আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তৃতীয় পর্ব : মেলা থেকে ফেরা

এটা আমার জন্য অনেক সুখকর যে, আমি এখন ব্লগ ও ফেইসবুক থেকে নিজেকে আসক্তিমুক্ত রাখতে পারছি। পরিবার ও পেশাগত জীবনের কর্মব্যস্ততা অনেক আনন্দের। ... ব্লগে মনোযোগ দিতে পারছি না; লিখবার ধৈর্য্য নেই, পড়তে বিরক্ত লাগে। কুটিমিয়াদের গ্রাম থেকে প্রায় তিন মাইল দূরবর্তী ঘোনা গ্রামে ফাল্গুন মাসে মেলা বসে। সেই মেলা তিন-চার দিন ধরে চলতে থাকে।

কুটিমিয়ার বয়স তখন চৌদ্দ পেরিয়ে গেছে। এমন এক মেলার দিনে তার আরেকজন প্রাণের সাথী রহিমুদ্দিন তাকে ধরে বসলো, ‘নু মামু, আইজ রাইত্রে জয়পাড়া হলে সিনেমা দেইক্যা আসি। ফিরার পতে মেলা দেখুম। ’ রহিমুদ্দিনের সাথে কুটিমিয়ার মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক। সে কুটিমিয়ার চেয়ে বয়সে সামান্য বড়।

আগেও তারা একসাথে বার কয়েক সিনেমা দেখেছে, তবে দিনের বেলা, রাতে এতো দূরে সিনেমা দেখতে যাবার সাহস পায় নি কুটিমিয়া। কিন্তু এবার পেলো। কারণ, আগের চেয়ে বয়স বেড়েছে। তাছাড়া মেলার জন্য রাস্তায় রাতভর মানুষজনের চলাচল থাকবে, ভয়ডরের বালাই নেই। সন্ধ্যার পর দিয়ে চুপিচুপি বাড়ি থেকে রহিমুদ্দিনের সাথে বেরিয়ে গেলো কুটিমিয়া।

সিনেমা হলে যাওয়ার পথেই মেলা। রাতের শো শুরু হবে নয়টায়। দুজনে মেলায় গিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলো, চড়ক গাছে চড়লো, মৌলভী সাহেবের দরগাহ্‌ শরীফ দেখলো, মুরলি কিনে খেলো, আরো কতো কী! তারপর সিনেমা দেখতে রওনা হলো। এখান থেকে হলের দূরত্ব মাইল খানেকের মতো। একটা জবরদস্ত ছবি দেখলো তারা— ‘নাগিনী’।

অসাধারণ প্রেমকাহিনি; ছবিভর্তি সাপ আর সাপুড়েদের কেরামতি, আর আছে নাগিনীবাঁশির সুরমূর্ছনা। যেসব ছবিতে দুরন্ত ঘোড়া আর সাপ-সাপুড়ে থাকে, সেসব ছবি কুটিমিয়ার দারুণ ভালো লাগে। ছবি দেখে মধ্যরাতে দুজন মেলায় ফিরলো। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর রহিমুদ্দিন বলে, ‘খুব ঘুম পাইতেছে রে, নু, বাইত্তে যাই। ’ ‘এতো রাইত্রে?’ কুটিমিয়ার কণ্ঠে ভয়।

‘তুই একটা ডর-হিয়াইল্যা। এতো ডরাছ ক্যান? আমরা দুইজন মামু-ভাইগ্ন্যা না? মামু-ভাইগ্ন্যা যেইখ্যানে আপদ নাইক্যা সেইখ্যানে। ’ এর একটু পর দুজনে মেলা থেকে বাড়ির পথে রওনা হলো। পথে নেমেই কুটিমিয়া টের পায়, তার মনে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই— হাজারো মানুষ মেলায় আসছে, ফিরে যাচ্ছে, কিছুদূর পরপর দু-চার জন আড্ডা দিচ্ছে, রাস্তার ধারে জুয়ার কোর্ট বসেছে— অনেক মানুষ গোল হয়ে ভিড় করে সেখানে হট্টগোল করছে। দিনের বেলায়ও গাছপালায় ঢাকা নির্জন রাস্তায় একা হাঁটতে কুটিমিয়ার গা শিউরে ওঠে।

কিন্তু এখন তার একদম ভয়হীন লাগছে— ভূতপ্রেত বলে কোনো কিছু থাকতে পারে তা-ও তার মন থেকে একেবারে হাওয়া হয়ে গেছে। ঘোনা থেকে কুটিমিয়াদের গ্রামে যেতে দুটি রাস্তা আছে। একটা রাস্তা খুব দীর্ঘ, কয়েকটা গ্রামের ভিতর দিয়ে অনেক পথ ঘুরে যেতে হয়, কিন্তু এটি ভালো পথ। এ পথ ধরে দোহারপুরী পর্যন্ত যেতে হবে, সেখান থেকে বামে মোড় নিয়ে খালপাড়ের কাঁচা রাস্তায় আধমাইলের মতো হাঁটা, তারপর ধান-পাট-গমের বিশাল চকের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হবে আরো এক মাইল— এরপরই কুটিমিয়াদের গ্রাম। পরের রাস্তাটি খুব সহজ— মেলা থেকে বের হয়েই চক বরাবর, ক্ষেতের আইল ধরে এই রাস্তাটা ওদের গ্রামের মাথায় পড়েছে।

কিন্তু এ রাস্তাটি নির্জন। রাতে চলার জন্য মোটেও ভালো নয়। ওরা ভালো রাস্তা ধরেই হাঁটতে থাকলো। এটি ভালো রাস্তা হওয়ায় মানুষের সমাগমও বেশি। মিনিট বিশেক হাঁটার পর রাস্তার দু পাশে ঘন বাঁশঝাড় পড়লো।

