণের হিমোগ্লোবিনের অভাবজনিত বংশগত রোগ। রোগীকে প্রতিমাসে ১/২ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। - হিমোফিলিয়া : এক ধরণের বংশগত রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তক্ষরণ হয় যা সহজে বন্ধ হয় না।

এ জন্য রোগীর নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন হয়। - প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ : সাধারণত প্রয়োজন হয় না তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে ১/২ ব্যাগ বা ততোধিক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হতে পারে। - ব্লাড ক্যান্সার : রক্তের উপাদানসমূহের অভাবে এ রোগ হয়। রোগীকে প্রয়োজন অনুসারে রক্ত দেয়া হয়। - কিডনি ডায়ালাইসিস : প্রতিবার ডায়ালাইসিসে সাধারণত ১ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়।

- ডেঙ্গু জ্বর রক্তের চাহিদা ২০১১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্টে দেখা যায়, সবধরণের রক্ত দাতা মিলে সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৯ কোটি ২০ লাখ ব্যাগ রক্ত সংগৃহীত হয়। এর ৫০ শতাংশ সংগৃহীত হয় উন্নত দেশে যার সারা বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিচালিত নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচী সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ছয় লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ পাওয়া যায় আত্মীয়স্বজন ও পেশাদার রক্ত বিক্রেতা থেকে আর ৩০ শতাংশ পাওয়া যায় স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে। রক্তদান কি? কেউ যখন স্বেচ্ছায় নিজ রক্ত অন্য কারও স্বার্থে দান করেন তাকে রক্তদান বলা হয়।

একারণে রক্তদাতার সম্মতি একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয় এবং এর মাধ্যমে পূর্ণবয়স্ক নয় এমন কারও রক্ত নেয়া নিরুৎসাহিত করা হয়। রক্তদানের যোগ্যতা ৩টি হ্যাঁ এক ব্যাগ রক্তদানের পূর্বশর্ত। প্রথম হ্যাঁ : বয়স রক্তদানের বয়স সীমা দেশ ভেদে ভিন্ন হয়। সাধারণত ১৭ থেকে ৬৫ বছর বয়সকে রক্তদানের জন্য উপযুক্ত বলে ধরে নেয়া হয়। তবে কিছু কিছু দেশে ১৬ বছর বয়সকেও রক্তদানের জন্য গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়।

আমাদের দেশে এই সীমা ১৮ থেকে ৬০ বছর। দ্বিতীয় হ্যাঁ : সুস্বাস্থ্য একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ৪৮ কেজি বা তার বেশি ওজনের ব্যক্তি রক্তদানের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন। তৃতীয় হ্যাঁ : স্বদিচ্ছা একটি মাত্র স্বদিচ্ছা, এক মুহূর্তের জন্য সামান্য সূচঁ ফুটানোর অমূলক ভীতি দূর আক্ষরিক অর্থেই বাচাঁতে পারে একটি জীবন। একজন সুস্থ্য সবল মানুষের রক্তদান না করার অর্থই হচ্ছে একজন অসুস্থ্য মুমূর্ষু মানুষকে পৃথিবীতে বাঁচার অধিকারকে না বলা। কতদিন পর রক্ত দেয়া যায়? একজন মানুষ কত দিন অন্তর রক্ত দিতে পারবেন এটা তার শারীরিক অবস্থার পাশাপাশি অঞ্চলের আবহাওয়ার উপরও নির্ভর করে।

