আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: অশরীরী

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ কথাটা অনিক-এর কানেও গিয়েছে। বাবার দূর সম্পর্কের এক বোনের মেয়ে নাকি গ্রাম থেকে এসে ঢাকায় ওদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে চায়। বাবা চুপ।

মা’র মুখ গম্ভীর। থমথমে। এ যুগে কে কার দায়িত্ব নেয়? উটকো ঝামেলা না? তা ছাড়া খরচের একটা ব্যাপার আছে। মধ্যবিত্তের গোনাগুনতির সংসার। ওদিকে সাগুফতা (অনিক এর বড় বোন) এ বছরই একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।

মেজবোন শাহানা কলেজে পড়ে। ওরা দু’জন একট ঘর শেয়ার করে। আর এ বাড়িতে এক্সট্রা ঘর কোথায়? তা ছাড়া অনিক- এর এ বছরই এসএসসি পরীক্ষা। কাজেই অনিক এর ফুপাতো বোনের ঢাকায় এসে পড়া আর হয়ে ওঠে না। অনিক বিষন্ন বোধ করে।

পাঁচ বছর আগে কাজল আপাকে ও একবার দেখেছিল। গ্রামে। তখন অবশ্য ও খুব ছোট ছিল। তবু আবছা মনে আছে। কাজল আপা ওকে পেয়ারা কেটে দিত।

কাজল আপার বিষন্ন মুখটা মনে করে বিষন্ন বোধ করে অনিক। জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা বলে এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে অনিক-এর উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা ছিল। পরে সেটা ধীরে ধীরে কেটে যায়। রেজাল্ট খুব একটা খারাপ হবে না। ... এখন অখন্ড অবসর।

আবার গিটার নিয়ে বসল সে। পরীক্ষার জন্য এত দিন বাজাতে পারেনি । মিউজিক ছাড়াও অনিক- এর ছবি তোলার শখ । ওর ক্যামেরাটা প্যানাসনিক লুমিক্স (ডিএমসি-টিএসফোর)। ওয়াটারপ্রুফ।

অনেক আবদারের পর গত বছর মেজমামা জার্মানি থেকে জিনিসটা এনে দিয়েছেন। ছবি তুলে/এডিট করে সময় যেন কাটে না। বন্ধুরা এখানে-ওখানে ছড়িয়ে গেছে। কেবল ওর দিনগুলি কাটছিল শ্লথ-মন্থর ... ঠিক এমন একটা সময় মঠবাড়িয়া থেকে দিলওয়ার কাকা এলেন ঢাকায়। বছরে দু/তিন বার আসেন।

কখনও বালাম চাল, নারিকেল, সুপারি; আবার কখনও পান, সরিষার তেল, কাঁঠাল নিয়ে আসেন। মঠবাড়িয়ায় অনিকদের বিস্তর জমাজমি। দিলওয়ার কাকাই দেখাশোনা করেন। কালো শুকনো মতন দেখতে মধ্যবয়েসি মানুষটা সব সময় কালো রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি পরে থাকেন । ঘাড় অবধি কোঁকড়া লম্বা চুল।

চোখে সুর্মা, কালো ফ্রেমের চশমা। গলায় পুঁতির মালা। সারাক্ষণ বিড়ি টানছেন। লও, আনোয়ারুল । মঠবাড়িয়া যাই।

দিলওয়ার কাকা বললেন। অনিককে দিলওয়ার কাকা আনোয়ারুল বলে ডাকে। অনিক- এর ভালো নাম-সৈয়দ আনোয়ারুল সাদিক। তাই। ইদানীং আকাশে ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ জমে।

বাবার মুখে সাকিনের খাল, তার ঘাসবন, কালো ঠ্যাংয়ের সাদাবকের কথা অজস্র বার শুনেছে অনিক। ছবি তোলার জন্য হলেও অনিক- এর একবার মঠবাড়িয়া যাওয়ার ইচ্ছা। দিলওয়ার কাকা শনিবার মঠবাড়িয়া ফিরে যাবেন। অনিকও যেতে চায়। কথাটা মাকে বলতেই মা বলল, যা না।

গ্রাম থেকে ঘুরে আয়। তোর তো এখন ছুটি। অনিক সঙ্গে গিটারটাও নিতে চেয়েছিল। মা বলল, গিটার-টিটার নিস না। তোর দিলওয়ার কাকা কনজারভেটিভ মানুষ।

