আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আরব ডায়েরি – ৩১ (আল বিরক বিচে একদিন ও বারবিকিউ)

... ইচ্ছে ছিল জিজানের ফারাসান আইল্যন্ড ঘুরতে যাব। ফারাসান আইল্যন্ড রেড সি’র মাঝে কতগুলো দ্বীপপুঞ্জের সমষ্টি। এটা আয়তনে আরব দেশ বাহরাইনের চেয়ে বড়। কিন্তু সে দ্বীপে গাড়ি নিয়ে যেতে হলে আগে থেকেই শীপে বুকিং দিতে হয়। এসব ঝামেলার কারনে এবার আর ফারাসান আইল্যন্ড যাওয়া হয়নি।

তাই বলে আমরা থেমে থাকিনি- অন্য আরেকটা ট্রিপের ব্যবস্থা করতে থাকলাম। সুযোগ হলে ফারাসান আইল্যন্ডে ভবিষ্যতে যাওয়া যাবে। এরই মাঝে আমাদের গ্রুপে নতুন আরেকটি ফ্যামিলি জয়েন করেছে। ১ সপ্তাহ হলো তারা এসেছেন। রিসালাত আপা ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছেন, সাথে ওনার হাজব্যান্ড রাশেদ ভাই।

প্রথম দেখাতেই ওনাদেরকে আমার বেশ ভালো লাগলো। আমাদের গ্রুপেও তারা খুব সহজেই মিশে গেলেন। টিমের সদস্য সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে আমাদের সমস্যাও বাড়লো। আগে বিভিন্ন ট্রিপে একটা টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার হলেই হতো। আমরা ৮/৯ জন খুব সহজেই বেড়িয়ে আসতে পারতাম।

এখন কাকে বাদ দেই? গত বছর আমরা শুকেইক বিচ ঘুরে এসেছিলাম। এবার ঠিক করলাম আল বিরক বিচে বেড়াতে যাব। বিচটাও অনেক বড় ও নিরিবিলি। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো গাড়ী নিয়ে। ২টা গাড়ী নিতে চাচ্ছিলাম না।

একেতো খরচ বেশী, তারপর জার্নিতে একসাথে থাকার মজা নষ্ট হবে। আমরা পরিচিত বাংলাদেশী ড্রাইভারদের মাঝে মাইক্রোবাস খুঁজলাম। কারোরই নেই। অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে মিলন একটা মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করতে পারলো। আমাদের আর পায় কে? আমরা দল বেঁধে বাজার করতে গেলাম।

বিচে বারবিকিউয়ের ব্যবস্থা হবে। বারবিকিউ ট্রে, ব্রাশ, কয়লা কেনা হলো। কেরেলান রেস্টুরেন্ট হতে বিশেষ পারোটা কিনে নিলাম বারবিকিউ’র সাথে খাবার জন্য। সকালের নাস্তার আয়োজন করা হলো, ফুটবল কেনা হলো বিচে খেলার জন্য, মাছ ধরার জন্য বড়শি আর জালের ব্যবস্থা হলো। আমরা চিন্তিত ছিলাম কিভাবে বিচে তাবু’র ব্যবস্থা করা যায় তা নিয়ে।

শেষ পর্যন্ত সবাই বেড কভার নিয়ে নিলাম। বুধবার রাতে আমরা যার যার মতো কাজ ভাগ করে নিলাম। দিবা নাগেটস ভাঁজবে, ইশরাত নুডুলস বানাবে। আর বাকীরা মুরগী প্রসেস করবে। ... দিবা ও ইশরাত চিন্তায় পড়ে গেল কিভাবে ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠবে? বারবার কনফার্ম হতে চাইল ওদেরকে বোকা বানাচ্ছিনাতো? ভোর বেলায় বৃহঃবার (৯ ফেব্রুয়ারি’১২) সকাল ৬.৩০ এ ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে হাজির।

সকালটা ছিল স্নিগ্ধতায় ভরা। একটু একটু ঠান্ডা লাগছিল। সবাই গরম কাপড় পড়লেও আমি শুধুমাত্র টিশার্ট পড়ে ছিলাম। যেখানে যাচ্ছি সেটা গরম এলাকা আর তখন প্রচন্ড রোদ থাকার কথা। ... আবহা থেকে জিজান যাওয়ার পথে গাড়ী নামছে আর আমরা হাসি তামাশায় মেতে উঠছি, সকাল হবার কারনে চারপাশে বেশ মেঘ দেখা যাচ্ছিল।