আমাদের জাতীয় রক্ত নীতিমালায় ৪ মাস পর পর রক্তদান করার কথা বলা হয়েছে। তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মত অনুযায়ী, একজন সুস্থ্য পুরুষ ৩ মাস ও নারী ৪ মাস অন্তর রক্তদান করতে পারবেন। কতটুকু রক্ত দেয়া যায়? পূর্বেই বলা হয়েছে, ছেলেদের শরীরের ওজনের কেজি প্রতি ৭৬ মিলি লিটার এবং মেয়েদের শরীরে ওজনের কেজি প্রতি ৬৬ মিলিলিটার রক্ত থাকে। উভয়ের ক্ষেত্রেই ৫০ মিলিলিটার রক্ত সংবহনের কাজে লাগে, বাকিটা উদ্বৃত্ত থেকে যায়। অর্থাৎ, ছেলেদের উদ্বৃত্ত রক্তের পরিমাণ = (৭৬-৫০) = কেজি প্রতি ২৬ মিলিলিটার মেয়েদের উদ্বৃত্ত রক্তের পরিমাণ = (৬৬-৫০) = কেজি প্রতি ১৬ মিলিলিটার ফলে ৫০ কেজি ওজনের একটি ছেলের শরীরে উদ্বৃত্ত রক্তের পরিমাণ = (৫০ x ২৬) = ১৩০০ মিলিলিটার এবং একটি মেয়ের শরীরে উদ্বৃত্ত রক্তের পরিমাণ = (৫০ x ১৬) = ৮০০ মিলিলিটার স্বেচ্ছায় রক্তদানে একজন দাতার কাছ থেকে ৩৭৫ থেকে ৪২৫ মিলিলিটার রক্ত সংগ্রহ করা হয় যা তার শরীরে থাকা মোট রক্তের ১০ ভাগের ১ ভাগ এবং উদ্বৃত্ত রক্তের অর্ধেক বা তারও কম।

এ কারণে অধিকাংশ রক্তদাতা রক্তদানের পর তেমন কিছুই অনুভব করেন না। যে পরিমাণ রক্তের তরল অংশ নেয়া হয় সেই পরিমাণ তরল অংশ মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই আবার আগের মতো হয়ে যায়। ইহা কি নিরাপদ? এখন প্রশ্ন আসতে পারে রক্ত দান প্রক্রিয়া কতটুকু নিরাপদ? আমরা ইতিমধ্যে ABO রক্তগ্রুপ ও Rh-Factor এর Positive ও Negative এর কথা শুনেছি। একই গ্রুপের সম রেসাস ফ্যাক্টরের অধিকারী দাতা-গ্রহীতা হতে পারেন। ফলে কার্যত রক্তদানে স্বাস্থ্যগত কোন ঝুঁকি নেই।

এছাড়াও আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, শারীরিক সুস্থ্যতা রক্ত দানের একটি প্রধান শর্ত। যে ব্যাগে রক্ত সংগ্রহ করা হয় তার সূচ ও ব্যাগ সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত থাকে ও তা একবারের বেশি ব্যবহার করা যায়না। কাজেই বলা চলে রক্তদান প্রক্রিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপই নিরাপদ। আমরা কেন রক্তদান করব? রক্ত কল-কারখানায় তৈরি হয় না। অন্য কোন প্রাণীর রক্ত মানুষের শরীরে দেয়া যায় না।

তাই হৃদয়ের দান হিসেবে অসুস্থ মানুষের প্রয়োজনে সুস্থ মানুষ রক্ত না দিলে রক্ত পাওয়ার আর কোন বিকল্প উপায় থাকে না। একজন রক্তদাতা রক্তদানের মাধ্যমে কিছু প্রাপ্তি অর্জন করেন। যেমনঃ রক্তদান একটি পুণ্যের কাজ মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করে। ” (আল-কোরআন, সূরা মায়েদা, আয়াত ৩২) মুহাম্মদ (স) বলেছেন, “তোমাদের কেউ তার অপর ভাইয়ের উপকার করতে সক্ষম হলে সে যেন তা করে। ” (মুসলিম) এছাড়াও তিনি বলেন, “তোমরা জগদ্বাসীর প্রতি সদয় হও, আল্লাহ তোমার প্রতি সদয় হবেন।

” (তিরমিযী, হাদীস নং ১৮৪৭) বুদ্ধদেব তাঁর শিষ্যদের বলতেন, “ভিুগণ তোমরা বহুর কল্যাণার্থে বিশ্বের প্রতি মমতা সহকারে মানুষের সেবা ও কল্যাণ সাধনে বের হও। ঋগবেদে বলা আছে, “নিঃশর্ত দানের জন্য রয়েছে অসাধারণ পুরষ্কার। তার লাভ করে আশীর্বাদ ধন্য জীবন ও অমরত্ব। ” (ঋগবেদঃ ১/১২৫/৬) সর্বজনীন মানব প্রেমের প্রবক্তা স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “জীবে প্রেম করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর”। শ্রী চৈতন্যের মতে, “জীবন প্রেম ও বিশ্বপ্রেম ঈশ্বর প্রেমেরই সমতুল্য।