উনি মাইন্ড করতে পারেন । মঠবাড়িয়া সদরে বাস বদলাতে হল। বর্ষাকাল। আকাশ সকাল থেকে মেঘলা হয়েই ছিল। ঘন্টা দুয়ের পর আবার বাস থেকে নেমে ওরা দুজন খালি একটা ভ্যানে চড়ে বসল।

তখনও মেঘলা আর বিষন্ন হয়ে ছিল । অজ গ্রামের সড়ক আজও পাকা হয়নি। বাঁশঝাড়ের মাঝখান দিয়ে পথ। রাস্তায় কাদা। গ্রামীণ নির্জনতা অনিক কে অভিভূত করে ।

ও টের পায়, এই অনুভূতি কেবল ছবি তুলে বোঝানো যাবে না। আরও গভীর কিছু প্রযুক্তি প্রয়োজন। কবে যে ছবিতে ‘ফিলিংস’ অ্যাড হবে ... অনীক এর দাদুবাড়ি এই অঞ্চলে ‘কাজীবাড়ি’ নামে পরিচিত। সাদা রং করা একতলা পাকাবাড়ি। মেঘলা দিনের শেষ বেলার ম্লান আলোয় নিঝুম হয়ে ছিল।

পাঁচ বছর পরে এল। সব আগের মতোই আছে। আবার অনেক কিছুই বদলে গেছে। ঠিক কি বদলে গেছে তা ধরতে পারল না অনিক। দিলওয়ার কাকা বিপপত্নীক।

সিতারা কাকীকে মনে আছে অনিক- এর। ফরসা গোলগাল চেহারার এক স্নেহময়ী মহিল । বছর পাঁচেক আগে অনিক যখন পরিবারের সবার সঙ্গে দেশের বাড়িতে এসেছিল, সে সময় এ বাড়িতে অনেক লোকজন ছিল। সিতারা কাকী তখনও বেঁচে ছিলেন। মা পাকের ঘরে পিঁড়িতে বসে সিতারা কাকীর সঙ্গে গল্প করত ।

অনিককে স্থানীয় একটা টিনসেডের প্রাইমারী স্কুলে নিয়ে গিয়ে ওর বাবা বলেছিল, আমি এই স্কুলে পড়তাম রে অনিক। সাগুফতা আর শাহানা আপাও তখন আপা স্কুলে পড়ত। ... কাজল আপার কথাও মনে আছে অনিক- এর । ছিপছিপে শ্যামলা মতন দেখতে । গম্ভীর।

এতিম বলে বাবা স্নেহ করত । মামার বাড়ি থাকত কাজল আপা। কাজল আপা তখন ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ত। কাজল আপাকে মা খুব একটা পাত্তা দেয়নি। তবে মা যে কাজল আপার রান্নার প্রশংসা করেছিল তা মনে আছে অনিক- এর ... দিলওয়ার কাকার একটাই মেয়ে।

রুখসানা। রুখসানার বিয়ে হয়ে গেছে; শ্বশুরবাড়ি ভান্ডারিয়া। সুতরাং কাজীবাড়ি খাঁ খাঁ করে । একটি ২২/২৩ বছরের মেয়ে এসে রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়। মেয়েটির নাম নূরানী ।

অল্প বয়েসে বিধবা হয়েছে নূরানী। শ্বশুরবাড়ি থাকে। সেখানে নিত্য গালমন্দ আর গঞ্ছনা । শুনে অনিক অবাক। সে ব্যথিত এবং ক্ষুব্দ বোধ করে ।

কাজল আপার কথাও মনে পড়ে তার । কাজল আপারও তো মা-বাবা বেঁচে নেই। আশ্চর্য! বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ কেমন ফট করে মরে যায়। যেন জীবন খুব সুলভ/সস্তা কিছু। এর কোনও গভীরতা নেই।

আশ্চর্য! ... নূরানীর রান্নার হাত চমৎকার। বিশেষ করে আমডাল। নূরানীর একটি পাঁচ/ছয় বছরের মেয়ে আছে। সেই মেয়েটি আবার বোবা। নাম-লাইলী।

লাইলী দেখতে কালো আর রোগা। কেমন টলটলে চোখে অনিক এর দিকে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা । অনিক ওর ষোল বছর বয়েসে এতসব দেখেশুনে বিস্মিত হয়ে পড়ে। দীর্ঘশ্বাস চেপে নূরানী আর লাইলীর ছবি তোলে। নূরানী আর লাইলীর জীবনের সঙ্গে ওর বা সাগুফতা আপু বা শাহানা আপুর জীবনের পার্থক্য বিপুল।