এতক্ষণ খোলা আকাশের নিচে তারার আলোয় পথ ছিল পরিষ্কার। কিন্তু এখানে এতো অন্ধকার যে চোখের সামনে নিজ হাতের আঙ্গুলটিও দেখা যায় না। দুজনে এ পর্যন্ত জোর কদমেই হাঁটছিল, কিন্তু এখানে এসে গতি মন্থর হয়ে গেলো, হাঁটতে লাগলো পা টিপে। ‘রহিম!’ অন্ধকার হাতড়ে রহিমুদ্দিনের কাঁধে হাত রাখে কুটিমিয়া। তারপর খানিকটা কাতর স্বরে বলে, ‘একটু অস্তে অস্তে হাঁট না।

’ ‘ডর লাগতেছে?’ রহিমুদ্দিন জিজ্ঞাসা করে। ‘না। ’ কুটিমিয়া গলার স্বরে সাহস প্রকাশের চেষ্টা করে, কিন্তু আদতে তা কাঁপে। ঠিক অমন সময়ে সামনে কী যেন প্রবল দাপাদাপি করে উঠলো, আর সঙ্গে সঙ্গে কুটিমিয়া ভয়ে লাফিয়ে উঠে রহিমুদ্দিনকে জড়িয়ে ধরে। যুগপৎ জন্তুগুলো খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দে চেঁচিয়ে উঠে দিগ্বিদিক ছুটে যায়।

‘ধূর পাগল, হিয়াল দেইক্যা কেওই ডরায়? তুই তো দেহি একটা আস্তা ডর-হিয়াইল্ল্যা। ’ কুটিমিয়াকে মৃদু ভৎর্সনা করে রহিমুদ্দিন। রহিমুদ্দিনকে ছেড়ে দেয় কুটিমিয়া। খেকশিয়ালের ডাক শুনে ভীতুরাই ভয় পায়। কুটিমিয়া পায় না।

হঠাৎ সামনে দাপাদাপি করে ওঠায় সে ভয় পেয়েছিল, এখন কেটে গেছে। নির্জন রাস্তায় বোবার মতো পথ চলতে নেই। মুখে শব্দ করতে হয়, হাততালি দিতে হয়, গান গাইতে হয়, দোয়াদরূদ পড়তে হয়। কুটিমিয়া একটু বিব্রত বোধ করছে। কারণ, ওর মুখটা বোবা।

ও কোনো গান জানে না, সুরা-কালিমাও জানে না। মাঝেমধ্যে টুকটাক দু একটা কথা যদিও বলে, কিন্তু বুকের ভয় দূর করার জন্য তা যথেষ্ট নয়। সে মুখ ফুটে বলতে পারছে না, ‘রহিম মামু, একটা গান ধর তো। ’ লজ্জায় সে নিজেও গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠতে পারছে না। হাঁটতে হাঁটতে দু পাশের বাঁশঝাড়ের সারি পার হলো।

আসমানের তারা দেখা গেলো। বুক হালকা হলো। রহিমুদ্দিনের মুখে এবার কথা ফুটলো। ‘ভূত দেইক্যা কুনো সুমায় ডরাবি না। যতো ডরাবি ভূত ততোই তর কাছে আইব।

সব সুমায় মনে মনে কবি, আমি ভূতরে ডরাই না। আমি ভূতরে ডরাই না। বুঝছা?’ ‘হ। ’ কুটিমিয়া নরম করে জবাব দেয়। ‘কানাওলায় ধরলে কী করন লাগে জানস?’ রহিমুদ্দিন জিজ্ঞাসা করে।

কুটিমিয়া কানাওলায় ধরার ভয়ংকর গল্প শুনেছে, যদিও নিজে কোনোদিন কানাওলার শিকার হয় নি। রাতের বেলা কানাওলায় বেশি ধরে। অনেক দূরের গঞ্জ থেকে ফেরার পথে বেপারিরা কানাওলার শিকার হয়। পাঁচ মাইলের পথ, অথচ ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা হাঁটতে থাকে, পথের শেষ হয় না; এক সময় ভোর হয়, তারা দেখে রাতভর এতো যে হাঁটাহাঁটি করেছে, তা কেবল একটি মাত্র ক্ষেতের চারদিকের আইল ধরে। রহিমুদ্দিন আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘জানস, কানাওলায় ধরলে কী করন লাগে?’ ‘না।

’ ‘কানাওলায় ধরলে ন্যাংটা অইয়া আডন লাগে। ব্যস, কানাওলা ছুইড্যা যায়। ’ কুটিমিয়ার শংকা হয়, ‘আমাগো কানাওলায় ধরে নাই তো?’ কিন্তু অচিরেই তার মন সংশয়মুক্ত হলো। বেশিক্ষণ হয় নি তারা মেলা থেকে রওনা দিয়েছে, এর মধ্যেই মোড়ের রাস্তায় পৌঁছে গেছে। কানাওলায় ধরলে এটুকু সময়ে এই মোড়ে পৌঁছা যেতো না।

এ রাস্তাটায় গভীর অন্ধকার, দু পাশে অসংখ্য ঝুটিধারী গাছপালা ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে; খালের পাড় ধরে আঁকাবাঁকা পথ। কোথাও গাছের গুঁড়ি, উঁচুনিচু জায়গা— একটু অসাবধানী হলেই হোঁচট খাবার ভয়। মোড়ের রাস্তায় নেমে পা টিপে টিপে হাঁটতে শুরু করলো দুজন। প্রায় আধ মাইল পথ হাঁটার পর গ্রামের শেষ, চকের শুরু। গ্রামের মাথায় এসে রহিমুদ্দিন হঠাৎ বলে ওঠে, ‘রাইত্রে কুনোদিন মানুষ কবর দিতে দ্যাকছা?’ কুটিমিয়ার গা ছমছম করে উঠলো।