” স্বাস্থ্যগত উপকারিতা প্রতি ৪ মাস অন্তর রক্ত দিলে দেহে নতুন Blood Cell তৈরীর প্রণোদনা সৃষ্টি হয়। এতে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকগুণ বেড়ে যায়। বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত যে, রক্ত দেয়া স্বাস্থ্যের জন্য কেবল উপকারিই নয়, রক্ত দিলে একজন মানুষ মুক্ত থাকতে পারেন বেশ কয়েকটি মারাত্মক রোগের ঝুঁকি থেকে। হৃদরোগের ঝুঁকি কমে ঈঘঘ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, রক্তে যদি লৌহের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে কোলেস্টেরলের অক্সিডেশনের পরিমাণ বেড়ে যায় ও ধমনী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যার ফলশ্রুতিতে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

নিয়মিত রক্ত দিলে দেহে এই লৌহের পরিমাণ কমে যা হৃদরোগের ঝুঁকিকেও কমিয়ে দেয় কার্যকরীভাবে। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে মিলার-কিস্টোন ব্লাড সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা যায়, নিয়মিত রক্ত দিলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। বিশেষ করে ফুসফুস, লিভার, কোলন, পাকস্থলী ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়মিত রক্তদাতাদের ক্ষেত্রে অনেক কম বলে দেখা গেছে। প্রাণবন্ততা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি রক্তদান করার সাথে সাথে আমাদের শরীরের মধ্যে অবস্থিত অস্থি মজ্জা (Bone Marrow) নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। দান করার মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায় আর লোহিত কণিকার ঘাটতি পূরণ হতে সময় লাগে ৪ থেকে ৮ সপ্তাহ।

আর এই পুরো প্রক্রিয়া আসলে শরীরের সার্বিক সুস্থতা, প্রাণবন্ততা আর কর্মক্ষমতাকেই বাড়িয়ে দেয়। নিজের সুস্থতা যাচাই রক্ত দিতে এসে একজন রক্তদাতা তার সার্বিক সুস্থতাকে যাচাই করে নিতে পারেন। ফলে প্রতি ৪ মাসে ১ বার করে বছরে ৩ বার তার ব্লাড প্রেশার, পালস লেভেল থেকে শুরু করে বিনামূল্যে ৫টি রক্ত বাহিত রোগের স্ক্রিনিং (হেপাটাইটিস বি ও সি, এইডস, সিফিলিস ও ম্যালেরিয়া) করতে পারেন যা তাকে আশ্বস্ত করে তার সুস্থতা সম্পর্কে। যাদের রক্ত ঝুঁকিপূর্ণ পেশাদার রক্তবিক্রেতা, যৌনকর্মী, শিরায় মাদকাসক্ত ব্যক্তি, অবাধ যৌনচারী ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গের রক্ত গ্রহণ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হয়। যারা রক্ত দিতে পারবেন না যেসব রোগ থাকলে রক্তদাতাকে সারা জীবন রক্ত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে: ক্যান্সার, হৃদরোগ, উচ্চ ও নিম্ন রক্তচাপ, রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা, অকারণে ওজন কমতে থাকা, ইনসুলিন নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, হেপাটাইটিস বি এবং সি, ক্রনিক নেফ্রাইটিসে আক্রান্ত, এইডস সংক্রমিত, বিপজ্জনক আচরণে অভ্যস্ত, যকৃতের রোগী, যক্ষার রোগী, নালিহীন গ্রন্থি আক্রান্ত রোগী, সিজোফ্রেনিয়া (মানসিক ভারসাম্যহীন), লেপ্রসি, মৃগী রোগী, হাঁপানি, পলিসাইথেমিয়া ভেরা প্রভৃতি রোগ থাকলে।

