আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাপ্তি কম হলেও কিছু ব্যবসা করতে হয়

দুই হাজার টাকা দিয়ে শুরু। এখন এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য। এক হাজার মাইলের দীর্ঘ ভ্রমণও শুরু হয় একটি পদক্ষেপ দিয়ে। এভাবেই ১৯৭৮ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের গোরখপুরের ৪২ জন ডিপোজিটরের কাছ থেকে মাসিক ১৫ টাকা কিস্তিতে 'প্যারা ব্যাংকিংয়ের' মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়েছিল সাহারার। সেদিনের সাহারা আজ ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী।

৩৪ বছরের বিরামহীন এ পথ চলায় যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই সুব্রত রায় বিশ্বাস করেন, 'তোমার সবচেয়ে ভালো যা, তা আজ বিনিয়োগ করো, মূল্যবোধের চর্চা করো, ছোট-বড় সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করো, আগামীকাল সবচেয়ে ভালো ফল তুমি পাবে। ' সাহারা পরিবারেরও এখন ফল পাওয়ার পালা। নিজের দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বাংলাদেশেও সম্প্রসারণ করতে চান সাহারাকে। এ দেশের মানুষের উন্নয়নে আবাসন, পর্যটন খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ নিয়ে গত সপ্তাহে ঢাকা সফর করে গেলেন সুব্রত রায় সাহারা। এ সময় কালের কণ্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর বিশেষ আগ্রহের কথা জানান।

গত শুক্রবার রাজধানীর রূপসী বাংলা হোটেলে তাঁর কক্ষে সাক্ষাৎকার নেন কালের কণ্ঠের বিজনেস এডিটর মাসুদ রুমী মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে পারে সামাজিক পুঁজি। এক সুতায় গাঁথতে পারে লাখো মানুষের জীবনসূত্র। তেমনি একটি পরিবার 'সাহারা'। সাহারা কোনো মরুভূমি নয়। এর হিন্দি আভিধানিক অর্থ সহায়তা বা সাহায্য।

তাই সহায়ক মানসিকতার বল নিয়েই প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রায় প্রয়োজন হয়নি কোনো বিদেশি পুঁজির। সবাই কেবল শ্রম দিয়েছেন। 'ধনবল থেকে শ্রমবলের মহত্ত্ব প্রমাণ করেছে সাহারা। '_বললেন এর ম্যানেজমেন্ট ওয়ার্কার এবং চেয়ারম্যান সুব্রত রায় সাহারা। তিনি মনে করেন কিছু ব্যবসা আছে, যেখানে প্রাপ্তি খুব কম হলেও সন্তুষ্টির জন্য করতে হয়।

কম্পানির সাফল্যের কারণ ব্যাখ্যা করে সাহারা গ্রুপের কর্ণধার বলেন, 'কম্পানির মূল মন্ত্রই হচ্ছে সবাই মিলে-মিশে কাজ করা। কম্পানির কর্মী সবাই, মালিকও সবাই। এটাই আমাদের সাফল্যের রহস্য। আমাদের শেয়ারহোল্ডোর, ডিরেক্টর, পার্টনার_সবাই ওয়ার্কার থেকে নির্বাচিত হন। আমাদের এখানে বাইরের কোনো লোক নেই, যিনি অর্থের বিনিময়ে শেয়ারহোল্ডার হয়েছেন।

' কম্পানির গোড়াপত্তনের ইতিহাস স্মরণ করে সাহারা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, '১৯৭৮ সালে মাত্র দুই হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আমি তখনো ওয়ার্কার ছিলাম, এখনো একজন ওয়ার্কার। আমাদের নীতি-আদর্শ একদম আলাদা। আমরা শপথ করেছি কেউ এই কম্পানি থেকে লাভ নেব না। এমনকি কোনো পরিবারও লাভ নিতে পারবে না।

এত বছর বয়স হয়েছে কম্পানির তার পরও কোনো ডিভিডেন্ড ডিক্লিয়ার হয়নি, প্রফিট শেয়ার হয়নি। পুরো অর্গানাইজেশনটা একটা পরিবারের মতো। আমরা যত অর্থ কামাব, এর লাভ সবার মধ্যে যাবে। এই নয় যে তা ১০ জন মিলে ভোগ করবে। ' 'মুনাফার ৪০ শতাংশ ব্যয় হয় কর্মীদের কল্যাণে, ৩৫ শতাংশ যায় কম্পানির তহবিলে এবং ২৫ শতাংশ ব্যয় হয় সামাজিক কার্যক্রমে।