এই বিষয়টি ওকে এক ঘোর বিস্ময়ের মধ্যে ফেলে দেয়। কাজল আপা ঢাকায় পড়তে চেয়েছিল। মার কারণে সম্ভব হয়নি। একবার কাজল আপার খোঁজ নিতেও ইচ্ছে করে; কাজল আপার কথা দিলওয়ার কাকাকে সরাসরি জিগ্যেস করতে পারে না। কোথায় যেন বাঁধে ... আবার লজ্জ্বাও করে ...কাজল আপা দিলওয়ার কাকার মাধ্যমেই যোগাযোগ করেছিলেন।

অনিক-এর দাদুরবাড়ি তুষখালী জায়গাটা বলেশ্বর নদীর পাড়ে। দিলওয়ার কাকা অনিককে নিয়ে ঘুরে ঘুরে নদীপাড়ের পৈত্রিক জমিজমা দেখালেন। জমির পরিমান দেখে অনিক অবাক। দিলওয়ার কাকা বিড়িতে ফুঁক দিয়ে বলেন, আমাগো পূর্বপুরুষের উপর আল্লাহতালার অশেষ রহমত ছেল। ওহ্ ।

অনিক-এর কেন যেন মনে হয় ... আল্লাহর রহমত তুষখালী গ্রামের সবার ওপর সমান নয় ... আসল কথা হইল রিজিক- এর মালিক আল্লা। তিনিই মাওলা পীরের বংশধর গো সহায় সম্পত্তি সব দিছেন। ওহ্ । কাউকে কাউকে তিনি বঞ্চিতও করেছেন ...কাজল আপা, নূরানী। বোঝলা আনোয়ারুল ।

মোরা হইলাম গিয়া মাওলা পীরের বংশধর। মওলা পীর ছেলেন জেবেরদেস্ত এক পীর। তিনি আরবী ঘোড়ায় চড়িয়া পারস্য দ্যাশ হইতে আমাগো দ্যাশে আসিয়া ছেলেন। ইয়া উঁচা-লম্বা আর ফরসা । মাথায় সবুজ পাগড়ী।

অনিক মুচকি হাসে। দিলওয়ার কাকা বুধবার সন্ধ্যার পর একতলার ঘরের মেঝেতে বসে জিকির-আজগার করেন । একে দিলওয়ার কাকা বলেন ‘ম্যায়ফিল’। ম্যায়ফিলে আরও অনেকে আসে। বেশির ভাগই ফকির-দরবেশ টাইপের।

অনীকও অজু করে পাঞ্জাবি পরে, তাতে আতর মেখে আধো-অন্ধকার ঘরের মেঝেতে পাতা চাদরের ওপর বসে। সারা ঘর আতর আর আগরবাতির গন্ধ ভরে ওঠে। দিলওয়ার কাকার ফকির বন্ধুদের মধ্যে রহমত ফকির মারাফতি গান জানেন- কামেলিরা কাম করিয়া/ কোথায় জানি লুকাইছে/ আরে কোথায় জানি লুকাইছে ... দুই পাহাড়ের মাঝে মওলায় মসজিদ বানাইসে ... আরেব্বা । দুই পাহাড়ের মাঝে মওলায় মসজিদ বানাইসে ... সবাই সমস্বরে গান ধরে ... পাগলের মতো মাথা নাড়তে থাকে। অনীক- এর হাত নিসপিস করতে থাকে ।

গিটারটা থাকলে এখন জোর রিদম বাজাতে পারত। মা তখন বলল, তোর দিলওয়ার কাকা কনজারভেটিভ। অনীক- এর অবশ্য সেরকম মনে হয় না। দিলওয়ার কাকা এবং তার ফকির বন্ধুদের তার দরাজ দিলের মনে হয়েছে। এদের মধ্যে বেলায়েৎ ফকির বললেন সময় করে একদিন জ্বীন দেখাবেন ।

আদম ফকির (ইনি থুত্থুরে বুড়ো ) একটা নদী রঙের আকিক পাথর পরিয়ে দিলেন মধ্যমায়। ম্যায়ফিল- এর রাতে দিলওয়ার কাকা নিজে রান্নাবান্না করেন । খিচুরি আর ছোট আলু দিয়ে ঝাল ঝাল করে রাঁধা কবুতরের মাংস। আর চালতার চাটনি। শেষে একবাটি করে কাউনের ক্ষীর।

