আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এখন এসএমইগুলোকে বাঁচাতে হবে

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার আধ্যাত্মিক সাধক হযরত সোলাইমান শাহ্ চিশতী (রঃ) মাজারে ৩ দিনব্যাপী ওরশ মোবারক আজ মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন থেকে নিজেরাই ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে। শুধু প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানির ঋণ ও কৃষি খাতের সুদহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের শিল্পকারখানা স্থাপন বা চলতি মূলধন প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। ৩৩/১৯৮৯ নম্বর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নমনীয় সুদহার নির্ধারণের নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।

এই নীতিমালা অনুযায়ী ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে আগের দেয়া সর্বোচ্চ লিমিট আর বহাল থাকবে না। দেখা যাচ্ছে, সুদের হার নির্ধারণের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপ করা চলে না। তাই এই ব্যবস্থা। এখন দেখা যাক, সুদের হার বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে কি কি প্রভাব পড়বে, এর ফলে ১. ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগ আরও নিরুৎসাহিত হবে।

২. শিল্পায়ন বিঘি্নত হবে। ৩. সুদের হার বাড়ার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আরও কমে যাবে। ৪. স্থানীয়ভাবে যেসব পণ্য ও সেবা সামগ্রী উৎপাদিত হয় সেগুলো প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারিয়ে ফেলার পরিণতিতে অনেক শিল্প-ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই আমাদের দেশে ঋণের সুদের হার অনেক বেশি।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর কথা বাদ দিলাম, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ঋণের সুদের হার আমাদের দেশ থেকে অনেক কম। পার্শ্ববর্তী দেশসহ উন্নত বিশ্বের শিল্প-ব্যবসার প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আমাদের থেকে অনেক বেশি। তাদের রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি ও নিরাপদ বাজার যা আমাদের নেই। আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিল্পপতি ব্যবসায়ী কেবল মানসিক শক্তির জোরে এবং প্রচ- পরিশ্রম করে তাদের অবস্থান টিকিয়ে রেখেছে। লিভারেজ সুবিধা আছে কেবল এরূপ হাতেগোনা কিছু শিল্প-ব্যবসা কিছুটা সুরক্ষিত।

সবচেয়ে নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগগুলো। আগে দেখা যেত, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প প্রকল্প বা ব্যবসায়ী উদ্যোগগুলো যেসব পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে বিপণন করত, বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সেগুলো উৎপাদন করত না। এখন সেই যুগ আর নেই। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সব ধরনের পণ্য ও সেবা উৎপাদন করছে এখন। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছে।

দেশীয় বৃহৎ শিল্প গ্রুপগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগপণ্য যেমন, আটা-ময়দা, রুটি-বিস্কুট, চিঁড়া-মুড়ি সবই উৎপাদন করে বিক্রি করছে। এদের এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি, বড় মাপের পুঁজি ও বিশাল অঙ্কের বিজ্ঞাপন ব্যয়। পক্ষান্তরে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প ব্যবসাগুলোর এই সক্ষমতা নেই। তার ওপর রয়েছে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামোগত সমস্যা। ইতোমধ্যে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এসএমইগুলোর জন্য বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

দক্ষ ব্যবস্থাপনার ঘাটতি তো রয়েছেই। এরপরেও ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পগুলোকে নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে টিকে থাকতে হয়। সরকারও এদের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে থাকে। কারণ এসব শিল্প ব্যবসাগুলো স্বল্প পুঁজির এবং শ্রমঘন। এদের দ্বারা বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।

তাছাড়া এদের মাধ্যমে জনসমর্থন ধরে রাখা যায়। ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগগুলোর মূল সমস্যা তিনটি। ১. অবকাঠামোগত ২. পণ্য উৎপাদন বিপণন এবং ৩. অর্থায়ন। এর মধ্যে অর্থায়ন তথা আর্থিক খাতের সমস্যাই প্রবল। বর্তমানে ব্যাংকগুলো যে হারে ঋণের সুদ ধার্য করে তা মোটামুটি নিম্নরূপ।

কৃষিতে সর্বোচ্চ ১৩%, পরিচালন মূলধন ১৫%, টার্ম লোন ১৩%, চাল ও নিত্যপণ্য ১২%, সাধারণ বাণিজ্যিক ঋণ ১৬-১৮%। নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের সুদের হার আরও বেশি। এসব প্রতিষ্ঠান বেশি আমানত নিয়ে যেমন মূলধন সংগ্রহ করে, তেমনি ব্যাংক ও অন্যান্য সূত্র থেকে পাইকারি হারে ঋণ নিয়ে একটি সুবিধাজনক স্প্রেড রেখে আবার তা কাস্টমার লেভেলে বিতরণ করে। এখন যদি সুদের হার আরও বেড়ে যায়, তবে পরিস্থিতি কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। প্রশ্ন হলো, সরকার কি বিষয়গুলো জানে না? নিশ্চয়ই জানে।

তবে তারা এরূপ আচরণ করছে কেন? বলা হচ্ছে আইএমএফের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নাকি এরূপ সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। মজার বিষয় হচ্ছে, আইএমএফ এরূপ নির্দেশনা দিতে গিয়ে কিন্তু একবারও বলছে না যে, ঋণের সুদের হার বাড়াতে হবে। তারা বলছে মুক্তবাজার ব্যবস্থার আলোকে বিষয়টি নমনীয় করতে হবে। এখন বাকি দায়িত্ব তো আমাদের। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক বা বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে তো পৃথিবীর প্রায় সব দেশই ঋণ নেয়।