সাময়িকভাবে যারা রক্ত দিতে পারবেন না: গর্ভপাত হলে- ছয় মাসের জন্য, রক্ত গ্রহণকারী ছয় মাসের জন্য, ১ বছরের মধ্যে সার্জারি হওয়া, বুকের দুধ খাওয়ানো মা ১ বছরের জন্য (শিশুর জন্মের পর থেকে), টাট্টোমার্কধারী- ছয় মাসের জন্য, চিকিৎসা সম্পন্ন ম্যালেরিয়া রোগী- তিন মাসের জন্য (এনডেমিক এরিয়ায়), টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগী- ১ বছরের জন্য (রোগমুক্তির পর), বিভিন্ন টিকা গস্খহণকারী- ১৫ দিনের জন্য, রেবিস ভ্যাকসিন- ১ বছরের জন্য (টিকা নেয়ার পর), হেপাটাইটিস ইমিউনগোবিউলিন- ১বছরের জন্য। একটি সফল রক্তদানে কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ আমেরিকান রেড ক্রস রক্তদানের আগে, সময় ও পরে বেশ কিছু করণীয় সম্পর্কে আমাদের জ্ঞাত করে যা একটি রক্তদান প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব নিরাপদ ও আরামদায়ক করতে সাহায্য করবে বলে বিশ্বাস। রক্তদানের পূর্বে করণীয় -লৌহ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ। -ভাল ঘুম হওয়া। -রক্তদানের পূর্বে অতিরিক্ত ১৬ আউন্স বা ২ কাপ পানি ও তরল খাবার গ্রহণ।

-প্লাটিলেট দাতাদের মনে রাখতে হবে, বিগত ২ দিনের মধ্যে এসপিরিন নিয়েছেন কিনা। নিয়ে থাকলে ডোনেশন না করাই উত্তম। রক্তদানের সময় করণীয় -কনুই পর্যন্ত সহজে ঘুটানো যায় এমন কাপড় পরিধান। -যে বাহু থেকে আপনি রক্ত দিতে সাচ্ছন্দ বোধ করেন তা জানান। -রক্তদানের সময় রিলাক্স থাকুন।

ইচ্ছা হলে এ সময় গান শুনতে পারেন, অন্য দাতাদের সাথে কথা বলুন বা এ সময় কোন কিছু পড়তেও পারেন। রক্তদানের পর করণীয় -রক্তদানের সাথে সাথে কিছু খান। অধিকাংশ ব্লাড ব্যাংকই কিছু স্ন্যাংকস রক্তদাতাকে খেতে দেয়। -ঘাটতি পূরণে রক্তদান পরবর্তী ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা বেশি পরিমাণে তরল খাবার খান। -রক্তদান পরবর্তী ৫ ঘন্টা ভারী ও শ্রমসাধ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।

-মাথা হালকা বোধ হলে পা দুটো কোনো কিছুর উপর সামান্য উঁচু করে রেখে শুয়ে পড়–ন। -আনন্দ করুন কেননা এই মাত্র আপনি একটি মানুষের জীবন বাচাঁলেন । বাংলাদেশে নিরাপদ রক্ত আন্দোলন ১৯৭২ সালে জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলাম নিজ রক্তদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের শুভ সূচনা করেন। তবে সাংগঠনিভাবে এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৯৭৮ সালে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘সন্ধানী’র মাধ্যমে। ১৯৮১ সালে সুইস রেড ক্রস ও ফিনিশ রেড ক্রসের সহায়তায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি শুরু করে তার রক্ত কার্যক্রম।

বর্তমানে সোসাইটির রয়েছে ৫টি রক্ত কেন্দ্র যার মাধ্যমে প্রতিবছর ৫৫,০০০ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করা হয় যা বাংলাদেশের রক্তের মোট চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ ছাত্রদের এলামনাই এসোসিয়েশন স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে ১৯৮২ সালে গড়ে তোলে ‘অরকা’। ১৯৯৬ সালে মোবাইল ডোনার পুল গঠনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের রক্ত কার্যক্রম। ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বেচ্ছা রক্তদান সংগঠন ‘বাঁধন’। সব কয়টি সংগঠনই রক্ত দাতাকে একটি ডোনার কার্ড প্রদান করে যার মাধ্যমে রক্ত দাতা পরবর্তী সময়ে রক্ত পেতে পারেন।

এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, রক্ত হলেই হবে না, অবশ্যই তা নিরাপদ রক্ত হতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিম্নোক্ত রক্ত পরীক্ষাসমূহ নিরাপদ রক্তের নিশ্চায়তা প্রদান করেঃ ১। হেপাটাইটিস বি ২। হেপাটাইটিস সি ৩। এইচ.আই.ভি/এইডস ৪।

ম্যালেরিয়া ৫। সিফিলিস কিন্তু এই নিরাপদ রক্ত আন্দোলন তখনই সফল হবে, যখন স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সর্বাত্মক সাড়া পাওয়া যায়। রক্ত দিতে চাইলে... এখানে কয়েকটি স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করা হলো- বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি কর্তৃক পরিচালিত ১। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট রক্ত কেন্দ্র ৭/৫, আওরঙ্গজেব রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭ ফোন : ০২-৯১১৬৫৬৩, ০২-৮১২১৪৯৭ ২। ফাতেমা বেগম রেড ক্রিসেন্ট রক্ত কেন্দ্র ৩৯৫, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম।

