আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তালা-চাবি: ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি

খ্যাঙ্কস গড। বিরাট এক ঝামেলা থেকে বাঁচলাম। দরজাটা টান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম, গলায় চাবিটা নেই। এখন আর দেখেও লাভ নেই। যা হবার, তা হয়ে গেছে।

দরজাকে আর ফেরানোর পথ নেই। তালা লেগে গেছে। আর চাবিটা ঘরের ভেতর। আমি যে ডরমিটরিতে আছি, সেখানে রুমের তালা খোলা আত সোজা কথা নয়। যে একবার এই আপদে পড়েছে একমাত্র সেই জানে তালার কতো প্যাঁচ! রুমের দরজা খোলার জন্য ডরমিটরির হাউস মাস্টার এর অফিসে যোগাযোগ করতে হবে।

লম্বা ফিরিস্তি সম্পন্ন হবার পর অফিসিয়াল লোক এসে তালা খুলে দেবে। আর তালা খোলার ফাইন হিসেবে গুনতে হবে ৫০ ইউরো। অবশ্য ফাইনের অঙ্কটা ৫০ এর ঘরে থাকবে কেবল উইক ডেজ গুলোতে এবং শুধুই দিনের বেলায়। ঘটনাটা যদি হয় রাতে তবে ফাইন আরো বাড়বে। আর যদি কেউ উইকেন্ডে এই কান্ড করে এবং সেটা যদি হয় রাত, তাহলে ফাইনের অঙ্কটা বেড়ে দু'শো থেকে আড়াই'শ ইউরো তে গিয়ে ঠেকবে।

আজ শনিবার। রাত বাজে সাড়ে আটটা কি নয়টা। উইকেন্ডের রাতে ঘরে চাবি ফেলে আমি দরজায় তালা মেরেছি! বন্ধ দরজার সামনে খানিক বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আশ-পাশের প্রতিবেশি কয়েকজনের দরজায় টোকা দিলাম। কারো কোনো সাড়া-শব্দ নেই।

কেউ নেই ঘরে। কী করবো? কোথায় যাবো? কার কাছে সাহায্য চাইবো কিচ্ছু তো বুঝতে পারছি না। ফ্লোর এর এমাথা ওমাথা বিনা কারণেই চক্কর দিলাম দুই- একবার। করিডোরে কারো দেখা নেই। এখানে আমি যে ডরমিটরিতে আছি, সেটার নাম টানিনবুশ-২ (টিবি-২)।

এই টিবি-২ এর একটা সমস্যা হলো দরজা লাগালেই সেটা অটো লক হয়ে যায়। প্রথম দিন, প্রথম বার রুমে এসে আমাকে সব বুঝিয়ে, চিনিয়ে দিচ্ছিলো আমার সহকর্মী রিয়াজ ভাই। সে আবার এ ডরমের-ই বাসিন্দা। রুম থেকে বেরিয়ে সে আমাকে কিচেন দেখাতে যাচ্ছিলো। তার পিছু পিছু যাবার আগে, আমি দরজাটা টেনে দিলাম।

আর সঙ্গে সঙ্গেই ''হায় হায়'' করে উঠলো রিয়াজ ভাই। ''সোমা, দরজায় তালা লাগায়া দিসেন! চাবি কই!" আমি তাকে আশস্ত করে বললাম, '' না, না, দরজায় তালা দেই নাই। এমনি আটকে দিয়েছি শুধু। আর চাবিও আমি নেই নাই। আপনি টেবিলের ওপরে যেখানে রেখেছেন সেখানেই আছে।

'' আমার এই নিরীহ কথা শুনে আরো বেশি আতকে উঠলো সে। কিন্তু ততক্ষণে দরজা বন্ধ। আমার ফ্লোরেই পাকিস্তানি একটি ছেলে থাকে। সে ছেলেকে দেখেই জোরে ডেকে উঠলো রিয়াজ ভাই। তার কাছে সাহায্য চাইলো।

সেই ছেলে কিচেন থেকে একটা কাঁটা চামচ নিয়ে এলো। চামচের কাঁটা একেকটা একেক দিকে বাঁকানো। বাঁকা সেই কাঁটা দিয়ে দরজার লক-এ সে গুঁতোগুঁতি শুরু করে দিলো। সব দেখে আমি তো থ! হচ্ছেটা কী! এই চামচে কাজ হচ্ছে না। তাই, আরেকটা কিচেন থেকে আরো দু'টো কাঁটা চামচ নিয়ে এলো সে।

