আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সত্যজিত রায়ের ডকুমেন্টারী সিকিম,

........ ...... ...... ....... ........ ১ম পর্ব (২য় পর্ব) ডকুমেন্টারীটি দেখার পর, দর্শক হিসেবে আমার সামান্য অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বলতে পারি ডকুমেন্টারীটি একেবারে পারফেক্ট মনে হয়েছে । একটি স্বতন্ত্র দেশের(তখন পর্যন্ত) ব্যাপারে ধারণা দিতে যা যা দরকার, তার সবই আছে এখানে । আগেই বলা হয়েছে সত্যজিত ডকুমেন্টারীটি শুট করার জন্য সিকিমের লোকালয় থেকে শুরু করে অত্যন্ত দুর্গম পাহারী এলাকা এমনকি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থাপনা কিছুই বাদ দেননি । একজন সাধারণ ফটোগ্রাফারও যদি কোন সাইট সিয়িং করতে যায় তবে তার একটা লক্ষ্য থাকে, ভ্রমণস্থানের সুন্দর, নৈসর্গিক, স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন-যাপনের পদ্ধতি কিছুই যেন তার ক্যামেরার চোখ এড়িয়ে না যায় । এজন্য ফটোগ্রাফার মাত্রই প্রচুর ছবি সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন এবং পরবর্তীতে নিজের ভাল ছবিগুলো বাছাই করে রাখেন ।

বিশ্ববিখ্যাত নির্মাতা সত্যজিত রায়ও এই একই পদ্ধতি যে অনুসরণ করেছেন তা বলাই বাহুল্য । দৃশ্য। দেশটির কোনো আকর্ষণীয় জায়গা যাতে বাদ না পড়ে, সে কারণে সত্যজিৎ রায় প্রায় ৪০ হাজার ফিট ছবি ধারণ করেন । ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে সিকিমের রাজা-রাণীর পূর্ণ সহায়তা পেয়েছিলেন সত্যজিত । চলচ্চিত্রটিতে বৌদ্ধমঠের জমকালো দেয়ালচিত্র থেকে শুরু করে বাজারের ভিখারিও বাদ পড়েনি।

প্রাচীন উৎসবের বিখ্যাত লামা-নৃত্যের পাশাপাশি আছে বাজারে একেবারে সাধারণ মানুষের গোগ্রাসে খাওয়ার শুটিং শেষ হবার পর পাঁচ ঘণ্টা ধরে ছবির রাশপ্রিন্ট (প্রথমে ছবির যে প্রিন্ট তৈরি করা হয়) দেখা হয় কলকাতার ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। পরবর্তীকালে এক সাক্ষাতকারে সত্যজিতপুত্র সন্দীপ রায়(যিনি ছবির শুটিং এর সময় সত্যজিতের সাথে ছিলেন) বলেন, “রাশপ্রিন্ট যেহেতু প্রথম প্রিন্ট, কাজেই সেখানে রঙের সামান্য ভুলত্রুটি থেকে যায়, যা সংশোধন করার কোনো সুযোগ থাকে না এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু 'সিকিম'-এর বেলায় একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। এত উঁচুমানের রাশপ্রিন্ট আমি আর কখনো দেখিনি। “ কাজেই বোঝা যাচ্ছে ছবিটি অত্যন্ত উঁচুমানের ডকুমেন্টারি ছবি হয়েছিল।

ছবিটি দেখার জন্য রাজা-রানী দুজনই সিকিম থেকে কলকাতা এসেছিলেন। ছবি দেখার পর রাজা এবং রানী কিছু কিছু দৃশ্য (একজন লোকের নুডলস্ খাওয়ার দৃশ্য, ভিখারির দৃশ্য, রাজপ্রাসাদ ঘেরাওয়ের দৃশ্য ইত্যাদি) বাদ দেওয়ার কথা জানান। হয়ত তারা ভেবেছিলেন, এতে করে পর্যটকরা হয়ত নিরুতসাহী হতে পারেন । রাজা-রাণির এই কথায় সত্যজিত খুশি হননি । কারণ উল্লেখিত দৃশ্যগুলো ধারণ করা অল্প সময়ের ব্যাপার ছিলনা ।

