আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : একজন দ্রোহ ও প্রেমের ফেরিওয়ালা

বালক ভুল করে পড়েছে ভুল বই , পড়েনি ব্যাকরণ পড়েনি মূল বই জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন। বাতাশে লাশের গন্ধ নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান। মাটিতে রক্তের দাগ - চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড় এ চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার ঘুম আসেনা- তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার, নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস্য শরীর ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি ঘুমুতে পারিনা… স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়কালে যে কজন কবি শিল্প ও জীবনাচারকে একই সূত্রে গ্রথিত করার চেষ্টা করেছেন, তাদের মধ্যে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাম প্রোজ্জ্বল।

দেশের দুর্যোগমুহূর্তে কবি কেবল নিভৃতভুবন নির্মাণ করবেন, এ তত্ত্বে দেশপ্রেমিক রাজনীতি সচেতন কবির বিশ্বাস নেই। তাই শিল্পের মোড়কে জীবনেতিহাস ও সমাজের চিত্র আঁকাই হয়ে ওঠে প্রকৃত কবির মৌল দায়। সে দায় পালনে রুদ্র স্বতঃপ্রণোদিত। শ্লোগানে কাঁপুক বিশ্ব, চলো, আমরা এগিয়ে যাই প্রথমে পোড়াই চলো অন্তর্গত ভীরুতার পাপ, বাড়তি মেদের মতো বিশ্বাসের দ্বিধা ও জড়তা। সহস্র বর্ষের গ্লানি, পরাধীন স্নায়ুতন্ত্রীগুলো, যুক্তির আঘাতে চলো মুক্ত করি চেতনার জট (মিছিল) এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার।

আন্দোলনের খাতিরেই গড়ে তোলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এরশাদ আর তার ভাড়াটে কবিরা বাহাদুরি দেখাতে ঢাকায় যখন করেন এশীয় কবিতা উত্সব , বিপরীতে রুদ্র খাড়িয়ে যান জাতীয় কবিতা উত্সব নিয়ে। ৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত দেশে কোনো আন্দোলন নাই যাতে রুদ্রর সশরীর অংশগ্রহণ ছিলো না। সদ্যস্বাধীন দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হতে দেখে সংক্ষুব্ধ রম্নদ্র লেখেন 'বাতাসে লাশের গন্ধ' কবিতা। স্বাধীনদেশেও পরাধীনতার গস্নানি বয়ে বেড়াতে হয় দেশপ্রেমিককে।

স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের সদম্ভ পদচারণায় ব্যথিত কবি। তারই সে বেদনাভরা প্রতিবাদই ধ্বনিত হয়, কবিতায় কবি বেদনার্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন- রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে শকুনে খেয়েছে যারে, সে আমার ভাই, সে আমার মা সে আমার প্রিয়তম পিতা স্বাধীনতা সে আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন স্বাধীনতা সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল ধর্ষিতা বোনের শাড়ি এ আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা। ' (বাতাসে লাশের গন্ধ)। আমি জানি, সম্মিলিত মানুষের চেয়ে কখনোই বেশি নয় অস্ত্রের ক্ষমতা। ...................... বুলেটের বিরুদ্ধে আমাকে আজ হাতে তুলে নিতে দাও আগুন ও বারুদের ভাষা।

(আগুন ও বারুদের ভাষা) পতিতজনের প্রতি দেখিয়েছেন গভীর মমত্ব। তাই তার কবিতায় চিত্রিত হয় এমন অকপট দৃশ্য - আজীবন বেশ্যাবৃত্তি করে যে মাতা হারিয়েছে সর্বস্ব যে মাতার সতীত্ব গ্যাছে ইংরেজি ট্রাউজারের পকেটে আমি তারই জারজ/ আমার কী দেখতে চাও আমার কী জানতে চাও?' (আমি ধর্ষিতা মায়ের জারজ)। অতোটা প্রেমের প্রয়োজন নেই ভাষাহীন মুখ নিরীহ জীবন প্রয়োজন নেই- প্রয়োজন নেই কিছুটা হিংস্র বিদ্রোহ চাই কিছুটা আঘাত রক্তে কিছুটা উত্তাপ চাই, উষ্ণতা চাই চাই কিছু লাল তীব্র আগুন। (অবেলায় শঙ্খধ্বনি) কথা ছিলো ‌’আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বন্টন’, আমাদের তীর্থ হবে শস্যপূর্ণ ফসলের মাঠ। অথচ পান্ডুর নগরের অপচ্ছায়া ক্রমশ বাড়ায় বাহু অমলিন সবুজের দিকে, তরুদের সংসারের দিকে।

