আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গত শতাব্দীর আলোচিত রাস্ট্রনায়ক দেশপ্রেমিক ফ্যাসিস্ট এডলফ হিটলারের পতন....জীবনাবসান- বার্লিনের যুদ্ধ

এপ্রিল ১৯৪৫। হিটলারের জার্মান বাহিনী বিভিন্ন রণাঙ্গনে তখন খারাপ অবস্হায় । মিত্র বাহিনীর তিন প্রধান ষ্ট্যালিন, রুজভেল্ট আর চার্চিল -১৯৪২ সনে অবশ্য মিত্র বাহিনীর অন্যান্য প্রধানগন ঠিক তখনি জার্মানিকে ধ্বংশ বা জার্মানীর রাজধানী ফুয়েরারের আবাসস্হল বার্লিন আক্রমন করার কথা ভাবছিলেন না । সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী জোসেফ স্ট্যালিন (১৮৭৮- ১৯৫৩) তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন কম্যুনিষ্ট পার্টি জেনারেল সেক্রেটারি তথা প্রধানমন্ত্রী জোসেফ স্ট্যালিন বার্লিন দখল করার পরিকল্পনা করলেন। তার পরিকল্পনা ছিল আগে ভাগে আক্রমন করে জার্মানী দখল করলে ভাগে বেশি পাওয়া যাবে।

পেয়েছিলেনও মনে হয়। এই জন্য তিনি লাল ফৌজের মার্শাল যুকভ আর মার্শাল কনিভকে দায়িত্ব দিলেন বার্লিন দখল করার। মার্শাল গিয়র্গি যুকভ (১৮৯৬-১৯৭৪) মার্শাল ইভান কনিভ (১৮৯৭- ১৯৭৩) এছাড়াও স্ট্যালিনের লালফৌজে ছিলেন রাশান লে. জেনারেল চুইকভ (এর কাছেই জার্মান সেনাপতি পরে আত্ম সমর্পন করেন) ইত্যাদি। লে. জেনারেল চুইকভ (১৯০০- ১৯৮২) ২০ শে এপ্রিল ১৯৪৫ সোভিয়েত বাহিনী প্রথম বার্লিনে আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপ করে যা শেষদিন পর্যন্ত বিরামহীন ভাবে চলে। শোনা যায় লক্ষ লক্ষ টন গোলা শুধু বার্লিনেই নিক্ষেপ করা হয়।

ওতে বার্লিন বাসীর মাথা পিছু ৩৯ কিউবিক গজ ধ্বংশস্তুপ সৃস্টি হয়। সব খবর জেনে অন্যদিকে জার্মান সর্বাধিনায়ক ফুয়েরার এডলফ হিটলার বার্লিনকে যুদ্ধ ফ্রন্ট ঘোষনা করলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে বার্লিন প্রতিরক্ষা যুদ্ধের জন্য তার সেনাপতিরা ছিলেন লে. জেনারেল হেলমুথ রেম্যান পরে অন্য একজন নাম ছিল লে. জেনারেল হেলমুথ উইডলিং। এছাড়াও ছিলেন লে. জেনারেল গোথার্ড হাইনরিখি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত শুধু বার্লিন প্রতিরক্ষার জন্য ছিলেন জেনারেল উয়েডলিং।

জেনারেল রেম্যান (১৮৯২-১৯৮৮) লে. জেনারেল হেলমুথ উয়ডেলিং (১৮৯১- ১৯৫৫) লে. জেনারেল গোথার্ড হাইনরিখি (১৮৮৬-১৯৭১) এবার বার্লিন যুদ্ধের (Battle of Berlin) জার্মান আর সোভিয়েত বাহিনীর শক্তির তুলনামুলক চিত্রটাও দেখুন: জার্মান ক। সৈন্য: ১০,০০,০০০ জন খ। আর্টিলারি গান: ১০,৪০০ টি গ। ট্যাংক: ১৫০০ টি ঘ। বিমান: ৩৩০০ টি সোভিয়েত + পোলিশ ক।

সৈন্য: ২৫,০০,০০০ জন খ। আর্টিলারি গান: ৪১,৬০০ টি গ। ট্যাংক: ৬২০০ টি ঘ। বিমান: ৭৫০০ টি তবে শুধু বার্লিন প্রতিরক্ষার জন্য ছিল: ৪৫০০০ সৈন্য যাদের অধিকাংশই ছিল বৃদ্ধ পেনশন ভোগী আর কিশোর, ছিল পুলিশ বাহিনী কয়েক হাজার, ছিল হিটলার ইউথ (Hitler Youth) কয়েক হাজার আর ফোকসস্টার্মস বা পিপলস আর্মি ছিল ৪৫০০০ যারা সবাই মোটামুটি বৃদ্ধ, তাদের ছবি দেখুন নীচে সুটেড বুটেড রিটায়ার্ড লোকেরা রাইফেল কাধে: ২৩ শে এপ্রিল ১৯৪৫। বার্লিনের পুর্ব আর উত্তর পুর্ব দিক থেকে আক্রমন শুরু হয়।

