আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘A Separation’: যেখানে কেউ দায়ী নয়, প্রত্যেকেরই কারণ আছে

“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, ‍স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” ইরানিয়ান চিত্র পরিচালক আসগার ফারহাদী যখন ম্যাডোনার কাছ হতে তার “A Separtion” ছবির জন্য এই বছরের গোল্ডেন গ্লোব সেরা ছবির পুরস্কার গ্রহন করেন, তিনি ম্যাডোনার সাথে হ্যান্ডসেক করেন নি। এমন কি, এক সাক্ষাতকারে তিনি এই ছবির কোনো রাজনৈতিক অর্থও চিন্তা করতে নিরুৎসাহিত করেছেন। এমন এক সময়ে তিনি এই ছবিটি ইরানে বসবাস করে, ইরানের মাটিতে, ইরানের দর্শকদের জন্য তৈরী করেছেন যখন মাত্র দুইমাস আগে ইরান সরকার ইরানের বিখ্যাত চিত্র পরিচালক জাফর পানাহীকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ইরানের ইসলামিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডার অপরাধে ছয় বছরের জন্য জেল এবং বিশ বছরের জন্য চলচ্চিত্র নির্মানে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং আরোপ করেছে কঠোর সেন্সরশিপ। ছবিটির ভিতরে না ঢুকে, শুধুমাত্র এই তথ্যগুলোই “A Separation” ছবিটি দেখার জন্য আমাকে উৎসাহী করেছিলো। ছবিটি শুরুই হলো চমক দিয়ে।

আর্টিস্টদের পরিচয়পত্র ফটোকপি করার মাধ্যমে ক্রেডিট দেখানো। মুগ্ধতা নিয়ে যখন প্রথম দৃশ্য দেখা শুরু করলাম, “Anne Hall”- এর কথা মনে পড়ে গেলো। দেখা গেলো, দুইজন স্বামী-স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে বিচারকের সাথে কথা বলছে। নিজেকে বোঝালাম এটা বোধহয় ডিভোর্স নিয়ে অন্য অনেক ছবির মতোই আরেকটি সাধারণ ছবি- Kramer vs Kramer goes to Tehran! কিন্তু এরপরেই পরিচালক কাহিনীতে নতুনত্ব আনলেন, গতি সঞ্চার করলেন, ফ্যামিলি ড্রামা থেকে শুরু হলো কোর্টরুম ড্রামা, একজন স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যেকার separation হয়ে গেলো সমাজের বিভিন্ন দিকের separation, আর এভাবেই এই ছবিটি গতানুগতিক থেকে হয়ে উঠলো এক অনন্যসাধারণ ব্যতিক্রমী ছবি। সিমিন আর নাদের, ইরানের উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিনিধিত্বকারী এক দম্পতি, যাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় চৌদ্দ বছর এবং এগার বছরের এক মেয়েও আছে, নাম তেরমাহ।

আর আছে আশি বছরের বৃদ্ধ বাবা, যে আলঝেইমার রোগে* আক্রান্ত। সিমিন আমেরিকায় যাবার সুযোগ পেয়েছে, সে তার স্বামী এবং মেয়েকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে, মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। কিন্তু স্বামী নাদের অসুস্থ, বৃদ্ধ বাবাকে ফেলে কোথাও যেতে চাইছে না। তাই সিমিন আদালতে ডিভোর্সের আবেদন করে। এক পর্যায়ে সিমিন বলে উঠে, “Does he even realize you are his son?”, নাদের তড়িত্ব জবাব দেয়, "But I know he's my father." হতাশাগ্রস্ত সিমিন বাবার বাড়িতে চলে যায়, মেয়ে তেমরাহ বাবা নাদেরের সাথে থেকে যায় এই আশায় যে, সিমিন ফিরে আসবে।

নাদের বৃদ্ধ বাবাকে দেখা-শোনা করার জন্য এক ধার্মিক, নিম্ন বিত্ত পরিবারের মহিলা রাজিয়েহকে নিয়োগ দেয়, যে মহিলা আবার তার স্বামীর অর্থনৈতিক চাপটা সামলানোর জন্য স্বামীকে না জানিয়েই কাজ করা শুরু করে। এরপর ঘটতে থাকে এই অনবদ্য ছবির একের পর এক অনবদ্য ঘটনা। ছবির কাহিনী বর্ননাতে আমি যাবো না, বরঞ্চ অন্য কিছু বিষয় নিয়ে আমি আলোচনা করি। ইরানিয়ান ছবিগুলোতে প্রথম দিকে যে বিষয়টি বেশি দেখা যেতো তা হচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে ছবি বা ফোকাসটা থাকে বাচ্চাদের দিকে, বিশেষ করে মাজিদ মাজিদির ছবিগুলোতে। তার ১৯৯৭ সালের Children of Heaven ছবিটিই ইরানি চলচ্চিত্রকে বিশ্বে এক বিশেষ মর্যাদা এনে দেয়।

