আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যখন গিয়েছে পড়ে ক্যারিয়ারের ঝোল

বাস্তবতার ভার্শন ২.০.৩ তে আছি, নিয়মিত আপডেট হচ্ছি। গত ১০ দিন পর বাসায় পানি আসাতে সব শার্ট আর গেঞ্জি ধুতে দিয়েছিলো আসিফ। তাই বাসা থেকে বের হতে চেয়েছিলো পুরনো ছোট গেঞ্জি গায়ে দিয়েই! উহু আটছিলো না! পেট বের হয়ে আসছে, কাধের তলার দিকে তাকালো, সেলাই ফেটে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছ! পাঞ্জাবী বলতে গেলে পড়া’ই হয় না! ঈদের সময়’ও না! সেই ২০০৯ সালের এক পাঞ্জাবী দিয়েই এখনো পার করছে! তবুও আজকে বাধ্য হয়ে পাঞ্জাবী গায়ে দিয়েই বের হতে হলো! মুখে খোচা খোচা দাড়ি। হাতে তিনটা টিফিন ক্যারিয়ার, একটা বাবার, একটা ভাইয়ার আর আরেকটা তাদের ম্যানেজারের! হরতালের জন্য বাবা আজ গাড়ি নিয়ে যায়নি দোকানে, তাই তাকেই দুপুরের খাবার নিয়ে যেতে বললো! তাদের বাসায় এটা হরতালের একটা ঐতিহ্য’ও বটে! যেদিনই হরতাল হবে, বাবা দুপুরে বাসায় আসবে না, কিংবা শো-রুমে খাবার’ নিয়ে যাবে না! তাকেই তখন টিফিন ক্যারিয়্যার নিয়ে যেতে হয়। ছোটবেলা থেকেই হরতালের সময় নিয়ে যেতে হয় বলে এটাকে সে হরতাল পালনের একটা অংশ হিসেবেই জানে! বাসা থেকে বের হলো, হাতে টিফিন ক্যারিয়ারগুলো ভালো করে ধরতে পারছিলো না।

একদিকে ক্যাঁৎ হয়ে পড়ছিলো। মা ৭০টাকা যাতায়াত ভাড়া দিতে দিতে বলে দিয়েছিলো সাবধানে রাখবি, যেনো ক্যাঁৎ হয়ে না যায়। ঝোল যা আছে সব পড়ে যাবে। আসিফের কথা হলো, ক্যাঁৎ করলে যদি ঝোল পড়েই যায়, তাহলে টিফিন ক্যারিয়্যারের দরকারটা কি? টিফিন ক্যারিয়্যার হলো খাবারের কাপড়, মানুষ যেমন তার দেহ ঢেকে রাখে কাপড় দিয়ে, তেমনি টিফিন ক্যারিয়্যার খাবারগুলোকে ঢেকে রাখে। মানুষের শরীরেও তো কত ঝোল বের হবার জায়গা আছে, কই সেখান থেকে তো চাইলেই ঝোল পড়ে না! এসব সাত-পাচ ভাবতে ভাবতে সে উত্তর ছায়াবিথী মোড়ের সামনে এসে দাঁড়ালো! পুরো রাস্তাই ফাকা।

ক্রিকেট খেলতে পারলে খারাপ হতো না। গত বিএনপি আমলে এরকম কোন এক হরতালের সময় সে পেপারে পরেছিলো তারেক জিয়া আর কোকো দুই ভাই মিলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ক্রিকেট খেলছে। তার’ও সেরকম খেলতে ইচ্ছে হচ্ছে! যেনো এ মুহুর্ত্যে ক্রিকেট খেললেই সে তারেক জিয়া কিংবা কোকো হয়ে যাবে। পরক্ষণেই তার মনে হলো, আরে তারেক কোকো হলেই তো লোকে তাকে দূর্ণীতিবাজ মনে করবে। উদ্ভট সব চিন্তা করতে করতে দেখতে পেলো বুড়া কিসিমের একটা রিক্সাওয়ালা আসতে আসতে এগিয়ে আসছে।

