আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প : ব্লু স্কাই হাইওয়ে

পাখি এক্সপ্রেস বাবার মন আজ খেয়াল করে দেখলাম কখনো মা’র কথা মনে পড়ছে, কখনো বাবার কথা। আমি ভাবতাম এদের কথা মনে পড়ে না। এ ব্যাপারে শিওর ছিলাম। তাই প্রায়ই বৌকে বলি আমি খুব শক্ত হৃদয়ের মানুষ। বিষয়টা আবার উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হয়।

তার কাছে দুনিয়াতে শক্ত বলতে কেবল শিমের বিচিই আছে। দশ টাকার শিমের বিচি ভাজা কিনে আনলে ছয় টাকার আভাঙা থেকে যায়। - আমি শিমের বিচির মতো শক্ত মানুষ। এভাবে বলার পর মাথাটা উপরে নিচে দু’বার নাড়িয়ে বুঝিয়ে দেয়, কথাটি সে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি বুঝতে পারছি না বাবা মাকে মনে পড়ার বিষয়টি এড়িয়ে যেতাম কেন? ইদানিং আমার মাঝে এড়িয়ে যাবার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।

গত পরশুর আগের দিন ছোটখাটো একসিডেন্ট করেছিলাম। একটা রিকশা মেরে দিয়েছিলো। খুব বিব্রতবোধ করেছিলাম। অন্তত রিকশা দুর্ঘটনায় পড়ার মতো অচেতন মানুষ আমি না। কিন্তু রিকশাওয়ালা বলতে গেলে গায়ের উপর তুলে দিলো।

এটা বেশ অপমানজনক। কাউকে বলতে গেলেও বিষয়টা ভারী হয় না। তুচ্ছ ব্যাপার। তাই এড়িয়ে গেলাম। রিকশাওয়ালাকে আরেকটু চোখ কান খোলা রেখে রিকশা চালানোর জ্ঞান দিয়ে ছেড়ে দিলাম।

আমার সাথে দু’জন কলিগ ছিলো। তারা বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাননি। পরে আর অফিসে যাইনি। বাসায় ফিরে ফেসবুকে একটা স্টাটাস দিলাম। এরপর থেকে কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি।

পরদিন অফিসে গিয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে সবার দৃষ্টি আকর্ষন করেছি। যাতে করে সবাই প্রশ্ন করে, আর আমি এড়িয়ে যেতে পারি। পুরো দুর্ঘটনা রাতে আবার স্বপ্নে দেখলাম। সবকিছু ঠিক আছে। কেবল স্বপ্নে দেখা দুর্ঘটনায় কোলে আমার আট মাস বয়সী ছেলে ছিলো।

রিকশা গায়ের উপর উঠিয়ে দেয়ার পর সে কোল থেকে ছিটকে পড়লো। কুড়িয়ে নিলাম। নড়াচড়া করেনি। চোখ দু’টো বন্ধ ছিলো। এবার আর দুর্ঘটনা এড়ানো যায়নি।

বিষয়টা ভারী হয়ে উঠলো। ঘুম ভেঙে গেলে ভয়ে কেঁদে দিয়েছি। বাকি রাত খুব বিষাক্ত ছিলো। ভালো ঘুম হয়নি। বাবাকে মনে পড়েছিলো।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে যেবার আইসিসি ট্রফি জিতেছিলো,স্কুল থেকে মিছিল নিয়ে বের হয়ে সেবার আমি একসিডেন্ট করেছিলাম। এটা ছিলো বাবার জন্য একটা উটকো ঝামেলা। তিনি নির্ভেজাল মানুষ। মনযোগ দিয়ে মুদি দোকান করেন। দুর্ঘটনার মতো ঝামেলা একদম পছন্দ করতেন না।

দুর্ঘটনার পর সবাই আমাকে বাজারে নিয়ে গেলো। প্রচন্ড রকমের বিরক্ত হয়ে দোকানের কর্মচারীকে বললেন পাঁজাকোলে করে বাড়িতে নিয়ে যেতে। বেশিদূরের পথ না। বাবাও সাথে সাথে ছিলেন। তিনি আরো বিরক্ত হচ্ছিলেন তখন।