ওরা এখন একটা গোরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এই কবরস্থানের কথা কুটিমিয়ার মনে পড়তো না, যদি রহিমুদ্দিন রাত্রে মানুষ মাটি দেয়ার প্রসঙ্গ না তুলতো। কুটিমিয়া এর আগে এ কবরস্থানে এসেছিল ওর দাদিকে কবর দেবার সময়ে। তবে সে সেদিন মাটি খোড়াও দেখে নি, মৃতদেহ কবরে শোয়ানোও দেখে নি। সে দূরে দাঁড়িয়ে কবরের চারপাশে মানুষের ভিড় দেখেছিল।

রহিমুদ্দিনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কুটিমিয়া উচ্চস্বরে কালিমা তৈয়ব পড়তে শুরু করলো— লা ইলাহা ইল্লাহু মুহাম্মাদুর রসসূলুল্লাহ্। কালিমা পড়তে গিয়ে দেখে তার মধ্যে এতক্ষণ যে লজ্জা বা সংকোচ ছিল, তার কিছুমাত্র নেই। এখন সে গলা ছেড়ে গানও গেয়ে উঠতে পারবে। কবরস্থান অতিক্রম করার পর পরই কুটিমিয়ার বুকের ভয় কেটে গেলো। কিন্তু তখনো সে সুর করে অনবরত কালিমা তৈয়ব পাঠ করছে।

কুটিমিয়ার দাদিজান অনেক দোয়াকালিমা জানতেন। তিনি বলতেন, যে কোনো বিপদ-আপদে অন্য কিছু যদি না-ও মনে থাকে, শুধু গলা ফাটিয়ে কালিমা তৈয়ব পড়লেই হবে, সমস্ত বালামুসিবত একশ হাত দূরে থাকবে। চকের মাঝামাঝি জায়গায় আসার পর রহিমুদ্দিন বলে বসলো, ‘খুব অরন লাগতেছে। বয়, একটু জিরাইয়া লই। ’ কুটিমিয়ার বসার ইচ্ছে ছিল না।

অল্প একটু পথ বাকি, তারপরই ঘর। এখানে বসে সময় নষ্ট করার অর্থ হয় না। কিন্তু রহিমুদ্দিন ইতোমধ্যে একটা তেমাথার ঢিভিতে ধপাস করে বসে পড়েছে; কুটিমিয়াও তার পাশটায় বসে পড়লো। রহিমুদ্দিনদের একটা পাগলা ষাঁড় আছে। এ তল্লাটে ওদের ষাঁড়টির মতো তাগড়া ষাঁড় আর কারোরই নেই।

নূরপুরের মাঠে পৌষ সংক্রান্তিতে গরুদৌড় হয়, তাতে ওদের ষাঁড়ের তেজ দেখে সবাই এক বাক্যে বলে, ‘হ, এইডাই অইলো সইত্যিকারের পাগলা ষাঁড়। ’ এ ষাঁড়টি যে এতো তাগড়া, এর পেছনে কারণও আছে। রাখালেরা বিরান মাঠে গরু চরায়, কখনোবা খুঁটি গেড়ে রসিতে বেঁধে দেয়। এ ষাঁড়টি খুঁটিতে বাঁধা হয় না, আলগা থাকে, চকের সমস্ত শস্যক্ষেত মাড়িয়ে আপন মনে চরে বেড়ায়। কখনোবা রাতের বেলাও এটিকে ছেড়ে দেয়া হয়।

ক্ষেতের ফসল নষ্ট হলেও কেউ বাধা দেয় না। কারণ, এ ষাঁড় গরুটি এ গাঁয়ের গর্ব। সবাই এটিকে খাইয়ে মোটাতাজা করার গর্বিত অংশীদার হতে চায়। হঠাৎ পেছনের দিকে কী একটা শব্দ শুনতে পেয়ে ওরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়; দেখে একটি ষাঁড় ক্ষেতের আইল ধরে ঘাস খাচ্ছে, সুতসুত করে মাটি শুঁকছে। ওরা বুঝতে পারে ওটা রহিমুদ্দিনদের পাগলা ষাঁড়।

দুজনে ষাড়ের কাছে এগিয়ে যায়। গলায় ছেঁড়া রসি ঝুলছে। এটাকে আজ ছাড়া হয় নি, গোয়ালঘর থেকে রসি ছিঁড়ে পালিয়েছে। ষাঁড়টি রহিমুদ্দিনের খুব বাধক। রসি হাতে তুলে নিতেই ঘুতঘুত করে সে আলাভোলা বালকের মতো মাথা দিয়ে রহিমুদ্দিনের শরীর ঘষতে লাগলো।

রসি ধরে রহিমুদ্দিন ষাঁড়ের আগে আগে হাঁটছে, পাশাপাশি হাঁটছে কুটিমিয়া। ভূতপ্রেতেরা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় গরুকে। গরুর সঙ্গে হাঁটলে জনমেও কোনো প্রেত কাছ ঘেঁষতে পারে না। পাগলা ষাঁড়ের সাথে চলতে গিয়ে কুটিমিয়া খুব নির্ভয় বোধ করছিল। কুটিমিয়াদের বাড়ির উত্তর দিকে প্রায় পাঁচশ গজ দূরে চকের মাঝখানে একটা পোড়ো ভিটা— খেজুর আর পেয়ারা গাছে ভরা, আর আছে শণের বাদাড়।