২৪ শে এপ্রিল ১৯৪৫ লাল ফৌজ বার্লিন প্রায় ঘেরাও করে ফেলে। ২৫ শে এপ্রিলের সন্ধ্যা নাগাদ বার্লিনের প্রতিরক্ষা প্রায় ভেঙ্গে পড়ে। ছবিতে হালকা সবুজ আর ধুসর তীরচিহ্ন হল সোভিয়েত আর পোলিশ বাহিনীর আক্রমন আর লাল লাইনগুলো জার্মান প্রতিরক্ষা লাইন। মাঝে লাল প্রায় বৃত্তাকার জায়গাটা বার্লিন। লাল ফৌজ ভাবল বার্লিনে জার্মানদের রাইখস্টাড বা পার্লামেন্ট ভবন দখল করতে পারলে বার্লিন দখল সহজ হবে, থার্ড রাইখের পতন হবে, জার্মানদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে।

সুতরাং তারা সেভাবেই অগ্রসর হল, উদ্দেশ্য রাইখস্টাড দখল। ডানদিকে পতাকা চিহ্ন দেয়া চৌকোনা জায়গাটাই রাইখস্টাড। লালফৌজ মনে করেছিল রাইখস্টাড দখল করা খুব কঠিন হবে বাস্তবে অতটা বাধা পায়নি লাল ফৌজ। ৩০ শে এপ্রিল সকালে লাল ফৌজ রাইখস্টাড আক্রমন করল। ততক্ষনে জার্মান সেনার শেষ অবস্হা।

ঐদিন হিটলার তার প্রিয় সঙ্গিনী এফা ব্রাউনকে (Eva Braun) বিয়ে করেন। এফা ব্রাউন এবং হিটলার হিমলার (১৯০০-১৯৪৫) ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে আসামীরা: ছবিতে সামনের সারিতে সর্ববামে গোয়েরিং ঐ দিন তিনি জার্মানীর দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যাক্তি এয়ারফোর্স চীফ লে. জেনারেল হারম্যান গোয়েরিংকে আর আভ্যন্তরীন মন্ত্রী হিমলারকে বরখাস্ত করেন---- বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে। লে. জেনারেল গোয়েরিংকে বন্দী করা হয়। যুদ্ধ শেষে ৫ ই মে ১৯৪৫ গোয়েরিং মুক্ত হন। তবে ৬ ই মে তিনি আবার মিত্রবাহিনীর হাতে বন্দী হন এবং ন্যুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে তার বিচার হয়।

বিচারে তার মৃত্যুদন্ড হয়। তিনি দন্ড কার্যকর করার আগের দিন সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ৩০ শে এপ্রিল ১৯৪৫ বেলা আড়াইটায় হিটলার উপস্হিত সবার সাথে শেষবারের মত দেখা করেন, সবাইকে নির্দেশ দেন আর তার শেষ উইলের কথা জানিয়ে দেন । এরপর হিটলার আর এফা ব্রাউন আলোচনা করেন ও তাদের স্টাডি রুমে প্রবেশ করেন। বেলা ৩ টা থেকে ৪ টার মধ্যে তারা আত্মহত্যা করেন।

এফা ব্রাউন সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন আর অনুমান করা হয় হিটলার গুলি করে আত্মহত্যা করেন। এর আগে ২৯ শে এপ্রিল ১৯৪৫ ইতালীর পরাজিত ফ্যাসিস্ট সরকার প্রধান বেনিতো মুসোলিনি মিত্র বাহিনীর কাছে ধরা পড়ার ভয়ে ছদ্ম বেশে ইতালী থেকে পালাতে চেষ্টা করেন কিন্তু পথে ইতালীয়ান পার্টিসানদের মানে মুক্তিফৌজদের হাতে ধরা পড়েন। তাকে পার্টিসানরা মেরে একটা দোকানের সামনে লাশ ঝুলিয়ে দেয়। আর এই খবরটা হিটলার জেনেছিলেন। যে সোফায় বসে তারা আত্মহত্যা করেন বলে অনুমান করা হয় সেই রক্তাক্ত সোফাটার ছবি নীচে: লাল ফৌজ সৈন্যরা সোফাটা পরীক্ষা করছে।

ফুয়েরার বাংকার বেনিতো মুসোলিনি, ইতালীর ফ্যাসিস্ট শাসক হিটলারের ইচ্ছানুযায়ী তাদের মৃতদেহ ফুয়েরার বাংকারের বাইরে বাগানে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। পরে যারা বাংকারে গেছেন তারা পেট্রোলের গন্ধ পান। লাশ ছিল কিনা এ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক ছিল ---আছে। হিটলারের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী গোয়েবলস জার্মানীর নতুন চ্যান্সেলর নিয়োজিত হন। অবশ্য তিনি চ্যান্সেলর ছিলেন কয়েক ঘন্টা।

