আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"অডিও ইন্ডাস্ট্রির নৈরাজ্যের ব্যাপারে কি কিছুই করার নেই?"

চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য থেকে শুরু করে গান-কবিতা, গল্প-উপন্যাস বা নাটক-চলচ্চিত্রের উৎকর্ষতা তথা শিল্প-সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক চর্চা বিকাশের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এখন আর কেউ কোনো প্রশ্ন তোলে না। কিন্তু এসবের সাথে জড়িত মানুষগুলোর অসহায়ত্ব বা এ সেক্টরের নৈরাজ্য নিয়েও আর কেউ ভাবতে চায় না, এমনকি রাষ্ট্রও না। অথচ এক সময় রাজা-বাদশাহরা তথা রাষ্ট্র সরাসরি এই সেক্টরের পৃষ্ঠেপাষকতা করত। অবশ্য এখন তো অবশ্য সব বাণিজ্যিকিকরণের যুগ। জাতির ঐতিহ্য-মননকে সারা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরার এই সৃষ্টিশীল ক্ষেত্রগুলোও পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের করায়ত্তে চলে গেছে।

তাদের সিন্ডিকেটই গড়ে তুলেছে এক একটি ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রি। যেসব ইন্ডাস্ট্রির অনুমোদন ছাড়া কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক বা চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চাওয়ার ইচ্ছেকে এখন বোকামী বা 'আঁতেলেকচুয়াল' ভাবা হয়। তাদের মর্জির বাইরে কেউ এসে গান বা কবিতা শুনিয়ে যাবে বা একটা নাটক-চলচ্চিত্র দেখিয়ে যাবে, এমনটা তারা হতে দেবে না। অর্থাৎ শুধু ব্যবসাই নয়, শিল্প-সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক চর্চার গতিধারাই নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছেন এ জাতীয় ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সংঘবদ্ধ গডফাদাররা। কেন যেন এই অসুস্থতায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি আমরা।

গডফাদারদের ছত্রছায়াই খুঁজছি আমি, তুমি এবং পুরো বাংলাদেশ। অবশ্য এরপরও কখনো কেউ না কেউ ভাবে- 'এমন আর কত দিন চলবে?' বা 'কিছু একটা করা দরকার'। এই সেক্টরের শ্রমিক হিসেবে আজ আমি নিজেও এমনটা ভাবছি বলেই হয়ত এ লেখাটি লিখতে বসেছি। মূলত গত রাতে (২২ জানুয়ারি দিবাগত) বদন-পুস্তকে প্রবর রিপনের নবায়নকৃত অবস্থা (স্ট্যাটাস) পড়ে এ ভাবনা পুনরায় জেগেছে, যা ক্রমাগত ভীত-সন্ত্রস্ত করছে আমাকে। স্ট্যাটাসে রিপন জানিয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ড্রাষ্টিতে কপিরাইট ও আর্টিস্ট পেমেন্ট বিষয়ক জটিলতায় সৃষ্ট এক অনাকাংখিত ঘটনায় মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইবি) ঘোষণা দিয়েছে যে তারা সকল ব্যান্ড ও ব্যান্ড শিল্পীদের এ্যালবাম প্রকাশ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখবে।

আজ থেকে প্রায় এক মাস আগে তারা এই ঘোষনা দিয়েছে এবং এই অচলাবস্থা নিরসনে সরকার, মিডিয়া, বামবা এবং এমআইবি এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। রিপন আরো বলেছে, "এমন এক অবশ অবস্থায় আমরা মনোসরণি আমাদের প্রথম এলবাম 'মনোসরণি'র সব কাজ শেষ করে এ্যালবাম রিলিজ করতে পারছিনা, যা রিলিজ হবার কথা ছিলো পয়লা ফেব্রুয়ারী এবং কোন দিশাও পাচ্ছিনা এই অচলাবস্থা নিরসনের প্রচেষ্টায়। তাই আমরা নতুন ব্যান্ড হিসেবে উদ্যোগ নিতে চাই এই অবস্থা কাটানোর জন্য। আমাদের মত যাদের এ্যালবাম এই কারণে পড়ে আছে তাদের সহযোগিতা কামনা করছি এই উদ্যোগে। " *** বিষয়টি হয়ত এখনো অনেকের কাছে পরিস্কার হয়নি।

তাই এ ব্যাপারে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের চুম্বক অংশ তুলে দিচ্ছি। অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন দ্বন্দ্ব ব্যান্ড অ্যালবাম বিক্রি বন্ধসহ আন্দোলনের ঘোষণা বিগত কয়েকদিনে সংগীতশিল্পী ও সংগীত প্রযোজনা সংস্থার মধ্যে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রকম বিভ্রান্তি ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে সংগীতাঙ্গনে। এসব ঘটনাকে অডিও প্রযোজকদের জন্য বিভ্রান্তিকর, বিব্রতকর, অসম্মানজনক এবং অপপ্রচার বলে মনে করছেন অনেকেই। একই সঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য দেশের দু-একজন শিল্পীর প্রতিও সরাসরি আঙুল তুলছেন অডিও প্রযোজকরা। এসব সমস্যা নিরসনে রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইবি)।