সেগুলোরও একেক কাঁটার একেক আকার। এর পরেও কাজ হচ্ছে না। সেই ছেলে এবার নিজের রুমের দরজায় গেলো। অভিজ্ঞ হাতে চামচটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে এক মুহূর্তেই খুলে ফেললো তালা। আবারো সে ফিরে এলো আমার দরজায় ।

আরো ৫/৭ মিনিট চেষ্টায়ও তালা খুলছে না। ততক্ষণে তালা-চাবির একগাদা ঘটনা শোনা হয়ে গেছে আমার। তার উপরে রিয়াজ ভাই বললেন, ''সোমা আপনার মনে হয় অফিসেই যোগাযোগ করতে হবে। '' কী করতে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেবার আগে, ছেলেটি বললো, ''লেটস ট্রাই এগেইন''। ২৪-২৫ ঘন্টার জার্নি করে, বাংলাদেশ থেকে উড়ে এসে জার্মানিতে ফ্রাঙ্কফুর্টে নামা।

সেখান থেকে ট্রেন ধরে বন আসা। ট্রেন থেকে নেমে ট্যাক্সি ধরে সোজা অফিস। তারপর এটা ওটা অফিসিয়াল র্ফমালিটিজ সেরে আমার ডরমিটোরিতে আসা। ৪০ কেজি ওজনের ব্যাগ-বোঁচকা হাতে করে, কাঁধে করে টানতে টানতে রুমে এসে দেখি আমার রুম গোছানো হয় নি। অথচ মনে হচ্ছিলো, গাছ থেকে ঝরে পরা ফুলের মতো নি:শব্দে এইবার টুপ করে বিছানায় ঝরে যাই।

কিন্তু তা হলো না। আমরা ফিরে গেলাম রিয়াজ ভাইয়ের রুমে। আহা! কী দয়ালু সে! ডিম ভেজে, পাউরুটি টোস্ট করে, প্রাথমিক একটা নাশ্তা বানিয়ে খাওয়ালো । চা বানিয়ে দিলো। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন অফিসের যেই জার্মান মহিলা, তিনি একটু নাশতা করে, একটু গল্প করে আমাকে ''গুড ডে এন্ড গুড লাক'' জানিয়ে চলে গেলেন।

আহা! রিয়াজ ভাই কী দয়ালু। সে বললো, ''সোমা, আপনি আমার ঘরেই একটু বিশ্রাম নেন। আমি আপনার জন্য একটু ভাত রান্না করি। '' উত্তরে আমি শুধু '' জ্বী, আচ্ছা'' বলে, কম্বল প্যাঁচিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘন্টা খানেক পর ঘুম থেকে উঠে, ভাত-সবজি-ডিম ভাজি-ডাল ভুনা খেয়ে দেহে মনে বল্ নিয়ে বোচঁকা-বাঁচকা টানতে টানতে নিজের রুমে এলাম।

আর এসেই কি-না দরজায় দিলাম তালা! আমার প্রতিবেশি ছেলেটা যখন ট্রাই করেই যাচ্ছে, আমি তখন মনে মনে ভাবি, ''সারসে! প্রথম দিনেই ফাইন দিয়া শুরু!'' এমন সময়ই ছেলেটা বললো ''গ্রেট!'' রিয়াজ ভাই বললো, ''ওহ্, খুলে গেছে!'' সেই প্রথম দিনে এত্তো কান্ড করার পর চাবিটাকে আমি আর কখনোই গলা থেকে নামাই নি। এক গোছা চাবির লম্বা ফিতাটাকে মালার মতো গলায় ঝুলিয়ে রাখি। সকালে ঘুম থেকে উঠে চাবির মালা গলায় পরি। আর রাতে ঘুমোতে গিয়ে খুলে রাখি বালিশের পাশে। এর মাঝে অফিসের সময়টাতে চাবিটা থাকে ব্যাগে।

গত আড়াই মাস ধরে এভাবেই চলছে। কিন্তু আজ শনিবারের এই ছুটির রাতে ঘরে চাবি রেখে তালা আটকে আমি যখন বোকা বনে দাঁড়িয়ে আছি দরজার সামনে, তখন আমার সাথে কেউ নেই। না রিয়াজ ভাই, না সেই পাকিস্তানি ছেলেটা, না আমার অন্যকোনো প্রতিবেশি। কী করবো, কী করবো ভেবে না পেয়ে, কারো কোনো সাড়া শব্দ না দেখে, পাকিস্তানী ছেলেটির কথাটা মাথায় এলো, ''লেটস ট্রাই''। আমার কিচেন থেকে সেই বিশেষ একটা কাঁটা চামচ খুঁজে আনলাম।