রাখাল ছেলেরা দিনের বেলা মাঠে গরুর পাল ছেড়ে দিয়ে দল বেঁধে এখানে আসে— পেয়ারা গাছে চড়ে বানর দলের মতো গাছ ঝাঁকড়ায়, গেছোমেছো খেলে, পেয়ারা খায়। পেয়ারা গাছের চেয়ে খেজুর গাছের সংখ্যা কম। কিন্তু তবু এটিকে সবাই খেজুর বাগ বলে। কারণ দূর থেকে দেখলে মনে হয় চকের মাঝখানে কেবল একসারি উঁচুমাথা খেজুর গাছই গলাগলি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শীতকালে খেজুর গাছের ডাওগাগুলো গোড়া থেকে ছেঁটে ফেলা হয়।

এ বছর যে-পাশ ছাঁটা হলো, পরের বছর ছাঁটা হয় এক ধাপ ওপরে তার উলটো পাশে। এ-পাশ ও-পাশ গুনে সহজেই বলে দেয়া যায় গাছটা কতো বছর ধরে ছাঁটা হচ্ছে। ছাঁটা অংশ তিন-চার বার চেঁছে ওপরের ছাল ফেলে মসৃণ করে কাটা হয়। একসময় সেই মসৃণ অংশে ঘামের মতো বিন্দু বিন্দু রস জমতে থাকে। চাঁছা অংশের দু পাশ থেকে সন্নিহিত কোণের দু বাহুর মতো দুটি ঢালু ও সরু নালা কেটে মাঝ বরাবর নিচে মিলিয়ে দেয়া হয়।

দু নালার সংযোগস্থলে যে কোণের সৃষ্টি হয় সেই কোণ বরাবর বাঁশের একটি নল বসানো হয়। নলটিও বিশেষভাবে তৈরি। একটি কঞ্চিকে প্রথমে অর্ধেক ফাড়া হয়। ফাড়া অংশের একদিক চোকা করে দু নালার কোণে ঢালু করে পুঁতে দেয়া হয়। এ নল বেয়ে গাছ থেকে রস ঝরে।

যারা খেজুর গাছ কাটে তাদের বলে গাছি। দুপুরে কিংবা বিকেলে গাছিরা হাঁড়ি পাতে— এ হাঁড়ির গলায় একটি সরু ও শক্ত রসি বেঁধে ডাওগার সাথে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। সারারাত ফোঁটায় ফোঁটায় নল বেয়ে হাঁড়িতে রস জমে। সকালে এ হাঁড়ি নামিয়ে আরেকটা বদল-হাঁড়ি পাতা হয়। বদল-হাঁড়িতে যে রস জমে তাকে আদতে রস না বলে বলা হয় ঝরা।

ঝরা সচরাচর বিস্বাদ কিংবা টক হয়ে থাকে। পালা করে তিনদিন রস ঝরানো হয়, পরবর্তী তিনদিন বিরতি থাকে। শীতের শেষের দিকে রসের পরিমাণ কমে আসে। তখন তিনদিনের বদলে এক সপ্তাহ পর্যন্ত এক নাগাড়ে গাছ কাটা বন্ধ থাকে। কখনো মাত্র এক বা দু দিনের জন্য রস পাতা হয়।

এ সময় কেবল ঝরাই নয়, রসও বিস্বাদ এবং টক হয়ে আসে। ঝরার পরিমাণ একেবারে কমে গেলে অনেক সময় এক, দুই কিংবা আরো অধিক দিন ধরে ঝরার হাঁড়িটি গাছে ঝুলতে থাকে, তখন ঝরা আরো কড়া ও কটু হয়, একটা উৎকট গন্ধও হয়। পাখি এসে নলে বসে, হাঁড়িতে ঠোঁট ঢুকিয়ে ঝরা খায়। চারদিকে মৌমাছি ভনভন করতে থাকে, কতো মৌমাছি আবার হাঁড়ির ভিতরে ঝরার সাথে মিশে পঁচে-গলে যায়; রাতের বেলা বাদুর এসে হাঁড়িতে ঝুলে পড়ে রস খেতে সচেষ্ট হয়। এই ঝরা তখন আর ঝরা থাকে না, হয়ে যায় ‘তাড়ি’।

ঝড়ো বাতাসে ঝুলন্ত হাঁড়িটি জোরে নড়বার ফলে নলের গোড়া আলগা হয়ে গেলে একসময় গাছ থেকে খসে পড়ে যায়, তখন ডাওগায় বাঁধা হাঁড়িটি গাছের এপাশ-ওপাশ বেধড়ক বাড়ি খায়, আর ঢং ঢং আওয়াজ হয়। খেজুরবাগের কাছাকাছি আসতেই ঝরার কটু গন্ধ এসে নাকে লাগে। এ বাগে এখন আর আগের মতো রস হয় না, গাছগুলো অনেক শীর্ণ ও থুত্থুরে হয়ে গেছে, একদিন রস পাতলে সাত দিন বন্ধ থাকে। ঝরার হাঁড়িটি অনেক দিন পর্যন্ত গাছে ঝুলতে থাকে, তাই ঝরার গন্ধ এতো কটু। রহিমুদ্দিন ষাঁড়ের রসি ধরে আগে আগে হাঁটছিল।

খেজুরবাগের ভিতর দিয়ে যাবার সময় পাগলা ষাঁড়ের দুষ্টুমি শুরু হয়ে গেলো। সে বার বার শণ-বাদাড়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে শণ খেতে উদ্যত হয়। রহিমুদ্দিন ষাঁড়ের রসি ধরে টান দেয়, কিন্তু ওটা একবার মাথা তুলে পরক্ষণেই ঘাসের উপর ঝুঁকে পড়ে। এবার কুটিমিয়াও পেছনে থেকে সামনে গেলো, এবং দুজনে একত্রে শক্ত করে ষাঁড়ের রসি ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকলো। কিন্তু কিছুতেই তারা ষাঁড়ের শক্তির সাথে কুলোতে পারলো না।

