আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোন এক একুশে ফেব্রুয়ারির গল্প এটি

© এই ব্লগের সকল পোষ্ট,ছবি,থিম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কোথাও বিনা অনুমতিতে প্রকাশ করা নিষেধ । ডিসক্লেইমার:এমন একটা সময়কে নিয়ে লিখতে যাওয়া যেই সময়টাকে আমি দেখিনি কখনো। ক্ষুদ্র এ চেষ্টায় ভুল জানি অনেক তারপরও চেষ্টা। সারাটা শহর জুড়ে ছাই চাপা আগুনের মৌন উত্তাপ। বোবা উত্তাপের ঐ আঁচ ছোট্ট চায়ের দোকানীটার মাঝে,শহরের চিকা-মারা দেয়ালে,রাস্তার এ গলি সে গলি পেরিয়ে খোলা মাঠে বসে থাকা কৈশোর পেরনো যুবক গুলোর মাঝে অথবা বিরামহীন ভাবে ডেকে যাওয়া কাক গুলোর মাঝে সুপ্ত আগ্নেয়োগেরির বইছে অবিরত।

আমি ও সেই আগুন ভেতরে পুষে হেটে যাই কলেজ স্ট্রিট থেকে নিউমার্কেট হয়ে নজরুল রোডের সরু রাস্তায়। আমার মত আসাদ,রাশেদ,সৌমেন্দ্র,কবির রা আসে এখানে প্রতিটা দিন আছর এর পর। সদ্য কলেজ পাস করা আমাদের মাঝে তখন স্বপ্নের অভাব নেই। নজরুল রোডের পাশের মাঠের রমিজ শেখের ছোট্ট হোলগা-বাঁশে গড়া চায়ের দোকনটায় বসে আমাদের স্বপ্ন দেখা পুষে রাখা আগুনটাকে স্ফুলিঙ্গে রূপ দিয়ে পাল্টে দেওয়া সময়টাকে। হয়তো সেই পাল্টে দেওয়ার স্বপ্নটা আমাদের একার ছিলো না, রমিজ শেখের মত কিশোরগঞ্জের প্রতিটা মানুষের ছিলো কিংবা পুরোটা বাংলাদেশের।

শরতের আকাশে তুলার মত মেঘেদের ছোটাছুটি,ছোটাছুটি আমাদের নতুন প্রকাশনার পরিকল্পনা নিয়ে। তবুও থেমে নেই নজরুল রোডের আড্ডা। এমনি শরতের কোন এক বিকেলের শুরুতে একটা জীপ এসে থামলও রমিজ শেখের চায়ের দোকানের উল্টো পাশের সরকারী ডাক্তারদের কলোনীটার গেটের পাশে। কিছুক্ষণ পরই জীপটার পেছনে এসে দাঁড়ালো রঙচটা একটা ট্রাক। দেখে বুঝার বাকী রইলো না নতুন কোন ডাক্তার এসেছেন কলোনিতে।

একে একে নামছে সবাই,মালামাল গুলে বুঝে নিয়ে,সেগুলোকে সঠিক জায়গায় রাখার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক। ধরে নিলাম তখন আমরা ইনিই হয়তো কিশোরগঞ্জ সরকারী হাসপাতালের নতুন ইন-চার্জ। হঠাৎ রাশেদ উঠে গিয়ে বলল,”আমরা কি কোন সাহায্য করতে পারি?”ভদ্রলোক বিনয়ের সাথে জানিয়ে দিলেন কর্মচারীরাই সব করে দিবে। সে সময় আমার চোখ আটকে গেলো চামড়ার সুট্যাটকেস হাতে নিয়ে নামছে একটি মেয়ে। সারা মুখে তার তখন দীর্ঘ ভ্রমণ ক্লান্তির ছাপ।

রুবি” কে সেটাই ছিলো আমার প্রথম দেখা। সেই দেখার সূত্রের শাখা প্রশাখা ই একদিন অনেকটাই পাল্টে দেয় আমার পৃথিবীকে। সেই পাল্টে যাওয়া পৃথিবীর মানচিত্রে ছিলো আমার মনের জমিন,ছিলো আমার দেশমাতা, ছিলো অগণিত অব্যক্ত অভিব্যক্তি উচ্চারণ। রুবি কয়েকটা দিন পরই ভর্তি হয় কিশোরগঞ্জ সরকারী কলেজে। আমরা তখন কলেজ চত্বরে শহীদ মিনার বানাবো বলে প্রিন্সিপাল স্যারকে বললাম।