সম্মেলনে অনির্দিষ্টকালের জন্য অডিও-ভিডিও অ্যালবাম প্রযোজনা ও প্রকাশনা বন্ধের ঘোষণাও দেওয়া হয়। এদিকে কপিরাইট আইন অনুযায়ী গানের মালিকানা এবং এর রয়্যালটি বিন্যাসের বিষয়ে শিল্পী, সুরকার, গীতিকার এবং প্রযোজকদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের জটিলতার সর্বশেষ ধাক্কাটি আসে ব্যান্ড তারকা জেমসের পক্ষ থেকে। জেমসের এক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দিবাগত মধ্য রাতে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন সাউন্ডটেকের স্বত্বাধিকারী সুলতান মাহমুদ বাবুল। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে অডিও প্রযোজকদের মনে। গ্রেপ্তারের পরদিন অডিও প্রযোজকদের সমিতি এমআইবি এবং কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ, রবি চৌধুরী, আসিফ আকবরসহ অনেকের প্রত্যক্ষ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জামিন পান সুলতান মাহমুদ বাবুল।

ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এটা তো কোনো খুনের মামলা নয় যে, মধ্য রাতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তা ছাড়া এমন একটা সময় তাঁর বাসায় পুলিশ পাঠানো হয়েছে, যে দিন ছিল বৃহস্পতিবার মধ্যরাত। পরের দুই দিন সরকারি ছুটি। কোর্ট-কাচারি বন্ধ থাকবে এবং তিনি জামিন পাবেন না। তবে কি সবই ছিল দুরভিসন্ধিমূলক এবং পরিকল্পিত! কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, মামলা-মোকাদ্দমায় জড়ানোর মতো কার্যক্রম কি আসলেই জেমস করছেন, নাকি অডিও ইন্ডাস্ট্রির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ এর ফায়দা লোটার অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ অডিও-ভিডিও দোকান মালিক সমিতির কার্যালয়ে আয়োজিত এক জরুরি সভায় অডিও-ভিডিও দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. মহিউদ্দিন পাটোয়ারী এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যেসব অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যান্ড শিল্পীরা প্রতিষ্ঠিত, তাঁরাই আজ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করছেন। যা কখনো কাম্য নয়। অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যান্ড শিল্পীরা যে ধরনের হয়রানিমূলক মামলা করেছেন তা প্রত্যাহার করা না হলে ব্যান্ড অ্যালবাম বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া বৃহত্তর আন্দোলনের নানা কর্মসূচি দেওয়া হবে।

এমআইবির সভাপতি নাজমুল হক ভুঁইয়া খালেদ বলেন, ২০ বছর ধরে বাংলা গানের প্রযোজনা ও প্রকাশনায় সাউন্ডটেক এবং সুলতান মাহমুদ বাবুলের অবদান অনেক। এই শহরের শীর্ষ শিল্পীদের ন্যায্য সম্মানি তো বটেই, অনেক তারকা শিল্পীর ফ্ল্যাট, গাড়ি, সংসার চলেছে সাউন্ডটেকের টাকায়। অথচ 'স্বাক্ষর নকল' করার অসম্মানজনক সাজানো অভিযোগে রাত দুপুরে তাঁকে গ্রেপ্তার করানো হয়। এটা পুরো ইন্ডাস্ট্রির জন্য লজ্জার। সাউন্ডটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুলতান মাহমুদ বাবুল বলেন, 'আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন জেমস।

অথচ জেমসের জন্য কি না করেছি আমি। তার শেষ অ্যালবামটি তো সাউন্ডটেকের টাকা দিয়ে তৈরি করে অন্য প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করে দিয়েছেন বেশি লাভের আশায়। আমার সেই টাকাও তো পেলাম না। এক সময় রাত নেই দিন নেই যখন জেমস টাকা চেয়ে লোক পাঠিয়েছেন, তখনই আমি তাঁর সন্মান রক্ষার্থে টাকা পাঠিয়েছি। সব ডকুমেন্ট আমার কম্পানির হাতে রয়েছে।

