আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কে এই ভবঘুরে! যার ইশারায় রাজ্য নড়ে!!- ১

তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা সাধারণ একজন মানুষ। দামেশকের পথে ঘাটে কাজ করেন, কাজ না পেলে কাজের খোঁজে বসে থাকেন। কেউ ডাকলে তার পেছনে কাজের সন্ধানে ছুটে চলেন। দিন শেষে ক্লান্ত শরীরে দামেশকের সবচেয়ে বড় মসজিদের এক কোণায় এসে আশ্রয় নেন। মহান বিজেতা বীর যোদ্ধা সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর কবর আর দামেশকের উমাওয়ী মসজিদের মাঝখানে যেটুকু ফাঁকা জায়গা- ওখানেই চুপচাপ শুয়ে থাকেন।

এ শহরে তার আর কেউ নেই। আর কোথাও তার আশ্রয়ও নেই। এমন ভবঘুরে মানুষকে আর কোথায় তাড়ানো যায়! মসজিদের হর্তকর্তারা তাই তাকে পড়ে থাকতে দেখেও কিছু না বলে এড়িয়ে যায়। মসজিদের পেছনে ছোট একটি মাদরাসা। মাদরাসার ছাত্রদের ব্যবহার শেষে কিছু পানি রয়ে গেলে চুপে চুপে রাতে সেখানে গিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে গোসল সেরে নেন।

তারপর আবার ফিরে এসে শুয়ে থাকেন চুপচাপ। রাতের অন্ধকারে নিজেকে সঁেপ দেন ঘুমের আশ্রয়ে। এভাবেই যাচ্ছিল দিন। পেরিয়ে যাচ্ছিল রাত। জীবনের সময়গুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিল এ লোকটির।

তার কাছে জীবন মানেই দিনভর সামান্য কয়েকটি দিরহামের সন্ধানে হন্য হয়ে ছোটা- রাতে এসে দু মুঠো খেয়ে গুটিশুটি হয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকা। শীতের রাত। তার ঘুম ভেঙে গেল। গভীর রাত। প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস।

তার গোসলের প্রয়োজন দেখা দিল। মসজিদের যে আঙিনায় তিনি শুয়ে আছেন- সেখানে তো অপবিত্র অবস্থায় থাকা যায় না। তিনি মাদরাসার চৌবাচ্চায় গেলেন। সেখান থেকে পানি ঢেলে গোসল করে নিলেন। তারপর এসে আবার শুয়ে পড়লেন।

আবার ঘুম ভেঙে গেল। আবারও গোসলের প্রয়োজন হলো। এমন শীতের ঠান্ডা রাত। চারদিক নিরব নিস্তব্ধ। কিন্তু তিনি যে মসজিদের আঙিনায় শুয়ে আছেন।

এটা তো পবিত্র জায়গা। এটাই তো তার আশ্রয়। বাধ্য হয়ে তিনি আবার গোসল করতে গেলেন। খেটে খাওয়া মানুষের জীর্ণ শীর্ণ শরীর। শীতের রাতে দু বার ঠান্ডা পানিতে গোসল তার এ খাটুনিভাঙা দেহ সয়ে নিতে পারলো না।

তিনি প্রচন্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারালেন। অচেতন এ মানুষটির চারপাশে তখন কেউ নেই। ফজরের আযানের খানিক আগে তার জ্ঞান ফিরে এল। মুসল্লীদের পদশব্দে তিনি জেগে উঠলেন। ফজর নামাজের পর মাদরাসার এক শায়খের সাথে তার দেখা।

তাকে পেয়ে খুলে বললেন গত রাতের বৈরী ঘটনা। এও বললেন, পরপর দুবার গোসলের প্রয়োজন হওয়ায় আমার অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছিল। রাতের শেষাংশে আমি অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। মাদরাসার শায়খ তার কথা স্বাভাবিকভাবেই শুনলেন। সাধারণ মানুষের কাছে এমন ঘটনা তিনি অহরহ শোনেন।