জলোচ্ছাসে ভেসে যায় আমাদের ধর্ম আর তীর্থভূমি, আমাদের বেঁচে থাকা, ক্লান্তিকর আমাদের দৈনন্দিন দিন। (কথা ছিলো সুবিনয়) আজ এইসব অতিকায় কদাকার বন্যমানুষগুলো নির্মূল করে আমরা আবার সমতার পৃখিবী বানাবো সম্পদ আর আন›দের পৃখিবী বানাবো শ্রম আর প্রশানির— পৃখিবী বানাবো। (ইশতেহার) বাংলা ভাষায় রুদ্র এক অসামান্য কবি। প্রেমে আর দ্রোহে, সবখানে। স্বাধীনতা পরবর্তী কবিদের মধ্যে রুদ্রর চেয়ে শক্তিমান কেউ নাই।

সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি তিনিই তো বলেন- দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো- কোন পক্ষে যাবে? কিংবা বলেন- তোমার বুলেট মানুষের বুক লক্ষ্য কোরে ছুটে যাচ্ছে তোমার বুলেট মানুষের মাথার খুলি উড়িয়ে দিচ্ছে আর নিজেকে বলেন- ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই কবিতা জীবনে ছবি নয়, প্রতিচ্ছবি। কিন্তু রম্নদ্র এমনভাবে চিত্র এঁকেছেন, তাতে হুবহু সমাজের ছবি উঠেছে। সাহিত্যে বাসত্মবতার যে তত্ত্ব প্রচলিত, তার ষোলআনাই রম্নদ্রর কবিতায় রয়েছে। কোন কল্পনার আতিশয্য নেই, নেই জীবনকে উপক্ষো করে শিল্পের ছবি অাঁকার মেকি আভিজাত্য। নিজে ছিলেন আজীবন বোহেমিয়ান, তাই সত্যপ্রকাশে অকপট থেকেছেন কবিতায়।

লিখেছেন- মনে পড়ে, বন্দরে সেই সব কালোরাত, ঈগলের মতো ডানা সেই বিশাল গভীর রাতে, একটি কিশোর এসে চুপি চুপি সাগরের কূলে দাঁড়াতো একাকী তন্ময় চোখে তার রাশি রাশি বিস্ময় নিয়ে। কবে তারে ডাক দিয়ে নিয়ে গেলো যৌবন সুচতুর, কবে তারে ডেকে নিলো মলিন ইটের কালো সভ্যতা ! সবুজ ছায়ার নিচে ঘুমে চোখ ঢুলে এলে মা যাকে শোনাতো সেই তুষারদেশের কথা, তার চোখে আজ এতো রাতজাগা ক্লান্তির শোক ! পেছনে তাকালে কেন নিরবতা আসে চোখে ! মনে পড়ে- জ্যোৎস্নায় ঝলোমলো বালুচর, একটি কিশোর- তার তন্ময় দুটি চোখে রাশি রাশি কালোজল- সুদূরের মাস্তুল মনে পড়ে….. (মনে পড়ে সুদূরের মাস্তুল) কেবল রাজনীতি, সমাজসচেতন ছিলেন, তা নয়; প্রেম ও প্রকৃতিকেও কবিতায় অঙ্গীভূত করেছেন। শেষ পর্যনত্ম কবিতায় উত্তীর্ণ করেছেন আপনচিত্তের দোদুল্যমানতাকে। এমন উচ্চারণ এতো সহজেই ভালোবেসে ফেলি কেন! বুঝি না আমার রক্তে কি আছে নেশা- দেবদারু-চুলে উদাসী বাতাস মেখে স্বপ্নের চোখে অনিদ্রা লিখি আমি, কোন বেদনার বেনোজলে ভাসি সারাটি স্নিগ্ধ রাত? সহজেই আমি ভালোবেসে ফেলি, সহজে ভুলিনা কিছু- না-বলা কথায় তন্ত্রে তনুতে পুড়ি, যেন লাল ঘুড়ি একটু বাতাস পেয়ে উড়াই নিজেকে আকাশের পাশাপাশি। (উল্টো ঘুড়ি) ১. থাকুক তোমার একটু স্মৃতি থাকুক একলা থাকার খুব দুপুরে একটি ঘুঘু ডাকুক ২ চোখ কেড়েছে চোখ উড়িয়ে দিলাম ঝরা পাতার শোক।