কিন্তু বেশির ভাগ দেশই তো ব্যবস্থাপনার দক্ষতা দেখিয়ে এর মধ্য থেকেও সুফল ভোগ করে, জনসাধারণ তথা জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হচ্ছে। কেবল তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশ পারছে না এর মাধ্যমে লাভবান হতে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এসব দেশের সরকারগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত এবং জনসাধারণের কাছে তাদের কোনরূপ দায়বদ্ধতা নেই। আমাদের দেশের সরকার তো সেরূপ নয়। বরং বিশাল জনসমর্থন নিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছে।

তাদের ভিশন তো হবে অনেক বিস্তৃত এবং জনকল্যাণমুখী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সরকারগুলোর আর্থিক খাতের নীতি নির্ধারকদের জনস্বার্থের পরিপন্থী কাজ তথা নেতিবাচক কর্মকা-ের প্রতি আগ্রহ বেশি। মুক্তবাজার অর্থনীতি তো পৃথিবীর প্রায় সব দেশ গ্রহণ করেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথার প্রচলন থাকলেও ইতিবাচক অনেক কিছু রয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বলা হয়েছে, চাহিদা সরবরাহের ভিত্তিতে বাজারই সব বিষয় নির্ধারিত হবে।

কিন্তু একটি পরিষ্কার শর্তে, তা হলো বাজার হবে চবৎভবপঃষু ঈড়সঢ়বঃরঃরাব. অর্থাৎ প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় সবকিছু নির্ধারিত হবে। আইএমএফ বলছে, ৫০টির বেশি ব্যাংক যেখানে কর্মরত সেখানে একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থায় ঋণের সুদের হার কমে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নরূপ। আমাদের পণ্যবাজারে যেমন অলিগোপালি বা কার্টেল প্রথা চালু রয়েছে, ব্যাংক ব্যবস্থায়ও একই অবস্থা বিরাজ করছে। আমানতের সুদ হার নির্ধারণ থেকে ঋণ প্রদানের সুদ নির্ধারণসহ বিভিন্ন রকম ব্যাংক চার্জ আদায়ে ব্যাংকগুলোতে কোন প্রতিযোগিতা হচ্ছে না, হচ্ছে সিন্ডিকেশন।

ফলে ব্যাংকগুলোর লাভের অঙ্ক পাহাড়সম হলেও ঋণ গ্রহীতারা হচ্ছে সর্বস্বান্ত। সম্প্রতি প্রকাশিত ব্যাংকগুলোর লাভের অঙ্ক সে কথাই প্রমাণ করে। জাতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তথা ব্যবসাবাণিজ্যে যে মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে তার কোন প্রতিফলন নেই ব্যাংকের লাভের অঙ্কে। কিন্তু এর জন্য অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে। ব্যাংকের ঋণের সুদের হার বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যেই দাবি করা হচ্ছে, সরকার আমানতের ওপর সুদহারে যে লিমিট ধার্য করেছে তা তুলে দেয়ার জন্য।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার এ দাবিও মেনে নেবে। আর তাহলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে আমানত সংগ্রহের বেলায়। সরকার থেকে সর্বোচ্চ ১২% সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে আমানত সংগ্রহের জন্য। কিন্তু প্রায় সব বেসরকারি খাতের ব্যাংক ১৩.৫-১৪% হারে আমানত সংগ্রহ করছে। যদিও কাগজে কলমে ১২% দেখানো হচ্ছে।

এখানে বাস্তবতা ভিন্ন। এখন এই সমস্যার সমাধান কী? সমাধান আছে। আমানতের ওপর সুদহার বাড়ানোর দাবি অগ্রাহ্য করতে হবে। কারণ ১২% এর ওপর আমানতের সুদহার দিলে মুদ্রাস্ফীতি আর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তাছাড়া শেয়ারবাজারে এর প্রচ- নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এমনিতেই শেয়ারবাজারে সৃষ্ট ধসের কারণে নেতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সরকার সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। নতুন করে সমস্যা সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। এসএমই খাতে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে ঋণ দেয় তা কিন্তু আমানতের টাকায় নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ৫% রেটে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ দেয় এসএমই খাতের ঋণ প্রদানের জন্য।

সুতরাং আমানত এবং স্প্রেডের দোহাই দিয়ে এসএমই ঋণের সুদের হার বাড়ানোর যে কোন প্রচেষ্টা সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রুখে দিতে হবে। অন্যথায় এসএমইগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। এসএমইগুলোকে বাঁচাতে এসএমই ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে। সরকার ২০১৩ সাল নাগাদ ৮% এবং ২০১৫ সাল নাগাদ ১০% অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অনেক প্রতিকূল অবস্থায়ও আমাদের শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি ১৬% হয়েছে।

এটা ধরে রাখতে হবে। কৃষির উন্নয়ন তথা কৃষি উৎপাদন পর্যাপ্ত এবং কৃষি পণ্যের প্রাথমিক বাজার মূল্য সীমিত হওয়া সত্ত্বেও ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে গড় মুদ্রাস্ফীতি কমছে না। যদিও ভারতে তা সম্ভব হয়েছে। কৃষি খাতের মূল্যস্ফীতি নেগেটিভ হওয়ায় গড় মূল্যস্ফীতি সেখানে ৭% এর নিচে নেমে এসেছে।

আমাদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করতে শিল্পখাতের উন্নয়নের ওপর নির্ভর করতে হবে। আর স্থানীয় শিল্পের ৮০% এর বেশি হলো এসএমইগুলো। ঈড়ংঃ ড়ভ ঋঁহফ বাড়লে এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা নষ্ট হবে। ফলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা হবে সুদূর পরাহত। মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে সেই আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।