'- বললেন সুব্রত রায় সাহারা। তিনি বলেন, 'মানুষই তো কাজ করে। টাকার থলেটা যদি রেখে দিই, তাহলে বাড়বে কি করে? যখন সঠিক মানুষ, অনেক মানুষ মিলে কাজটা করে, তখনই বড় কিছু হয়। ' পারিবারিক কনসেপ্ট কম্পানির অগ্রগতির জন্য একটা বিরাট কারণ বলে জানান সুব্রত রায় সাহারা। তিনি বলেন, 'মানুষ যদি মন থেকে কোনো কাজ করে, তাহলে তার প্রডাক্টিভিটিই আলাদা হয়।

আমরা এত কমিটেড, ডেডিকেটেড, ডিসিপ্লিন্ড, তা বলে বোঝানো যাবে না। সবাই দিন-রাত কাজ করে। নিজের মতো করে কাজ করে। সাহারার কর্মপরিবেশ একেবারেই আলাদা। ' সাহারার সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম (সিএসআর) ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'হিন্দুস্থানে সবচেয়ে বেশি সিএসআর আমরাই করি।

আমাদের আগে কেউ সিএসআর করেনি। সিএসআর দেখার জন্য আমাদের ১৫০ জনের আলাদা ডিপার্টমেন্টই আছে। স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট, কালচারাল ডেভেলপমেন্ট, ইটস হিউজ ওয়ার্ক। ' সাহারার পরিবারের চেয়ে বেশি সামাজিক কার্যক্রম আর কেউ করছে না বলে দাবি করেন তিনি। নিজেকে অন্য সবার মতো গ্রুপ বা কম্পানি হিসেবে পরিচয় দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।

সাহারার দাবি_'আমরাই বিশ্বের বৃহত্তম পরিবার'। নিতান্ত অসম্ভব নয় এই দাবি। কারণ ভারতজুড়ে ১০ লাখেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মসূত্রে পরিবারের সুখ, শান্তি, সন্তুষ্টি এবং ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে বৃহত্তর এই পরিবারের সঙ্গে। টাইম ম্যাগাজিন এই প্রতিষ্ঠানটিকে ভারতের রেল বিভাগের পর দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান প্রদানকারী হিসেবে গণ্য করেছে। ভারতে সাহারার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে_অর্থনৈতিক সেবা, জীবন বীমা, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আবাসিক খাতে অর্থ জোগান, অবকাঠামো ও আবাসন, সংবাদপত্র ও টেলিভিশন, বিনোদন, চলচ্চিত্র প্রযোজনা, স্বাস্থ্যসেবা, পণ্য উৎপাদন, ক্রীড়া ও তথ্যপ্রযুক্তি।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ, পর্যটন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও আইটি খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে সাহারা। এ প্রসঙ্গে সুব্রত রায় সাহারা বলেন, 'এবার বাংলাদেশে এসে অনেক কিছু জানলাম। প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টার কর্মব্যস্ততায় অনেক কিছু মাথায় নিয়েছি। যেখানে থাকি, সেই সাবজেক্টটা মাথায় ঢুকে থাকে। এখন বাংলাদেশে আছি, এই দেশটা মাথায় ঢুকে আছে।

বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা হচ্ছে। এগুলোর অনেক কিছু নোট নিয়েছি, বুঝছি। এডুকেশন, হেলথকেয়ার, ট্যুরিজম, পাওয়ারে এখানে অনেক ভালো কিছু করার আছে। ' সুব্রত রায় বলেন, 'আমরা মূলত আবাসন খাতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ এই খাতে আমাদের অভিজ্ঞতা বেশি।

