আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশি প্রতারক

'মাত্র নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া। এ জন্য মেলেনি বোর্ডের সার্টিফিকেট। দুই নামে ব্যবহার করেন সাতটি পাসপোর্ট। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেন না। স্বাক্ষর জালিয়াতির ফাঁদে ফেলে জিম্মি রাখেন ব্যাংক কর্মকর্তাদের।

ভুয়া দলিলে জমি দখল করে প্রকৃত মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। টাকা ধার নিয়ে শোধ করার পরিবর্তে হুমকি দেন। প্রতারণার শিকার সাধারণ মানুষ মামলা ছাড়া তেমন প্রতিবাদ করতে পারেন না। ' খোদ সরকারের বিশেষ এক গোয়েন্দা সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে এসব কথা। কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যানের দেওয়া সনদপত্র অনুসারে এই প্রতারকের নাম আবদুল মান্নান মজুমদার।

নিজ এলাকা কুমিল্লায় পরিচিতি 'মামলাবাজ ও কিডনি মান্নান' নামে। একের পর এক প্রতারণার ঘটনা জানার পর বাংলাদেশ ব্যাংকও দেশের সব ব্যাংককে দেওয়া এক চিঠিতে মান্নানের ব্যাপারে সাবধান করে দেয়। মান্নানের ফাঁদে পড়ে অগ্রণী, সোনালী, কৃষিসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি সাত ব্যাংকের ১৩ কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছেন। প্রতারণার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন এক ব্যাংক ম্যানেজার। শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ, মামলাবাজ মান্নানের কারণে এখন নিঃস্ব মানুষের সংখ্যা কয়েক হাজার।

পাল্টা মামলা দিয়ে তটস্থ রাখেন বলে নতুন করে কেউ মুখ খুলতেও সাহস পান না। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী মান্নান ১৯৮৭ সালে পুরান ঢাকার ৭/১ মনির হোসেন লেন, নারিন্দায় ৫০০ টাকা ভাড়ার এক রুমে সাবলেট থেকেছেন। এখন ঢাকা, কুমিল্লা, সাভার ও নারায়ণগঞ্জে তাঁর নামে আছে শত শত বিঘা জমি। রাজধানীর নয়াপল্টন, শান্তিনগর, বনানী ও ধানমণ্ডিতে কয়েক কোটি টাকা মূল্যে কিনেছেন চারটি অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট। চড়েন বিএমডাব্লিউ, প্রাডো, ল্যান্ড ক্রুজারসহ পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়িতে।

প্রতারণা শুরু যেভাবে : মান্নান ১৯৮৭ সালে ঢাকায় এসে নারী ও শিশু পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। উচ্চবেতনে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-শিশু ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করতে থাকেন। টাকার বিনিময়ে কিডনি বিক্রি করে দিয়ে অনেককেই অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন। মান্নানের প্রতারণার শিকার কুমিল্লার মোসলেম ও শাহীন ভারত থেকে পালিয়ে এসে কিডনি বিক্রির লোমহর্ষক কাহিনী ফাঁস করেন ১৯৯১ সালে। মানুষের কিডনি বিক্রির দায়ে ভারতের পুলিশও মান্নানকে গ্রেপ্তার করে।

কিছুদিন জেল খেটে জামিনে ছাড়া পেয়ে দেশে ফেরেন মান্নান। এরপর মান্নানের বিরুদ্ধে শিশু অপহরণের অভিযোগে জনৈক জয়নাল আবেদীন মামলা করলে গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৯৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি জেলে যান মান্নান। কিছুদিন পর কুমিল্লার চান্দিনা থানার আরেকটি শিশু অপহরণ মামলায় প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয় তাঁর। এ মামলায় ১৯৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে কিছুদিন জেলও খাটেন মান্নান। জামিনে ছাড়া পেয়ে পরিচিত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নাম ও ছবি ব্যবহার করে জমির জাল কাগজপত্র দিয়ে মোটা অঙ্কের ঋণ নিতে শুরু করেন।

ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে কখনো নিজের, কখনো পরিচিতদের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করতেন। আর ব্যাংকে মর্টগেজ রাখার ক্ষেত্রে দিতেন নিজের নামের সম্পত্তি। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আবদুল মান্নান মজুমদার নিজে এবং তাঁর মা রোকেয়া বেগম, স্ত্রী ফেরদৌসী মজুমদার ও পুত্র মাজহার আলম রোমেলসহ কাজের ছেলের নাম পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। তবে, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে নিলেও এর সবই ভোগ করেন মান্নান নিজে। ভুয়া প্রতিষ্ঠান, কোটি কোটি টাকা ঋণ : উত্তরা ব্যাংক শান্তিনগর শাখা থেকে মাহিয়া এন্টারপ্রাইজের নামে ৪৭ লাখ ছয় হাজার টাকা, সাধন এন্টারপ্রাইজের নামে ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, মুনলাইট এন্টারপ্রাইজের মালিক ইসমাঈলের নামে ৯ লাখ ২৩ হাজার টাকা, ফেরদৌসী এন্টারপ্রাইজ ও সুসান এন্টারপ্রাইজের নামে এক কোটি টাকা ঋণ নিলেও পরিশোধ করেননি মান্নান।