কী অপূর্ব স্বাদ। সেদিন সকাল থেকেই দিনটা ছিল রৌদ্রময়। আকাশ সুনীল। বলেশ্বর নদীর দিক থেকে এলোমেলো হাওয়া ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল কাজীবাড়ির আঙ্গিনায়। অনিক দাওয়ার ওপর বসে ছিল।

দিলওয়ার কাকা বাড়ি ছিলেন না। কোন্ গ্রামে সালিশ ছিল। সকাল- সকাল বেড়িয়েছেন। তুষখালী গ্রামে কাজীবাড়ির একটা অন্যরকম ইজ্জ্বত আছে। এ বাড়ির লোকদের সালিশে ডাক পড়ে।

লাইলী বসে ছিল দাওয়ার ওপর পাতা মাদুরের ওপর। ওর সামনে একটা বাটি। বাটিতে মুড়ি। লাইলী মুড়ি খেতে খেতে অনিক- এর দিকে তাকাচ্ছিল। কী মায়া-জড়ানো টলটলে চোখে।

ছবি তোলার সময় ফ্ল্যাশের আলোর ঝলকে চমকে ওঠে। কিন্তু, কি এর ভবিষ্যৎ? এর মা যদি মরে যায়? তখন? তখন কে এর দায়িত্ব নেবে? অনিক- এর বুকটা টনটন করে ওঠে। জীবনের কি কোনও উদ্দেশ্য আছে? মানে আছে? ওকে বিষন্নতা গ্রাস করছিল। মুহূর্তেই ঝেরে ফেরে। ও ঠিক করে ও ডাক্তার হয়ে এই গ্রামেই ফিরে আসবে।

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সেবা করবে। দিলওয়ার কাকা ফিরলেন দুপুরের পর । আকাশে তখন মেঘ জমছিল। দিলওয়ার কাকার হাতে বাজার-সদাই। সে গুলি নূরানী এসে রান্নাঘরে নিয়ে যায়।

দিলওয়ার কাকা বললেন, বড় খারাপ খবর শুনলাম আনোয়ারুল। কি? অনিক- এর বুক ধক করে ওঠে। শুনলাম কাজল নাকি বাঁইচা নাই । ওহ্ । কাজল মানে ...কাজল আপা? হ।

উনি কবে মারা গেলেন? অনিক- এর মাথা টলছিল। দিন সাতেক হইল। আইজ জানখালীতে আসলামের সঙ্গে দেখা। সেইই কইল। আসলামে থাকে দেবীপুর ।

তার লগে দেখা না হইলে জানতে পারতাম না। আহা রে। বড় ভালা মাইয়া ছিল কাজল। তোমার মনে আছে কাজলের কথা? আমার ফুপাতো বোন তহুরার মাইয়া। তহুরার কপাল মন্দ।

স্বামী মরল। এক মেয়ে লইয়া ভাইয়ের বাড়ি আশ্রয় নিল। হেই তহুরায় মরল । কাজলে এতিম হইল। তয় কাজলের পড়াশোনার মাথা ছেল ভালো ।

এইচ এস সি পাস করছে। ঢাকায় গিয়া পড়তে চাইছিল। তা তোমাগো না কি কী সমস্যা- দিলওয়ার কাকা কথাটা শেষ করেন না। অনিক -এর বুকে ঠান্ডা কিছু ঢুকে যায়। বড় হিম।

বড় যন্ত্রণাময়। বলে, কাজল আপার মামা বাড়ি কোথায়? দেবীপুর । যাবেন আপনি? হ। কেমনে কী হইল, একবার খবর নিতে হইব না? দেবীপুর কি অনেক দূরে ? না। কাছেই।

সুতিখালি বিরিজ পার হইলে সাকিনের খালের পাশ দিয়া হাঁটাপথ। কাকা আমি যাব। তুমি যাইবা বাবা ? হ্যাঁ। তা তোমার খাওয়া-দাওয়া হইছে? হ্যাঁ। নূরানী কি রান্ধছিল? বাইল্লা মাছের তরকারী, কাচকি মাছের বড়া, আমড়া ডাল।

অনিক অন্যমনস্ক স্বরে বলে। ও ভাবছিল গ্রামাঞ্চলে মানুষ কী সহজে মরে যায়। কাজল আপাও মরে গেল। আশ্চর্য! এই রকম কথাবার্তার ফাঁকে তুষখালী গ্রামীণ আকাশে মেঘে মেঘে ছেয়ে যায়। বলেশ্বর নদীর দিক থেকে মোষরঙা মেঘ তেড়ে আসে।