ফোন : ০৩১-৬২০৬৮৫ ৩। মুজিব জাহান রেড ক্রিসেন্ট রক্ত কেন্দ্র চৌহাট্টা, সিলেট। ফোন : ০১৬১১-৩০০৯০০ ৪। আহাদ রেড ক্রিসেন্ট রক্ত কেন্দ্র মুনশী মেহেরুল্লাহ রোড, যশোর ফোন : ০৪২১-৭৩১০০, ০৪২১-৭৩৪৫০ ৫। বেগম তৈয়বা মজুমদার রেড ক্রিসেন্ট রক্ত কেন্দ্র পাহাড়পুর, দিনাজপুর ফোন : ০৫৩১-৬৪০২১ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত কোয়ান্টাম ল্যাব ৩১/ভি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সড়ক শান্তিনগর, ঢাকা-১২১৭ (ইস্টার্ন প্লাস মার্কেটের পূর্ব পাশে) ফোন : ০২-৯৩৫১৯৬৯, ০২-৮৩২২৯৮৭ সন্ধানী কর্তৃক পরিচালিত ১।

সন্ধানী কেন্দ্রীয় কার্যালয় রুম নং ৩৫ টিন শেড আউটডোর বিল্ডিং, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাহবাগ, ঢাকা ১০০০ ফোন : ০২-৮৬২১৬৫৮ ২। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ইউনিট বাসা নং ৩৪, রোড ১৪/এ (নতুন), ধানমন্ডী আবাসিক এলাকা ঢাকা-১২০৯ ফোন : ০১৭১৬৮৫৮৭২৩ ৩। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইউনিট ফোন : ০২-৯৬৬৮৬০৯, ০২-৯৬৬৮৬৯০, ০২-৮৬১৬৭৪৪, ০২-৯৬৬৩৪২৯ ৪। স্যার সলিমুল্লা মেডিকেল কলেজ ইউনিট মিডফোর্ড রোড, ঢাকা ফোন : ০২-৭৩১৯১২৩, ০২-৯৬৬৮৬৯০ ৫। চট্টগ্রাম মেডেকেল কলেজ ইউনিট ফোন : ০৩১-৬১৬৬২৫ ৬।

কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুমিল্লা ৭। শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ইউনিট, বগুড়া ফোন : ৬৪৪-৫১০০২৯৫ ৮। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ ইউনিট ফোন : ০৫৩১৪৭৮৭ ৯। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ইউনিট, ফরিদপুর ফোন : ০৬৩১-৬৬২০০ ১০। খুলনা মেডিকেল কলেজ ইউনিট, খুলনা ফোন : ০৪১-৭৬১৫০৯ ১১।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ইউনিট, ময়মনসিংহ ফোন ঃ ০৯১-৫৪৮২৯ ১২। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ইউনিট, রাজশাহী ফোন : ০৭২১-৫২১৬৫১৮০, ০১৭২১-৭৭৩০৮০ ১৩। রংপুর মেডিকেল কলেজ ইউনিট, রংপুর ফোন : ৫২১৬৫১৮০ ১৪। এম.এ.জি. ওসমানি মেডিকেল কলেজ ইউনিট, সিলেট ফোন : ০৮২১-৭১০৮৮০ ১৫। জালালাবাদ রাজীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ইউনিট, সিলেট বাধঁন কর্তৃক পরিচালিত বাধন টি.এস.সি (নিচ তলা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফোন : ০২-৮৬২৯০৪২ জন হেনকি : সত্যিকারের মহানায়ক জন হেনকি, সতেরো বছরের এক কিশোর, দূরারোগ্য কান্সারে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয় নিউ ইয়র্কের লিনাক্স হিল হাসপাতালে।

ক্যান্সার খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল শরীরের আনাচে কানাচে। ডাক্তাররা বাচাঁনোর শেষ উপায় হিসাবে পা দুটো কেটে বাদ দেয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। অবশেষে সবাই বুঝে ফেলে তার দিন শেষ হয়ে আসছে। ছোটবেলা থেকেই জন জড়িত ছিল বয় স্কাউট আন্দোলনের সাথে।

