আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাপুনযেল (একটি মেয়ের গল্প)

কোন এক সময় এক দম্পতি যারা অনেক দিন থেকে বৃথা আশায় দিন যাপন করছিলেন শুধু একটি সন্তান লাভের জন্য। অবশেষে সৃষ্টিকর্তা তাদের আশা পূর্ণ করার ইচ্ছে করলেন। তখনকার দিনে মানুষের ঘরের পিছন দিক থেকে একটি ছোট্ট জা্নালা রাখা হতো, যা গলিয়ে তাদের জাঁকজমকপূর্ণ বাগানে অতি মনোরম ফুলের দৃশ্য দেখতে পারে। বাগানটা ছিলো একটা উঁচু দেয়ালে পরিবেষ্টিত। কেউ বাগানের ভিতরে যাওয়ার মতো এমন দুঃসাহস করতে পারতো না।

কারণ এটা ছিলো এমন এক মহা শক্তিধর মহিলা জাদুকরের বাগান,যার অনিষ্টের ভয়ে সারা বিশ্বের মানুষ আতঙ্কিত থাকতো। একদিন মহিলাটি তার ছোট্ট জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ঐ জাদুকরীর বাগানের প্রতি দৃষ্টিপাত করছে। যখন সে দেখল বাগানের একটি স্থানে অতি মরোরম নীল ফুলে্র একটি গাছ যা কি না এতো সুন্দর ও সবুজ দেখাচ্ছিলো; ওটা পাওয়ার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো। তার স্বামী তাকে জিজ্ঞেস করলোঃ 'কিসে তোমাকে এতোটা কষ্ট দিচ্ছে আমাকে বল প্রিয় সঙ্গিনী?' 'আহ,' সে উত্তর দিলো, ' আমি যদি কিছু নীল ফুল (র‍্যাম্পন) না খেতে পারি যা আমাদের ঘরের পিছনে ঐ বাগানটিতে আছে, তবে আমি মরে যাব। ' যে মানুষটি তাকে ভালোবাসতো সে চিন্তা করলোঃ 'যদি তুমি তোমার স্ত্রীকে অতি শিঘ্রই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে না চাও তবে তুমি নিজে তাকে কিছু র‍্যম্পনের নীল ফুল এনে দাও।

গোধূলির সময়, অতি কষ্টে দেয়াল বেয়ে পুরুষটি ঐ জাদুকরীর বাগানে ঢোকলো, খুব ত্বরিত গতিতে এক মুঠো র‍্যাম্পন দৃঢ়ভাবে চেপে ধরলো এবং তা তার স্ত্রীর কাছে এনে দিলো। তার স্ত্রী নিজে সঙ্গে সঙ্গে সালাদ তৈরি করে নিল, এবং সাগ্রহে তা খেয়ে নিল। এগুলো খেয়ে সে এতো তৃপ্ত হয়েছিল যে, পরের দিন তিনবার তা আবার খাবারের জন্য খুব আগ্রহান্বিত হল। যদি তার একটু সময় মিলত, তার স্বামী জানতো সে অবশ্যই একধিকবার ঐ বাগানে অবতরণ করবে। অতএব,সন্ধ্যার অন্ধকারে সে আবার বাগানে প্রবেশ করলো, কিন্তু যখন সে দেয়ালে আরোহন করে বাগানে প্রবেশ করল সে ভয়ঙ্কর ভাবে ভীত হল, যখন সে ভয়ংকর জাদুকরীকে তার সামনে দেখতে পেলো।

