ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা পড়া আর না পড়া – অনেক দিন ধরেই এটি একটি বিতর্কের বিষয়। এই তর্কটি, কোন পদ্ধতি ভাল ও উত্তম শুধুমাত্র এই বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়,বরং ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা পড়া যাবে কি যাবে না অর্থাৎ জায়েজ নাকি মানা – এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে সালাতের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বিভিন্ন আলেম উলামাদের এ নিয়ে বিভিন্ন মতামত লক্ষ্য করা যায় এবং অনেক বই, অনুচ্ছেদ ও পাওয়া যায়।
নামাযের অন্যান্য বিষয়গুলো যেমন রাফয়ে ইয়াদাইন ইত্যাদির ক্ষেত্রে ২ টি মতামত এর মাঝে কোনটি অধিকতর ভাল তা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা পাওয়া যায়,কিন্তু ইমামের পিছনে মুক্তাদীর কেরাত এর বিষয়টি অনেক গুরুতর,কারণ কারও মতে ইমামের পিছনে মুক্তাদীর কেরাত ফরজ,কারও মতে ওয়াজিব,আবার কারও মতে মাকরুহে তাহ্রীমী আর কারও মতে হারাম।
ইমামের পিছনে মুক্তাদীর কেরাত পড়া কি জরূরী? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তবে কোন নামাযের ক্ষেত্রে, সিরী নামায(ইমাম যখন কেরাত চুপে চুপে পড়েন) এবং জেহরী নামায (ইমাম যখন কেরাত শব্দ করে জোরে জোরে পড়েন), উভয়ের ক্ষেত্রে না যে কোন একটির ক্ষেত্রে।
উত্তর যদি না হয়, তাহলে সে সব হাদীসের ব্যাখ্যা কি যেগুলো দেখতে এ মতামতের বিরোধী মনে হয়?
এই প্রবন্ধটি বা লেখাটি আশা করি আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর দিবে এবং আপনার বুঝে আসবে।
আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে বুঝার তওফীক দান করুন। আমিন।
চার ইমাম এবং উলামা কেরাম গণের মতামতঃ
প্রথমত, ইমাম এবং মুনফারিদ (যে একাকী নামায পড়ে) নামাযে সুরা ফাতিহা পড়বে কি পড়বে না – এ বিষয়ে মুজতাহিদ ইমাম গণের মাঝে কোন মত বিরোধ নেই।
সকল ইমাম এবং মুহাদ্দিসগণ একমত যে তাদের কে অবশ্যই সুরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে এবং এটি বাধ্যতামূলক। তাঁদের এ বিষয়েও ঐক্যমত্য আছে যে, ইমামের পিছনে মুক্তাদীর অন্য কোন সুরা বা আয়াত পড়তে হবে না যা সাধারণত ইমাম বা মুনফারিদ কে সুরা ফাতিহার পড়ে অবশ্যই পড়তে হয়।
কিন্তু মুক্তাদী যখন ইমামের পিছনে নামায আদায় করবেন, তখন সুরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে কি না তা নিয়ে উলামা দের মাঝে মতবিরোধ আছে।
ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদঃ
তাদের উভয়েরই মত হলঃ জাহরী নামায ( ইমাম যখন কেরাত শব্দ করে জোরে জোরে পড়েন, ফজর, মাগরিব, এশা ) এর ক্ষেত্রে মুক্তাদীর ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা পাঠ করার দরকার নেই। কিন্তু সিরী নামায(ইমাম যখন কেরাত চুপে চুপে পড়েন, যোহর, আসর) এর ক্ষেত্রে সুরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে।
ইমাম শাফীঃ
উনার প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, জাহরী নামায এবং সিরী নামায উভয় ক্ষেত্রেই মুক্তাদীর সুরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে।