ঘাস খাওয়ার জন্য ওটা বড্ড অবাধ্য হয়ে উঠলো। রসি টানতে টানতে দুজনে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বিরক্ত হয়ে ওটাকে ছেড়ে দিল। রহিমুদ্দিন কষে একটা গালি দেয়, ‘যা হালার কুইত্তার বাচ্চা, জন্মের মতন ছন খা। ’ বলে সে হাত ঝাড়ে। কয়েক পা এগিয়েই রহিমুদ্দিন বলে, ‘জরা খাবি?’ কুটিমিয়া বিরক্ত হয়।

শীতের সকালে চুলাপাড়ে বসে চালভাজা আর রসের চা খেতে তার প্রচুর ভালো লাগে। কিন্তু সে ঝরা মোটেও পছন্দ করে না, কেউ সাধলে ওয়াক-থু করে বলে ওঠে, ‘আমি চুইক্যা রস খাইবার পারি না। ’ তাছাড়া হাঁটতে হাঁটতে পা খুব ব্যথা হয়ে গেছে। ঝরা খাওয়ার চেয়ে জলদি বাড়ি পৌঁছে বিছানায় শুয়ে পড়ার তাগিদটাই ওর কাছে জরুরি মনে হলো। একটা মাঝারি ধরনের খেজুর গাছের গোড়ায় গিয়ে রহিমুদ্দিন থামলো।

কুটিমিয়ার বিরক্তির শেষ থাকে না। সে গাছের আগার দিকে তাকায়। ডাওগার সাথে ঝুলন্ত হাঁড়িটি বাতাসে ডানে-বামে বাড়ি খাচ্ছে, মৃদু ঢংঢং শব্দ শোনা যায়। ‘গাছ কাডা বন্দ। খাইল্যা আরি ডনডন করবার লাগছে।

তুই জরা খাবি কই গনে?’ কুটিমিয়ার কণ্ঠ থেকে একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ে। লুঙ্গিতে কাছা দেয় রহিমুদ্দিন। আস্তে কদম ফেলে গাছের গোড়ার দিকে এগিয়ে যায় সে; ডান পা ওপরে বাড়িয়ে দু হাতে গাছ ধরে মাথা তুলে হাঁড়ির দিকে তাকায়, তারপর রাগত স্বরে বলে, ‘কুন হালায় কইছে গাছ কাডা বন্দ অইছে? পরশুদিনও চান্দাগাছি গাছ কাইড্যা গেছে। দেহছ না আরি বইরা ফুডায় ফুডায় জরা পইর্যা যাইবার লাগছে?’ কথাটা যে মিথ্যে নয় মুহূর্তেই কুটিমিয়া তার প্রমাণ পেলো। হাঁড়ি চুইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরা-রসের গুঁড়ি বাতাসে উড়ে এসে তার কপালে পড়লো।

সে ওপরে তাকিয়ে সূক্ষ্মভাবে পরখ করে আরেকটা জিনিস বুঝতে পারলো। রস পড়ার নলটি গাছ থেকে খসে পড়ে গেছে। হাঁড়িটি এখন ডাওগার সাথে রসিতে ঝুলে আছে, আর গাছের বুক বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রস নিচে পড়ে যাচ্ছে। ‘মামু, আরিতে একটুও জরা পাবি না। দেহছ না নল নাইক্যা?’ কুটিমিয়া বলে।

‘খালি বাদা দেয়। মুখ বুইজ্জ্যা বইয়্যা থাক। ’ বলতে বলতে রহিমুদ্দিন গাছ বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। কুটিমিয়া লক্ষ করে দেখে, রস চুইয়ে পড়ার ফলে ওপরের দিকে গাছটার অনেকখানি ভিজে জবজবে হয়ে আছে। খেজুর গাছ ভিজলে খুব পিছল হয়ে যায়।

ভিজা গাছে গাছিরাও উঠতে সাহস করে না, পা পিছলে পড়ে যাবার ভয়ে। ‘রহিমুদ্দিনরে কি পাগলে পাইছে?’ কুটিমিয়ার বিরক্তি বাড়তে থাকে। রহিমুদ্দিন গাছের ভিজা অংশের কাছে পৌঁছে গেছে। কুটিমিয়া আঁতকে উঠলো, রহিমুদ্দিন যদি পা ফস্কে পড়ে যায়! ওর কি মৃত্যুর ভয় নেই? কুটিমিয়া ভাবলো সে বলবে, ‘মামু, সাবদানে ওড্, গাছটা কিন্তু জবর পিছল অইয়্যা আছে। ’ আবার ভাবলো, এতে সে উলটো ঝাড়ি খাবে।

কুটিমিয়ার বুক কাঁপতে থাকে। অথচ আশ্চর্য, রহিমুদ্দিন স্বচ্ছন্দে তরতর করে ওপরে উঠে যাচ্ছে। গাছের মাথায় পৌঁছেই রহিমুদ্দিন ধমকে উঠলো, ‘এই হালার বেক্কল, এইডার মইদ্যে তো কুনো আরিই বান্দা নাই। মুখ শুকাইয়া ফাইড্যা রইছে। ’ বলেই সে বিরক্তভাবে নিচে নামতে থাকে।