স্কাউটিং এর জন্য প্রদত্ত সব কয়টি খেতাবই সে অর্জন করে, সর্বোচ্চ পদক “ঈগল ব্যাচ” ছাড়া। এই সুন্দর পৃথিবীকে বিদায় বলার আগে তার শেষ চাওয়ার ছিল ঐ ঈগল ব্যাচটিই। কিন্তু তা পেতে হলে যে সমাজের কল্যাণে মহৎ কিছু করতে হয়! জন হেনকি, সতেরো বছরের পা’হীন ক্যান্সার আক্রান্ত এক কিশোর হাসপাতালের বেডে শুয়ে কিভাবে সমাজের জন্য মঙ্গল কিছু বয়ে আনবে? একদিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আতঙ্কিত কন্ঠে লাউড স্পিকারে জানান দেয় তাদের ব্লাড ব্যাংকে কোন রক্ত নেয়। অবস্থা জেনে জনের বুকেও কাঁপন ধরে। মনে পড়ে পা অপারেশনের সময় কি বিপুল পরিমাণ রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল তার।

রক্তের এরকম ঘাটতি চলতে থাকলে রক্তের চাহিদা আছে এমন রোগীদের কি পরিণতি হবে? সে ভাবে। ভাবতেই থাকে। হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। হ্যাঁ, সে নিজেই আহ্বান জানাবে। যদি তার ডাকে সাড়া দিয়ে ১০০ জন মানুষও এগিয়ে আসে তাহলে আর কোন সমস্যা থাকেনা।

একই সাথে এই কাজ হয়তো ঈগল ব্যাচের অপ্রাপ্তিও ঘুচাবে। এই বার ভাবনাকে কাজে রূপ দেয়ার পালা। জন ব্লাড ব্যাংকের সেক্রেটারি ডেকে এনে পাশে বসায়। জানায় সে কি করতে চায়। জনের পরিকল্পনা মতো সেক্রেটারি মহোদয় ছড়িয়ে দেন জনের আহবান।

আমি জন হেনকি। আমার বয়স সতেরো। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে লড়াই করছি ক্যান্সারের সাথে। ছিলাম স্কাউট আন্দোলনের দুরন্ত বালক। ঈগল ব্যাচ ছাড়া পেয়েছি সব কয়টি সম্মান।

এখন শুয়ে আছি বিছানায়। অপেক্ষা করছি মৃত্যুর। কিন্তু পেতে চাই, না পাওয়া সেই পদক। কিছুদিন আগে ক্যান্সারের গতি থামাতে কেটে ফেলতে হয় আমার পা দুটো। অপারেশনের সময় প্রয়োজন হয় অনেক রক্ত।

আমার মতো অনেক রোগীর নিত্য চাহিদা রক্তের। অথচ আজ এই হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে কোন রক্তই নেই। কি হবে তার যার এই মুহূর্তে অপারেশন করা লাগবে? ঈগল ব্যাচ! আমার শেষ আকাঙ্খা! সমাজ কল্যাণে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালনকারীই পারে কেবল এর দাবিদার হতে। আজ আমার সামনে এসেছে একটি সুযোগ। আপনারাই পারেন আমার জীবনের শেষ ইচ্ছাকে পূরণ করতে।

আপনারা যদি রক্ত দান করেন, এই হাসপাতালের রক্তের ঘাটতি মিটিয়ে দেন তবে হয়তো আমার জন্য খুলে যাবে ঈগল ব্যাচের দরজা। আপনাদের দান করা রক্ত প্রাণ বাঁচাবে অনেক মানুষের। আপনাদের দান করা রক্ত বাস্তব করবে আমার স্বপ্ন। আপনারা কি আসবেন না? পরদিন সকাল বেলা দুই বালক কড়া নাড়ে হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে। “এটাই কি সেই জায়গা যেখানে রক্ত দিতে হবে? আমরা এসেছি জনের জন্য।

” কিছুক্ষণ পর আরো পাচঁজন এসে হাজির। তারাও রক্ত দিতে চায়। এভাবে একজন দুই জন করে আসতেই থাকে। রক্তকেন্দ্রের সামনে বাড়তে থাকে ভিড়। একসময় সেটা জনসমুদ্রে পরিণত হয়।