এ কারণে উত্তরা ব্যাংক ১৯৯৮ সালে তিনটি মামলা দায়ের করেছে জামিনদার মান্নান ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। অগ্রণী ব্যাংক রায়সাহেব বাজার শাখা থেকে বিএস এন্টারপ্রাইজের মালিক সিরাজুল ইসলামের নামে দুই কোটি ৮৪ লাখ টাকা, ট্রেড লিংক ইন্টারন্যাশনালের মালিক আবদুর রশিদ রাফির নামে ৫৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকা, এইচ এন্টারপ্রাইজের মালিক হারিছ উদ্দীন হিরনের নামে এক কোটি ১৭ লাখ ৫১ হাজার টাকা এবং আবদুল মান্নান মজুমদারের মায়ের নামে ১৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েও শোধ করেননি মান্নান। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংক নবাবপুর শাখা থেকে আহসানো ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানি এবং এফআর ট্রেডিংয়ের নামে পাঁচ কোটি টাকার এলসি খোলেন মান্নান। এ টাকায় রড আমদানি করে লোকসানের অজুহাত তুলে পুরো টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ঋণ ও এলসির টাকা ফেরত পেতে ২০০৫ সালে অগ্রণী ব্যাংক পৃথক দুটি মামলা করেছে।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড দিলকুশার প্রধান শাখা থেকে এস কে এন্টারপ্রাইজের মালিক দেখিয়ে বাড়ির কাজের ছেলে জীবন কৃষ্ণের নামে ৩২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েও তা শোধ করেননি মান্নান। এ ছাড়া এই ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ভারত থেকে যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খুলে পুরো টাকা আত্মসাৎ করেন মান্নান। ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড উত্তরা শাখা থেকে সিরাজুল ইসলামের নামে ৪৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি মান্নান। পটেটো ফ্যাক্স কারখানা তৈরির নামে সোনালী ব্যাংক থেকে ৫৫ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করিয়ে উত্তোলন করেন ৮৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। এরপর কারখানার যন্ত্রপাতি আমদানির নামে ৭০ লাখ টাকা গচ্চা যাওয়ার অজুহাত তুলে কোনো টাকা শোধ করেননি মান্নান।

চারটি চেক গ্যারান্টি হিসেবে দিয়ে জনতা ব্যাংক থেকে দুই কোটি ৮৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এলসি খোলেন মান্নান। পরে শিল্প-কারখানা স্থাপনের নামে মেশিনারিজ আমদানি, গাড়ির যন্ত্রাংশ ক্রয়সহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ভারতীয় ব্যবসায়ীর কাছে টাকা পাঠান। অথচ ভারত থেকে আসে কার্টুনভর্তি বালি ও খোয়া। যার সত্যতা পায় বাংলাদেশ ব্যাংক, এসজিএস ও বেনাপোল চেকপোস্টে। এ ঘটনায় ঢাকার সিএমএম আদালতে মান্নানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে জনতা ব্যাংক।

কৃষি ব্যাংক গোলাকান্দাইল শাখা থেকে নারায়ণগঞ্জ কুরশিয়া ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ২৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এলসি খুলে পণ্যসামগ্রী আমদানির নামে পুরো টাকা আত্মসাৎ করা হয়। কুমিল্লার সোনালী ব্যাংক ওয়াপদা শাখা থেকে মজুমদার ব্রাদার্সের নামে চার কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা ঋণ নিলেও তা শোধ করেননি মান্নান। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন দু-একজন কর্মকর্তাকে হাত করে মান্নান অর্থ তুলতেন। প্রতারণায় জিম্মি ব্যাংক কর্মকর্তারাও : মান্নান জিম্মি করেন ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও। ব্যাংক থেকে টাকা তোলার পর 'ব্যক্তিগত সম্পর্কের' ভিত্তিতে হাতে-হাতে টাকা দেওয়ার দাবি করে ফাঁসিয়ে দেন ব্যাংক কর্মকর্তাদের।

