আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজ আমার ছোট ভাই-বোনের রেজাল্ট দেবে: মনে পড়ে গেল আমার রেজাল্টের সেই দিনগুলো

১২ জুন ২০০৭ এর কথা, সাকাল থেকে আমার আশেপাশের মানুষগুলা কেমন জানি আড় চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো কৌতুহল, নতুবা সন্দেহ। কারন আজ যে আমার দাখিল (SSC) পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। সাকাল থেকে বন্ধু মহলের ফোনে আব্বু বিরক্ত। কারন তখন তো আর দশম শ্রেনীতে পড়া ছেলার মোবাইল থাকত না।

যাই হোক, বন্ধুরা সবাই খুব চিন্তিত, সাথে অধৈর্যও, কি জানি হয়। আমাদের সময় তো আর জ়ে.এস.সি আর সমাপণী ছিলনা, এই ১০ম শ্রেনীর দাখিল পরীক্ষাই ছিল প্রথম বড় কোন মুল্যায়ণ। দুপুর থেকে পাঞ্জাবি পরে বসে আছি , আব্বু এসে মাদ্রাসায় নিয়ে যাবে। সেখানে ৪টা ৩০ এ রেজাল্ট আসার কথা। দুপুর তখন ৩ টা , আমি ঘামছি, পাঞ্জাবি অর্ধেক ভিজে গেছে আমার ঘামে।

ক্ষানিক পরেই আব্বু মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির। সাথে সাথে উঠে পড়লাম পিছনে। হাত পা কাপছে না, সমস্ত শরীরই কাপছে। ৩: ৩০ এর দিকে যখন মাদ্রাসার কাছে চলে আসলাম , বিড়াল – কুকুর (cats and dogs) আকারের বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। এর ফলে হাতে গোনা কিছু বন্ধু ছাড়া কেউই আসতে পারল না সেদিন।

৪ টা ৩১ বাজে , আপেক্ষা করছি রেজাল্ট এর, হঠাত একটা পাজেরো গাড়ি মাদ্রাসার মেন বিল্ডিংয়ের সামনে দাড়ালো, আনুমান করছি রেজাল্ট এসেছে। হঠাত ৫ মিনিটের মধ্যে আমাদের আবিভাবকদের দৌড়া- দৌড়ি শুরু। সবাই একটা ঘরের দিকে উসাইন বোল্টের গতিতে ছুটে গেল। সাথে সাথে, বুকের ভেতর কি জানি একটা লং জাম্প দিল। বন্ধুদের সবার মুখের দিকে চেয়ে বুঝলাম, একই জিনিস তাদের ভেতরও জাম্প দিয়েছে।

ক্ষনিকের মধ্যে আমাদের ডাক পড়লো। দেখলাম আমার আব্বুর কাছে রেজাল্টের শিট, আমায় বলল তোর রোল খোজ। প্রথম রেজাল্ট শিট টা হাতে নিলাম। প্রথম দুই পেজ উল্টালাম , আমার রোল নাই। কিন্তু সেই দুই পেজের রেজাল্ট দেখে আমি সেখানে আর্ধেক শেষ।

৪ পেয়েছে ৩ জন, বাকী সবাই ৩ এর ঘরে। হঠাত আমার রোলের দিকে নজর পড়ল, পাশের ৫.০০ দেখে ভেতরে আবার একটা লং জাম্প আনুভুত হল। তাকালেম পাশে আব্বুর দিকে, তার চেহারা দেখে বুঝলাম তারও সেম কেস। প্রকৃতি যেন নিরবে, শব্দহীন ভাষায় আনন্দটুকু আমাদের ভেতর ছড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষকদের জানিয়ে চলে আসলাম বাড়িতে।