সবাইকে বলছিলেন স্কুল থেকে ফিরে ভাতগুলো পর্যন্ত ঠিকমতো খায়নি। রেডিওতে জেতার খবর পেয়েই দৌড় মেরেছে। আজ রেডিও ভেঙে ফেলবেন বলেও হুমকি দিলেন। গ্রাম্য ডাক্তার ব্যান্ডেজ ট্যান্ডেজ করে যাবার আগ পর্যন্ত আরো বিরক্ত হলেন। অনেক বেশি বিরক্ত হয়ে কেঁদে দিলেন।

বললেন এতো বারণ করার পরও কেন কথা শুনি না। কেন বারণের পথে যাই! স্বপ্নের কথা বৌকে বলেছি। অফিসে গিয়ে প্রিয় এক কলিগকেও বলেছি। কিন্তু্ বাবাকে মনে করে দ্বিতীয়বার কান্নার কথা কাউকে বলিনি। বাবাকে এড়িয়ে গেলাম।

অনেক আগে থেকে এড়িয়ে যেতে যেতে এখন মনে হয় বাবা মা’কে মনে পড়ে না। গত ক’দিন ধরে মা ফোন করে বলেন বাবা নাকি অনেক নরোম হয়ে গেছেন। কারো সাথে কথা বলেন না। কেউ উনার সাথে কথা বললে বিরক্ত হোন। আজ সন্ধ্যায় ফোন করে অভিযোগ করলেন।

আমি কেন বাবাকে ফোন করি না? বললেন এখন একটু কথা বলতে। কথা বলা শুরু করলাম। বাবা প্রথমে মা’র কথা সত্য প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। বেশিক্ষণ টিকলেন না। সে চিরচেনা দরাজ গলায় কথা বলা শুরু করলেন।

এটা অনেকটা ছোট থেকে বড় এবং বড় থেকে ছোট খেলার মতো। শুরুতে আমি বড় বড় কথা বলি, বাবা বলেন ছোট ছোট। পরে ঠিক এর উল্টোটা হয়। বাবার চাঞ্চল্যতা বাড়িয়ে দিতে মাঝে একবার লাইন কেটে দিলাম। আবার কল দিলাম।

কথোপকথনে এতোটা মনযোগ দিয়েছেন যে, আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন লাইন কাটলাম কেন? বললাম -নেটওয়ার্ক সমস্যা। -নাকি ইচ্ছে করেই কেটে দিয়েছিস! বাবা আসলেই বদলে গেছেন। সম্ভবত লজ্জা ভেঙে গেছে। আমরা যখন পিচ্চি ছিলাম, বাবা কখনো কোলে নিতেন না। উনার লজ্জা লাগতো।

আমাদের সাথে কুয়ারা করে তনুননু করতেন না। তাতেও নাকি লজ্জা লাগতো। এখন আর সন্তানের জন্য হাহাকার লুকিয়ে রাখতে পারেন না। ফোনের লাইন কেটে গেলেও ছটফট করে উঠেন। অবশ্য এটাতে আমার খুশি হওয়ার কোন কারণ নেই।

বুড়ো কালে মানুষের এমনিতেই লজ্জা কমে যায়। তবুও বাবা দিনে দিনে অনেক বড় হয়ে গেছেন। এখন মুদি দোকান ছাড়াও অনেক কিছু বুঝেন। কিছুদিন আগে ঢাকা আমার বাসায় বেড়াতে এসে বুঝতে পেরেছেন তার ছেলে অসম্ভব কিছু করে ফেলেছে। মা’কে বলেছেন ছেলে নাকি চিন্তাভাবনায় তার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।

মা আবার কুটনামি করে কথাটি আমাকে বলে দিয়েছেন। তার যেনো বিশ্বজয় হয়েছে। বৃদ্ধকালে এসে ছেলেকে স্বামীর প্রতিপক্ষ বানাতে মা’রা খুব পছন্দ করে। চান ছেলে যেনো তার বাবাকে ছাড়িয়ে যায়। ছাড়িয়ে গেলেই দুনিয়ার আনন্দ।