এই মতটি যদিও প্রসিদ্ধ, কিন্তু এটি ইমাম শাফীর সর্বশেষ মত ছিল না।
তাঁর কিতাবগুলোর উপর ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এই মতটিকে তাঁর পূর্বের মত হিসেবে পাওয়া যায়।
ইবনে কদামাহ তাঁর কিতাব “আল মুগনী” তে এই মতটিকে ইমাম শাফীর পূর্বের মত বলে অভিহিত করেছেন।
(আল মুগনী ৬০১ : ১)
ইমাম শাফীর নিজের লিখা “কিতাবুল উমম” গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি জাহরী নামায এর ক্ষেত্রে মুক্তাদীর সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত জরূরী নয়, তবে সিরী নামায এর ক্ষেত্রে সুরা ফাতিহা পাঠ অবশ্যই জরুরী।
তিনি “কিতাবুল উমম” গ্রন্থে লিখেন, “এব্ং আমরা বলি ইমাম নিঃশব্দে পড়েন এ রকম প্রত্যেক নামাযের ক্ষেত্রে ইমামের পিছনে মুক্তাদীর অবশ্যই কিরাত পাঠ করতে হবে। ”
(আল মুগনী ৬০১ : ১)
“কিতাবুল উমম” ইমাম শাফীর পরবর্তী কিতাবগুলোর মধ্যে একটি যা হাফেজ ইবনে কাসীর তার “আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২৫২ : ১০) এবং আল্লামা সুয়ুতী “হুসনুল মুহাদরাহ” গ্রন্থে দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেছেন। এটি প্রমাণ করে যে “কিতাবুল উমম” এর মতামতটি ইমাম শাফী পরে দিয়েছেন।
ইমাম শাফীর মত থেকে অনেক গাইর মুকাল্লীদীন দাবি করেন সুরা ফাতিহা পড়া মুক্তাদীর জন্য ফরয, এমনকি জাহরী নামায এর ক্ষেত্রেও।
দাউদ জাহিরি এবং ইবনে তাইমিয়ার মতে জাহরী নামায এ মুক্তাদীর কেরাত পড়া যাবে না।
ইমাম আবু হানিফাঃ
ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ এবং মুহাম্মদ তাঁরা সবাই তাদের মতামতে এক। তাঁরা বলেছেন, “ইমামের পিছনে মুক্তাদীর পবিত্র কোরআনের যে কোন অংশ তিলাওয়াত করা, সেটি সুরা ফাতিহা হোক বা অন্য কোন আয়াত হোক, জায়েজ নেই, সিরী এবং জাহরী উভয় নামাযের ক্ষেত্রে। ”
একটি কথা বলা হয়ে থাকে যে, সিরী নামাযের ক্ষেত্রে সুরা ফাতিহা পড়া ভাল – ইমাম মুহাম্মদের এ রকম একটি মত আছে- এটি সত্য নয়। ইবনে হুমাম এটিকে ইমাম মুহাম্মদের উপর ভ্রান্ত অভিযোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং তিনি বলেন, “সত্য হল যে ইমাম মুহাম্মদের মতামত ইমাম আবু হানিফা এবং আবু ইউসুফের মতই । ”
(ফাতহুল মুলহিম ২০ : ২)
উপরের বর্ণনা থেকে কিছু point পাওয়া যায়ঃ
১।
জাহরী নামাযের ক্ষেত্রে মুক্তাদীর সুরা ফাতিহা পড়া ফরয বা বাধ্যতামূলক - কোন ইমাম এ মত পোষণ করেন নি।
২। কেউ কেউ শুধুমাত্র সিরী নামাযের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বলেছেন।
৩। হানাফী ইমাম গণের শুধুই একটি মত, তা হচ্ছে মুক্তাদীর জন্য কোন কিরাত নেই।
এই মতটিই পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে সবচেয়ে সঠিক ও সহীহ হিসেবে পাওয়া যায়, যা এ প্রবন্ধে প্রমাণ করা হবে ইনশাল্লাহ।
পবিত্র কোরআনের আলোকেঃ
১।
“আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখ এবং নিশ্চুপ থাক যাতে তোমাদের উপর রহমত হয়। ”
(সুরা আ’রাফ : ২০৪)
হযরত আবু হুরাইরা(রঃ),হযরত ইবনে মাসঊদ(রঃ),হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রঃ),মুজাহিদ(রঃ),ইবনে জুবাইর(রঃ),ইবনে জারীর(রঃ) প্রমখ সাহাবীগণ বলেছেন যে, এই আয়াতটি নাযিল হয়েছে সালাত এবং জুম’আর খুতবা সম্পর্কে।