তিনি তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইলম জানেন না বলেই আপনার এত কষ্ট হলো। আমাদের মাসআলায় বলা আছে, প্রচন্ড ঠান্ডায় শারীরিক অসুস্থতার প্রবল আশংকা থাকলে গোসলের পরিবর্তেও তায়াম্মুম করে নেয়া যায়। ’ এ একটি বাক্য এ সাধারণ মানুষটিকে ভীষণভাবে লজ্জিত করলো। তিনি অনুশোচনায় দগ্ধ হলেন। হায়! এমন জানি না বলে জীবনভর হয়তো আর কতো দুঃসহ যন্ত্রণা সয়ে যেতে হবে আমার! শরীয়তের এ একটি মাত্র সমাধান তাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করলো।

গোসলেরও কি তায়াম্মুম হয়। আহা! কত সুন্দর সহজ আমার ধর্ম ইসলাম। এবং সেদিন থেকেই। সেদিন থেকেই সূচনা হলো এক নতুন অধ্যায়ের। তিনি নিজেকে বদলে ফেললেন।

তার কোনো আশ্রয় নেই, সম্বল নেই, মাথা গোজার ঠাঁই নেই। এত নেইয়ের ভীড়ে জন্ম নিলো এক নতুন আত্মবিশ্বাস। আমি ইলম শিখবো, আলেম হবো। দিনভর কাজ শেষে তিনি রাতভর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শেখার জগতে। শুধু পড়া আর শেখার জন্য নিজের ঘুম বিসর্জন দিলেন।

শূন্য থেকে তিনি শুরু করলেন। গন্তব্য অনেক দূর। তিনি যাত্রা করলেন তার আত্মমক্তি ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে। আমাকে শিখতেই হবে। আমাকে পারতেই হবে।

একাধারে দশটি বছর পেরিয়ে গেল। ততদিনে বদলে গেছে চারপাশের অনেক দৃশ্য। বদলে গেছেন তিনি নিজেও। এ পৃথিবীর সব চাকচিক্য ও লালসা মোহ তার কাছে এখন অর্থহীন। যে ইলমভান্ডারের সন্ধান তিনি পেয়েছেন, যে সাগর তিনি পাড়ি দিয়ে এসেছেন- চারপাশের এ রঙিন পৃথিবী তার কাছে বড়ই মূল্যহীন।

এরপর। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। মাথা উঁচু করে শাসিয়ে যাওয়া। তিনি মসজিদের মিম্বর থেকে শাসন করতেন শাসকদেরকে। বিচার করতেন সাধারণ মানুষের।

শুধু সাধারণ মানুষ নয়, তার সামনে বসে মাথা নুয়ে থাকতেন তৎকালের আমীর উমারা। আমীর ও রাজা-বাদশাহদের সাথে এ মানুষটির সাহসিকতার কিছু অবিশ্বাস্য ঘটনা নিয়েই এ লেখা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেছিল বলে কেউ দাবী করতে পারবে না। একজন সাধারণ দিনমজুরের আশ্রয় ছিল যে মসজিদের আঙিনায়- ভবঘুরের মতো তিনি যে মসজিদের এ কোণায় ও কোণায় পড়ে থেকে রাত কাটিয়ে দিতেন ভোরের আশায়- সেই সাধারণ ভবঘুরে মানুষটি কালের বিবর্তনে সেই মসজিদের প্রধান খতীব পদে সমাসীন হলেন। যে শহরে তার কেউ ছিল না, তিনি সেই দামেশকের বিচারপতি হলেন।

মাত্র একটি বাক্য শুনে বদলে যাওয়া একজন পথচারী কি প্রবল সাহসিকতা ও প্রচন্ড একনিষ্ঠতার গুণে নিজেকে নিয়ে গেলেন এমন উচ্চতায়- ভাবা যায়! এ মানুষটির অবিশ্বাস্য কিছু যুগান্তকারী ঘটনা নিয়ে তিন পর্বের এ ধারাবাহিক পড়ার আমন্ত্রণ সবার জন্য। নাম নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তা আসবে, যথাসময়ে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।