৫২ এর পর অনেক জায়গায় শহীদ মিনার হলেও কলেজ চত্বরে আমাদের ছিলোনা কোন শহীদ মিনার। তাই আমরা নিজেরাই উদ্যোগ নিই শহীদ মিনার বানানোর। সেই সময়টায় অবাঙালী ডিসট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট আর পুলিশ সুপার নোটিশ দিলো এ রকম কিছু না করার । সেটা শুনে আমাদের বুকের সুপ্ত আগুনটা যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। ঠিক করলাম একুশের প্রকাশনা আর শহীদ মিনারের কাজ একই সাথে করবো ।

গোপনে তখন সংগঠিত করতে লাগলাম আমরা ছাত্র-শিক্ষক,সাধারণ মানুষ সহ সবাইকে। রাত জেগে প্রকাশনার কাজ আর শহীদ মিনার তৈরির সরঞ্জাম জোগাড়ে যখন ব্যস্ততার মাঝেও কলেজে যেতে হত তখন প্রায় প্রতিদিনই। আমাদের সেই সময়ে সকলের অংশ গ্রহণ নিশ্চিতের জন্য ঠিক করে দিতে হচ্ছিলো মনিটর। অল্প কয়েকদিনেই রুবি আমাদের সাথে কাজ করবে বলে জানিয়ে দিলো। তার ডাক্তার বাবার অনুপ্রেরণায় আর আমাদের একান্ত চেষ্টায় সে কলেজের মেয়েদের সংগঠিত করার চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করলো।

তার মাঝে তাকে প্রকাশনার কাজটাও বুঝিয়ে দিলাম। কলেজ শেষ করে প্রকাশনার কাজ শেষ করতে করতে প্রায় দেরি হতো বিধায়,আমি তাকে পৌঁছে দিতাম কোয়াটার পর্যন্ত। মাগরিবের আযান শেষ হয়ে যেত পৌছতে পৌছতে। দেখতাম “রুবি”র বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখতেই বলে উঠতেন রক্তিম তোমাদের কাজ কত দূর?আমি হেসে উত্তর দিয়ে বলতাম চলছে যুদ্ধ।

এই ভাবেই কথা এগোতে সময়। সেই সময়ের হাত ধরে জন্ম নেয় অবাক ভালোবাসার লন্ঠন,অব্যক্ত কিছু অনুভূতির পঙক্তি। ৬৫ এর ফেব্রুয়ারি । আমের মুকুলের গন্ধে পুরোটা কিশোরগঞ্জ মৌ মৌ করছে। শীতের তীব্রতা কমতে শুরু করছে।

কিন্তু তারপর ও কুয়াশার রেশ প্রায় থেকেই যেত। এরই মাঝে আমরা তৈরি করে ফেলি শহীদ মিনার। ২১ শে ফেবুয়ারীর খুব সকালে দেখা হয় রুবির সাথে। সে সাদা শাড়ি পড়ে এসেছিলো সে দিন। আমি তখন বড্ড ক্লান্ত একুশের প্রকাশনার কাজটার প্রুফটা সারা রাত ধরে করতে করতে।

সেই ক্লান্তিকে অগ্রাহ্য করে আমি রুবির হাতে দিলাম সেই প্রকাশিত বইটি আর একটি আলপনি জরানো কালো ব্যাচ। ঠিক সেই সময়টা কোথা থেকে যেন শুরু হলো তুমুল হট্টগোল। দ্বিকবিদিক ছুটছে মানুষ। পুলিশ এর অতর্কিত সেই আক্রমণে তখন প্রায় সবাই দিশেহারা। তখন আমিও ছুটছিলাম,কিন্তু খানিকটা দূর যাওয়ার পরই মনে হলো রুবির কথা।

দেখি সে পেছনে পরে আছে। আমি দৌড়ে গেলাম তার কাছে। হাতটি ধরেই বললাম চলো। বেশ খানিকটা পথ পেরোনোর পর দেখলাম সূর্য উঁকি দিচ্ছে কুয়াশার রেশ কাটছে। আমার তখন তীব্র পানির তৃষ্ণা।

সেই সাথে রাতভর জেগে থাকার ক্লান্তি। দেখলাম রাস্তার পাশে একটি টিউবওয়েল। টিউবওয়েলের হাতল চেপে পানি খেতে যাব, তখন রুবিনা বলল”আমি টিউবওয়েলটা চেপে দিচ্ছি। “কিছু বললাম না তখন। রুবি টিউবওয়েলটা চাপতে চাপতে বলে উঠলো,”রক্তিম আমার কিছু কথা ছিলো।

“আমি মুখটা সরিয়ে বললাম বলও। কি ভেবে যেন সে তখন বলল “আচ্ছা আজ তুমি বড্ড ক্লান্ত। বিশ্রাম নেও। পরে বলবো। “ আমি তাকে তার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিলাম।