কিন্তু আনাড়ী হাতে তালা তো খুলে না! পাশের একটা কিচেনে গেলাম। সেখানে আর কোনো 'বিশেষায়িত চামচ' পেলাম না। আরেকটা কিচেন আছে। সেখানেও খোঁজলাম। পেলাম না আর কোনো 'রক্ষা কবচ'।

আবারো সেই একই চামচ দিয়ে গুঁতোগুঁতি করছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। চেষ্টা করা থামিয়ে, আমি এদিক ওদিক খুঁজে দেখি কাউকে দেখা যায় কি-না। কেউ নেই। সবাই বাইরে।

আমিও বাইরে থেকেই বেড়িয়ে এলাম মাত্র। পোশাক পাল্টে বাথরুমে যাবার সময় এ কান্ড করেছি। চাবি জিনিষটা আমি জীবনেও সামলাতে পারি নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার সময়েও কোনো দিনও চাবি সঙ্গে রাখি নি। দরজার চাবিটা বারান্দায় ফুলের টবের এক কোণায় রেখে দিতাম।

হল ছাড়ার পর, বাসায় উঠে একই চাবির কয়েকটা কপি বানিয়েছি। একটা আমার স্বামীর কাছে, একটা তার বন্ধুর কাছে, একটা আমার বোনের কাছে আর একটা চাবি আমার কাছে থাকতো। কিন্তু এইখানে তো চাবি কপি করারও অনুমতি নেই। এক কপি চাবি। বারন্দার টবে রাখার উপায় নেই।

কপি করে কারো কাছে রাখার উপায় নেই। আনাড়ী আমার গলায়, চাবির গোছা তাই মালা হয়ে শোভা পায়। তালা তো কিছুতেই খুলছে না। কাউকে যে একটা ফোন দিয়ে সাহায্য চাইবো সেই উপায়ও নেই। মোবাইলটাও ঘরের ভেতর।

মনে মনে আড়াই'শ ইউরো ফাইন গুনছি, আর রাগে মেজাজ তিরিক্ষি হচ্ছে। এই মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ৫০ ইউরো ফাইন খেয়েছি। প‌্যারিস ট্যুর এর বুকিং দিয়েছিলাম। কিন্তু অনিবার্য কারণে বুকিংটা ক্যান্সেল করতে হলো। বুকিং ক্যান্সেল করার পর ট্যুর অপারেটর কোম্পানি বললো, একবার বুকিং দেয়া হয়ে গেলে আর ক্যান্সেল করা যায় না।

ক্যান্সেল করলে, ট্যুর এর খরচের একটা নির্ধারিত পরিমাণ টাকা জরিমানা হিসেবে দিতে হয়। তুমি যদি ক্যান্সেল করো তাহলে ৫০ ইউরো জরিমানা দিতে হবে তোমার। কী আর করা। দিলাম। আমার সঙ্গে বুকিং দিয়েছিলো হিন্দি সার্ভিসের এক সহকর্মী।

ব্যাচারা! আমার দু:খে 'সরি' 'সরি' বললো কয়েক বার। প‌্যারিস ট্যুর তো হলোই না। তার উপরে জরিমানা গুণলাম। সেই দু:খই আমার পুরোনো হয় নি এখনো। তার মধ্যে, আজকে এই রাতের বেলায় আমি এখন আরেক বার জরিমানার সামনে! মনে মনে নিজেকে যথেষ্ঠই ঝারলাম।

এক আপু আমাকে আজ রাতে শুটকি খাওয়ার দাওয়াত দিলো। এতো পীড়াপিড়ী করলো। আমি কি-না গেলাম না। আর এখন! আমার ফ্লোর ছেড়ে অন্য কোনো দিকে যেতেও পারছি না। একবার বেরোলে তো আর ফ্লোরেই আসার উপায় নেই।

প্রত্যেক ফ্লোরেরও তো আলাদা আলাদা চাবি। কাঁটা চামচ দিয়ে দরজায় খোচাঁতে খোঁচাতে- রাগ, ক্ষোভ, বিরক্তি, মেজাজ খারাপ মিলিয়ে, যখন রীতিমতো আমি অসহায় বোধ করছি; কাউকে না পেলে, কী ভাবে কী করতে হবে কিছু না জানলে, সারা রাত হয় করিডোরে, নয় কিচেনে চেয়ারে বসে কাটাতে হবে ভেবে যখন প্রমাদ গুনছি, তখনই দরজাটা খুলে গেলো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.