কিন্তু কুটিমিয়া অবাক না হয়ে পারে না। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে গাছের মাথায় চাঁছা মসৃণ অংশ ফরসা দেখাচ্ছে, তার নিচে নলবিহীন অবস্থায় কালো হাঁড়িটা ডাওগার সাথে রসিতে ঝুলে আছে, বাতাসে এদিক-ওদিক বাড়ি খাচ্ছে, ঢংঢং শব্দ করছে। সে-ও রহিমুদ্দিনের ওপর বিরক্ত হয়ে বলে, ‘কী যে আবুল-তাবুল কছ! এতো নিচে গনে আমি দ্যাকপার লাগছি আরিড্যা জুলবার লাগছে, তুই কছ আরি নাই। ’ রহিমুদ্দিন কোনোরূপ উত্তর না দিয়ে চুপচাপ নিচে নামতে থাকে। অর্ধেক নামার পর হঠাৎ রহিমুদ্দিনের মাথায় এক ফোঁটা রস পড়ে, সে সঙ্গে সঙ্গে ওপরের দিকে তাকায় এবং অতিশয় আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করে যে একটা বড় রসের হাঁড়ি গাছটার মাথায় ডাওগার সাথে রসিতে ঝুলছে; তার এক পাশে নলের মাথাটি বের হয়ে আছে, যা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রস ঝরে পড়ছে।

সে মুখ নামিয়ে এক হাতে চোখ ডলে আবার ওপরের দিকে তাকায়। না, মোটেও সে ভুল দেখে নি। শুধু যে হাঁড়িটিই ঝুলে আছে তাই নয়, একটা বিশালাকৃতির দাঁড়কাক হাঁড়িটির গলার ওপর বসে নলের মাথায় ঠোঁট রেখে রস খাচ্ছে, তাতে বার বার হাঁড়িটি এদিক-ওদিক নড়ে গিয়ে গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে শব্দ করছে। ‘ও কুডি!’ কাঁপা গলায় রহিমুদ্দিন ডেকে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে সে সকল রহস্য ধরে ফেলেছে।

তাদেরকে কানাওলায় ধরেছে। মেলা থেকে তারা বের হয়েছে অনেক আগে, বাড়িতে পৌঁছতে এতো সময় লাগার কথা না। এই রাতবিরাতে ঝরা কিংবা রস খাওয়ার লোভ তার কোনোদিনই ছিল না। সে ভেবে ভেবে কেবলই অবাক হতে লাগলো, এর আগে খেজুর গাছ তো দূরের কথা, আমগাছেও সে অতো উঁচু শাখায় উঠতে সাহস করে নি। সেই রহিমুদ্দিন আজ কী করে রসের শেষ কাটালে এসে এই রাতের বেলা এতো উঁচু খেজুর গাছে উঠলো? প্রচণ্ডবেগে রহিমুদ্দিনের পা কাঁপতে শুরু করেছে।

গাছের মাঝামাঝি এসে সে স্থির হয়ে আছে। জোরে চিৎকার দিবে কিনা ভাবছে। তাতে কি কোনো লাভ হবে? ভয়েই ভয় বাড়ে। চিৎকার দিলে ভয় বহুগুণ বেড়ে যাবে, তার সাথে কুটিমিয়াও গলা ফাছিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠবে, কানে তালা লাগবে, কিন্তু উদ্ধার করার কেউ নেই এই নির্জন খেজুরবাগে। গ্রাম থেকে কি ওদের চিৎকারের আওয়াজ কেউ শুনতে পাবে? ‘কিরে, নামছ না ক্যান?’ কুটিমিয়া জিজ্ঞাসা করে।

‘কুডি!’ কুটিমিয়াকে ডেকে আর সে কিছু বলে না, আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে। ‘তারাতারি নাইম্যা আয় না? কী অইছে?’ খুব বিরক্তির সাথে কুটিমিয়া বলে। ‘কুডি!’ রহিমুদ্দিন খেয়াল করে দেখলো, মুখে শব্দ করলে বুকের ভয় হালকা হয়। সে বললো, ‘কুডি, আমার পায়ে খুব বিষ করতেছে রে। একটু উপ্রে উইড্যা আয়।

’ ‘কুন্ পায়?’ বলেই সে খেজুর গাছে উঠতে লাগলো। রহিমুদ্দিনের কাছে পৌঁছে সে আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘তর কুন্ পায় বিষ করতেছে?’ রহিমুদ্দিনের ভয় অনেক কেটে গেছে। সে একটা পা ঝাড়া দিয়ে বলে ওঠে, ‘যা, নাইম্যা পড়্, বিষ গ্যাছে গা। ’ রহিমুদ্দিন যখন গাছের গোড়ায় নেমেছে ঠিক তখন একটা বিশালকায় কালো পাখি ভারী ডানা ঝাঁপটে হাঁড়ির গলা থেকে উড়াল দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে হাঁড়িটি রসি থেকে ছিঁড়ে গিয়ে ঝপঝপ শব্দে নিচে মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। দুজনেই চমকে ওঠে, তবে পরক্ষণেই সামলে নেয়।

রহিমুদ্দিন আর কোনো দেরি করে না। বলে, ‘মামু, জলদি আট, খুব গুম পাইতেছে। ’ বলেই দ্রুত হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে রহিমুদ্দিন বলে, ‘ঐ যে আমাগো ষাঁড়ডা দেকলি না, ঐড্যা কিন্তু সইত্য সইত্যই আমাগো ষাড়গরু আছিল না। ’ কুটিমিয়া আরো জোর পায়ে সামনে এগিয়ে রহিমুদ্দিনের গা ঘেঁষে হাঁটতে থাকে।

রহিমুদ্দিন বলে, ‘ঐড্যা ষাড়ের ছল ধইরা আইছিল। ’ এ কথা শুনে কুটিমিয়ার শরীর হিম হয়ে আসে। ওর কাছে মনে হলো ষাঁড়টা আবার ওদের পিছু নিয়েছে, সুতসুত করে মাটিতে ঘাস শুঁকার শব্দ শোনা যায়। রহিমুদ্দিনকে পেছন থেকে ঠেলে দ্রুত হাঁটতে থাকলো কুটিমিয়া। ফিরে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না, মুখ দিয়ে কথা বলারও শক্তি হারিয়ে গেছে।