এখানে মূলত একেবারে উচ্চবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তদের টার্গেট করে আবাসন গড়ে তোলা হবে। কারণ বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কম। ঢাকার জমির চড়া দামের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বম্বে ও ম্যানহাটনের চেয়ে ঢাকার জমির দামের চেয়ে বেশি। ' বাংলাদেশে পর্যটন খাত উন্নয়নে যথেষ্ট সুযোগ আছে উল্লেখ করে সুব্রত রায় বলেন, সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে সাহারার যে প্রকল্প রয়েছে, তা বাংলাদেশের অংশেও সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। আবাসন খাতে বাংলাদেশের ডেভেলপারদের সঙ্গেও মিলে-মিশে কাজের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সাহারা গ্রুপের চেয়ারম্যান।

গত শুক্রবার বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি। তিনি বলেন, 'গত কয়েক দিনে সবার সহযোগিতামূলক মনোভাব দেখে আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশে ভালো কিছু করা সম্ভব। আমরাও খুব ওপেন মাইন্ড। কিছু জমি দেখেছি। সব অঙ্ক কষে দেখব কোনটা করলে ভালো হয়।

আমার সহকর্মীরা সব জমি নিয়ে একটা রিপোর্ট দেবে, তা থেকে আমরা পছন্দের এলাকা বের করতে পারব। কোথায় কী ধরনের অপরচুনিটি আছে, তাও দেখব। ' 'আমরা যেখানেই টাউনশিপ করি না কেন, বাস সার্ভিসটাকে গুরুত্ব দিই। দেখতে হয় কোন দিকে রোডটা একটু বেশি খালি থাকে, কোন দিকে ট্রাফিক বেশি- এ রকম অনেক ছোট-বড় ফ্যাক্টর থাকে, যা বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প করা হবে। সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা সময় লাগবে।

'- বললেন সুব্রত রায় সাহারা। 'বাংলাদেশ থেকে আমাদের ছেলেরা আরো ইনফরমেশন পাঠাক। একটু সময় কাটুক। তারপর ভেবে-চিন্তে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। আসলে আমার এবং আমার সিনিয়রদের জীবনে এত বেশি বিজনেস অ্যাক্টিভিটি হয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না।

দিনে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। একেকটা টপিককে ডিল করতে ১৮ থেকে ২০ দিন লেগে যায়। অনেক জনম কাজ করিনি মনে হয়, তাই ওপরওয়ালা হয়তো বলছেন, যাও এবার গিয়ে কম্পেনসেট করে এসো, কাজ করে। সে রকম কিছু একটা হয়েছে বোধহয় আমার সঙ্গে। '- বললেন সাহারা গ্রুপের কর্ণধার।

সরকার জমি দিলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিয়ে এ দেশের আবাসন খাতে ভালো কিছু প্রকল্প করা সম্ভব বলে মনে করেন সুব্রত রায়। 'পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ এ ক্ষেত্রে ভালো অপশন হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে পিপিপি নীতিমালা এখনো হয়নি। ' বাংলাদেশে শপিংমলের ব্যবসার সম্প্রসারণের আরো সুযোগ আছে বলে মনে করেন সাহারা গ্রুপের কর্ণধার। ভারতের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, শুধু মুম্বাই শহরেই ৭০ থেকে ৮০ টি শপিংমল আছে।

ভারতে শপিংমলের আধিক্যের কারণে সেখানে এর চাহিদা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। সাহারা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, 'অনেক ব্যবসা আছে যেখানে খুব একটা রিটার্ন নেই। কিন্তু এসব ব্যবসা করতে পারলে মনে মনে খুব ভালো লাগে। একটা সন্তুষ্টি আসে। ভগমান যখন দিয়েছেন তখন সমাজকেও তো কিছু দেওয়া উচিত।

' নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহে নিজের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে সুব্রত রায় সাহারা বলেন, 'এটি বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। আমি শুনেছি এখানে প্রতিবছর এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ আর্সেনিকদূষণসহ পানিবাহিত নানা রোগে মারা যাচ্ছে। আমরা বিষয়টি খুব বিবেচনা করছি, কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করছি। ভারতে গ্রামে গ্রামে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করেছি। এখানেও বিষয়টি নিয়ে আমরা গবেষণা করে কিছু করার জন্য প্ল্যান করব।