তার প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো, 'কেমন সাহস তোর! আমার বাগানে প্রবেশ করে চোরের মতোই র‍্যাম্পন ফুল চুরি করছিস? তোকে এজন্য শাস্তি ভোগ করতেই হবে। !' দুই. 'আহ,' সে উত্তর দিল, 'বিবেচনা করে আমাকে করুণা করুন, আমি শুধু প্রয়োজনের খাতিরেই এ কাজটা করতে মন স্থির করেছি। কারণ আমার স্ত্রী আমাদের জানালা দিয়ে র‍্যাম্পন ফুল দেখে খাবার জন্য এতোই ইচ্ছে প্রকাশ করলো যে, তা না খেতে পারলে সে মরে যেতো। জাদুকরীর রাগ কিছুটা কমে গেলো, এবং তাকে বললোঃ 'যদি তুমি আমার সাথে এই শর্তে এক মত হতে পারো যে,তোমার স্ত্রী যে সন্তানটি প্রসব করবে তা আমাকে দিয়ে দিবে। আমি ঐ বাচ্চাটির সাথে ভালো ব্যবহার করবো, ঠিক তার মায়ের মতোই আমি তাকে লালন পালন করবো, আমি তোমাকে যত ইচ্ছে র‍্যাম্পন ফুল নিয়ে যেতে অনুমতি দেব,।

এই অত্যধিক ভীতিকর অবস্থায় মানুষটি সব শর্তেই রাজি হয়ে গেলো। যখন স্ত্রীলোকটিকে বিছানায় নিয়ে যাওয়া হোল, তৎক্ষণাৎ জাদুকরীটির তা দৃষ্টিগোচর হোল। একটি মেয়ে বাচ্চা প্রসব করলো, বাচ্চাটির নাম রাখা হোল রাপুনযেল, এবং তাকে তার সাথে দূরে সরিয়ে আনা হলো। খোলা আকাশ ও সূর্যের নীচে দেখতে খুব সুন্দর ফুটফুটে রাপুনযেল বড় হয়ে উঠছে। যখন রাপুনযেলের বয়স ১২ হলো তখন জাদুকর মহিলা তাকে জঙ্গলের মধ্যে একটি উচ্চ দালানে মধ্যে আবদ্ধ করে রাখলো।

দালানটিতে না ছিল কোন সিঁড়ি, নাছিল কোন দরজা, কিন্তু ছাদের কাছাকাছি ছিল ছোট্ট একটি জানালা। যখন জাদুকরিটি দালানের ভীতরে যেতে ইচ্ছে করতো, সে নিজেকে অন্তরালে লুকিয়ে রাখতো আর এ ভাবে ডেকে বলতঃ 'রাপুনযেল, রাপুনযেল, তোমার চুলগুলো আমার নাগালে খুলে দাও। ' রাপুনযেলের ছিলো চমকপ্রদ লম্বা সোনালী চুলগুচ্ছ,এবং যখন সে জাদুকরি মহিলার আওয়াজ শুনতে পেত, সে তার সুন্দর বাঁধা চুলগুলো ছেড়ে ঐ উপরের ছাদের কাছের ছোট্ট জানালা দিয়ে ঝুলিয়ে দিত, আর তা বিশ হাত লম্বা হয়ে নিচে ঝুলে পরত, আর জাদুকরি মহিলা এর সাহায্যে আরোহন করে ভিতরে প্রবেশ করত। এক,দু'বছর পর, এক জন রাজকুমার এই অরণ্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, আর যখন তিনি এই উচ্চু দালানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন সে একটি গান শুনতে পেলো, যা ছিল এতোই মধুর, যে তিনি সাথে সাথে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল। এটা ছিল রাপুনযেল, যে তার একাকীত্বের সময়গুলো এভাবে সুন্দর গান গেয়ে অতিক্রম করতো।