অথচ ষাঁড়টি যেন ওদের চেয়েও দ্রুত পায়ে পিছে পিছে হেঁটে আসছে। ষাঁড়ের হাঁটার শব্দ শোনা যায়। ওটি যেন পেছন থেকে তেড়ে আসছে, মনে হচ্ছে এক্ষুণি পেছন থেকে শিং দিয়ে গুঁতা মেরে ওপরে তুলে ফেলবে, তারপর দড়াম করে মাটিতে আছড়ে মারবে। সহসা তার মনে অন্য ভয় ঢোকে। এটা তো ষাঁড় না যে গুঁতা দিবে।

এটা এসে পেছন থেকে ঘাড় মটকে ধরবে। উঁচু করে তুলে নিয়ে ঝিলের কাদায় মাথা পুঁতে ফেলবে। হঠাৎ তার ভুল ভাঙ্গে। সে ভাবে, রহিমুদ্দিনের কথা ঠিক না, এটা সত্যি সত্যিই ওদের পাগলা ষাঁড়টা। ওটা ওকে চিনে বলেই এখন পিছে পিছে বাড়ি ফিরে আসছে।

তার বুকের ধুকধুকানি কমে যায়, ভয়ে ভয়ে পেছনে ফিরে তাকায় আর অমনি চোখে পড়ে আজদাহা এক হাতি শূঁড় উঁচু করে ওদের পিছে পিছে ধেয়ে আসছে। ‘রহিম রে, দ্যাক হাত্তি!’ কিন্তু রহিমুদ্দিন পেছনে তাকায় না। বলে, ‘জলদি দইর দে। ’ বলেই দৌড়াতে শুরু করে। কুটিমিয়াও দৌড়ায়।

এক দৌড়ে বাড়ির কাছে এসে শুকনো খাল পার হয়ে ওপাড়ে উঠে দুজনে পেছনে চকের দিকে তাকায়। শরীর দিয়ে দরদর বেগে ঘাম ছুটছে। রাস্তার ধারে কুটিমিয়াদের উত্তর ভিটার ঘর, তার ডুয়ায় হেলান দিয়ে দুজনে হাঁপাতে থাকে। রহিমুদ্দিন ফিসফিস করে বলে, ‘আল্লায় বাঁচাইছে রে। আমাগো দ্যাশে কুনো হাত্তি আছে? ঐড্যা অইলো শয়তান।

পয়লাবার আমাগো ষারের ছইল দইরা আইছিল, এইবার আইছে হাত্তির ছইল দইরা। ইশ্, অল্ফের জইন্যে রক্ষা পাইছি। দরবার পারলে এক পারায় মাডিতে গাইরা ফালাইতো। ’ কুটিমিয়ার পিঠে হাত দিয়ে রহিমুদ্দিন বলে, ‘খুব ডরাইছা? যা, গরে যাইয়্যা হুইয়্যা পড়্। ’ ‘তুই একলা যাইবার পারবি?’ কুটিমিয়া জিজ্ঞাসা করে।

‘পাগল!’ রহিমুদ্দিন বলে, ‘আমি যাইবার পারুম না ক্যান?’ ‘বাশছুপের নিচ দিয়া যাইবার সুমায় তর ডর লাগবো না?’ ‘আমি আবার কেওইরে ডরাই নি? জীবনে দ্যাকছা কুনোদিন?’ কুটিমিয়া হেসে দেয়। বলে, ‘তাইলে হাত্তিরে এতো বয় পাইলি ক্যান?’ ‘আমি আবার বয় পাইলাম কুতায়? বয় পাইছা তো তুই। ’ ‘তুইও অনেক বয় পাইছা। অহনতুরি তর বুক কাপতেছে। ’ রহিমুদ্দিন জড়ানো স্বরে টেনে টেনে বলে, ‘আমি আবার কারে বয় পামু রে, আমার চাইতে বড় কুনো কন্দকাটা আছে?’ বলেই সবগুলো দাঁত বের করে সে হাসতে থাকে।

তারপর গা থেকে জামাটি খুলে এক পাশে রাখে। রহিমুদ্দিনের খালি গায়ের ওপর কুটিমিয়ার দৃষ্টি পড়তেই ভয়ে তার কথা বন্ধ হয়ে যায়, সে লক্ষ করে রহিমুদ্দিনের গা-টি মানুষের গায়ের মতো না, ষাঁড়ের গায়ের মতো ওর গা, চামড়া দেখা যায় না, গা-ভর্তি কেবল কালো কালো লোম আর লোম, ওর ষাঁড়ের-গা থেকে ভেসে আসা প্রচণ্ড উৎকট গন্ধে কুটিমিয়ার পেট থেকে পাকস্থলি ঠেলে বের হয়ে যায় যেন। রাত প্রায় শেষের দিকে, ইতোমধ্যে শেয়াল আর মোরগের একপ্রস্থ ডাকাডাকি শেষ হয়ে গেছে। কুটিমিয়ার বাবার ঘুম ভেঙ্গে যায়, আর কিছুক্ষণ পর বাইরে এসে ওজু করবেন, তারপর নামাজ পড়ে চকে যাবেন ক্ষেতে ইটা ভাংতে, সঙ্গে কুটিমিয়াও যাবে। হঠাৎ ঘরের পেছনে ডুয়ার কাছে কিসের গোঙানির শব্দ শুনতে পান নালমিয়া।

