আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সৌর বিদ্যুত-ই দিতে পারে বিদ্যুত ঘাটতি পূরণের প্রধান অন্তরায়

শে সব ধরনের উত্পাদন ও প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি বিদ্যুত্। দেশের শিল্প উন্নয়ন তথা সার্বিক উন্নয়নে এই খাতের গুরুত্ব সর্বাধিক। সেই বিচারে সরকারকে বিদ্যুত্ খাতের ওপর অধিক নজর দেওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করি। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক হারে বিদ্যুত্ উত্পাদন এবং এই লক্ষ্যে কাজ করা। যদিও এই উপলব্ধি থেকে বর্তমান সরকার দেশে বিদ্যুত্ খাতের মানোন্নয়নে নানামুখী পরিকল্পনা ইতোমধ্যেই গ্রহণ করেছে।

উত্পাদিত বিদ্যুত্ ও ভাড়ায় চালিত বিদ্যুত্ দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ করা কতটুকু সম্ভব হবে? যদিও বর্তমান সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ২০১৩ সালের মধ্যে ৮ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুত্ এবং ২০১৫ সালের মধ্যে ১৫ হাজার ৩৫৭ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে, যা ইতিবাচক। কিন্তু ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা কোনোভাবেই দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট সমাধানের পথ নয়। যদিও সরকারের নানামুখী প্রকল্প গ্রহণের সুফল হিসেবে নগরবাসী কিছুটা হলেও বিদ্যুতের অসহনীয় লোডশেডিং থেকে রক্ষা পেয়েছে। সরকারের এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ একদৃষ্টিতে ইতিবাচক কিন্তু অধিক আমদানি নির্ভরশীলতায় বিদ্যুত্ উত্পাদন দেশের স্বার্থে কখনই মঙ্গলজনক নয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এতে ধারণা করা হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুতের এই চাহিদার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াটে।

এরূপ পরিস্থিতিতে দেশের সীমিত সম্পদ ও অধিক আমদানি নির্ভরশীলতা এবং গ্যাসের ওপর ভিত্তি করে বিদ্যুত্ উত্পাদন করে এই খাতের ঘাটতি কতটুকু লাঘব করা সম্ভব হবে সেটাই দেখার বিষয়। এক্ষেত্রে আমরা মনে করি, বিদ্যুত্ খাতের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করতে সরকারকে বিশেষ করে নিজস্ব প্রাইমারি এনার্জি ব্যবহার করে বিকল্প পন্থায় বিদ্যুত্ উত্পাদনের দিকে অধিক নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার যদি বিকল্প বিদ্যুত্ হিসেবে সৌরবিদ্যুতের প্রসার ও এর মূল্যহ্রাস, সেই সঙ্গে পুরনো প্রকল্পগুলো সংস্কার ও তা যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, অবৈধ সংযোগ রোধ, আমদানি নির্ভরশীলতা কমাতে প্রাইমারি এনার্জি সন্ধান ও কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুত্ উত্পাদনের দিকে অধিক গুরুত্বারোপ করতে পারে তবে তা হবে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক। কমমূল্যে আমরা যদি ঘরে ঘরে সৌরবিদ্যুতের সুবিধা নিশ্চিত এবং এ খাতের মানোন্নয়নে যদি প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে সক্ষম হই সেই সঙ্গে মধ্যমমেয়াদি বিদ্যুত্ উত্পাদনের প্রকল্পগুলো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও তা বাস্তবায়ন উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারি তবে আগামীতে এ খাতে যে ভয়াবহ সঙ্কটের আশঙ্কা করা হচ্ছে তা থেকে দেশ ও জাতিকে কিছুটা হলেও রক্ষা করা সম্ভব হবে। দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ও লোডশেডিংয়ের কারণে দেশের শিল্প-কারখানা বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে পড়েছে।

ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্পে মূল্যবান যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ছে। ফলে স্থবির হয়ে পড়ছে শিল্প-কলকারখানা। উত্পাদন কাজ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। বিদ্যুত্ সরবরাহ কম থাকায় কারখানায় শ্রমিকদের সঠিকভাবে কাজও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সারাদেশে ব্যাপকহারে বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে, দেখা দিচ্ছে সামাজিক নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা, যা দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

গ্রামগঞ্জে অনেকেই পল্লীবিদ্যুত্ সেবার আওতায় থাকলেও বারবার তাগাদা দিয়েও বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়ার অভিযোগ আছে। দেশের সীমিত সম্পদের ওপর ভিত্তি করে চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোনোভাবেই প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তাই প্রাকৃতিক সূর্যালোককে ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে এই বিদ্যুতের ঘাটতি যতটুকু লাঘব করা সম্ভব হয় সেই লক্ষ্যে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। ইতোমধ্যেই উন্নত দেশগুলো যেখানে সূর্যের আলো ব্যবহার করে বিদ্যুতের সঙ্কট নিরসনে কাজ করে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের ঋতুবৈচিত্র্য ও সার্বক্ষণিক সূর্যের আলোর উপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুতের ঘাটতি লাঘবে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার কীভাবে আরও জোরালো করা যায় সেই লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে বলা যায়, ইতোমধ্যেই এদেশের জনগণ এর সুফল পেতে শুরু করেছে।

২০০৩ সাল থেকে এর যাত্রা সফলভাবে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি মানুষকে এই সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে, যা এই শিল্প প্রসারে ইতিবাচক বলে মনে করি। বিদ্যুত্ সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টদের এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করাকে অনেকটা সাফল্য বলে মনে করি। বর্তমানে এই সুবিধার আওতায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুত্ সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী রাতের আঁধারে এখন আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছে, টেলিভিশনে ছবি দেখতে পাচ্ছে, ইন্টারনেট চালাতে পারছে, মোবাইল চার্জ দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে, গৃহস্থালি ও খামারি কাজে এই বিদ্যুত্ ব্যবহার করে অধিক সুফল পাওয়া যাবে। মোটকথা, পরিবেশবান্ধব, বিলবিহীন, নিরাপদ ও ঝামেলামুক্ত সৌরবিদ্যুত্ প্যানেলগুলো একাধারে ২০ বছর ব্যবহারের সুযোগ থাকায় এর চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তথ্যমতে, এখন প্রায় প্রতিদিনই দুই হাজার বাড়িতে বিদ্যুত্ ঘাটতি পূরণে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপন হচ্ছে।

ইতোমধ্যে প্রায় ২২ লাখ প্যানেল স্থাপনের মাইলফলক ছুঁয়েছে যা আমাদের মনে আগামীতে বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানে দারুণ আশার সঞ্চয় করেছে। অগ্রগতির এই ধারা আগামীতে অব্যাহত থাকুক এটাই জাতি প্রত্যাশা করে। অপর তথ্যমতে, ধারণা করা হচ্ছে সৌরবিদ্যুতের এই ২২ লাখ প্যানেল থেকে বিদ্যুত্ পাওয়া যাবে প্রায় ৯০ মেগাওয়াট, যার আওতায় ২০১৫ সালের মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপন করা সম্ভব হবে। যেখান থেকে বিদ্যুত্ পাওয়া যাবে প্রায় ১৭০ মেগাওয়াট। জাতীয় গ্রিডের যেখানে বিদ্যুত্ সরবরাহ নেই সেখানে এটি ব্যবহার করা যাবে।