সে বুড়া রিক্সাওয়ালাদের রিক্সায় সাধারণত চড়ে না। এগুলো খিটখিটা ধরনের হয়, ভাড়াও বেশি চায়, আর সারাক্ষণই গুটুর গুটুর করতে থাকে। তাই এদেরকে আসিফের পছন্দ না। তবুও এই দুর্মূল্যের বাজারে সে রিক্সাওয়ালাটাকে ডাকলো, -এই মামা, যাবা নাকি? -কই? -শিববাড়ী। -৬০টাকা।

-পাগলে পাইছে, ১৫টাকার ভাড়া ৬০ টাকা চাও! -আজকে সবাই এমুনই দিছে। -২০ যাবা? -একদাম ৫০ যাবাইন? -সামনে বাড়াও। আসিফ জানতো এই বুড়ারা খারাপ কিসিমের হয়। অহেতুক বাড়তি ভাড়া চায়। সে ডিসাইড করলো হেটেই চলে যাবে।

বেশি দূর তো না, মাত্র দুই কিলো! দোকান থেকে ৩টা মার্লব্রো সিগারেট কিনে একটা ধরিয়ে মুখে পুরে হাটতে লাগলো। রোদ পড়েছে প্রচুর। পকেট থেকে সানগ্লাসটা বের করে পড়লো। ঠোটে জ্বলন্ত সিগারেট, হাতে ক্যাঁৎ হয়ে যাওয়া তিনটা টিফিন ক্যারিয়্যার নিয়ে হেটে যেতে যেতে মসজিদ মার্কেট এলাকা পার করে শিববাড়ী মোড়ের কাছাকাছি আসলো। দূর থেকে দেখতে পেল একটা পুলিশ পেট্রোল টিম লোকজনকে ধরে ধরে তল্লাশী করছে।

তাদের তল্লাশী করার স্ট্যাইলটা অনেকটা যুদ্ধের মতো। পারলে প্যান্ট খুলে দেখে। ৭১ এর কয়েকটা বইয়ে আর মুভিতে সে এরকম দেখেছে, লোকজন হাত তুলে দাঁড়ায়, আর রাজাকার ও পাকিস্তানীরা প্যান্ট লুঙ্গি খুলে উকি মেরে দেখে খতনা আছে কি নেই। এর অবশ্য খতনা দেখবে না, তবে পুরো শরীর তল্লাশী করে দেখবে। বাম দিকের দোকানগুলোর দিকেও তার চোখ গেলো।

কয়েকটা মহিলা পুলিশ’ও দাঁড়িয়ে আছে দোকানের ছাউনীর তলে। মনে মনে ভাবতে লাগলো ছেলে পুলিশগুলো মেয়েদের তল্লাশী করবে আর মেয়ে পুলিশগুলো ছেলেদের তল্লাশী করবে, তাহলেই তো দুই পক্ষই সেধে সেধে নিজেদের তল্লাশী করাতে আসবে। কোন কাজ না থাকলেও একবার এ মাথা থেকে ও মাথে অযথাই ঘুরাঘুরি করবে এই এক তল্লাশী খাওয়ার জন্য! আস্তে আস্তে সে চেকপোস্ট পর্যন্ত এগিয়ে আসলো। ওসি নিজে পর্যন্ত ফিল্ড ওয়ার্কে নেমে পড়েছে, আর হাবিলদার, ঠোলাগুলো এখনো গাছতলায় বসে আরাম করছে। মেয়ে পুলিশগুলো তো মনে হয় এখনো ডিউটিতেই নামেনি।

ওসি আসিফকে জিজ্ঞাস করলো, -কোথায় যাওয়া হচ্ছে? -যেখানে অর্ডার পড়েছে! ওসির নাম “আলাউল জোয়ার্দার। ” তাগড়া লোক। নেমপ্লেটের নাম পড়তে পড়তে ওসি’র পুরো শরীরটা এক পলক দেখে নিলো। পেট বেড়িয়ে আছে। ঘুষের পেট।

যে যা দেয়, খুশি হয়ে নেয় মনে হয়। সে’ও চোখে কালো সানগ্লাস লাগিয়েছে। একটা মোটা খানদানি গোফ’ও আছে। তাকে দেখতে দেখতে ওসি আবার তাকে জিজ্ঞাসা করলো, -কিসের ওর্ডার? -মাল ডেলিভারী দেওয়ার! ওসি সাহেব আর তার সাথের ঠোলারা কানাকানি করে কি যেনো বললো। কথা বলা শেষ হতেই একটা বেটে বাটকুল ঠোলা এগিয়ে আসলো তার কাছে, কোন কিছু বলবার আগেই হাত থেকে কেড়ে নিলো টিফিন ক্যারিয়্যার তিনটি।