তারপর আর কি, পরবর্তী ৩ দিন আব্বুর পকেট খালি হতে থাকলো। আমার বিগত ২ মাসের অপেক্ষা, ১ মাসের পরীক্ষা, আর দীর্ঘ ২ বছরের প্রচেষ্টা সবই তার পর্যাপ্ত স্বীকৃতির হয়তো একটু বেশিই পেলছিল সেদিন। ৩ মাস আগে যখন প্রথম পরীক্ষা দিতে যায় , কি উদ্বেগ, কত কৌতূহল ভেতরে। নতুন পাঞ্জাবি গুলো আলাদা করে রেখেছি্লাম পরীক্ষায় পরে যাব বলে। মাদ্রাসায় যেহেতু আল-কুরআন দিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়, সেহেতু ওজু করেই সবাই যায়।

কিন্তু , বাড়ি থেকে বের হওয়া থেকে পরীক্ষা হলে যেতে যেতে আর্ধেকেরই হয়ত সেই আযু থাকেনা। থাকার ও কথা না। মানুষ ভয়ে, আর চিন্তায় পড়লে আসলেই যে এত প্রতিকর্ম করে থাকে, সেদিন টের পেলাম। বিগত এক বছর যাদের সাথে ক্লাস করেছি , তাদের সাথে দেখা হল শেষের পরীক্ষায়। শুধু সেই চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষায় সবাই একত্রে এক সেন্টারে আসলাম।

কারনটাও বিরল। ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাস, আশে পাশের সুভাকাঙ্খিদের উপদেশ, আমার বাবা যেন আমায় জিলাপি হুজুর না বানান( আর্থাত মিলাদ পড়াব আর, বাড়ি জিলাপি আনবো) । সাথে সাথে বাপ-বেটা আর কওমি মাদ্রাসায় না পড়ার পণ করে বের হলাম নতুন মাদ্রাসার খোজে। বাসাই আম্মু বেজায় বিরক্ত। কারন তার স্বপ্ন ছিল ছেলে হাফেজ হবে, সেটা তো দুরের কথা , আমি কিনা খারেজি লাইনও ছেড়ে দিলাম।

এখন মডার্ন হুজুর হবার প্রক্রিয়াধীন। খুজতে খুজতে পেয়ে গেলাম এক আদ্ভুদ ধরনের ইন্সটীটীউট। পুরাই কওমি ফেল। আধুনিক শিক্ষক আর সিলেবাসের সাথে কওমি গ্রাজুয়েট শিক্ষদের সমন্বয়ে এক অসাধারণ মাদ্রাসা । আমার মাদার ও খুশি, ফাদারও খুশি।

আমি পড়লাম চিপায়। ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জীবনের যে গুরুত্বপূর্ণ সময় আমার ওখানে কেটেছে , যেন মনে হয় সবকিছুই দেখে ফেলেছিলাম। বন্ধুত্ব, শত্রুতা, মান- আভিমান, ভালবাসা, ঘৃণা, আদর, শাস্তি, আনন্দ-উল্লাস, ফাকিবাজী, ক্রিকেট, ফুটবল খেলা কিছুই বাদ যায় নি এই সামান্য সময়ে। বাদ গিয়েছে শুধু লেখা-পড়া। কওমিতে ১ম-২য় হতে পারলেও, এখানে চেষ্টা করেও কোনদিন ২৫ এর ভেতর আসতে পারিনি।

অসাধারন সব টেলেন্টেড ছেলেগুলাকে যেন সব আল্লাহ আমার ব্যচের জন্যে পাঠিয়েছিলেন। আর বড় যেই ভাইগুলা ছিল, তার যেন আরো এককাঠি বেশি টেলেন্টেড। তারা সবাই নিজ নিজ স্বপ্নের মতই বড় আর প্রশস্ত ছিল। আর আমার স্বপ্নটা ঠিক তাদের মতই বড় হতে চাইতো, যা কিনা আমার চেয়েও ৪ ইঞ্চি লাম্বা। বক্তৃতা, আল-কুরআন তেলাওয়াত, হামদ-নাত , রেজাল্ট, সবে তারা এগিয়ে।