সাউন্ডটেকের কাছে জেমসের কোনো পাওনা টাকা নেই। বরং সাউন্ডটেকের টাকা নিয়ে অন্যত্র অ্যালবাম বিক্রি করে দেওয়ায় এখন প্রতারণার মামলা করবে সাউন্ডটেক। পাশাপাশি জেমস আমাদের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছেন তারও হিসাব নেবে সাউন্ডটেক। ' এ বিষয়ে জেমস বলেন, 'কপিরাইট আইন ভঙ্গ করে শিল্পীদের অর্থ আত্মসাৎ করার ঘটনা এ দেশের প্রযোজকদের বেলায় নতুন কিছু না। অথচ দেশের প্রথম সারির শিল্পীদের অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসা কিংবা নানা প্রয়োজনে সাহায্যের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়।

আমি শিল্পীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ নিয়েছি। এটা সুখের খবর যে, আইন ও সরকার আমাদের দাবি আদায়ে সচেষ্ট হচ্ছে। ' *** আশাকরি বিষয়টি এখন সবাই বুঝতে পেরেছেন। তারপরও এখানে আরো কিছু কথা উল্লেখ করা প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। বিজয় দিবসের রাতে বাবুলের গ্রেপ্তারকে নতুন প্রজেন্মর সঙ্গীতের বিজয় হিসেবে অবহিত করেছিলেন ব্যান্ড শিল্পীরা।

ব্যান্ড তারকা পার্থ বড়ুয়া বলেছিলেন, "আমার জীবনে আজ সত্যিকারের বিজয়ের রাত। সুলতান মাহমুদ বাবুলরাই অডিও ইন্ড্রাস্ট্রি ধ্বংসের মুল হোতা। এরাই সবচেয়ে বড় পাইরেসির চক্র। '৯০ সালের পর নামমাত্র টাকায় শিল্পীদের অ্যালবাম বিক্রি করে তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সুপারহিট অ্যালবামেও তারা কোনো রয়্যালিটি দেয়নি শিল্পীদের।

শিল্পীদের 'বেস্ট অফ' অ্যালবাম প্রকাশের ক্ষেত্রেও কোনদিন অনুমতি দেননি। এরাই ভদ্রবেশী অডিও প্রডিউসারের নামে ভারতীয় ক্যাসেট পাইরেসি করে বাজারজাত করেছে। শুধু তাই নয়, এরাই একদিকে পাইরেসি করে অন্যদিকে পাইরেসি রোধে আন্দোলনও করে। বিষয়টা অনেকটা চোরকে চুরি করতে বলে গেরস্থকে সযোগ থাকতে বলার মতো। জেমসকে এই সাহসী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমি অভিনন্দন জানাই।

" বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিক অ্যাসোসিয়েশনের (বামবা) সভাপতি ও ব্যান্ড তারকা হামিন আহমেদ বলেছিলেন, "সঙ্গীতের নানা অনিয়ম দূর করে আমরা অডিও শিল্পকে পুনরুদ্ধারের শপথ গ্রহণ করেছি। বাবুলের মতো একজন ব্যবসায়ী জেমসের মতো একজন শিল্পীর সই নকল করে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত হয়েছে। সে তার অপকর্মের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছে। এতেই সঙ্গীতের বড় একটা বিজয় সাধন হয়েছে। পাইপলাইনে আমাদের আরো অনেক পদক্ষেপ রয়েছে।

পর্যায়ক্রমে সেগুলো আসবে। থলের বেড়ালকে ধরা পড়তেই হবে। " ওই সময়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে আরো জানা গেছে, "বাবুল সাউন্ডটেকের নবাবপুরের ঐতিহ্যবাহী শোরুমটিকে বিক্রি করে দিয়েছেন। ক্রমশ সাউন্ডটেক অডিও শিল্পের টাকাকে অন্যখাতে বিনিয়োগ করে জুরাইনে সুবিশাল মার্কেট এবং ইম্পেরিয়াল সিরামিক ইন্ড্রাস্ট্রি গড়ে তুলেছে। কোনোমতে পাটুয়াটুলীতে এখন সাউন্ডটেকের একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে মাত্র।

অডিও শিল্পের টাকা অন্যখাতে বিনিয়োগ হওয়াতেই শিল্পীদের আজ এই দুরবস্থা বলে মনে করেন অডিও ইন্ড্রাস্ট্রি সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর নেতারা। " *** আমাদের রাস্ট্রে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় নামক একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। যার মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এবং প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন অডিও ইন্ডাস্ট্রির এই নৈরাজ্য সম্পর্কে আদৌ জানেন কিনা সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে। তবে এ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আছেন 'সুপার-হিট' শিল্পী মমতাজ ও অভিনেত্রী তারানা হালিম। তারা অন্তত এই বিষয়টি সরকারের গোচরে আনবেন, এমনটা আশা করা কি ভুল হবে? আসলে বুঝে উঠতেই পারছিনা এই অবস্থায় আমাদের করণীয়টা কি; নাকি কিছুই করার নেই?  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.