সেদিক থেকে “A Separation” বাচ্চাদের নিয়ে কোনো ছবি নয়। ইরানি ছবিগুলোতে ইরানি সমাজ ব্যবস্থায় ইনডোরে প্রাপ্তবয়স্ক পাত্র – পাত্রীদের শুটিং করা এক বিশাল ব্যাপার, দেখা যায় বেশিরভাগ পরিচালকই তা এড়িয়ে যান। এক্ষেত্রে “A Separation” ব্যতিক্রম, ছবির সব গুরুত্বপূর্ন ঘটনাগুলোরই শুটিং হয়েছে ইনডোরে। কাহিনী হচ্ছে ডিভোর্সের মতো এক জলন্ত ইস্যু নিয়ে, যেখানে দেখানো হয়েছে এক নারীর ইরান ছেড়ে চলে যাবার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষাকে। আব্বাস কিয়ারোস্তামী বা মহসেন মাখমলবাফের মতো বিখ্যাত ইরানি পরিচালকরা ইরানি ছবিকে বিশ্বের সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন, কিন্তু তাদের ছবিগুলো মনে হয়েছে ধীর গতির, অথচ “A Separation” এর ঘটনাগুলো ঘটেছে খুব দ্রুত।

অন্যান্য ইরানি ছবি থেকে এই ছবিটি আরেকটি কারণে আমার কাছে আলাদা মনে হয়েছে- এর টুইস্টের জন্য, শেষের দিকে এর রহস্য উন্মোচনের জন্য, যা আমাকে আলফ্রেড হিচককের ছবিগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ইরানি ছবিগুলো সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর পটভূমিই আমরা দেখে থাকি, কিন্তু “A Separation” -এ আমরা দেখি উচ্চ-মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত পরিবারের কাহিনী, দেখি ইরানি উচ্চবিত্ত সমাজে পরিবর্তনের ছোঁয়া। ছবিতে নাদেরের যে ফ্ল্যাটটি দেখানো হয়, সেখানে দেয়ালে দেখা যায় Andrew Wyeth- এর বিখ্যাত পেইন্টিং, যা ইরানের ট্রাডিশনাল জীবনযাত্রা থেকে ওয়েস্টার্ন কালচারের দিকে ধাবিত হবার কথাই মনে করে দেয়। ফারহাদীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ছবির কোন দৃশ্যটি তাকে খুব আপ্লুত করে। তার উত্তর ছিলো, যে দৃশ্যে রাজিয়েহ নাদেরের বাবাকে বাথরুমে নিয়ে পোশাক পরিবর্তন করতে বলে, আর সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে এবং কিছুক্ষণ পর দরজা খুললে নাদেরের বাবা অস্ফুট স্বরে বলে উঠে ‘সিমিন’।

আমার কাছে মনে হয়েছে, যে দৃশ্যে এরেস্ট হবার হাত থেকে স্বামীকে বাঁচানোর জন্য রাজিয়েহ বিচারকের কাছে এন্টি-সাইকোটিক ওষুধ দেখিয়ে অনুরোধ করে এবং তখন নাদেরও একই অনুরোধ বিচারককে জানায়, যা দেখে আমাদের হারিয়ে যেতে বসা মানবিকতার কথাই শুধু মনে পড়ে। ছবিটির আরেকটি ইন্টারেস্টিং দিক হচ্ছে – এর বিচার ব্যবস্থা, যেখানে বাদী এবং বিবাদী সরাসরিই বিচারকের সাথে নিজের কথা বলতে পারছে, নেই কোনো আইনজীবী বা অন্য কোন obstacle. হৃদয়কে নাড়া দিয়ে গেছে তারমেহকে নাদেরের বলা “What is wrong is wrong, no matter who said it or where it's written”- বলা উক্তিটি। ছবিতে এসেছে ধর্মও, দেখা গেছে ধার্মিক রাজিয়েহ-এর জীবনে ধর্ম কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে, তা সত্বেও যখন দেখি পরস্ত্রী হয়ে প্রয়োজনের তাগিদে নাদেরের বাবার পোশাক পাল্টিয়ে দিচ্ছে, তখন মনে হয় এটা মানবিকতারই জয়। ছবিটির অধিকাংশ দৃশ্যই হ্যান্ড ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে। অভিনেতারা করেছেন অসাধারণ অভিনয়।