রাজ কুমার তার নিকট যাওয়ার জন্য ঐ উঁচু দালানে উঠার চেষ্টা করলো, এবং দালানের কোন দরজা আছে কী না তা খোঁজে দেখতে লাগলো, কিন্তু কোন দরজা দেখতে পেলো না। তিনি আবার ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি ফিরলেন, কিন্তু ঐ গানটি এতোটাই তার হৃদয়কে স্পর্শ করছিল যে, তিনি প্রায়ই ঐ অরন্যের দিকে ছুটে যেতেন শুধু তার গান শুনার জন্য। তিন. একদা তিনি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি দখলেন যে একজন জাদুকরি মহিলা সেখানে আসলো, এবং সে শুনলো, কী ভাবে সে বললোঃ 'রাপুনযেল, রাপুনযেল, তোমার চুলগুলো খুলে আমার নাগালে দাও। ' তখন রাপুনযেল তার চুলগুলোর বেণী খুলে তার নাগালে দিলে জাদুকরী মহিলা এর সাহায্যে তার নিকট পৌঁছলো। যদি একটা উঁচু মই থাকতো, তাহলে আমি ওর সাহায্যে আমিও আমার ভাগ্য পরীক্ষা করে দখতাম, 'সে বললো' এবং পরবর্তি দিন যখন অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, সে ঐ দালানের নিকট গেলো আর বললোঃ 'রাপুনযেল, রাপুনযেল, তোমার চুলগুলো আমার নাগালে দাও।

' তৎক্ষণাৎ তার চুলগুলো খুলে দিলে নীচে ঝুললো আর রাজ পুত্র উপরে আরোহন করলো। শুরুতে রাপুনযেল অত্যধিক ভয়ে কেঁপে উঠল যাখন একটি পুরুষ দেখলো, এমন ভাবে সে কখনো দখে নি, তার নিকট আসতে; কিন্তু রাজপুত্র তার সাথে এমন ভাবে কথা বলতে শুরু করলো যেন একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু। এবং রাজপুত্র তাকে বললো যে তার হৃদয় তাকে সারাক্ষণ অস্থির করে রাখছে, এবং তার মন তাকে বাধ্য করে তাকে দেখার জন্য এখানে নিয়ে এসছে। তখন রাপুনযেল তার ভীতিকর অবস্থা কেটে উঠলো, এবং যখন রাজপুত্র তাকে প্রস্তাব করলো যে সে যদি তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহন করতে চায় তবে সে তাকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিবে কী না, এতে রাপুনযেল ভেবে দেখলো যে, এ তো মায়াবী সুদর্শন আকজন তরুণ! তাকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিলে সেই জাদুকরি মহিলা থেকেও অনেক বেশী ভালোবাসবে তাকে, জীবনে সুখী হওয়া যাবে। সে সম্মতি জানালো যে সে তাকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিতে তার কোন প্রকার আপত্তি নেই।

অবশেষে সে তার হাত রাজপুত্রে হাতে রাখলো। সে বললোঃ 'আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে তোমার সাথে দূরে চলে যাব, কিন্তু আমি জানি না কী ভাবে এখান থেকে নিচে নেমে বেরিয়ে যাবো। যখনই তুমি আস, তোমার সাথে কিছু রেশমের রশি নিয়ে এসো, এবং আমি তা দ্বারা এখান থেকে বের হবার জন্য একটি মই তৈরি করব, আর এটা দিয়ে আমি এখান থেকে নেমে আসবো, এবং তুমি আমাকে তোমার ঘোড়া্র পিঠে করে নিয়ে যাবে। ' তারা উভয়ে একমত হলো যে রাজপুত্র প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় আসা উচিত, কারণ বৃদ্ধা মহিলাটি দিনের বেলা আসে, এই জাদুকরি মহিলা এ ব্যাপারে কিছুই জানতো না, যে পর্তযন্ত না সে তাকে বললো যে, 'আমাকে বলো হে সম্ভ্রান্ত মহিলা! এটা এমন কেন যে ঐ রাজ পুত্রের চেয়েও তুমি অধিকতর ভারি আমার জন্য, তোমাকে এখানে উঠাতে। সে আমার নিকট কিছুক্ষণ ছিলো।