সকলে এসেছে জনের জন্য। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ১০০ নম্বর রক্তের ব্যাগ সংরক্ষণাঘারে নিয়ে যাওয়া হয়, সময়টি ছিল ২৩ মার্চ, ১৯৮১ সাল। অল্পদিনেই জনের বহু আকাঙ্খার বহু স্বপ্নের ঈগল ব্যাচে লাগে বাস্তবের ছোঁয়া। জনের পরমানন্দের একটি দিন, উল্লাসিত হবার দিন। অথচ জন বিছানায়।

ইতিমধ্যে তার শরীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সেই সাথে হারিয়েছে একটি চোখ। জনের হাতে আছে আর মাত্র কয়েকটা দিন। ডাক্তাররা স্কাউটস কর্তৃপক্ষকে যত শীঘ্রি সম্ভব অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য তাগাদা দেয়। ৩০ মার্চ, জাকঁজমকের সাথে অনুষ্ঠিত হয় জনের ঈগল ব্যাচ পড়ার অনুষ্ঠান।

স্ট্রেচারে শুয়ে জন প্রবেশ করে হলরুমে। স্কাউটস মাস্টার জনের নাম ঘোষণা করেন এবং তার মাকে অনুরোধ জানান জনের হয়ে পদকটি গ্রহণ করার জন্য। সারা হলরুম উল্লাসে ফেটে পড়ে। এর মাত্র দুই সপ্তাহ পর সকলেই আবার একত্রিত হয় স্থানীয় একটি গীর্জায়। এখানেও জন আছে অনেকগুলো উৎসুখ চোখের কেন্দ্রে।

আগের মতোই শুয়ে। নিথর হয়ে এবং নিথর করে। জন হেনকি, মিরাকল ঘটিয়েছিল যে ছেলেটি, সকলে নীরব শোকে বিদায় জানায় তাকে। Only blood will do.........only you can give ধর্ম, বর্ণ, জাতি, ভাষা, শিল্প, সংস্কৃতি, কৃষ্টি আর ঐতিহ্যে মানুষের পার্থক্য যাই হোক না কেন রক্তের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সব মানুষের রক্তের রং লাল।

রক্তদান হচ্ছে ভালোবাসার দান, হৃদয়ের দান যা আর্থিক মাপকাঠিতে কখনোই পরিমাপ করা যায় না। একজন মানুষের কোন ডাক্তারি ডিগ্রির প্রয়োজন নেই একটি জীবন বাঁচাতে। শুধুমাত্র ভালোবাসা আর রক্তরাখী বন্ধনই পারে একজন মুমূর্ষু রোগীকে চিরচেনা মুখরিত জীবনে ফিরিয়ে আনতে। রক্তদান কঠিন কোন কাজ নয়। একটি জীবন বাঁচাতে মাত্র ১০টি মিনিট সময় লাগে।

‘না’ বলার আগে একবার ভেবে দেখুন, আপনারই রক্তে বাঁচার অপেক্ষায় আছে একটি জীবন। আপনার ‘না’ বলার কারণে ভেঙ্গে যেতে বসেছে একটি স্বপ্ন। আপনার সাহায্য ছাড়া একটি শিশু আর কখনো মা বলতে পারবেনা। আপনার ভালোবাসা ছাড়া এই পৃথিবীর আলো বাতাস উপভোগ করার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হবে একটি নবজাতক। একজন ব্যক্তি যখন রক্ত দান ফরমে স্বাক্ষর করেন তখন কিন্তু তিনি একজন মানুষকে নবজীবন দান করার ফরমেই স্বাক্ষর করেন।

প্রিয় বন্ধু তারপরও কি তুমি পিছিয়ে থাকবে? ----------------------------------------------------------------------------- তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: * খোন্দকার জাকারিয়া খালেদ ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি * অধ্যাপক ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ রক্তপরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ * ডা. মুনশী এম হাবিবুল্লাহ সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা * জয় দাশগুপ্ত রাজ প্রাক্তন যুব উপপ্রধান যুব রেড ক্রিসেন্ট, চট্টগ্রাম * জনি সাহা সাংগঠনিক বিভাগ প্রধান যুব রেড ক্রিসেন্ট, চট্টগ্রাম * আমেরিকান রেড ক্রস * বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা * কোয়ান্টাম মেথড * E-Medical Poiint * মনোজগত * মুহাম্মদ আরিফুর রহমান  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।