ক্লান্তি আর দুর্বলতা নিয়ে বাসায় ফিরে ঘুম দিলাম। ঘুমটা ভাঙ্গলও ঠিক সন্ধ্যের সময়। বাড়িতে প্রচণ্ড জোড়ে কড়া নড়ার শব্দে। আমাকে সেদিন সন্ধ্যায় পুলি ধরে নিয়ে গেলো আইন অমান্য করার অভিযোগে। আমার সাথে আসাদ,রাশেদ,সৌমেন্দ্র,কবির রাও ছিলো সেদিন।

সেই সাথে ছিলো আরো অনেকেই। জেলে বসেই শুনতে পাই রুবির বাবা এই ধরণের কিছু একটার আঁচ করে তাকে সেদিনই ঢাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আমার ১০ মাসের মত জেল হলো। সেই সাথে ধরেই নিয়েছিলাম রুবির সমাপ্তি আমার সব কিছুতে। কারণ এর পরের সময় গুলোর দৃশ্য এত দ্রুত পাল্টে যায় যে আমার ভাবার শক্তিকে মিয়ম্রাণ করে দেয়। বাবা মারা যান সেই সময়টায়।

মা অনেকটাই নির্ভর হয়ে পরেন আমার উপর। পড়াশুনার বাকি পাঠটা শেষ করতে না করতে মা চলে যান আমায় ছেড়ে। দেশের পরিস্থিতি এত দ্রুত পাল্টাতে থাকে তখন বলার বাইরে। আমিও একা হয়ে যাওয়ার পর নিজেকে বিলিয়ে দিই মিটিং-মিছিলের সাথে। কিন্তু তারপরও স্মৃতি হাতরে বের করতাম রুবিনাকে,যাকে আমিরুবি বলেই ডাকতাম।

ভাবতাম কেমন আছে রুবি?এতটা দিনে হয়তো বিয়ে হয়েছে। হয়তো বা আমাকে ভুলেই গেছে। আচ্ছা সেদিনে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে কি বলতে চেয়েছিলও সে?কি ছিলো সেটা, সেই প্রশ্নের উত্তর কত সহস্রবার তারা করেছে আমায়। আমিও পালাতে চাইতাম সেই সব তাড়িত প্রশ্ন থেকে। এরই মাঝে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

জড়িয়ে পরি তাতে জুনের মাঝামাঝি সময়েই। ২নম্বর সেক্টরের অধীনে থেকে চালিয়ে যাই মুক্তির সংগ্রাম। এভাবে চলতে থাকে নয় টি মাসের সংগ্রাম। যুদ্ধ শেষের আবার ফিরে যাই সেই কিশোরগঞ্জে। কোন কিছুর প্রত্যাশা না করেই যোগ দিই কিশোরগঞ্জের পুরনো কলেজটাতেই।

অনেকটা দিন পার হয়ে যায়। কোন একটা কাজে একদিন যেতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে গিয়ে ঠিক বহু বছরের পুরনো সেই আমের মুকুলের সুবাস পাচ্ছিলাম। সেদিনকার বিকেলে কলা ভবনের তিন তলায় হঠাৎ করে আবার আটপৌরে শাড়িতে আবিষ্কার করলাম রুবিনাকে। সেই আবিষ্কারের অনুভূতিটা যেন কত সহস্র বছর মাটিচাপা পড়ে থাকা কোন পুরাকীর্তি বের করে আনার মত।

সেদিন রুবির বাসায় যাই। কথা হয় তার টুকু আর মিনুর সাথে। এও জানতে পারি রুবির স্বামী একাত্তরে শহীদ হয়েছেন। সন্ধ্যের সময়টায় রুবি বলে রক্তিম তোমার দেওয়া সেই একুশের প্রকাশনা আর ঐ আলপিনে গাথা কালো ব্যাজটা এখনো আছে। আমি শুনে হাসলাম।

খানিকটা চুপ থেকে রুবি বলে”সেদিনের একটা কথা বলতে গিয়ে বলা হয়নি রক্তিম। “আমি বললাম,”থাক না সেটা তার মতই। “রুবি মুখটা সরিয়ে নিলো। হয়তো চোখের জলটাকে লুকোনোর জন্যই। মিনু,টুকু,আমি আর রুবি হেঁটে যাচ্ছি শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে।

মিনু কে ঠিক ১০ বছর পেছনের রুবির মত লাগছে। আমরা হেঁটে যাচ্ছি শত আলোক বর্তিকা পেড়িয়ে। তখনো সূর্যের আলো ফুটেনি,আমার হাতটি ধরে মিনু বলে উঠে “কাকা চলেন এক সাথে গাই,আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো,একুশে ফেব্রুয়ারি...আমি কি ভুলিতে পারি। “  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।