' চার. 'আহ!' তুমি দুষ্ট মেয়ে, 'চিৎকার দিয়ে জাদুকরী মহিলা বললো। আমি তোমার কাছ থেকে এসব কী শুনছি! আমি মনে করতাম তোমাকে বিশ্বের সব কিছু থেকে আলাদা করে রেখেছি, এবং এ পর্যন্ত তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছ!' প্রচন্ড রাগে সে রাপুনযেলের সুন্দর চুলের গোছা বাম হাতে চেপে ধরে দুবার ঝাকি দিয়ে ডান হাতে কেচি দিয়ে কেটে দিলো, আর এতো সুন্দর চুলের গোছে নীচে পরে রইলো। এবং সে এতোটাই নির্দয় ছিল যে,এই অসহায় রাপুনযেলকে একটা মরুভূমিতে রেখে এলো, যেখানে অতি দুঃখ কষ্টে তাকে বাস করতে হলো। ঠিক ঐ দিনই সে রাপুনযেলকে প্রত্যাক্ষাণ করল, যাই হোক, জাদুকরী মহিলাটি তার কাটা চুলগুলোকে এক সাথে বেঁধে রাখল। যখন রাজপুত্র আসলো আর আওয়াজ করে বললোঃ 'রাপুনযেল, রাপুনযেল, তোমার চুলগুলো আমার নাগালে দাও।

' সেই জাদুকরী মহিলা কাটা চুলগুলোকে ঐ ছোট্ট জানলা দিয়ে নীচে ঝুলিয়ে দিলো। রাজপুত্র দালানের ভিতর প্রবেশ করলেও রাপুনযেলকে তো পেলোই না, বরং জাদুকরীর সাথে দেখা হয়ে গেলো, যে স্থির ভাবে বিষাক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল তার দিকে। 'আহ!' সে মুখ ভেংচিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, তুই তোর সুপ্রিয় ভালোবাসাকে গিয়ে নিয়ে আসতে পারবি, তবে সুন্দর পাখি আর তার বাসায় নেই, একটি বিড়াল তা শিকার করে নিয়ে গেছে, এবং একই ভাবে তোর চোখ খোচিয়ে বের করা হবে। রাপুনযেল তোর কাছ থেকে হারিয়ে গাছে; তুই আর কক্ষনো তাকে দেখবি না। ' রাজপুত্র দুঃখে নিজেকে পাশকাটিয়ে নিল, এবং সে হতাশায় লাফ দিয়ে উঁচু দালানের জানালা থেকে নিচে পড়ে গেলো।

সে তার জীবন নিয়ে পালিয়ে গেলো, কিন্তু সে তার চোখে কাঁটা বিধলো বলে অনুভব করতে লাগলো। সে কিছুটা অন্ধের মতো অরন্যে ভ্রমন করলো,সে গাছের নরম মূল ও কিছু ছোট্ট রাসালো ফল ছাড়া আর কিছুই খেতে পেল না, এবং তার সুপ্রিয় ভালোবাসাকে হারিয়ে কিছুই করতে পারল না পরিতাপ আর ক্রন্দন করা ছাড়া। এভাবে সে কিছু বছর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরল অসহায় হয়ে, অবশেষে ঘুরতে ঘুরতে মরুভুমিতে এলো, যেখানে রাপুনযেল দু'টি যমজ শিশু জন্ম দিয়ে ওদের নিয়ে অসহায় ভাবে অবস্থান করছে, একটি বালক ও একটি বালিকা,ওদেরকে নিয়ে হিনাবস্থায় বেঁচে আছে। রাজপুত্র একটি শব্দ শুনতে পেল, এবং তার নিকট তা পরিচিত পরিচিত মনে হলো, তখন সে ঐ শব্দের দিকেই এগিয়ে গেলো, এবং যখন রাপুনযেলের নিকটবর্তি হোল, রাপুনযেল তাকে চিনতে পেরে তার গলায় মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। কী ভাবে তার চোখের দু'ফুটা অশ্রু তার চোখে পরে তার চোখ ভিজে গিয়ে আগে মতোই সুস্থ হয়ে উঠলো, এখন সে আগের মতোই আবার দেখতে সক্ষম হোল।

সে তাকে তার রাজ্যে নিয়ে গেলো, যেখানে তারা আনন্দের সাথে গৃহীত হয়েছিলো এবং সেখানে তারা সুদীর্ঘজীবন পরিতুষ্টের সাথে অতিবাহিত করলো। ----------------------- ব্রাদারস গ্রিম এর লেখা অনূদিত রূপকথার গল্প  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.