নাদেরের ভূমিকায় পেয়ম্যান মোয়াদি, সিমিন চরিত্রে লায়লা হাতামি, রাজিয়েহ ভুমিকায় সারেহ বায়াত, রাজিয়েহ এর রক্ত গরম স্বামীর চরিত্রে সাহাব হোসেনি, এমনকি নাদের আর সিমিনের মেয়ের চরিত্রে পরিচালকের নিজের মেয়ে সারিনা ফারহাদীসহ সবার অভিনয়ই এত প্রাণবন্ত এবং বাস্তব মনে হয়েছে যে প্রথম কোনো ইরানি ছবি হিসেবে বার্লিন ফেস্টিভালের অভিনয় ক্যাটাগরির সবগুলো পুরস্কারই এই ছবিটি পেয়ে গেছে। আর মনে হয়েছে, ছবিতে এতো ঘটনা ঘটলো, কিন্তু কারো প্রতি কোনো ক্ষোভ জন্ম নিলো না, কারণ প্রতিটি চরিত্রের কাজের পিছনেই মনে হয়েছে যুক্তিসঙ্গত কারণ, তাই পাওয়া যায় নি কাউকে অপরাধী বানানোর সুযোগ। পশ্চিমা মিডিয়াগুলো আর সব ইরানি ছবির মতো এই ছবিতেও অনেক রাজনৈতিক অর্থ খুঁজে পেয়েছে, ছবিটিকে দেখেছে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। কিন্তু যখন শেষ দৃশ্যে বিচারক তারমেহকে জিজ্ঞেস করে সে বাবা না কি মায়ের কাছে থাকবে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না, এবং যখন দেখি তারমেহ অশ্রুসজল চোখে উত্তর দিয়েছে, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন আমার আর কোনো রাজনৈতিক অর্থ খুঁজতে ইচ্ছে করে না। তখন শুধুই মনে হয় A Separation ছবিটি একটি মানবিক আবেগসম্পন্ন ছবি, যা জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়।

********************** *(এবার একটু পেশাগত কাজের প্রকাশ ঘটাই। আলঝেইমার হল এক ধরনের মানসিক ব্যাধি যা মানুষের স্মৃতিশক্তি, জ্ঞান, বুদ্ধিকে ক্রমান্বয়ে ধ্বংস করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। কেউ এই রোগে আক্রান্ত হলে তার ব্যক্তিত্ত্ব, ব্যবহার, চরিত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়, তার সকল প্রকার মানসিক দক্ষতা হারিয়ে ফেলে এবং রোগী অকারনেই উদ্বিগ্ন ও ভীত হয়ে পড়েন। তার হ্যালুসিনেসনও (দৃষ্টিভ্রম) হতে পারে। সাধারণত ৬৫ বছর বয়সের বেশী লোকেরা এই রোগে আক্রান্ত হন।

এই রোগ বংশগতও হতে পারে। তবে কিছু বায়োলোজিকাল ফ্যাক্টর এ রোগের জন্য দায়ী। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কোন কিছু সহজে মনে রাখতে পারেন না, কাউকে হঠাৎ চিনতে পারেন না, অকারণে ভীত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, তার দৃষ্টিভ্রম হয়, ভাষাগত সমস্যা হয় এবং কথা বলতে সমস্যা হয়। এই রোগ প্রতিরোধ করতে কিছু উপদেশ মেনে চলতে বলা হয়। বয়স্ক লোকেরা এই উপদেশ মেনে চললে উপকৃত হবেন।

সাধারণত স্বাস্থ্যবান লোকেরা এ রোগে কম আক্রান্ত হন। নিয়মিত শরীরচর্চা করলে, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখলে, মনকে সর্বদা প্রফুল্ল রখলে, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা না করলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। ) বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ আমি সবসময়ই ইন্টারনেটের গতির কারণে ডিভিডি কিনে ছবি দেখি, ডাউনলোড করতে পারি না। আটি ডাউনলোড লিংকও জানি না। কেউ যদি ডাউনলোড লিংক দিয়ে দেয় আমি কৃতজ্ঞ থাকবো।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।