' আর্সেনিক বিষয়টি সংশ্লিষ্টদেরও গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি। বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করেন সুব্রত রায় সাহারা। বাংলাদেশ সফরে এসে নিজের ভালো লাগার কথা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, 'খুব ভালো লাগছে বাঙালিদের ভাষার প্রতি ভালোবাসা, সম্মান, অতিথিপরায়ণতা দেখে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছি। সবাই খুবই অমায়িক। এখানে শেখার অনেক কিছু আছে।

এটা দু-চারজনের নয়, প্রত্যেকটা মানুষের। সেটা ড্রাইভার হোক আর প্রধানমন্ত্রী হোক। প্রধানমন্ত্রী নিজেও একজন সুন্দর বাঙালি। ' যেখানেই গিয়েছি ভালো লেগেছে উল্লেখ করে সুব্রত রায় সাহারা বলেন, সবাই বাংলায় কথা বলেছে। আমাদের দেশে এ ব্যাপারটা উল্টো হয়ে গেছে।

যে বাংলা ভাষা বলতে পারে, সেও ইংরেজিতে কথা বলে। ইংরেজির দরকার আছে; কিন্তু নিজের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। আপনাদের ভাষা দিবস আছে, ভাষা নিয়ে লড়াইয়ের ইতিহাস আছে। এগুলো বড় ভালো জিনিস। এখানে এসে আমার বড্ড ভালো লেগেছে।

সবাই ভালো মানুষ, সিধা মানুষ। মন খুলে কথা বলেন। ' তিনি বলেন, আমি ভুলে যাইনি আমার পূর্ব পুরুষেরা বাংলাদেশের সন্তান। বাংলাদেশের জন্য কাজ করার ইচ্ছা অনেক আগে থেকেই। শেকড়ের টান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে।

তাঁর এই শেকড়ের টান বাংলাদেশ ও সাহারা পরিবারের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এবং সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ খুলে দেবে বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনার দ্বার। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বিক্রমপুরে। এ গ্রুপের ইচ্ছা বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগী হয়ে কিছু অবদান রাখা। বললেন, 'বাংলাদেশের মানুষ আমাকে চেনে, খুব ভালো লাগে। এই মাটির সঙ্গে আবেগ আছে।

টান আছে। আমি আবার আসব। ' দুই হাজার টাকা দিয়ে শুরু। এখন এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য। এক হাজার মাইলের দীর্ঘ ভ্রমণও শুরু হয় একটি পদক্ষেপ দিয়ে।

এভাবেই ১৯৭৮ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের গোরখপুরের ৪২ জন ডিপোজিটরের কাছ থেকে মাসিক ১৫ টাকা কিস্তিতে 'প্যারা ব্যাংকিংয়ের' মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়েছিল সাহারার। সেদিনের সাহারা আজ ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী। ৩৪ বছরের বিরামহীন এ পথ চলায় যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই সুব্রত রায় বিশ্বাস করেন, 'তোমার সবচেয়ে ভালো যা, তা আজ বিনিয়োগ করো, মূল্যবোধের চর্চা করো, ছোট-বড় সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করো, আগামীকাল সবচেয়ে ভালো ফল তুমি পাবে। ' সাহারা পরিবারেরও এখন ফল পাওয়ার পালা। নিজের দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বাংলাদেশেও সম্প্রসারণ করতে চান সাহারাকে।

এ দেশের মানুষের উন্নয়নে আবাসন, পর্যটন খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ নিয়ে গত সপ্তাহে ঢাকা সফর করে গেলেন সুব্রত রায় সাহারা। এ সময় কালের কণ্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর বিশেষ আগ্রহের কথা জানান। গত শুক্রবার রাজধানীর রূপসী বাংলা হোটেলে তাঁর কক্ষে সাক্ষাৎকার নেন কালের কণ্ঠের বিজনেস এডিটর মাসুদ রুমী মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে পারে সামাজিক পুঁজি। এক সুতায় গাঁথতে পারে লাখো মানুষের জীবনসূত্র। তেমনি একটি পরিবার 'সাহারা'।

সাহারা কোনো মরুভূমি নয়। এর হিন্দি আভিধানিক অর্থ সহায়তা বা সাহায্য। তাই সহায়ক মানসিকতার বল নিয়েই প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রায় প্রয়োজন হয়নি কোনো বিদেশি পুঁজির। সবাই কেবল শ্রম দিয়েছেন। 'ধনবল থেকে শ্রমবলের মহত্ত্ব প্রমাণ করেছে সাহারা।