(তাফসীর ইবনে কাসীরঃ ১ : ২৮১)
এই আয়াত দ্বারা যে কেউ সহজে বুঝতে পারবেন যে, মুক্তাদীর ইমামের পিছনে কেরাত না পড়ার জন্য এটি একটি বড় ও পর্যাপ্ত দলিল এবং যখন ইমাম কেরাত পড়তে থাকেন তখন মুক্তাদীর চুপ থাকা ও মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা আবশ্যক।
“তানযীম উল আশতাত” গ্রন্থে উল্লেখ আছে, এই আয়াতটি মুক্তাদীকে ২টি আদেশ দেয়ঃ
১। নীরব থাকা- সিরী এবং জেহরী উভয় নামাযের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে চুপ থাকা
২। মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা- জেহরী নামাযের ক্ষেত্রে।
এ থেকে বুঝা যায় যে,মুক্তাদী জেহরী নামাযের ক্ষেত্রে ইমামের কেরাত মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করার জন্য সম্পূর্ণরূপে চুপ থাকবে এবং সিরী নামাযের ক্ষেত্রেও সে চুপ থাকবে যদিও সে ইমামের কেরাত শুনতে পাই না (১ম আদেশ অনুযায়ী)।
তাছাড়া এই আয়াতটি তে বলা হয়েছে, “আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়” (উচ্চস্বরে হোক বা চুপে চুপে হোক, কেউ শুনতে পাক বা না পাক),
এই আয়াতটিতে “শুধুমাত্র যখন তুমি কোরআন শুনতে পাবে” বা “শুধুমাত্র যখন কোরআন উচ্চস্বরে পাঠ করা হয়” – “তখন নিশ্চুপ থাক,অন্যথায় নয়” – এ রকম কোন সীমাবদ্ধতা দেওয়া নেই।
সুতরাং এটি পরিষ্কার যে, এই আয়াতের মানে সিরী নামাযের ক্ষেত্রে অবশ্যই চুপ থাকতে হবে এবং যদি জেহরী নামায হয় তখন মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করাও জরুরী।
এখন, যারা বলে থাকেন যে, এই আয়াতটি সালাতের ক্ষেত্রে নয়, বরং শুধুমাত্র খুতবার সময় চুপ থাকার জন্য নাযিল হয়েছে, তাদের জন্য এটি আরও পরিষ্কার করা জরুরী। এই আয়াতটি শুধুমাত্র নামাযে নিশ্চুপ থাকার জন্যই নাযিল হয়েছে, খুতবার ক্ষেত্রে নয়। তার কারণ হলঃ
হাফেজ ইবনে তাইমিয়া তাঁর “ফতওয়া” কিতাবে লিখেছেনঃ
“পূর্বসূরীদের কাছ থেকে এটি বুঝা যায় যে এই আয়াতটি নামাযের কেরাতের ক্ষেত্রে নাযিল হয়েছে এবং কেউ বলেছেন খুতবার ক্ষেত্রে। ইমাম আহমদ লিখেছেন, মুহাদ্দিস ও হাদীস বিশারদ গণ নামাযের কেরাতের ক্ষেত্রে একমত ।
”
(ফতওয়া ২৬৯ : ২৩)
ইবনে কদামাহ তাঁর কিতাব “আল মুগনী” তে লিখেছেনঃ
“ইমাম আহমদ আবু দাউদ এর কাছ থেকে বর্ণনা করেন, সবাই একমত যে এই আয়াতটি সালাতের ক্ষেত্রে নাযিল হয়েছে। ”
(আল মুগনী ৬০১ : ১ )
ইবনে তাইমিয়াও লিখেছেনঃ
“আহমদ এ মত দিয়েছেন যে মুক্তাদীর জন্য কেরাত আবশ্যকীয় নয় যখন ইমাম শ্রবণযোগ্য ভাবে কেরাত পড়েন। ”
(ফতওয়া ২৬৯ : ২৩)
ইমাম আহমদ আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেনঃ
আহমদ বলেনঃ “আমরা কোন মুসলিম মনীষীর কাছ থেকে কখনো শুনি নি যে যদি ইমাম জোরে কেরাত পড়েন আর মুক্তাদী নীরব থাকে, তাহলে মুক্তাদীর নামায হবে না। ” তি্নি আরও বলেন, “এটিই রসুলুল্লাহ (সঃ), সাহাবী, এবং তাবেঈন, হিজাজ এর জনগণ থেকে মালিক, ইরাকের মনীষীদের থেকে তাওরী, সিরিয়ার জনগণ থেকে আওযায়ী এবং মিশর থেকে লাইত, কেউ বলেননি, যে ব্যক্তির ইমাম তিলাওয়াত করল আর সে তা করল না তার নামায শুদ্ধ হবে না । ”
(আল মুগনী ৬০২ : ১ )