(গুচ্ছ কবিতা) একাকিত্বের যন্ত্রণায় ব্যথিত কবি কাঙ্ক্ষা করেন, কারও ঘনিষ্ঠ সঙ্গ। তাই বলেন- বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন, এইতো মাধুরী, এই তো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত। তুমি জানো নাই– আমি তো জানি মাটি খুঁড়ে কারা শষ্য তুলেছে, মাংসের ঘরে আগুন পুষেছে যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু, করতলে তারা ধরে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার পরাজয় এসে কণ্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা, চিতার চাবুক মর্মে হেনেছো মোহন ঘাতক তবুও তো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়, পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু। বৈশাখী মেঘ ঢেকেছে আকাশ পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়– ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ চোখ আর কতোদিন? নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতোটা জীবন? কতোটা জীবন?’ ‘কিছুটা তো চাই– হোক ভুল হোক মিথ্যে প্রবোধ, অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই… (অভিমানের খেয়া) তোমাকে পারিনি ছুঁতে, তোমার তোমাকে- উষ্ণ দেহ ছেনে ছেনে কুড়িয়েছি সুখ, পরস্পর খুড়ে খুড়ে নিভৃতি খুঁজেছি। তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।

যেভাবে ঝিনুক খুলে মুক্ত খোঁজে লোকে আমাকে খুলেই তুমি পেয়েছো অসুখ, পেয়েছো কিনারাহীন আগুনের নদী। (দূরে আছো দূরে) আহারে বৃষ্টির রা, সোহাগি লো, আমি থাকি দূর পরবাসে। কান্দে না তোমার বুকে একঝাঁক বুনোপাখি অবুঝ কৈতর? কেমনে ফুরায় নিশি? বলো সই, কেমনে- বা কাটাও প্রহর? পরাণ ছাপায়ে নামে বাউরি বাতাস, দারুণ বৃষ্টির মাসে। (মানুষের মানচিত্র-১) চ’লে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে, চ’লে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভূবনে আছো। (এ কেমন ভ্রান্তি আমার) শেষদিকে খুব নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন।

এই ব্রম্মান্ডের ভেতর একটি বিন্দুর মতো একা। নিঃষঙ্গতায় কবির কন্ঠে উঠে আসে বেদনার পঙ্কতি- এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি। শুন্যতার দিকে চোখ, শুন্যতা চোখের ভেতরও– এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি। বিলুপ্ত বনস্পতির ছায়া, বিলুপ্ত হরিণ। মৌসুমী পাখির ঝাঁক পালকের অন্তরালে তুষারের গহন সৌরভ ব’য়ে আর আনে না এখন।

দৃশ্যমান প্রযুক্তির জটাজুটে অবরুদ্ব কাল, পূর্ণিমার চাঁদ থেকে ঝ’রে পড়ে সোনালী অসুখ। ডাক শুনে পেছনে তাকাই– কেউ নেই। এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি একা…. সমকালীন সুন্দরীগণ অতিদ্রুত উঠে যাচ্ছে অভিজাত বেডরুমে, মূল্যবান আসবাবপত্রের মতন নির্বিকার। সভ্যতা তাকিয়ে আছে তার অন্তর্গত ক্ষয় আর প্রশংসিত পচনের দিকে। (এক গ্লাস অন্ধকার হাতে) ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখোর মতো অসম্ভব সুন্দর আর জনপ্রিয় গান লিখেছেন।

গানের দল গড়েছেন অন্তর বাজাও নামে। শেষ জীবনে ফিল্ম বানাতে চেয়েছিলেন। মৃত্যু ঠেকিয়ে দিলো। ভীষণ এক খামখেয়ালীর জীবন ছিলো তাঁর। পারিবারিক স্বচ্ছলতা ছিলো, সেপথে যাননি।

চাকরির প্রাতিষ্ঠানিকতায় বাঁধেননি নিজেকে। কয়েকটা রিক্সা ছিলো, তা থেকে আয় হতো, তাতেই চলতেন। ঠিকাদারী করেছেন, চিঙড়ির খামার করেছেন। জীবন নিয়ে রুদ্র যতো হেলাফেলাই করুক, কবিতা নিয়ে কখনো করেননি। কবিতায় তিনি সুস্থ ছিলেন, নিষ্ঠ ছিলেন, স্বপ্নময় ছিলেন।

তাঁর সেই গানটি দিয়েই শেষ করি - আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে। ঢেকে রাখে যেমন কুসুম, পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম তেমনি তোমার নিবিড় চলা মরমের মূল পথ ধরে। পুষে রাখে যেমন ঝিনুক, খোলসের আবরনে মুক্তোর সুখ তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া ভিতরের নীল বন্দরে। ভালো আছি, ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো দিও তোমার মালাখানি, বাউলের এই মনটা রে। আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।

তথ্যসূত্র: জীবনী গ্রন্থমেলা, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (তপন বাগচী) বাংলা একাডেমী কবিতার রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ - শহীদ ইকবাল  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।