আর ডকুমেন্টারীতে ধারাবাহিকতার অভাব কোন পরিচালকেরই পছন্দ হওয়ার কথা নয় । আর অপূর্ণাঙ্গতার ব্যাপার তো আছেই । (স্থানীয়দের কাঠের বাড়ি) (সিকিমের তখনকার রাজা চোগিয়েল ও তার মার্কিন স্ত্রী হোপ কুক) এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যজিৎ রায়ের মতো বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারের সব ছবি মুক্তি পেলেও 'সিকিম' নির্মাণের পর কী এমন ঘটল যে, ছবিটি মুক্তি দিতে ভারত সরকার কুণ্ঠিত হলো? ছবিটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করল? এই তথ্যচিত্রের সহকারী আলোকচিত্রী পুর্ণেন্দু বসু র মতে, “দুই সরকারেরই কথা ধরা যাক। সেই সময়ে সিকিমের জনতার মধ্যে মিশে গিয়েছিল নানা জাতির মানুষ। সিকিমের আদি বাসিন্দারা তো ছিলেনই, তাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক দিক থেকে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে ছিলেন তিব্বতি, নেপালি আর লেপচা জাতির মানুষ।

তত দিনে সিকিমের নেপালি অদিবাসীরা আন্দোলন শুরু করে দিয়েছেন। সিকিমে থেকেও নিজেদের বিশেষ আইডেন্টিটি খোঁজার জন্যই তাদের এই সংগ্রাম। স্বভাবতই সিকিমের রাজা এই আন্দোলনকে মেনে নিতে পারেননি। অথচ 'সিকিম' তথ্যচিত্রের প্রথম দৃশ্যই ছিল বাজারের এবং বাজারের অধিকাংশ দোকানদারই ছিলেন নেপালি এবং খুবই গরিব। তাদের আন্দোলন ঠিক সেই সময়ে যেহেতু শুরু হয়ে গেছে, তাই রাজা চাননি নেপালিদের দুরবস্থার চিত্র তথ্যচিত্রটিতে ফুটে উঠুক।

তিনি চাননি এতজন গরিব নেপালিকে ছবির বাজারের দৃশ্যে দর্শকরা দেখুক। কিন্তু বাস্তবে বাজার থেকে এতগুলো নেপালিকে বাদ দেওয়াও সম্ভব নয়। তখন মহারাজা চোগিয়াল ও রানী হোপ কুক উভয়েই চাইলেন তথ্যচিত্র থেকে বাজারের ছবিটা বাদ দিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু পুরো দৃশ্য কেটে দিতে সত্যজিৎ রায় আদৌ রাজি ছিলেন না। এটা তো গেল রাজবাড়ির অসুবিধার কথা।

এবার ভারত সরকারের দিকটা পর্যবেক্ষণ করা যাক। সিকিমে তখন রাজা-রানী থাকলেও অর্থনীতির দিক থেকে নানা ব্যাপারে সিকিম ছিল ভারতের ওপর নির্ভরশীল। সিকিম সরকার সেই নির্ভরশীলতা নানা দিক থেকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। যেমন পর্যটনশিল্পের কথা বলা যায়। 'সিকিম' তথ্যচিত্রটি তৈরি করা ছিল স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার জন্য একধরনের চেষ্টা।

ছবিটা দেখে সিকিমে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে যাবে। ফলে সিকিম একটু একটু করে স্বাবলম্বী হওয়ার দিকে এগিয়ে যাবে_এটাই ছিল রানী হোপ কুকের আশা। '' পুর্ণেন্দু বসু আরো বলেন, ''আর ঠিক এখানেই ভারত সরকারের ভয়। কারণ, তখনকার ভারত সরকার চেয়েছিল, অন্তত অর্থনীতির দিক থেকে সিকিম অনভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকুক। 'সিকিম' চলচ্চিত্রটি ব্যাপকভাবে দেখানো হলে সেই নির্ভরশীলতায় ফাটল ধরার সম্ভাবনা সৃষ্টি হতো।

সত্যজিৎ রায়ের এই ছবির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির বড় কারণ এটাই। '' আগেই বলা হয়েছে, সিকিমের পরবর্তী পরিণতি কিন্তু ভারতের আশেপাশের ছোট দেশগুলোর জন্য খুব একটা সুখকর কিছু না । ১৯৭৩ সালে সিকিমে সংঘটিত দাঙ্গার ফলে সিকিম ভারতের সাহায্য চাইতে বাধ্য হয়। মহারাজা চোগিয়াল তখন জনপ্রিয়তা হারাতে থাকেন। ১৯৭৫ সালে ভারতীয় সংসদে সিকিমে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব পেশ করা হয়, যে প্রস্তাবের প্রধান হোঁতা ছিলেন সিকিমেরই অন্যতম প্রধান নেতা লেন্দুপ দর্জি এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাজি।

অবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৬ মে সিকিমকে বাইশতম অঙ্গরাজ্য হিসেবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মাঝে কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মেসেজ রয়েছে । নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করলে লেন্দুপ দর্জিরা তৃতীয় পক্ষের দালালী করতে কিন্তু ভুল করবে না । কাজেই এখনি সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই । সবাইকে ধন্যবাদ ।

(সমাপ্ত) তথ্যসূত্রঃ ইত্তেফাক, সানন্দা ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.