ইবনে জারীর ও ইবনে আবী হাতিম তাঁদের তাফসীরে এবং ইমাম বায়হাকী “কিতাবুল কিরাত” এ মুজাহিদ থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন, “এই আয়াতটি নাযিল হয়েছে রসূলুল্লাহ (সঃ) এর কিছু সাহা্বী সম্পর্কে যাঁরা ইমামের পিছনে তিলাওয়াত করতেন।
”
যদিও এটি মুরসাল, (যে সনদে একজন তাবী সরাসরি রসূলুল্লাহ (সঃ) এর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন, মাঝখানে কোন সাহাবীর নাম উল্লেখ না করে), কিন্তু এটি মুজাহিদ থেকে বর্ণিত যিনি “আ’লামুন নাস বিত তাফসীর” নামে পরিচিত যার অর্থ “তাফসীর শাস্ত্রে মানব সমাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান বা পান্ডিত্যের অধিকারী”, তাই এটি একটি উপযুক্ত প্রমাণ এবং এটি গ্রহণ করা যাবে।
ইবনে জারীর “তাবারী” তে ইয়াসির ইবনে জারীর থেকে হযরত ইবনে মাসঊদ (রঃ) সম্পর্কে আরও একটি হাদীস বর্ণনা করেন যে, ইবনে মাসঊদ (রঃ) নামায পড়তেছিলেন, তখন তিনি কিছু মানুষকে ইমামের পিছনে তিলাওয়াত করতে শুনলেন। শেষ (নামায) করার পর তিনি বললেন, “সে সময় কি এখনও আসেনি যাতে তোমরা বুঝতে পার? সে সময় কি এখনও আসেনি যাতে তোমরা বুঝতে পার যে - যখন কোরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক যেভাবে আল্লাহ পাক তোমাদের আদেশ দিয়েছেন?”
(ইলাউস সুনান ৪৩ : ৪; তাবারী ৩৭৮ : ১১)
অতএব,উপরের সমস্ত উক্তি এবং উদ্ধৃতি প্রমাণ করে যে, কোরআনের এই আয়াতটি নাযিল হয়েছে সালাতের ক্ষেত্রে, খুতবার ক্ষেত্রে নয়। এ কথার উপর জোর দেয়ার জন্য বা এর সত্যতা প্রমাণ করার জন্য আরও একটি বিষয় জানা দরকার যে, এটি হচ্ছে মক্কী আয়াত, আর সালাতুল জুম’আ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আরও পরে মদীনাতে। সুতরাং, কোন ভাবেই এই আয়াতটি জুম’আর খুতবার সময় নিশ্চুপ ও নীরবতা পালন করার ক্ষেত্রে নাযিল হয়নি।
২।
“কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর। ”
(সুরা মুযযাম্মিলঃ ২০)
এই আয়াতটি নির্দেশ করে, পবিত্র কোরআনের যে কোন অংশ তিলাওয়াত করা নামাযে ফরজ। কিন্তু এখানে শুধুমাত্র সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করাকে বলা হয়নি, বরং পবিত্র কোরআনের যে কোন অংশ তিলাওয়াত করার কথা বলা হয়েছে।
অনেকে বলে থাকেন, এই আয়াতটিতে সুরা ফাতিহাকে বুঝানো হয়েছে, নামাযে এটি তিলাওয়াত করা সবার জন্য অত্যাবশ্যক কেননা রসূলুল্লাহ (সঃ) হাদীসে বলেছেন,
“সুরা ফাতিহা ছাড়া কোন নাযায গ্রহণ করা হবে না ।
”
তাঁরা এই হাদীসের সথে উক্ত আয়াতটির সামঞ্জস্য করেন এভাবে যে, আয়াতে উল্লেখিত 'Maa' শব্দটি অস্পষ্ট বা অনির্দিষ্ট (an indefinite term) এবং এই হাদীসটি তার ব্যাখ্যা। এভাবে তাঁরা কোরআনের আয়াতটির অর্থ “নামাযে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত কর (বাধ্যতামূলক বা ফরজ)” বলে থাকেন।
কিন্তু এই ধরণের ব্যাখ্যা শুধুমাত্র তখনই দেয়া হয়ে থাকে যখন (কোন আয়াত বা হাদীস ) বিচার বিশ্লেষণে কারও অজ্ঞতা থাকে (পূর্ণ জ্ঞান না থাকা)।
কারণ, বাস্তবতা হল, এখানে 'Maa' শব্দটি অস্পষ্ট বা অনির্দিষ্ট (an indefinite term) নয়, বরং সাধারণ বা আ’ম। সু্তরাং এক্ষেত্রে আয়াতটি নামাযে পবিত্র কোরআনের যে কোন অংশ তিলাওয়াত করার অনুমতি দেয় এবং শুধুমাত্র সুরা ফাতিহা তিলাওয়াতকে বুঝায় না।