আসিফ তাড়াতাড়ি চিৎকার বলে উঠলো, -ক্যাঁৎ করবেন না, সর্বনাশ হয়ে যাবে। আসিফের চিৎকার শুনে ঠোলাটা ভয়ে হাত থেকে তিনটা টিফিন ক্যারিয়্যারই ফেলে দিলো। ওসি ও তার আশেপাশের লোকজন কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। আসিফ তবুও কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো। পড়ে যাওয়া টিফিন ক্যারিয়্যার তিনটি তুলে নিতে গিয়েই পেছন থেকে একটা লাঠির বাড়ি তার কোমরে এসে পড়লো।

আচমকা এমন বাড়ি খেয়ে মাটিতে উবু হয়ে শুয়ে পড়লো। আর সঙ্গে সঙ্গেই আরো কয়েকটা বাড়ি তার হাঁটু, পা কোমর, পিঠ, মাথায় এসে পড়তে লাগলো। এমন সময় তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে লাইটার আর বাকী দুইটা সিগারেট পড়ে গেলো। ওসি হাপাতে হাপাতে বলতে লাগলো, -এহ শিবির হয়ে আবার গাঞ্জা খায়! এদিকে আসিফ পুরো বেকায়দায় পড়লেও বুঝতে পারলো, যে কেনো তাকে এতক্ষণ মারা হলো। বুঝার সঙ্গে সঙ্গেই সে বুদ্ধি করলো যে করেই হোক, তাকে পালাতে হবে, নাহলে তাকে গ্রেপ্তার করলে না জানি আরো কয় দিন হরতাল দেয় বিএনপি কে জানে? বুকে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে সে এগুতে লাগলো টিফিন ক্যারিয়্যারটার দিকে, ওপাশ থেকে এলপাতাড়ি লাঠিচার্জ চলছেই।

অবশেষে আসিফ তার টিফিন ক্যারিয়ার তিনটার একটার নাগাল পেলো। আর সাথে সাথেই বুকে জড়িয়ে ধরে হুঙ্কার দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, আর বললো, আর যদি কাছে আসছিস, তো এটার মুখ খুলে ফেলবো, এটা বলতে বলতে আসিফ চারপাশটা দেখে নিলো, দেখলো মসজিদ মার্কেটের কাছাকাছি পুলিশের টহল গাড়ি,আর একটু দূরেই একটা বাস থেকে যাত্রীরা হু হু করে নামছে, ভেবেছে মারামারি হচ্ছে বোধহয়। আসিফ আর কোন দিকে না ভেবে কোনমতে দুইটা টিফিন ক্যারিয়্যার নিয়ে একটা ভো দৌড় দিলো। ঠোলা গুলো’ও দৌড়াতে লাগলো, তবে আসিফের গায়ে তখন অসুরের শক্তি। আসিফ দৌড়ে বাসটায় উঠে পড়লো।

ঠোলাগুলো দৌড়ে উঠতে পারলো না। একপ্রকার বলা যায় এ যাত্রায় বাস-ড্রাইভারই তাকে বাচালো। ঠোলাগুলো তাকিয়ে আছে চলে যাওয়া বাসটির দিকে, দৌড়ে তাকে ধরতে না পারায় এখন টহল গাড়িকে ইশারায় ডাকছে। এদিকে বাসের সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। জানতে চাইলো কি হয়েছে? আসিফের তেমন কোন ভাবান্তর হলো না! এতক্ষণ পুলিশের এলোপাতাড়ি বাড়ি খেয়ে সে এখন পর্যদুস্থ।

