আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক ফোঁটা শিশির নয় ‘অশ্রু’

এসো আবার চড়াই উৎড়ই.......... দিনটিকে তাপদাহের জন্য বছরের সর্ব্বোচ্চ অতিষ্ঠময় দিন বলে বিবেচনা করা হতে পারে, বছর শেষে আবহাওয়াবিদরা এর একটা নামকরণও করতে পারেন। শুধু এটুকু হলে দিনটি আবিরকে মোটেই ভাবিয়ে তুলত না, যা আবিরকে ভাবিয়ে তুলছে বর্তমানে পেটের ক্ষুধা এবং বাসায় ফেরার তাগাদা সত্ত্বেও মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুড়ে বেড়ানো। ঘুড়ে বেড়ানোর মাঝে, মানুষের সাথে দেখা সাক্ষাতের মাঝে, যে আনন্দ জড়িত থাকে তার কিছুই উপভোগ করার অবস্থা এই মহূর্তে আবিরের নেই, আসলে ব্যাপারটা উপভোগ্য হয়ে উঠার সমাজ প্রচলিত দৃষ্টিকোনে কোন কারণই নেই। রাষ্ট্র-সমাজ এই অবস্থাটাকে বড়জোড় হাস্যকর বা করুনার চোখে দেখতে পারে। এর বেশি কিছু না।

সমস্যার শুরু যেদিন থেকে, মানব সভ্যতার শুরু সেইদিন থেকেই। আবিরের ২০০০/- টাকা দরকার, আজ রাতের মধ্যেই, পরীক্ষার ফরম পূরণের আগামীকালই শেষ দিন। তাহলে, আবিরকে পাঠক চট-জলদি একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিন, এতোদিন কি ব্যাটা তুই বসে বসে ঘাস কাটছস্ ? জানসনা যে, তোর ফরম ফি পূরনের জন্য টাকা লাগবে? এইক্ষেত্রে নিতাই একটা কথা বলে উঠতে পারে, " আসলে ওর পরীক্ষা দেওয়ারই ইচ্ছে নেই"। হরিশঙ্কর বাবু অনুগ্রহ করে জিজ্ঞেস করবেন না, এতো টাকা পরীক্ষা ফি? এটা কি স্বর্গে যাবার পরীক্ষা নাকি? আমেনার মা বলতেই পারেন যে, পরীক্ষা দিয়া কি হইব? রাস্তার কুলিও যেই কথা ম্যাজিস্ট্রেটও সেই একই কথা, সবাই-ই মানুষ, এইবার না হইলে পরীক্ষা সামনের বার দিব। ভটভটি মশাইতো বলেই বসলেন "দেখো টাকা দিয়া কোন আকাম-কুকাম করতে যাইব, কিংবা এমনও হতে পারে যে বেশ্যালয়ে ঘুরতে যাইব"।

আওলাদের বাপতো বলেই বসলো তোমার বাপেরে আমার সাথে দেখা করতে কইবা। সমস্যা যাই হোক, পাঠক এরা কেউই যে আবিরের কোন উপকারেই আসবে না সেটা পরিস্কার। আবিরের এই সময়টাতে যা করবে, ঠাট্টা-মশকরা করে মজা লুটবে। কারণ, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে এটিই ঠিক, এটিই করণীয়। এর উল্টোটা যদি করে বসেন, তবে তিনি শুধু বোকাই না, উন্মাদও বটে।

জুতার শুকতলার সাথে সময় বহে চলে কালের প্রবহমান ধারায়, আবিরকে স্থির হয়ে বসে থাকতে দেখা যায়, একটা বিশাল কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায়। সাথে ধূমপান চলতে পারে সেক্ষেত্রে একটি ধূমপান বিরোধী ক্যাম্পেইনেরও আয়োজন। এরই মাঝে আবিরের টাকা অন্বেষণের খবরটি চাউড় হতে থাকে। আবিরের প্রাক্তণ বান্ধবী এই ক্ষেত্রে একটা বিশাল সমীকরণের পর সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, “এই ঘটনার সাথে নিশ্চয়ই কোন ব্ল্যাকমেইলিং এর মতো ষড়যন্ত্র জড়িত”। আবিরের এক পরিচিত আবিরকে জুয়ার আসরে আমন্ত্রণ জানায় ‘টাকা’ কামিয়ে নিতে।