অবসর সময়ে ছেলের পুরো মালিকানা নিজের কাছে রেখে বলতে পছন্দ করেন, “দেখেছেন, আমার ছেলে এখন কতো সামর্থবান হয়েছে? আপনিতো সারাজীবন তাকে ছোট করেই গেলেন!” মায়ের এমন নির্ভেজাল আনন্দ আরো বাড়িয়ে দিতে পত্রিকায় ছাপানো আমার সাক্ষাতকারটা দেখিয়ে দিলো তার পুত্রবধু। এবার পত্রিকা হাতে নিয়ে যুবতী মেয়েদের মতো দৌড় মেরে স্বামীর কাছে গেলেন। পত্রিকাটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফিরে এলেন। - দিয়ে এসেছি, দেখুক বসে বসে। বুঝতে পেরেছি মা তখন ছেলেকে বুকে জড়াতে চাচ্ছেন।

পাশ থেকে বাহুতে বেড় দিয়ে ধরলাম। একেবারে সিনেমার মা’র মতো ঘাঁড় বাঁকিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেখলাম ফাল্গুনী আকাশের মতো উজ্জ্বল একটি চেহারা। দুই টাকার বাবা বাবার সাথে আমার মেজো মামার বন্ধুত্ব ছিলো। বন্ধুর বোনকে বিয়ে করেছেন।

তখন বাবা ছিলেন দরিদ্র আর মামা ছিলেন মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের ছেলে। দৈনিক পনের বিশ টাকাতো খরচ করতেনই। বাবার কোন খরচ ছিলো না। মাসের পর মাস কোমরে লুঙ্গির ভাঁজে দুই টাকা গুঁজে রেখে কাটিয়ে দিতেন। এসব গল্প মা’র কাছে শুনেছি।

আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি, দৈনিক খরচের জন্য বাবার তহবিল থেকে বরাদ্ধ ছিলো দুই টাকা করে। মা’র তহবিল থেকে আসতো পাঁচ টাকা। আর দোকানের ক্যাশবাক্স থেকে চুরি করে যা পাওয়া যেতো! আমার বিশ্বাস ছিলো ঠিক এ বয়সে বাবার লুঙ্গির ভাঁজের দু’টাকার সাথে আমাকে দেয়া দু’টাকার কোন যোগসূত্র আছে। উনি আসলে রিমাইন্ডার সেট করে রেখেছিলেন। প্রতিদিন যখন আমাকে দু’টাকা করে দিতেন, তখন দরিদ্র কৈশোরের কথা মনে পড়ে।

উনি সচেতন হয়ে উঠেন। এটা এক ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। মা’কে ঠিক এভাবে বললে হেসে উড়িয়ে দিতেন। উনি আরো অনেক কিছু হেসে উড়িয়ে দেন। বলতাম বাবা প্রেম করে বিয়ে করেছেন এবং মা’কে প্রেমপত্র লিখতেন।

মা নাকি পড়ালেখা জানতেন না। আচ্ছা সেটা না হয় গেলো, কিন্তু চোখে চোখে নিশ্চয় প্রেম চালাচালি হতো। এবার মা আমাকে দৌড়িয়ে উঠোন ছাড়া করতেন। মা বোধহয় লজ্জা পেতেন। অথবা আনন্দ পেতেন।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস উনারা প্রেম করেছিলেন। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাবার সময় রিকশাওয়ালার জন্য ভাংতি দুই টাকা নিয়ে যেতে হয়। অবশ্য দু’একটা রিকশা মুলামুলি করলে দশ টাকায় যাওয়া যায়। কিন্তু আমিও বোধহয় কোন রিমাইন্ডার সেট করে রেখেছি। তাই সচেতনভাবে বারো টাকা দিয়ে যাই।

তখনো বাবাকে মনে পড়ে। আমার বয়সী একজন বাবাকে মনে পড়ে। তারপর এড়িয়ে যাই। ব্ল্যাক স্কাই হাইওয়ে আমরা সবাই কেমন বদলে গেছি। আমার সে বিলাতি বিড়াল, কৃষ্ণমহুরী খাল হারিয়ে গেছে।

প্রতি রাতে ধবধবে শাদা বিড়ালটি কৃষ্ণমহুরীর বুকে সাতার কাটতো। এটা ভোর রাতে হতো। বাবা ভাবতেন ভোরে উঠে গ্রামের মহিলাদের ফরজ গোসল দেখতে বেরিয়ে পড়তাম। নইলে কেন বলতেন ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে, আযান দেয়ার আগে উঠে কই যায়! ওসব ফরজ গোসলে আমার আগ্রহ ছিলো না। লাজুক নারী বরাবরই ভালো লাগতো।