এভাবে কোরআনের আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায়, “তাই তিলাওয়াত কর যা তোমার পক্ষে তিলাওয়াত করা সম্ভব” এবং এটিই অধিকতর শুদ্ধ কারণ এই আয়াতটিকে শুধুমাত্র সুরা ফাতিহার মাঝে সীমাবদ্ধ করা আয়াতটির প্রকৃত বা মৌলিক অর্থের পরিপন্থী এবং এটি অশুদ্ধ।
হানাফী ইমাম গণ এভাবেই আয়াত ও হাদীসটির মাঝে সামঞ্জস্য করেন যে, আয়াতটির মাধ্যমে নামাযে পবিত্র কোরআনের যে কোন অংশ তিলাওয়াত করা ফরজ এবং হাদীসটির মাধ্যমে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করা ওয়াজিব করা হয়েছে।
আগের আয়াত ও এই আয়াতের ব্যাখ্যা একত্রিত করলে দাঁড়ায়, ইমাম ও মুনফারিদ সুরা ফাতিহা ও পবিত্র কোরআনের অন্য কোন অংশ বা আয়াত তিলাওয়াত করবে, কিন্তু মুক্তাদী কোনটিই করবে না। কারণ পূর্বের আয়াতের মাধ্যমে মুক্তাদীকে কোরআন তিলাওয়াত এর সময় চুপ থাকতে বলা হয়েছে।
ইমামের কেরাত যে মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট - পরে হাদীসের আলোকে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হবে ইনশাল্লাহ।
৩।
“ ……. তোমরা নামাযে তোমাদের স্বর উচ্চ করো না এবং অতিশয় ক্ষীণও করো না, এই দুই এর মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো । ”
(সুরা বনী ইসরাঈলঃ ১১০)
ইবনে আব্বাস (রঃ) এই আয়াত নাযিল হওয়ার সময়কার অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন।
এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় রসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কায় গোপনীয়ভাবে ছিলেন। তিনি সাহাবীদেরকে নামায পড়াতেন এবং তাতে উচ্চস্বরে কিরাত পড়তেন।
যখন মুশরিকরা তিলাওয়াত শুনতে পেত, তখন তারা কোরআন এর সমালোচনা করত, যিনি এটি নাযিল করেছেন (আল্লাহ পাক) তাঁর সমালোচনা করত, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত এবং যিনি আমাদের কাছে কোরআন নিয়ে আসছেন (রসূলুল্লাহ (সঃ)) তাঁকে গালি দিত। এজন্য আল্লাহ পাক রসূল (সঃ) কে আদেশ দিলেন, “নামাযে এমন উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করবেন না যাতে মুশরিকরা শুনতে পায় এবং এত ক্ষীণ স্বরেও তিলাওয়াত করবেন না যাতে বিশ্বাসীদের শুনতে কষ্ট হয়। ”
(তা’লীক উস সাবীহ ৩৬৬ : ১, মুসলিম)
এ আয়াতে আল্লাহ পাক তাঁর রসূলকে এমন পর্যাপ্ত স্বরে তিলাওয়াত করতে বলেছেন যাতে তাঁর পিছনের সাহাবীরা (নামাযরত) শুনতে পাই। আর এটি তখনই সম্ভব যখন সাহাবীরা চুপ থেকে বা নীরব থেকে মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। অতএব, এই আয়াতটি প্রমাণ করে যে কিরাত পড়া শুধুমাত্র ইমামের দায়িত্ব।
তিনি যখন ইমামতি করবেন তখন উচ্চ স্বরে (জেহরী নামায) তিলাওয়াত করবেন এবং মুক্তাদী চুপ থাকবে ও মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং কোন তিলাওয়াতে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে না।
এরপর আমরা হাদীসের প্রসংগে আসব। এসব হাদীস গুলো উপরোক্ত আয়াতগুলোর মাধ্যমে যে বিষয় বা আদেশ গুলো এসেছে, তা আরও পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট করবে ইনশাল্লাহ।
(চলবে ইনশাল্লাহ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।