হঠাৎ কোন কারন ছাড়াই পোড়া গন্ধ পেলাম। প্রথমে আমরা তেমন আমলে না নিলেও দেখলাম কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার গাড়ী থামিয়ে দিল। চাকার ভেতর থেকে অনবরত ধোঁয়া বের হচ্ছে, কোনভাবেই কমছে না। ... আমরা টেনশনে পড়ে গেলাম, খাইছে !! পিকনিকের বারোটা বাজবে নাতো? শেষ পর্যন্ত গাড়ী চলল, আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। গাড়ী যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।

আস্তে আস্তে সবাই অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি। একটা গ্যাস স্টেশনে থামলাম সকালের নাস্তা সারার জন্য। নাস্তা শেষে চা খেতে গেলাম- চা’তো না যেন চিনির শরবত। আরো এক ঘন্টা ড্রাইভ করা শেষে আর বিরক এলাকায় আসলাম। তেমন কোন ভালো বিচের দেখা পেলাম না।

অনেক ঘুরে একটা বিচ পছন্দ হলো, কিন্তু আশে পাশে তেমন সুযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে। কয়েকজন ফ্যামিলি সেখানে তাবু ভাড়া নিয়েছে। এখানে বিচে তাবু ভাড়া দেয়া হয়। ... আমরা নিরিবিলি দেখে একটা জায়গায় থামলাম। প্রচন্ড রোদ আর বাতাস।

যদিও বাতাসের কারনে রোদের আক্রমন তেমন বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে শফিক ভাই গাড়ী থেকে নেমেই বিচে ফুটবল খেলতে লাগলেন। আমরা আছি টেনশনে-এই বাতাসে কিভাবে তাবু টানানো যাবে, বারবিকিউ এর আগুন জ্বলবে কিনা কুল কিনারা করতে পারছি না। তাবু টানাতে গিয়ে মহা হ্যাপা- বাতাসের কারনে কোন মতেই বেড কভারগুলো সামলাতে পারছিনা। একদিকে ঠিক করলে আরেকদিকে উড়িয়ে নিয়ে যায় ।

রাশেদ ভাই অনেক কষ্ট করে একটা ব্যবস্থা করলেন, আমি আর মিলন সাহায্য করলাম। শেষ দিকে শফিক ভাই ও আদিল ভাইও হাত লাগালেন। অবশেষে বেড কভার দিয়ে তৈরি রঙ্গীন তাবুতে প্রাণ আসলো। বারবিকিউ এর কয়লায় আগুন জ্বালাতে গিয়ে দেখলাম এটা আরো কঠিন কাজ। প্রচন্ড রকম বাতাসের কারনে কোন মতেই আগুন জ্বলছেনা।

আমরা পেট্রোল এনেছিলাম- তাতেও কাজ হচ্ছে না। আমি মোটামুটি ঝলসানো মুরগি খাবার আশা ছেড়েই দিলাম। কিন্তু রাশেদ ভাই লেগে থাকলেন, আধা ঘন্টা’র অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে আগুন জ্বালালেন। এতক্ষন পর্যন্ত আমি পানিতে নামিনি। সব কাজ শেষে দৌড়ে পানিতে নামলাম।

আহ! কি প্রশান্তি। মেয়েরা সবাই মিলে তখন পানিতে মজা করছিল। তাদের উঠিয়ে দিলাম বারবিকিউ তৈরি করতে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছি-এবার তোমাদের কাজ। রাশেদ ভাই আরাম করে পানিতে গা ডুবিয়ে শুয়ে রইলেন, আমরাও মজা পেয়ে গেলাম। বিচে অল্প পানিতে শুয়ে আছি, আর ঢেউ এসে ধাক্কা মারছে- অদ্ভুত মজা।

আদিল ভাই পানিতে নামতে চাননা, সিনিয়র মানুষ- আমাদের বাচ্চাদের মতো হুটুপুটি ওনাকে সাজায় না। আমাদের টিজিং আর ভাবীর ডাকাডাকিতে মুখ গোমড়া করে হাটু পানিতে কিছুটা সঙ্গ দিলেন। শফিক ভাই, মিলন আর রাশেদ ভাই পানিতে ফুটবল নিয়ে খেলছিলেন। একটা বাতাস এসে ফুটবলটিকে দূরে সরিয়ে নিল। আফসোস আমি ফুটবলটিতে একটা লাথিও মারতে পারলাম না।