ঘটনার কাল-ক্ষেপণ বাড়তে থাকে, ভূত থেকে ভূতে কল্পকাহিনী রচিত হয়। “বন্ধু পতœীরা ফ্যান্টাসীতে ভোগে”, “বন্ধুরা(?) সন্দেহে”। রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ এই নিয়ে সভা-সেমিনারের আয়োজন করেন, এই সুযোগে এমন একটা তাগড়া ছেলেকে দলে ভিড়ানোর সমস্ত রকমের রাজনৈতিক কূট-কৌশলের ফন্দি-ফিকির চলে। “সভ্যতার বাতাস শব্দে ভারী হয়”। রংয়ের কৌটায় ভার্ণিশের ঘ্রাণ।

সমস্ত কর্পোরেট আয়োজনে আবিরকে আনতেই হবে। এই সুযোগে ছেলেটারে ধর্মান্তরিত করা প্রয়োজন। ‘নারী’ হইল বশীকরণের চাবিকাঠি। মিডিয়া মোগলরা খবরটাকে লুফে নিলেন “এই সুযোগে যদি একটা কিংবদন্তীর জন্ম দেওয়া যায়”, “কিংবা একটা নতুন ধর্ম”। পুঁজিপতি বিশ্বের কর্ণধার ছুটে আসেন।

“বাউন্ডারী ভাঙ্গার কথা বলা হয়”। “সময় পাল্টেছে নতুন পৃথিবীর অস্তিত্বের ঘোষণা আসে”। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিভিত্তিক টক-শো এর আয়োজন চলে। সময় বহে যায়......................... বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র মিলে ফেসবুকে-এ একটা গ্র“প করেছে, সেখানে লিখেছে “আবিরের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসুন”। দেশের সমস্ত ব্লগেও তাই।

যে দ্বন্দের সূত্রপাত পাঠক গত এক ঘন্টা ধরে দেখে এসেছেন, এটি সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসে সমস্ত সময়ের একটি স্বাভাবিক প্রতিরূপ মাত্র। পৃথিবীর মৃত ও জীবিত সমস্ত কিংবদন্তীকে একসাথে উঠে আসতে হয় সংলাপের মাধ্যমে, নতুন কোন দ্বন্দের অবসানে। কে বলেছে, মানুষ পাল্টায়, সময় পাল্টায়? এখানে আমরা ধরে নিতেই পারি সমস্ত কিছুই স্থির, এমনকি দৃষ্টিভঙ্গিটাও। মিডিয়া মোগলদের রেষারেষি, স্বদেশী-বিদেশীদের রেষারেষি এমনকি ধর্মীয় গোষ্ঠির রেষারেষিও আবিরকে স্পর্শ করেনা। সমাজতান্ত্রিক দল এরই মাঝে জনতাকে বুঝিয়ে ফেলতে সক্ষম হয় সাম্রাজ্যবাদের দালালদের কু-কীর্তি, এরই মাঝে সমস্ত পূঁজিপতিদের নাঙ্গা করার আয়োজন চলে, সমস্ত কাঁদা ছোড়াছুড়ির অবসান ঘটিয়ে ঘোষনা করা হয়, আবির একজন ‘উন্মাদ’, ‘পাগল’, ‘বিধর্মী’, ‘নাস্তিক’, ‘মৌলবাদী’, ‘দালাল’, ‘সন্নাসী’, ‘হিজড়া’, ‘আত্মঅহংকারী’, ‘ছ্যাচঁড়া’, ‘কামুক’, ‘চরিত্রহীণ’।

কৃষ্ণচূড়ার কথা বললেই দেশের কবি-সাহিত্যিকরা বুঝে ফেলেন লাল ফুলের সৌন্দর্য, সুপ্ত মনে প্রকৃতি লালন করা কিছু পাঠকও। আবির যে সময়টুকু কৃষ্ণচূড়ার নীচে বসে তার ক্লান্ত সময়টুকু কাটাচ্ছে, সে সময়টুকুতে দেশের কবি সাহিত্যিকরা বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর বা সৃষ্টির প্রতিধ্বনি শোনার আয়োজনে ব্যাস্ত। “সাব্যসাচী লেখকের সংজ্ঞা নিয়ে, কেন রবীন্দ্রনাথ নয় নজরুল শ্রেষ্ঠ, কিংবা কেন নজরুল নয় রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠ, সেই কু-তর্কও চলে আসে”। প্রকাশকগণ একটি নতুন ‘মুরগী’ দেখতে পান আবিরের মাঝে, যে ক্রমাগত স্বর্ণের ডিম পাড়বে। ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রিজ শুনতে পায় “ ফের কোন সত্যজিত রায় বা জহির রায়হানের আগমণ ধ্বনি”।