কিন্তু একসময় বুঝে ফেলেছিলাম লজ্জা হচ্ছে স্পষ্ট কপটতা। ওটাকে বরং আড়ষ্টতা বলা যায়। খুব বেশি হলে বিব্রত হওয়া। মেয়েরা যখন দরজা বন্ধ গোসলখানায় গোসল করে, তখন দরজার ফুটো দিয়ে সে গোসল দেখলে লজ্জার গোমর ফাঁক হয়ে যায়। কীসব বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি! একান্তে নির্জনে যার লজ্জা নাই, অন্য কোথাও তার লজ্জায় সততা নেই।

সে কৌতুহল স্কুল জীবনেই ভেঙ্গেছে। বিলাতি বিড়ালের গল্পতো কলেজ পেরোনোর পরের। বাবা এখন কেবল মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটেন না। বরং চারপাশটা ভালো করে দেখেন। ছোটবেলায় বলতেন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে।

কে শোনে কার কথা! চারপাশে তাকিয়ে হাটতাম বলেই গ্রামের বহু মানুষের ভালো খারাপের সাক্ষি হতে পেরেছি। সেখান থেকে যা শিখেছি, তা বারোটা ক্লাস পড়েও শিখতে পারিনি। বাবা ঢাকা বেড়াতে আসলে তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছি। দেখেছি মিরপুর রোডের ফার্নিচার দোকানগুলোর সাইনবোর্ড পড়ে শেষে করে ফেলেছেন। এমনকি চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার মাজারের অপ্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন।

দেখেছি কোন কিছুতেই তিনি বিরক্ত হচ্ছেন না। অথচ এক সময় তার বিরক্তির শেষ ছিলো না। সেসব বিরক্তি আমাদের শৈশবকে বিষিয়ে তুলেছিলো। বাবা তার অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছেন। আমাকে সৌদি- দুবাই পাঠাতে না পারার কষ্ট, মুদি দোকানদার বানাতে ব্যর্থ হওয়ার আপসোস, কোরিয়া যেতে চেয়ে কয়েক লাখ টাকা নষ্ট করার ক্ষোভ হারিয়ে গেছে।

হারিয়ে ফেলেছেন কয়েক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সে ব্ল্যাক স্কাই হাইওয়ে। আমি বাড়িঘর ছেড়ে চলে আসার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন অন্তত একবার এ হাইওয়েতে চড়িয়ে ছাড়তেন। যখন আমার প্রতি রুষ্ট হতেন, থুতনির গোড়া থেকে শুরু হয়ে সৌদি দুবাই স্পর্শ করে কপালের উপর দিয়ে কোরিয়ার ইনচিয়ন বিমানবন্দরের পাশ দিয়ে এ হাইওয়ে গিয়ে থামতো বাম কানের পাশে। এটি নাকি বাবার রাগ রগ। যখন তীব্র রাগ হতেন, রক্ত জমে রগটি কালো হয়ে ফুলে যেতো।

চওড়া চেহারাটা দুর্ভিক্ষের হুকুমদাতা ঈশ্বরের মতো ভয়ংকর হয়ে যেতো। দীর্ঘ হাইওয়েটি ইঞ্চি মেপে মেপে পার হতাম। এছাড়া উপায় ছিলো না। ক্রোধ নেভা পর্যন্ত আটকে রাখতেন আর থেমে থেমে গর্জন করে উঠতেন। সেদিনের সে রাত, পরের কয়েকটি দিনের প্রতিটি মুহূর্ত মনে পড়লে এখন আর আঁৎকে উঠি না।

এখন আর হাত পা শীতল হয় না। ওসব এড়িয়ে যাই। চোখের সামনে নিজের সন্তান বেড়ে উঠছে। তাকে হারানোর ভয় জেগেছে। হারাতে পারবো না বলে আমার চেহারায় বাবাচর্চার রেখা নাই।