সঙ্গে জোরতাল বাতাস। একটু পর বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে থাকে। অনিক- এর হঠাৎ মনে হল, আসল কথাটাই দিলওয়ার কাকা কে জিগ্যেস করা হয়নি। অনিক জিগ্যেস করে, কাজল আপা কি ভাবে মারা গেল? কাজলে গলায় দড়ি দিসে ... দিলওয়ার কাকার কন্ঠস্বর খসখসে হয়ে ওঠে। অনিক মুহূর্তেই জমে যায়।

ওর সমস্ত শরীর শিরশির করে ওঠে। কাজল আপা আত্মহত্যা করেছে? কিন্তু কেন? মামার বাড়িতে কষ্টে দিন কাটছিল? কাজল আপা পড়াশোনায় ভালো ছিল। এইচ এস সি-র পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? অনিক- এর মনটা ভারী আর বিষন্ন হয়ে ওঠে। চোখের আড়ালে কত জীবন অলখে ঝরে যায়। একবার মার কথা মনে হয়।

প্রতিটি মৃত্যুর পিছনে কেউ না কেউ তো দায়ি। অনিক বলে, কিন্তু, কাকা। কাজল আপা আত্মহত্যা করল কেন? আপনার কাছে এনে রাখলে তো পারতেন। ওর কন্ঠস্বরে ক্ষোভ। কইছিলাম বাবা।

কাজলে রাজি হয় নাই। কাজলে বড় গোঁয়ার আছিল। কয় ঢাকা শহরে পড়ালেখা করবে। ডাক্তার হইব। ওহ্ ।

ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ঝরে। ওরা ছাতা নিয়ে বেরুল । পাশাপাশি দূরত্ব রেখে ছাতার নীচে দু’ জন হাঁটতে থাকে । ঝোড়ো হাওয়া ছাতা উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। চারিদিকে মেঘলা আঁধার।

বর্ষার দুপুরটা কালো হয়ে আছে। দুপুরেই অন্ধকার। বৃষ্টির ঝাঁঝ এখন কমেছে। বৃষ্টি এখন ঝিরঝির করে ঝরছে। সুতিখালি বিরিজ আসলে একটা কংক্রীটের পুরনো ভাঙাচোরা কালভার্ট।

ওটা পেরিয়ে সামান্য বাঁয়ে ঢালুপথ। পথের বাঁয়ে একটা সরু খাল। এটাই কি সাকিনের খাল? যে খালের কথা বাবা বলতেন? বর্ষার পানিতে এই মুহূর্তে টইটুম্বুর হয়ে আছে। বৃষ্টির ফোঁটায় মনে হচ্ছিল যেন ফেটে যাওয়া চৌচির কাঁচখন্ড। ওর কৈশরের মতো।

তার ওপর একটা পানসি নৌকা। হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে। নৌকায় কাউকে দেখা গেল না। গলুইয়ের ওপর একটা লাল রঙের গামছা, তার ওপর একটা ছোট দেশি জাতের কাছিম। সবুজ রঙের।

খালের দু’পাড়ে ঘাসের ঘন বন। একটা কালো ঠ্যাংয়ের সাদা বক দাঁড়িয়ে । যেন এখুনি উড়ে যাবে। মুহূর্তমাত্র ...ক্যামেরায় ক্লিক করে ওই দূর্দান্ত দৃশ্যটা তুলে রাখে অনিক। সাকিনের খালের ওপর ভেসে থাকা পানসি নৌকা দেখিয়ে দিলওয়ার কাকা বললেন, বোঝলা আনোয়ারুল ।

ঐ নাওটা হইল কাজলের মামা তোরাবালির। ওহ্ । নৌকাটা তখন মেঘলা আলোয় অল্প অল্প দুলছে। সেই সাদা বকটা উড়ে গেছে। ঘাসবনে পাগলা বাতাস সরসর শব্দ তোলে।

তোরাবালি বড় গরিব। আগে আখচাষ করত। মাজরা পোকায় আখক্ষেত উজার করছে। কী আর করব? এখন মাছ ধরে হে। ওহ্ ।

অনিক ভাবল, কাজল আপা শহরে গিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। পারল না! তোরাবালির বাপদাদারা ছেল এই অঞ্চলের কাহার। তারা পালকি বাইত। ওহ্ । ডাইনে একটা মাঠ।