কেউ কেউ এরই মাঝে আবিরকে গৃহছাড়া, সমাজছাড়া এমনকি রাষ্ট্রছাড়া করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, কয়েকজন বলে বসেছেন “ঈগল পাখি মুরগীর ছানাদের মাঝে থেকে থেকে মুরগী বণে যাওয়ার গল্প”। পাঠক আমরা আবিরের পদধ্বনি শুনতে পাই আবিরের মনের অব্যক্ত কথা নয়। আর তাই ফুলহীন কৃষ্ণচূড়ার গুঁড়িতে শুয়ে থাকা আবিরকে নিয়ে আমরা সুশীল-অশ্লীল, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিদ্বান-নির্বোধ, ব্যবসায়ী-ভোক্তা, কর্মকর্তা-কর্মচারী ইত্যাদি দ্বন্দে জড়িয়ে পড়ি। আবিরের সময়টুকুকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অবসান গড়ি। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির অমীমাংসিত সূত্র প্রয়োগ করি।

নীতি-অনীতির প্রশ্ন তৈরী করি। অবশেষে, দিনশেষে ঘরে ফিরি, নিজেদের কাজ-কর্মের মাঝে নিজেদের হারিয়ে ফেলতে থাকি। ক্লান্ত আবির একটা গড়ান দিতেই, গাছের গুঁড়ি থেকে নীচের বালিয়াড়িতে গড়িয়ে পড়ে, এর ফলে কোথাও কোন আঘাত না লাগলে, বিভিন্ন সিক্রেট ও আনসিক্রেট সামরিক সংস্থাসমূহ আবিরকে নিয়ে টানাটানি লাগিয়ে দেয়। পুরো সন্ধ্যাটা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে আসার পর, ঘরের দ্বারঘোড়ায় পাটাতনে বসে থাকা কুকুরটির সাথে কথা বলা নিয়ে পশুপ্রেমী ও পশুবিজ্ঞানীদের মাঝে আবিরকে নিয়ে আগ্রহ তৈরী হয়। বাসায় ফিরে আবির যখন হাঁসিমুখে বলে “এ বছর আর বুঝি পরীক্ষাটা দেওয়া হলো না”।

সভ্যতা চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে, বলেছিলাম না “ব্যাটা একটা দার্শনিক”। আবির হতাশ নয়, বসে বসে পুরোনো একটা মেশিন ঠিক করে চালানোর পর, নতুন একটা থিওরী নিয়ে চিন্তা-ভাবনার ফুসরত মিলে। বিশ্ববাসী অট্টহাঁসে হুমম............ আরেকজন নিউটন/গ্যালিলিও/আইনস্টাইন পাওয়া গেল। পরদিন ঘুম ভেঙ্গে আবির হতাশা টের পায় এবং হতাশাকে চাঙ্গা করতেই খেতে থাকে ঘরে যা পায় তাই, অবশেষে আবার ‘ঘুম’। এইখানে দেশের তথাকথিত গুনীজনরা মন্তব্য করেন “আবির একজন সাধারন মানুষ”।

পাঠক আবিরও বুঝে যে, সে একজন সাধারন মানুষ, শুধু যে প্রশ্নগুলোর উত্তর পায় না, সেগুলোর উত্তরের জন্য আপনি প্রস্তুত তো? ---পাঠক অসুস্থ কে? আবির না এই যারা সমাজে এইসব টিকিয়ে রেখেছে ? --- ‘শিক্ষা’, ‘বাসস্থান’, ‘খাদ্য’, ‌'বস্ত্র', ‘চিকিৎসা’, ‘নিরাপত্তা’ এই মৌলিক চাহিদাগুলো, একটি শিশুর জন্য যদি কোন সমাজ-রাষ্ট্র নিশ্চিতই করতে না পারে, তার অস্তিত্ব কি মেকী বা ভন্ডামী নয়? তা কি মানব সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর নয় ? পরবর্তি শীতের জন্য আবিরকে অপেক্ষা করতে হয়, মাঝে মাঝে জেগে উঠা বিষাদগ্রস্থতায় কিংবা প্রকৃতির কোন রূপে মোহাচ্ছন্ন হয়ে শিশিরে অশ্রু“ মিশিয়ে ফেলতে............। আহম্মদ শিবু ২৭/০৫/২০১২ //এই গল্পটি কোন মাস্টার-পীস নয়, এটি কোন ব্যক্তিগত কাহিনীও নয়, এটি চলমান সময়ের অস্থিরতার গল্প, পূর্বের কথাটি আবারো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি “লেখক ও তার লেখাকে গুলিয়ে ফেলে, যে সমস্ত নির্বোধের দলেরা জল ঘোলা করতে পছন্দ করেন, তাদের নোংরামী তারা যেন তাদের পকেটেই রেখে দেন// ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।