এ ক্ষেত্রে তিনি রিসিভ কপিতে কম্পিউটার স্ক্যানিং করা জাল স্বাক্ষর প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করান। এই প্রতারণার শিকার কর্মকর্তাদের একজন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক শাখার কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই ব্যাংক থেকে ছয় লাখ ৮৫ হাজার ৮০০ টাকা ঋণ নিয়েও তা শোধ করেননি মান্নান। অথচ বিভিন্ন ব্যক্তির উপস্থিতিতে আমার কাছে টাকা জমা দিয়েছেন বলে দাবি করে প্রমাণ হিসেবে জাল স্বাক্ষরের মিথ্যা হলফনামা দাঁড় করান। ফলে চাকরি যায় আমার।

' স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডের ঢাকার প্রধান শাখার তৎকালীন ম্যানেজার (১৯৯৯) এম সাদিকুর রহমানকেও বিপাকে ফেলেন মান্নান। ২০ লাখ টাকা নেওয়ার পর একপর্যায়ে মান্নান বলেন, 'ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো' হওয়ায় তিনি নগদ ১৯ লাখ টাকা সাদিকুরের হাতে জমা দিয়েছেন। ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে মাত্র এক লাখ টাকা দিয়ে মুক্তি পান মান্নান। অন্যদিকে ম্যানেজার সাদিকুর ১৯ লাখ টাকা পরিশোধ করে ক্ষোভে চাকরি ছেড়ে বিদেশ চলে যান। ওরিয়েন্টাল ব্যাংক লিমিটেড ইমামগঞ্জ শাখার কর্মকর্তারা জানান, আবদুল মান্নান এই শাখা থেকে আবদুর রউফ রাফীর নামে এক কোটি সাত লাখ ৯৬ হাজার ৩০৩ টাকা ঋণ নেন।

ঋণ পরিশোধের মেয়াদ শেষের দিকে এলে বারবার চিঠি দেওয়ার পর মান্নান একদিন বলেন, 'ভালো সম্পর্ক' বিধায় তিনি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে শাখা ম্যানেজার ফাইজুল ইসলামের হাতে টাকা জমা দিয়েছেন। তিনি ম্যানেজারের স্বাক্ষরিত (কম্পিউটার স্ক্যানিং করা) একটি ভুয়া প্রমাণও দাঁড় করান। এ কথা শোনার পর তাৎক্ষণিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান ফাইজুল ইসলাম। অগ্রণী ব্যাংকের (চাকরিচ্যুত) সাবেক এজিএম মির্জা মোহাম্মদ দিদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'চতুর মান্নান টাকা দিয়ে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতেন। ভুয়া কাগজপত্রে নিতেন কোটি কোটি টাকা ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় মান্নানকে ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানানো এবং ব্যাংক আইনের পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদ করায় আমাকে বরখাস্তের শিকার হতে হয়। ' দিদার আরো বলেন, 'অগ্রণী ব্যাংকের তৎকালীন দুই ডিএমডির নির্দেশনায় কৃষি ও অগ্রণী ব্যাংক কর্মকর্তারা সরাসরি আইন লঙ্ঘন করতে বাধ্য হয়েছেন। ওই দুই ডিএমডির কারণে এই দুই ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে অন্তত ১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন মান্নান। ' দিদার জানান, মান্নানের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বিভিন্ন ব্যাংকের অন্তত ১৩ কর্মকর্তা (শাস্তিস্বরূপ) চাকরিচ্যুত হয়েছেন। মান্নানের জমির দখল নিয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ও সোনালী ব্যাংক : ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় বিভিন্ন ব্যাংক অন্তত ২৫টি মামলা করেছে মান্নানের বিরুদ্ধে।

তবে এসব মামলা যাতে ধীরগতিতে চলে এজন্য নানা কলকাঠি নাড়েন মান্নান। ফলে ব্যাংকগুলোও সুবিধা করতে পারছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মান্নানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চললেও সাত বছর ধরে চলা একটি মামলার রায় পেয়েছি আমরা। ' ওই কর্মকর্তা জানান, মান্নান গ্যারান্টার হয়ে কাজের লোক জীবন কৃষ্ণের নামে ১৯৯৭ সালে মতিঝিল প্রিন্সিপাল ব্রাঞ্চ থেকে ৩২ লাখ টাকা ঋণ নেন। ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় আদালতে মামলা করে ব্যাংক।

২০০৭ সালের ২২ নভেম্বর আদালতের ওই রায়ে কুমিল্লায় মান্নানের মালিকানাধীন ৬৫ শতাংশ জমি স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় দখলে নেয় রাজধানীর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক প্রিন্সিপাল শাখা। পটেটো ফ্ল্যাঙ্ কারখানা প্রতিষ্ঠার নামে নেওয়া প্রায় ৮৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে শোধ করেননি মান্নান। এ কারণে মামলা হলে অর্থঋণ আদালত, ঢাকার আদেশে কুমিল্লার উত্তর রামপুরা মৌজার ২.১০ একর জমি ও স্থাপনার দখল নেয় সোনালী ব্যাংক। এ ছাড়া স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের দায়ের করা একটি মামলায় মান্নান মজুমদারকে ২০০৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পল্টন থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। ব্যাংকগুলোকে সাবধান করে দেওয়া হয় : ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিরাগমন শাখার সিনিয়ন সহকারী সচিব মোহাম্মাদ আবদুল লতিফ স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো এক পত্রে বলা হয়, 'সরকারের এক গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এখন থেকে আবদুল মান্নান মজুমদার নামে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