বাবার সেই চেহারা আর বর্ষার আকাশের চাইতে ভয়ংকর কিছু পৃথিবীতে থাকতে পারে না। বর্ষা আসুক। সন্তানের জন্য ঘরের ভেতর একটি ঝকঝকে নীল আকাশ বানিয়ে দিবো। বাবার ভালোবাসা বড্ড বিদঘুটে নোংরা। মুদি দোকানটা ভালোবেসেছেন।

চল্লিশ বছর ধরে তাই করছেন। ভাগ্য ভালো কোদালটা ভালোবাসেননি। নইলে হয়তো ওখানেই আটকে থাকতেন। থাকার জন্য টিনের ঘর ভালোবাসতেন। জীবনে অনেক সম্পত্তি হয়েছে, কিন্তু টিনের ঘরটি আর দালান হয়নি।

আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু উনার ভালোবাসা এড়িয়ে নিজেকে ভালোবেসেছি বলে আমাকে আর বনসাই বানাতে পারেননি। সে ব্যর্থতা নাকি উনাকে নরোম করে ফেলেছে। ফোন করলে মার একটাই কথা। তোর বাবা কারো সাথে কথা বলে না।

অবশ্য কবেইবা মার সাথে বাবা কথা বলতো! ওই যে রাতে ঘুমানোর আগে সন্তানদের খোঁজ খবর নেয়া আর দিনের বেলা বাজার থেকে ফিরে সাংসারিক আলাপ ছাড়া আর কোন কথা হতো বলে জানতাম না। ওসব কথাতে মার প্রেম বসেছে। সেসব শোনার জন্যই হৃদয়ে তোলপাড় লেগে যায়। যে দিনমজুর প্রতিদিন বাকি নিতে এসে বাবার বকা খায়, সেও হাসতে পারে। সেও তার স্ত্রীর সাথে দু’টো ব্যক্তিগত কথা বলতে পারে।

বাবা যেনো প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছেন। এখন আর সে প্রাতিষ্ঠানিক কথাও ফোটে না। খুব জোর করে ধরলে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারেন। -সুমন যদি ঢাকা থেকে আমাদের কাছে চলে আসতো...! মা জানেন, এসব মিছে মায়াকে তার ছেলে তুচ্ছজ্ঞান করে। বাবার ওসব কথায় তিনি অতিদ্রুত বিরক্ত হয়ে উঠছেন।

জানতাম না পিতা পুত্রের এ সম্পর্ককে উনি একটি গেম এর মর্যাদা দিয়েছেন। সেদিন খুব আকুতি মিশিয়ে বললেন -ওই কালো রগটি এখন আর নেই। কিন্তু ভয়ংকর কালো আকাশটা রয়ে গেছে। তোর বাসায় বেড়াতে গিয়ে সে আকাশটাও হারিয়েছিলো। গ্রামে ফিরে আবার আগের মতো হয়ে গেছে।

তুই মহান হয়ে যা। জিতে যা। জীবনের শেষ কয়টা দিন তোর কাছে নিয়ে রাখ। রাজি হয়েছে। যাবে বলেছে।

অবাক হয়ে দেখলাম বাবার মৃত্যুর সব প্রস্তুতি মা নিয়ে ফেলেছেন। মা’র সাহস দেখে কিছুটা ভরসা পাচ্ছি। হয়তো আমি জিতে যাবো। বৈশাখে জমিন থেকে ফসল ঘরে তুলে বর্ষার আগে আগে বাবা মা ঢাকা চলে আসবেন। এ বয়সে এসে বাবা যেন অভিমানি শিশু হয়ে গেছেন।

কিন্তু এ অভিমান যে নিজের উপর, তা কখনো স্বীকার করবেন না। এটাই বাবাকে শনাক্ত করার সবচেয়ে শক্তিশালী চিহ্ন। আমার আনন্দের শেষ নাই। এবার আর বুড়ো যাবে কোথায়! ঠিকই গলা জড়িয়ে ধরবো, হাত ধরে হেঁটে বেড়াবো, বসে বসে দুষ্টুমি করবো, চুল দাঁড়িতে চিরুনি করে দিবো, একসাথে সিনেমা দেখবো, রং চা খাবো। আর মার সাথে যে প্রেম করে বিয়ে করেছে, সে স্বীকারোক্তি আদায় করে ছাড়বো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.