কোনমতে বাস থেকে নেমে সে তার বাবার দোকানে গেলো। ছেলের এমন অবস্থা দেখে বাবা ফিট হয়ে যায় যায়, কালো পাঞ্জবীর উপরে রক্তের হাল্কা হাল্কা ছোপ, ঠোট, কপাল, মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। দৌড়ে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলো, -কি হয়েছে? পিকেটাররা ধরেছিলো? আসিফ কোন কথা বললো না, চুপচাপ বসে পড়লো চেয়ারটা টেনে। পুরো কাহিনী সে আবার বললো শো-রুমের সবার সামনে। এদিকে ওসি ও তার ঠোলা বাহিনী এখনো ধান্দার মধ্যে আছে! পাশের র‍্যাব টিম এখন ডিউটিতে চৌরাস্তায় আছে।

আসতে আসতে আরো প্রায় মিনিট দশেক লাগবে। এই টিফিন ক্যারিয়্যারকে কি করা যায়? ভাবতে ভাবতে তিনি উপরের মহলে ফোন করতে লাগলেন। র‍্যাবের স্পেশ্যাল বোম্ব ডিফিউজ টিম এসে পড়েছে। টিফিন ক্যারিয়্যারটাকে প্রথমে আস্তে করে তুলে পানির বালতিটার মাঝে রাখলো। দশ থেকে পনেরো মিনিট রাখবার পরে সাবধানে তুলে নিয়ে টিফিন ক্যারিয়্যারের মুখটা খুলে যখন দেখলেন গরুর মাংসের তরকারী আর আলু ভর্তা, তখন র‍্যাবের ক্যাপ্টেন মোর্শেদ একবার ক্যারিয়্যারের দিকে তাকায় আরেকবার ওসি’র দিকে তাকায়! একটা ধমক দিয়ে তিনি বললেন, -এইসব কি? -আমি কি করে বলবো? -আপনারা যদি এই সামান্য চেকটুকু করতে না পারেন, তাহলে কি করে হবে? -তা আপনারা চেক করলেই পারেন।

-শুধু তো ঐ কথাই বলতে শিখেছেন? ভুড়িটার দিকে কি একবার’ও চোখ যায়? -দেখুন ভদ্রভাবে কথা বলুন। র‍্যাবের ক্যাপ্টেন আর কোন কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসতে গেলেন। ড্রাইভার ইঞ্জিন স্ট্যার্ট দিতে দিতে ক্যাপ্টেন মোর্শেদ ওসি জোয়ার্দারকে বললেন, এরপর থেকে একটু ভালোভাবে নজর রাখবেন। র‍্যাবের পেট্রোল চলে গিয়েছে। ওসি জোয়ার্দার এখনো তাকিয়ে আছেন।

আশেপাশের লোকজন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তিনি একটা ধমক দিলেন। কোন কাজ হলো না! তারপর রাগত ভঙ্গিতে হাটতে হাটতে তিনি টিফিন ক্যারিয়্যারের বাটিগুলোর কাছে গেলেন। গোছাতে গিয়ে তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। কে যেনো তার আর ক্যাপ্টেন সাহেবের কথা বলার সময় বাটির সব তরকারী খেয়ে কেটে পড়েছে।

মাংসের টুকরাটা দেখার পর পরই তিনি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন, তিনি এই তরকারী দিয়ে ভাত খাবেন। তিনি সব সেন্ট্রিদের ডাকলেন, অন্য জায়গায় ডিউটিতে যেতে হবে। এখানে অনেক্ষণ সময় পার হয়ে গিয়েছে। হঠাতই তিনি খেয়াল করলেন, তার একজন সেন্ট্রির ঠোটের চারপাশে হলুদ ঝোল লেগে আছে। বুঝতে আর বাকী থাকলো না যে সে’ই তার মাংসের টুকরাটা মেরেছে।

এতো কষ্ট করে শিবির মনে করে ছেলেটাকে পেটালাম, বিনিময়ে এক বাটি তরকারী পেলাম, সেটাও সাবার করে দেয় আরেকজন! পুলিশের চাকরীর এই এক জ্বালা! কখন যে কে ধান্দায় পড়ে যায় কেউ বলতে পারে না! বিঃদ্রঃ কাহিনীগুলো অনেক এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। কল্পনাপ্রসূত কাহিনী, তাই ভুল ক্রুটি অন্য যেকোন গল্পের চেয়ে বেশি। তাই ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবার জন্য অনুরোধ রইলো! আরেকটি অনুরোধ, ভুল থাকলে চোখে ধরিয়ে দিন! এটি'ই বেশি দরকারি! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।