'_বললেন এর ম্যানেজমেন্ট ওয়ার্কার এবং চেয়ারম্যান সুব্রত রায় সাহারা। তিনি মনে করেন কিছু ব্যবসা আছে, যেখানে প্রাপ্তি খুব কম হলেও সন্তুষ্টির জন্য করতে হয়। কম্পানির সাফল্যের কারণ ব্যাখ্যা করে সাহারা গ্রুপের কর্ণধার বলেন, 'কম্পানির মূল মন্ত্রই হচ্ছে সবাই মিলে-মিশে কাজ করা। কম্পানির কর্মী সবাই, মালিকও সবাই। এটাই আমাদের সাফল্যের রহস্য।

আমাদের শেয়ারহোল্ডোর, ডিরেক্টর, পার্টনার_সবাই ওয়ার্কার থেকে নির্বাচিত হন। আমাদের এখানে বাইরের কোনো লোক নেই, যিনি অর্থের বিনিময়ে শেয়ারহোল্ডার হয়েছেন। ' কম্পানির গোড়াপত্তনের ইতিহাস স্মরণ করে সাহারা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, '১৯৭৮ সালে মাত্র দুই হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আমি তখনো ওয়ার্কার ছিলাম, এখনো একজন ওয়ার্কার। আমাদের নীতি-আদর্শ একদম আলাদা।

আমরা শপথ করেছি কেউ এই কম্পানি থেকে লাভ নেব না। এমনকি কোনো পরিবারও লাভ নিতে পারবে না। এত বছর বয়স হয়েছে কম্পানির তার পরও কোনো ডিভিডেন্ড ডিক্লিয়ার হয়নি, প্রফিট শেয়ার হয়নি। পুরো অর্গানাইজেশনটা একটা পরিবারের মতো। আমরা যত অর্থ কামাব, এর লাভ সবার মধ্যে যাবে।

এই নয় যে তা ১০ জন মিলে ভোগ করবে। ' 'মুনাফার ৪০ শতাংশ ব্যয় হয় কর্মীদের কল্যাণে, ৩৫ শতাংশ যায় কম্পানির তহবিলে এবং ২৫ শতাংশ ব্যয় হয় সামাজিক কার্যক্রমে। '- বললেন সুব্রত রায় সাহারা। তিনি বলেন, 'মানুষই তো কাজ করে। টাকার থলেটা যদি রেখে দিই, তাহলে বাড়বে কি করে? যখন সঠিক মানুষ, অনেক মানুষ মিলে কাজটা করে, তখনই বড় কিছু হয়।

' পারিবারিক কনসেপ্ট কম্পানির অগ্রগতির জন্য একটা বিরাট কারণ বলে জানান সুব্রত রায় সাহারা। তিনি বলেন, 'মানুষ যদি মন থেকে কোনো কাজ করে, তাহলে তার প্রডাক্টিভিটিই আলাদা হয়। আমরা এত কমিটেড, ডেডিকেটেড, ডিসিপ্লিন্ড, তা বলে বোঝানো যাবে না। সবাই দিন-রাত কাজ করে। নিজের মতো করে কাজ করে।

সাহারার কর্মপরিবেশ একেবারেই আলাদা। ' সাহারার সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম (সিএসআর) ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'হিন্দুস্থানে সবচেয়ে বেশি সিএসআর আমরাই করি। আমাদের আগে কেউ সিএসআর করেনি। সিএসআর দেখার জন্য আমাদের ১৫০ জনের আলাদা ডিপার্টমেন্টই আছে। স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট, কালচারাল ডেভেলপমেন্ট, ইটস হিউজ ওয়ার্ক।

' সাহারার পরিবারের চেয়ে বেশি সামাজিক কার্যক্রম আর কেউ করছে না বলে দাবি করেন তিনি। নিজেকে অন্য সবার মতো গ্রুপ বা কম্পানি হিসেবে পরিচয় দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। সাহারার দাবি_'আমরাই বিশ্বের বৃহত্তম পরিবার'। নিতান্ত অসম্ভব নয় এই দাবি। কারণ ভারতজুড়ে ১০ লাখেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মসূত্রে পরিবারের সুখ, শান্তি, সন্তুষ্টি এবং ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে বৃহত্তর এই পরিবারের সঙ্গে।