ইতোমধ্যেই এই সৌরবিদ্যুত্ সেবা সম্প্রসারের জন্য, মাঠপর্যায়ে প্রায় ৪৭টির অধিক বেসরকারি সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। এখন যদি সরকার তাদেরকে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতে পারে এবং এই সেবা গ্রাহকদের দ্বারপ্রান্তে নিতে ব্যাংকিং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও গ্রাহকদের ঋণমুক্ত আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা সম্ভব হয় তবেই আমরা আশা করি বিকল্প বিদ্যুত্ হিসেবে সূর্যালোক থেকে বৈজ্ঞানিক পন্থায় সংগৃহীত সৌরবিদ্যুতের ছোঁয়া এদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। এরই ফলশ্রুতিতে বিদ্যুতের ঘাটতি কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যেই বর্তমান সরকার নতুন ভবন ও প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক সৌরবিদ্যুতের সেবা গ্রহণের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তা এই শিল্পের সার্বিক মানোন্নয়নে ইতিবাচক বলে মনে করি। তবে এই সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সত্যিকারের অর্থে সেবার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

সেবার নামে অর্থ জালিয়াতি, অবৈধ ব্যবসা ও অনৈতিক চর্চা থেকে বিরত থাকতে হবে। সরকার যদি বিদ্যুত্ উত্পাদনের পুরনো প্রকল্পগুলোর দিকে অধিক নজর ও এর সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে তবে পুরনোগুলো থেকে উত্পাদনকৃত বিদ্যুত্ যথাযথভাবে ব্যবহার করাও সম্ভব হবে। অবৈধ সংযোগ দানের মাধ্যমে আমাদের দেশে সিস্টেম লসের যে কথার প্রচলন আছে তা যত দ্রুত সম্ভব প্রতিহত করতে হবে। প্রাইমারি এনার্জি ব্যবহার করে নতুন নতুন বিদ্যুত্ উত্পাদন করার পথ সৃষ্টি করতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব গ্যাসের নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। অতি দ্রুত বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের দ্বারা গবেষণা করে দেশীয় এনার্জি সোর্স খুঁজে বের করতে হবে, সেক্ষেত্রে কয়লা খনির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে।

কয়লা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মূলত স্থানীয় কয়লা ব্যবহারের দিকে অধিক মনোনিবেশ করতে হবে। বর্তমানে সরকারের গৃহীত কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ উত্পাদন নিয়ে অনেকেই আশাহত। কেননা কুইক রেন্টালের মাধ্যমে যে পরিমাণ বিদ্যুত্ উত্পাদন আশা করা হয়েছিল তার সবই এখনও উত্পাদনে আসেনি বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিদ্যুত্ উত্পাদন ও চাহিদার পরিমাণ নিয়েও সঠিক তথ্য প্রকাশ করার মধ্যেও রয়েছে নানা বিভ্রান্তি। ফলে গড়ে বিদ্যুত্ উত্পাদন কতটুকু বেড়েছে তা নিয়েও অনেক সংশয় রয়েছে।

ইতোমধ্যে কুইক রেন্টাল প্রকল্প নিয়ে অভিযোগও উঠেছে অনেক। অনেকে ধারণা করছে, এই প্রকল্পের জন্য বেশি সময় দেওয়া হয়েছে এবং এই প্রকল্পের কারণে জ্বালানিতে ভর্তুকির পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে, কিন্তু বস্তুতপক্ষে বিদ্যুতের এই সঙ্কট রয়েই গেছে। সরকারের উচিত অভিযোগগুলো যথাযথ তদন্ত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত বিশেষ কিছু প্রকল্পের দিকে অধিক দৃষ্টি না দিয়ে বিদ্যুত্ উত্পাদনের সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রকল্পের দিকে সমান দৃষ্টি দেওয়া। সবশেষে বিদ্যুতের ক্রমাগত সঙ্কট নিরসনে নিরাপদ, বিলবিহীন ও পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুতের প্রসার অধিক জরুরি বলে আমরা মনে করি।

দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করে বিদ্যুত্ ঘাটতি লাঘব ও দেশের অর্থনীতির মজবুত বুনিয়াদ বিনির্মাণে সংশ্লিষ্টদের এই খাতে আরও অধিক মনোনিবেশ করার সদিচ্ছা কামনা করছি। লেখক : লাইব্রেরিয়ান, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি -  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।