আর ওদিকে পানিতে ফুটবল নিয়ে খেলতে গিয়ে শফিকভাই মোবাইল ফোন খানা ভিজিয়ে ফেলেছেন। ইশরাত আসার আগে বলেছিল এসব বিচে নাকি প্রচুর মাছ, পায়ে পয়ে বাড়ি খায়। তাই জাল ও বড়শি’র ব্যবস্থা করা হয়েছে। শফিক ভাই জিজান থেকে বড়শি নিয়ে এসেছেন, আর আমাদের ড্রাইভারের নিজেরই জাল আছে। আমিতো ভেবেছিলাম দু একটা ৫/৬ কেজি ওজনের কোরাল ধরেই ফিরব।

কিন্তু কোথায় কি? মাছের কোন দেখাই নাই। আমরা ৪ জন আধা ঘন্টা ধরে আনাড়ি হাতে জাল নিয়ে হুড়োহুড়ি করলাম। কিছু শামুক আর বালি ছাড়া আর কিছুই উঠলোনা। বড়শি ফেলব কি? আমাদের হতাশা দেখে ড্রাইভার সাহেব হাতে জাল নিলেন। নিপূন দক্ষতায় জাল ফেলতে লাগলেন।

যেন শিকারী বাঘ। কিন্তু সত্যই মাছ তেমন ছিলনা। ছোট ছোট কিছু মাছ উঠলো। কিন্তু মাছ ধরার নেশা বড় নেশা। ড্রাইভার সাহেব জাল ফেলছেন তো ফেলছেনই ।

ফেরার নাম নেই। অবশেষে আমাদের ডাকাডাকিতে ক্ষ্যান্ত দিলেন। ইশরাতের আশা ছিল ব্যাগ বোঝাই করে মাছ নিয়ে বাসায় আসবো। তা আর হলো না। অল্প কয়েকটা মাছ সে পরিস্কার করে ঝলসিয়ে নিল।

জাল দিয়ে মাছ ধরার অপচেষ্টা... মাছ ধরে এসে দেখি আদিল ভাই রোদ পোহাচ্ছেন, ব্যপার কি? উনি আমাদের সাথে গিয়েছিলেন ছোট একটা ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ভিডিও করতে। আর তখনই পকেটে থাকা মোবাইল ফোন পানিতে ভিজে গেছে। তাই তিনি ও মোবাইল ফোন দুজনেই রোদ পোহাচ্ছেন। ম্যানগ্রোভ জাতের গাছ এদিকে শাকিলা, দিবা বারবিকিউ তৈরি করে ফেলেছে, সাথে পারোটা আর ঝলসানো মাছ। লিজা ও ভাবী সবাইকে পরিবেশন করে দিল।

আমরা গোল হয়ে মজা করে খেলাম। বারবিকিউ প্রস্তুতি ধরে আনা মাছ ঝলসানো হচ্ছে ইয়ামি... ইয়ামি খাওয়া দাওয়ার পর সময় কিছুটা বাকী ছিল। ভাবলাম শুকেইক বিচ ঘুরে যাই। শুকেইক গিয়ে দেখলাম সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ। সৌদিরা সব বিচে ফ্যামিলি নিয়ে বসে আছে।

পানিতে দু একজন বাচ্চা ছাড়া আর কেউ নেই। আমাদের মেয়েরা সবাই পানিতে নেমে গেল। ছেলেরা দেখলাম কাপড় ভিজাতে হবে বলে কেউ আর পানিতে নামতে চায়না। আমি আর শফিক ভাই নেমে পড়লাম- লাফালাফি আর দাপাদাপি যা করার করে নিলাম। একবার বেশ কিছু পানি মুখের ভেতর ঢুকে গেল।

সমুদ্রের সব কিছুই ভালো – একমাত্র এই লবন পানি ছাড়া, মুখটা একেবারে বিস্বাদ হয়ে যায়। দিবা'র ক্যামেরায় ধরা পড়লো অসাধারন একটি মূহুর্ত ... তারপর সন্ধায় বাসার পথে রওনা হলাম। বাসায় এসে যখন গোসলে গেলাম – আমার চারপাশে শুধু বালি আর বালি। পকেটে বালি, কাপড়ের সেলাইয়ের ভেতরে বালি, জুতোয় এত বালি ছিল যে তা ফেলেই দিলাম। এবং আরামদায়ক ঘুম।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।