একই সাথে হিটলারের উইল মোতাবেক জার্মান নৌবাহিনীর প্রধান গ্রান্ড এডমিরাল কার্ল ডনিৎজ জার্মানীর প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। তিনি মাত্র কয়েক সপ্তাহ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২৩ মে ১৯৪৫ মিত্র বাহিনী ঐ মন্ত্রীসভা বাতিল করে। সাধারনত স্হলবাহিনীর লোকেরাই এধরনের নিয়োগ পান। তবে হিটলার মনে করতেন স্হল বাহিনী আর বিমান বাহিনী তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাই তিনি নৌবাহিনীর প্রধান ডনিৎজকে প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ দেন।

যুদ্ধ শেষে ডনিৎজ বন্দী হন আর ন্যুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে তার বিচার হয়। বিচারে তার ১০ বছর কারাদন্ড হয়। ১৯৫৬ তে স্পান্ডাউ কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান। তিনি অনেক দুর্লভ পদ 'গ্রান্ড এডমিরাল' ছিলেন যা পৃথিবীতে খুব বেশী ছিলনা। আর সেজন্য জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাকী জীবন তিনি সন্মান নিয়েই বেচে ছিলেন।

১৯৮০ সালে তিনি হৃদরোগে মারা যান। গ্রান্ড এডমিরাল কার্ল ডনিৎজ (১৮৯১-১৯৮০) এদিকে ১ লা মে রাত আটটায় নব নিযুক্ত চ্যান্সেলর গোয়েবলস একজন ডাক্তারের সাহায্যে তার ৬টি সন্তানকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলেন। প্রথমে তাদের মরফিন দিয়ে অজ্ঞান করিয়ে তারপর তাদের মুখে বিষ দেয়া হয়। গোয়েবলস তার স্ত্রী মাগডা আর তাদের ছয় সন্তান। পেছনে এয়ার ফোর্সের সার্জেন্টের ইউনিফর্ম পড়া লোকটা তার সৎ পুত্র।

এরপর গোয়েবলস আর তার স্ত্রী একজন সেন্ট্রিকে বলেন তাদের গুলি করতে এবং শোনা যায় তারা ঐ ভাবেই গুলি খেয়ে মারা যান। পরে তাদের দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয় তবে যথেষ্ঠ পেট্রোল না থাকায় তাদের দেহ সম্পুর্ণ পোড়েনি। পরে তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। হিটলারের স্টাফ মার্টিন বোরম্যান কয়েকজন সঙ্গি নিয়ে ১ লা মে লাল ফৌজের ঘেরাও টপকে পালাতে সক্ষম হলেও পরে আর তার কোন খোজ পা্ওয়া যায়নি। মার্টিন বোরম্যান জেনারেল হান্স ক্রেবস (১৮৯৮- ১৯৪৫) পরে ১৯৪৬ এর অক্টোবরে ন্যুরেমবার্গ এর আন্তর্জাতিক মিলিটারী ট্রাইবুনালে (International Military Tribunal) বিচারে বোরম্যানের অনুপস্হিতিতেই তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়।

প্রায় একই সময় হিটলারের বিশ্বস্ত জেনারেল বার্গডরফ আর বার্লিন প্রতিরক্ষার কমান্ডার জেনারেল উয়েডলিং এর চীফ অফ জেনারেল স্টাফ জেনারেল ক্র্যাবস আত্মহত্যা করেন ২রা মে ১৯৪৫। এদিকে জার্মান জেনারেল উয়েডলিং চেষ্টা করলেন রাশিয়ানদের কাছে আত্মসমর্পন না করতে কারন তাতে ম্যাসাকারের সম্ভাবনা ছিল। তিনি চাইছিলেন যেন যুক্তরাস্ট্র বা যুক্তরাজ্যের বাহিনীর কাছে সারেন্ডার করতে। তবে তা আর সম্ভব হয়নি। তিনি পরে প্রস্তাব দেন কিন্তু সোভিয়েত বাহিনী একবোরে বিনা শর্তে জার্মান বাহিনীর আত্ম সমর্পন যা একটু কঠিন ছিল, আর লাল ফৌজ তাতে রাজি হয়নি।

জেনারেল উয়েডলিং এর কাছে আর কোন পথও খোলা ছিলনা, বার্লিন তখন ধ্বংশস্তুপ। নীচে ছবিতে রাইখস্টাড এর ধ্বংশস্তুপ বার্লিন বিশাল আবর্জনার ভান্ডার। অবশেষে ২ রা মে ১৯৪৫ সকাল ৮-২৩ মিনিটে বার্লিন প্রতিরক্ষা অধিনায়ক জেনারেল উয়েডলিং লালফৌজের জেনারেল চুইকভ এর নিকট শর্তহীন আত্মসমর্পন করেন। একজন লাল ফৌজ সার্জেন্ট গিয়ে লাল রাশান পতাকাটা ভবনের মাথায় টাঙ্গিয়ে দেন। অন্যান্য জায়গাতেও কাস্তে হাতুড়ি মার্কা রাশান পতাকা টাঙ্গানো হয়।

শেষ হল ঐতিহাসিক বার্লিন যুদ্ধ।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৬ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।