টাইম ম্যাগাজিন এই প্রতিষ্ঠানটিকে ভারতের রেল বিভাগের পর দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান প্রদানকারী হিসেবে গণ্য করেছে। ভারতে সাহারার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে_অর্থনৈতিক সেবা, জীবন বীমা, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আবাসিক খাতে অর্থ জোগান, অবকাঠামো ও আবাসন, সংবাদপত্র ও টেলিভিশন, বিনোদন, চলচ্চিত্র প্রযোজনা, স্বাস্থ্যসেবা, পণ্য উৎপাদন, ক্রীড়া ও তথ্যপ্রযুক্তি। বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ, পর্যটন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও আইটি খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে সাহারা। এ প্রসঙ্গে সুব্রত রায় সাহারা বলেন, 'এবার বাংলাদেশে এসে অনেক কিছু জানলাম। প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টার কর্মব্যস্ততায় অনেক কিছু মাথায় নিয়েছি।

যেখানে থাকি, সেই সাবজেক্টটা মাথায় ঢুকে থাকে। এখন বাংলাদেশে আছি, এই দেশটা মাথায় ঢুকে আছে। বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা হচ্ছে। এগুলোর অনেক কিছু নোট নিয়েছি, বুঝছি। এডুকেশন, হেলথকেয়ার, ট্যুরিজম, পাওয়ারে এখানে অনেক ভালো কিছু করার আছে।

' সুব্রত রায় বলেন, 'আমরা মূলত আবাসন খাতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ এই খাতে আমাদের অভিজ্ঞতা বেশি। এখানে মূলত একেবারে উচ্চবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তদের টার্গেট করে আবাসন গড়ে তোলা হবে। কারণ বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কম। ঢাকার জমির চড়া দামের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বম্বে ও ম্যানহাটনের চেয়ে ঢাকার জমির দামের চেয়ে বেশি।

' বাংলাদেশে পর্যটন খাত উন্নয়নে যথেষ্ট সুযোগ আছে উল্লেখ করে সুব্রত রায় বলেন, সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে সাহারার যে প্রকল্প রয়েছে, তা বাংলাদেশের অংশেও সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। আবাসন খাতে বাংলাদেশের ডেভেলপারদের সঙ্গেও মিলে-মিশে কাজের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সাহারা গ্রুপের চেয়ারম্যান। গত শুক্রবার বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি। তিনি বলেন, 'গত কয়েক দিনে সবার সহযোগিতামূলক মনোভাব দেখে আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশে ভালো কিছু করা সম্ভব। আমরাও খুব ওপেন মাইন্ড।

কিছু জমি দেখেছি। সব অঙ্ক কষে দেখব কোনটা করলে ভালো হয়। আমার সহকর্মীরা সব জমি নিয়ে একটা রিপোর্ট দেবে, তা থেকে আমরা পছন্দের এলাকা বের করতে পারব। কোথায় কী ধরনের অপরচুনিটি আছে, তাও দেখব। ' 'আমরা যেখানেই টাউনশিপ করি না কেন, বাস সার্ভিসটাকে গুরুত্ব দিই।

দেখতে হয় কোন দিকে রোডটা একটু বেশি খালি থাকে, কোন দিকে ট্রাফিক বেশি- এ রকম অনেক ছোট-বড় ফ্যাক্টর থাকে, যা বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প করা হবে। সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা সময় লাগবে। '- বললেন সুব্রত রায় সাহারা। 'বাংলাদেশ থেকে আমাদের ছেলেরা আরো ইনফরমেশন পাঠাক। একটু সময় কাটুক।

তারপর ভেবে-চিন্তে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। আসলে আমার এবং আমার সিনিয়রদের জীবনে এত বেশি বিজনেস অ্যাক্টিভিটি হয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। দিনে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। একেকটা টপিককে ডিল করতে ১৮ থেকে ২০ দিন লেগে যায়। অনেক জনম কাজ করিনি মনে হয়, তাই ওপরওয়ালা হয়তো বলছেন, যাও এবার গিয়ে কম্পেনসেট করে এসো, কাজ করে।