টিনসেডের স্কুল ঘর। পিছনে আমগাছ। মাঠের একপাশে টিউবওয়েল। ছাতা সামলে বিড়ি টানতে টানতে হাঁটে দিলওয়ার কাকা। তার হাঁটার ছন্দে কেমন ব্যস্ততা।

অনিক তাকে অনুসরণ করে। কাদায় পা পিছলে যায় ওর । একবার শামুকের খোলে পা কাটল। তীব্র ব্যথা টের পায়। ব্যথা সহ্য করে হাঁটে অনিক।

ওর মনে হয় বাবার সঙ্গে এসেছিল। এ পথে ...। তহুরা ফুপুর মুখটাও যেন আবছা মনে পড়ে। পথটা ধীরে ধীরে একটা আমবনে মিশে গেছে। আমবনে ঘন অন্ধকার।

আর পায়ের তলায় থিকথিকে আঠালো কাদা। বাতাসে ভেজা ঘাসপাতার গন্ধ। একটানা ব্যাঙের ডাক। আম পাতায় বৃষ্টি ঝরার সরসর শব্দ। একটু হাঁটার পর গাছপালার ফাঁকে খড়ের স্তূপ কলাগাছ চোখে পড়ে।

ওপাশে মাটির ঘর। ওপরে ছন। ওরা একটা জামরুল গাছের পাশ দিয়ে উঠানে উঠে আসে। উঠানে কাদা। কাউকে দেখা যায় না।

ওরা কাদা মাড়িয়ে হাঁটতে থাকে। দাওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। দাওয়ার ওপর একটা কাঠের বেঞ্চি। দাওয়ায় উঠে দিলওয়ার কাকা বললেন, কেউ নাই দেখতেছি। তুমি বও, আনোয়ারুল।

আমি দেখি ভিতরে কে আছে ... বলে দিলওয়ার কাকা ভিতরে চলে যান। অনিক দাওয়ায় উঠে বেঞ্চির ওপর বসে। চারপাশে তাকায়। চারপাশ থমথম করছে। এ বাড়ির কেউ গলায় দড়ি দিয়েছে মনেই হয় না।

কিন্তু, এ বাড়িতে কোনও লোকজন নেই কেন? কাজল আপার মামা কি মাছ ধরতে গেছেন? আর কেউ থাকে না? দিলওয়ার কাকা এখনও আসছেন না কেন? সাড়া শব্দ নেই। অনিক উঠে দাঁড়ায়। ঘরের ভিতরে ঢোকে। ঘরের ভিতরে অন্ধকার। একপাশে একটা চৌকি।

তোষক বা জাজিম নেই। কেবল একটা কাঁথা পড়ে আছে। এলোমেলো। একপাশে ধানচাল রাখার বড় একটা মঠ। পাকা কাঁঠালের গন্ধ পায় অনিক।

বৃষ্টির ভোঁতা শব্দ ওর মাথার ভিতরে ফাটে। কেমন ঘোরের মধ্যে ওপাশের দাওয়ায় চলে আসে। একদিকে একটা উঠান। অন্ধকার উঠান। উঠানে কেউ নেই।

শূন্য উঠান। দিলওয়ার কাকা কোথায় গেল? আশ্চর্য! উঠানে ওদিকে একটা পুকুর। অর্ধেক কচুরি পানা । অর্ধেক কালো টলটলে পানি। বৃষ্টিতে চৌচির কালো পানি ।

পুকুর পাড়ে কাঁঠাল গাছ, জামগাছ, ঝিকাগাছ। কাজল আপা কি ওই জাম গাছে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন? অনিক- এর শরীর ঝমঝম করে ওঠে। সে প্রায় চেতনাশূন্য উঠানে নেমে আসে। তারপর কাদা মাড়িয়ে হাঁটতে থাকে। ওর কেমন শীত শীত করে।

অন্ধকার পুকুর পাড়ের দিক থেকে সরসর বাতাস ছুটে আসে। হঠাৎই ওর মনে হয় ... ওই জামগাছের আড়ালে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। যাকে খুঁজতে সে এখানে এসেছে । বেঁচে থাকতে যে প্রচন্ড অভিমানে এখানে দাঁড়াত। অনিক এর কেমন এক পিছল অনুভূতি হয় ।

ও টের পায়, সে এসেছে ... অশরীরী ... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.