এমন কি তারা অধিকাংশই হাফেজ ছিল। মাঝে পড়ে আমার লাভ হয়েছিল এতটুকুই যে, আমি ২০০৪ সালে ক্লাস ৭ আর ৮ এক সাথে পাশ করি। বাংলাদেশে আর কোথাও এমন হয় কিনা আমার জানা নাই, সেখানে হতো। হাফেজি পড়তে যে সময় ব্যয় হয়, সেটা পুষিয়ে দিতে এই ব্যবস্থা কতৃপক্ষের। এটাই শেখ আব্দুর রাজ্জাক ইসলামি ইন্সটিটিউট, যেটাকে তখনকার যশোর শহরের ঢা.বি/ বুয়েট বললে ভুল হবেনা।

সমস্যা একটাই যে, কতৃপক্ষ দাখিল পরীক্ষার জন্য স্পেশাল সিলেবাস বা ব্যবস্থা রাখেন না। আধিক খারেজী লাইনের পড়ার চাপ থাকায়, ৯ম শ্রেনীতে কিছু সিলেবাস কাভার করে, আর ১০ম শ্রনীর শেষের দিকে পুরো দোমে শুরু প্রস্তুতি নেয়। আবার এটা সরকারি ছিল না বলে, আমাদের রেজিস্ট্রেশনও করতে হত অন্য মাদ্রাসা থেকে। যাদের হয়ে আমরা পরীক্ষা দিতাম। এটা আমার বাবার ( রেশনাল বলেই কিনা) পছন্দ হলো না।

রেজিস্ট্রেশন করলেও, ১০ম শ্রেনীর ক্লাস করতে আমায় ভর্তী করে দিল যশোর আমিনিয়া আলিয়া মাদ্রাসায়। হঠাত নতুন একজনকে দেখে সবারই চোখ কপালে উঠলো প্রথম কিছু দিন। এটাও কি সম্ভব? তারা ভাবতে লাগলো। চিন্তা আর যুক্তির তালগোল পাকিয়ে তারা বের করলো, হয়তো সম্ভব ( কারন বাংলাদেশ ঠিক তখনই তো দুর্ণীতিতে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছিল)। কিন্তু এটা দুর্ণীতি ছিলনা, একটু সজনপ্রীতি আর মহানুভবতা থাকতে পারে।

কারন আমি শুধু ক্লাস গুলা করেছিলাম। পরীক্ষা কিন্তু আগের মাদ্রাসর হয়েই দেয়া লেগেছে। আমিনিয়া মাদ্রাসা শুধু আমায় নিঃস্বার্থ সাহায্য করেছিল ভাল রেজাল্ট করতে। আসাধারন বান্দর টিইপের কিছু বন্ধুর পাশা পাশি মেধাবি কিছু বন্ধু জুটল এখানে। প্রথম পরীক্ষায় আংকে ৪০ পাওয়ার পর বুঝতে পারলাম , সামনের পথটা খুব একটা বন্ধুর বই, নিরাপদ হবেনা।

১ টা বছর অনেক চেষ্টা করলাম । ক্লাসে ভাল ফলের সাথে, দাখিলেও ভাল রেজাল্ট হল। শুধু হতাশ হলাম পুরানো মাদ্রাসার সেই পুরানো বন্ধুদের রেজাল্ট এ। তারা আমার চেয়ে মেধাবী ছিল ঠিকই, কিন্তু প্রস্তুতি, অনুশীলনের ঘাটতি এবং বিলম্বই শেষপর্যন্ত তাদের কাল হয়ে গেল। পরে এই একই মাদ্রাসায় আলিমে ভর্তি হয়েছিলাম, ফার্স্টও হয়েছি, ক্রিকেট খেলায় শুধু চেম্পিয়নই হয়নি, ম্যান আদ দা সিরিজও হয়েছি।

আসাধারন সেই মাদ্রাসা লাইফ আমার। আজ যখন ভাবছি দাখিল/ssc এর রেজাল্ট দেবে, আমার সেই দিনগুলো স্মৃতিপটে ভেসে এল । দেরি না করে লিখে ফেললাম। পুথিগত স্মৃতি হয়ে হলেও, থাকুক না এখানে  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।