সে রকম কিছু একটা হয়েছে বোধহয় আমার সঙ্গে। '- বললেন সাহারা গ্রুপের কর্ণধার। সরকার জমি দিলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিয়ে এ দেশের আবাসন খাতে ভালো কিছু প্রকল্প করা সম্ভব বলে মনে করেন সুব্রত রায়। 'পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ এ ক্ষেত্রে ভালো অপশন হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে পিপিপি নীতিমালা এখনো হয়নি।

' বাংলাদেশে শপিংমলের ব্যবসার সম্প্রসারণের আরো সুযোগ আছে বলে মনে করেন সাহারা গ্রুপের কর্ণধার। ভারতের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, শুধু মুম্বাই শহরেই ৭০ থেকে ৮০ টি শপিংমল আছে। ভারতে শপিংমলের আধিক্যের কারণে সেখানে এর চাহিদা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। সাহারা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, 'অনেক ব্যবসা আছে যেখানে খুব একটা রিটার্ন নেই। কিন্তু এসব ব্যবসা করতে পারলে মনে মনে খুব ভালো লাগে।

একটা সন্তুষ্টি আসে। ভগমান যখন দিয়েছেন তখন সমাজকেও তো কিছু দেওয়া উচিত। ' নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহে নিজের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে সুব্রত রায় সাহারা বলেন, 'এটি বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। আমি শুনেছি এখানে প্রতিবছর এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ আর্সেনিকদূষণসহ পানিবাহিত নানা রোগে মারা যাচ্ছে। আমরা বিষয়টি খুব বিবেচনা করছি, কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করছি।

ভারতে গ্রামে গ্রামে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করেছি। এখানেও বিষয়টি নিয়ে আমরা গবেষণা করে কিছু করার জন্য প্ল্যান করব। ' আর্সেনিক বিষয়টি সংশ্লিষ্টদেরও গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি। বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করেন সুব্রত রায় সাহারা। বাংলাদেশ সফরে এসে নিজের ভালো লাগার কথা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, 'খুব ভালো লাগছে বাঙালিদের ভাষার প্রতি ভালোবাসা, সম্মান, অতিথিপরায়ণতা দেখে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছি।

সবাই খুবই অমায়িক। এখানে শেখার অনেক কিছু আছে। এটা দু-চারজনের নয়, প্রত্যেকটা মানুষের। সেটা ড্রাইভার হোক আর প্রধানমন্ত্রী হোক। প্রধানমন্ত্রী নিজেও একজন সুন্দর বাঙালি।

' যেখানেই গিয়েছি ভালো লেগেছে উল্লেখ করে সুব্রত রায় সাহারা বলেন, সবাই বাংলায় কথা বলেছে। আমাদের দেশে এ ব্যাপারটা উল্টো হয়ে গেছে। যে বাংলা ভাষা বলতে পারে, সেও ইংরেজিতে কথা বলে। ইংরেজির দরকার আছে; কিন্তু নিজের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। আপনাদের ভাষা দিবস আছে, ভাষা নিয়ে লড়াইয়ের ইতিহাস আছে।

এগুলো বড় ভালো জিনিস। এখানে এসে আমার বড্ড ভালো লেগেছে। সবাই ভালো মানুষ, সিধা মানুষ। মন খুলে কথা বলেন। ' তিনি বলেন, আমি ভুলে যাইনি আমার পূর্ব পুরুষেরা বাংলাদেশের সন্তান।

বাংলাদেশের জন্য কাজ করার ইচ্ছা অনেক আগে থেকেই। শেকড়ের টান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। তাঁর এই শেকড়ের টান বাংলাদেশ ও সাহারা পরিবারের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এবং সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ খুলে দেবে বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনার দ্বার। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বিক্রমপুরে। এ গ্রুপের ইচ্ছা বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগী হয়ে কিছু অবদান রাখা।

বললেন, 'বাংলাদেশের মানুষ আমাকে চেনে, খুব ভালো লাগে। এই মাটির সঙ্গে আবেগ আছে। টান আছে। আমি আবার আসব। ' ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।