তাড়াতাড়ি রহিমন বিবিকে ডেকে তোলেন, কুপিবাতি জ্বালেন। বাতি হাতে বাইরে এসেই দেখেন, কুটিমিয়া মাটিতে উপুড় হয়ে এলোপাথাড়ি হাত-পা ছিটকাচ্ছে, মনে হয় কেউ বুঝি তার পিঠের ওপর হাজারমণী পাথর চেপে রেখেছে, যন্ত্রণায় সে মাথা আছড়াচ্ছে, নাকমুখ দিয়ে লালা ছুটছে, সেই লালায় মুখের সামনে মাটি ভিজে যাচ্ছে। নালমিয়ার বুক ফেটে গেলো। সচিৎকারে ছেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, ‘ও বাজান, তুই এইখানে এমুন করতাছা ক্যান? ও বাজান? বাজানরে। ’ তিনদিন তিনরাত নুরু ফকিরের একটানা ঝাড়-ফুঁক চললো, তারপর কুটিমিয়ার মুখ ফোটে।

রাতে কেন সে বাইরের রাস্তায় গিয়েছিল, কেউ তাকে এই প্রশ্ন করলে সে সত্য গোপন রেখে বলে, ‘প্যাশাপ করবার গেছিলাম। ’ ‘তারপর?’ ‘শিমুল গাছে গনে কালো ছায়ার মতন আজদাহা একটা কী জানি নাইম্যা আইলো। দইর দিবার আগেই আমারে দইরা ফালাইলো। জরাইয়া দইরা মাডিতে ফালাইয়া দিল, তারপর আমার সাতে পাছরাপাছরি শুরু কইরা দিল। আমি ছুটপার চাই, কিন্তু ছুটপার পারি না।

চিক্কর দেই, কিন্তু গলা দিয়া শব্দ বাইর অয় না, আসের মতন ফ্যাশফ্যাশ করে গলা। ’ এ রহস্য ঘিরে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। কুটিমিয়ার চারপাশে মানুষ ভিড় করে নানান প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। সে জবাব দেয় আর রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করে। সর্বশেষ সে দেখেছিল— পাশে খালি গায়ে বসে থাকা রহিমুদ্দিন হঠাৎ করে ওদের পাগলা ষাঁড়ের ছল ধরে ফেলে, তারপর প্রচণ্ড শক্তিতে শিং দিয়ে ওকে মাটিতে পিষতে থাকে।

কুটিমিয়া প্রাণপণে ছুটে পালাবার চেষ্টা করে, কিন্তু ওর গায়ে যেন এক ফোঁটাও শক্তি নেই। সে সজোরে চিৎকার দেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু গলা দিয়ে কেবল ফ্যাশফ্যাশ আওয়াজ বেরোয়। কুটিমিয়ার মনে সন্দেহ দোল খায়, রহিমুদ্দিন আসলে মানুষ নয়, অন্য কিছু, মানুষের ছল ধরে সে মানুষের মধ্যে বসবাস করে। হয়তো আসল রহিমুদ্দিন একদা পয়দা হয়েছিল, তাকে ধ্বংস করে তার শরীরে এই রহিমুদ্দিনের আছড় পড়েছে। সুযোগ পেলেই সে আরেক জনকে গুম করে তার বেশ ধরে দিব্যি ঘুরে বেড়াবে পরবর্তী শিকারের সন্ধানে।

রহিমুদ্দিন যে আসল রহিমুদ্দিন নয় তার আরেকটা প্রমাণ হলো— গত তিন দিনে সে একবারও কুটিমিয়াকে দেখতে আসে নি, অথচ কতো মানুষ আসলো-গেলো। ঠিক এই সময়ে রহিমুদ্দিন এসে হাজির। পাশের মানুষ সরিয়ে রহিমুদ্দিন কুটিমিয়ার সিথানের কাছে এসে বসে। রহিমুদ্দিনকে দেখে এখন আর কুটিমিয়া ভয় পাচ্ছে না। তবে তার মনে হচ্ছে সে এ ঘরে একা হলেই ভয় পাবে।

শুধু তাই নয়, রহিমুদ্দিন তখন একটা ভয়ঙ্কর জন্তুর রূপ ধারন করে তাকে গলা টিপে মারবে। কুটিমিয়া রহিমুদ্দিনের চোখের দিকে এক নজর তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল, চোখে যদি কিছু দেখতে পায়— এ ভয় ওর মনে। রহিমুদ্দিন ঝুঁকে পড়ে কুটিমিয়ার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, ‘তরে না আমি ঘরে ঢুকাইয়া দিয়া গেছিলাম, পরে আবার কুন্ সুমায় বাইর অইছিলি?’ কুটিমিয়ার হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে যায়, ততোটা স্পষ্ট নয়, আবছা আবছা। রহিমুদ্দিনের চোখে চোখ রেখে সে তাকায়। সে মনে করার চেষ্টা করে।

হ্যাঁ, কিছুটা তার মনে পড়ছে, কেউ একজন তার ঘর পর্যন্ত এসে তাকে ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। পুরোটা মনে নেই। শুধু এটুকু মনে পড়ে— সে রহিমুদ্দিনের সাথে দৌড়ে এ পাড়ে এসে ডুয়ায় হেলান দিয়ে বসে পড়েছিল। এর মাঝখানেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে কেউ একজন তাকে বলেছিল, ‘ভালো কইরা ঘরে জাপ দিয়া হু। ’ সে তাকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল।

কুটিমিয়া চোখ বন্ধ করে এক ধ্যানে প্রতি কদম ঘটনার কথা মনে করার চেষ্টা করে, কিন্তু সবই আরো ধোঁয়াটে হয়ে যায়, কিছুই মিলে না। সিরিজ... প্রথম পর্ব : লৌকিক রহস; অথবা অলৌকিক দ্বিতীয় পর্ব : সাপ-রহস্য ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।