' দেশে কার্যরত সকল তফসিলি ব্যাংকের প্রধানদের কাছে ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের পাঠানো পত্রে বলা হয়, 'ব্যাংক আইন ভঙ্গ করে আবদুল মান্নান মজুমদারকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তে (৯৮৯ নম্বর পত্র) প্রমাণিত হয়েছে। নিয়ম ভেঙে ঋণ প্রদানের বিষয়ে জরুরিভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হলো। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে আবদুল মান্নান মজুমদারের নামে ঋণ দিতে নিষেধ করা গেল। ' বহু ব্যক্তি প্রতারণার শিকার : ব্যাংকের পাশাপাশি বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকেও মান্নান হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা, যার অধিকাংশই পরিশোধ করা হয়নি। পাওনা ফেরত চাওয়ায় অনেককেই দেওয়া হয়েছে হত্যার হুমকি।

'বড় বিপদে আছি' উল্লেখ করে কুমিল্লার বাসিন্দা মিনহাজুর রহমান লুথার বলেন, 'পূর্বপরিচিত হওয়ায় ইউসিবি ব্যাংকে স্ত্রীর সম্পত্তি বন্ধক রেখে ১০ লাখ টাকা তুলে মান্নানকে দেই। এ ছাড়া নিজে জামিনদার হয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংক সাত মসজিদ রোড শাখা থেকে মান্নানের ছেলে মাজহার আলম রোমেলের নামে আরো আড়াই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দেই। নির্ধারিত সময়ে মান্নান ঋণ শোধ না করায় সম্প্র্রতি ইউসিবি ব্যাংক আমার স্ত্রীর জমি নিলামে বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে। ' ঢাকার নবাবপুর রোডের সিমলা হোটেলের স্বত্বাধিকারী নাসির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে মান্নান একদিন বলেন, ভারত থেকে আসা পণ্য বেনাপোল চেকপোস্টে আটকে আছে, ছাড়াতে হবে। মান্নান চেক ও প্যাডে লিখিত দিয়ে চার লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আর শোধ করেননি।

মদনপুর বন্দর থানার ঢেউটিন ব্যবসায়ী আবদুস সালামের অভিযোগ, ব্যাংক থেকে তাঁকে বড় অঙ্কের ঋণ তুলে দেওয়ার নাম করে দেড় লাখ টাকা নেন মান্নান। পরে ব্যাংক ঋণ তোলা হলেও সালামকে দেননি মান্নান, ফেরত দেওয়া হয়নি ওই দেড় লাখ টাকাও। আরামবাগ গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রওশন আরা বলেন, শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠায় ব্যাংক ঋণ নিয়ে দেওয়ার নামে তিন লাখ টাকা নিয়ে তা আর ফেরত দেননি মান্নান। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানার উত্তর রামপুর মৌজার (পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অফিসসংলগ্ন) কাজী শাহ আলমের মালিকানাধীন ১১ শতক জমির জোরপূর্বক দখল নেয় মান্নান। এক্ষেত্রে সহিদুল্লাহ নামের এক ব্যক্তিকে ওই জমির ভুয়া মালিক সাজিয়ে দলিল করে মালিক বনে যান মান্নান।

পরে বিষয়টি নিয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা হয়। শুনানি শেষে শাহ আলমের নামে পূর্ণ মালিকানার রায় দেন আদালত। আদালতের রায়ের পরও জমির দখলে গেলে মান্নান জোরপূর্বক ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের দিয়ে দখলপ্রাচীর ভাঙচুর করে পাহারাদারকে মারপিট করে। এরপর বিষয়টি নিয়ে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা হলে তদন্তের পর মান্নানের বিরুদ্ধে প্রথমে সমন জারি এবং উপস্থিত না হওয়ায় পরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এখন জমির মালিককে অব্যাহত হুমকি দিচ্ছে মান্নানের লোকজন।

কুমিল্লার বাসিন্দা কবির আহমেদ বলেন, ফিলিং স্টেশন ক্রয় এবং আধুনিকায়নের নামে তাঁর থেকে এক কোটি টাকা নিয়েছেন মান্নান। কিন্তু তিনি কোনো কাজ করে দেননি; আবার টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য অভিযোগের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও তাকে কুমিল্লায় যৌথ বাহিনীর ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে দুদিন পরই ছাড়া পায় মান্নান। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।