আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রক ক্যাডেট : গারদখানার আমলনামা-৭ (ক্যাডেট কলেজের জীবন নিয়ে একটি প্রামাণ্য উপন্যাস)

বাংলার আলো-জলে ধূলো মেখে বেড়ে ওঠা মুক্তি সেমি লাষ্ট এপিসোড, আগের এপিসোডগুলোর লিংক নিচে দেয়া আছে- সকালে ঘুম থেকে উঠেই টেবিলের ওপর শরীফের খোলা ডায়েরীর চোখে পড়ল রিজভীর। বাহ! বাহ! সাতসকালে টেবিলের উপরে ডায়রীটা খোলা। ডায়রীর পাতা খুলে রেখে শরীফ আবার কই চলে গেল! চকচক করে উঠল রিজভীর চোখ দুটো। টেবিলের সামনে গিয়ে ডায়রীর পাতায় চোখ রাখতেই অবাক হয়ে গেল। এতো নিত্য দিনের কাজকর্মের খেরোখাতা না! আস্ত কবিতা দেখা যাচ্ছে।

উপরে বড় করে লেখা ‘বিসর্জন’। কবিতার নাম তাহলে বিসর্জন। নিশ্চই তুলিকে ভেবেই লিখেছে শরীফ। আরতো না পড়ে থাকা যায় না এই কবিতা। এখনি পড়তে হবে ভেবে চেয়ারে দুম করে বসে কবিতার পাতায় চোখ রাখল রিজভী।

তুখোড় হব তোমাকে পাবার জন্য লিপ্ত হব দুঃসাহসিক সব কাজে কেল্লা আমি বানাবো মাটি অথবা বাঁশে ভাসাব পালের নৌকা অকুল পাথার মাঝে। লড়ব আমি হাত চালিয়ে , হারাব সব শত্রুকে বাঁধা বিপত্তি সবকিছুকে -আমি ফেলব ছিড়ে কুঁড়ে সিক্ত বা জীর্ণ হব সব হারিয়ে , শুধু পেতে তোমাকে। সাত লাইনের ছোট একটা কবিতা। কী প্রবল আকুতি। কী সংকল্প।

রিজভী অবাক হয়ে গেল কবিতাটা পড়ে। তুলিকে একবার হিংসে হল রিজভীর। এমন করে তো কেউ কখনো কবিতা লেখেনি তাকে নিয়ে । সেও লেখেনি কারো জন্য। আসলে কোন মনবালিকা তাকে এভাবে আলোড়িত করেনি দীর্ঘ সময়ের জন্য, যেভাবে শরীফ আলোড়িত হচ্ছে তুলির পরশে।

দুরন্তপণায় অস্থির হয়ে থাকা সময়গুলোতে এভাবে কাউকে নিয়ে গভীর স্বপ্নে মগ্ন হওয়ার কথা মাথাতেই আসেনি রিজভীর। বালিকারা যে খুব দ্রুতই মনবালিকা হয়ে যায় তার। আবার বনবালিকা হয়ে যেতেও সময় লাগে না। আবহাওয়া বদলের মতোই রিজভীর মনও বদল হয় যখন তখন। শুধু দুষ্টামি আর বিদ্রোহী ভাবটাই বদল হয়না কখনো।

কবিতাটা কেমন হয়েছে? শরীফের কণ্ঠ শুনেই পিছে ফিরল রিজভী। এককথায় দুর্দান্ত। বলেই ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি উঁচু করে ধরল রিজভী। তা দেখে ঠোট উল্টিয়ে মুচকি হেসে মাথা ঝাকাল শরীফ। তুলির জন্যই তো তোর এতো বিসর্জন।

না কি? বলেই শরীফের দিকে তাকাল রিজভী। উপরে নিচে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো শরীফ। তাহলে এটা প্যাডের পাতায় ভালো করে লিখে তুলির কাছে পাঠিয়ে দে। রিজভীর কথা শুনেই মুখটা ভাদ্র মাসের ঝড়ো মেঘের মতো কালো হয়ে গেল শরীফের। নাহ।

চিঠি বা কবিতা দিয়ে কোন লাভ হচ্ছে না। এটা আমি কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিনে দেয়ার জন্য লিখলাম। যদি প্রকাশ হয় তাহলে একটা ম্যাগাজিন তুলিকে দেয়া যাবে তখন। বলেই ডায়েরীর ভিতরটা আরেকটা ভাঁজ করা প্যাডের পাতা বের করল শরীফ। শোন, কালকে রাতে পড়ার সময় একটা ছোট ছড়া লিখলাম- এই মন / সারাখন / ভাবে তোমাকে এই মন / গহীন বন / তোমাকে ডাকে এই মন / খোঁজে তোমায় / সকল ফাঁকে এই মন / হৃদয় পাতায় / তোমাকে আঁকে এই মন / তোমায় খুব / ভালোবেসে থাকে।

সাদাকালো জল ছাপ দেয়া প্যাডের উপর নীল জেল পেন দিয়ে লেখা শরীফের একমুঠো আবেগ রিজভীকে পড়ে শোনানোর আগেই জানালার পাশে থেকে গলা দিয়ে গরগর শব্দ করে নিজের উপস্থিতি জানিয়ে দিলো মালু স্যার। র্কিরে! পদ্য কপচাচ্ছিস নাকি? লেখাপড়া করিস না। পরীক্ষার খাতায় শূণ্য পাস। আবার পদ্য কপচাস! রাগে কাঁপতে কাঁপতে রুমের ভিতরে ঢুকল সে। স্যারকে দেখেই প্যাডের পাতাটা লুকিয়ে ফেলল শরীফ ।

কিন্তু ডায়েরীটা আর লুকানোর সময় পেল না। শরীফের হাত থেকে ডায়েরীটা কেড়ে নিল মালু স্যার। তারপর ওর বাম কানটা টেনে ধরে টানতে টানতে রুম থেকে নিয়ে গেল। আধাঘন্টা পর শরীফ রুমে ফিরে এল। সাদা শার্ট ঘেমে ভিজে গেছে।

মুখ লাল হয়ে আছে। কোন কথা না বলে চাদরে গা ঢেকে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল শরীফ। রিজভী কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। শরীফকে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? শরীফ কোন উত্তর দিল না। একটু পর নিজে থেকেই বলল, মালুকে যদি টানা দুই’শ বার কান ধরে ওঠা-বসা করানো যেত তাহলে শালার কি অবস্থা হতো তাই ভাবছি।

ভয়ানক ব্যাপার। দুই’শ বার কান ধরে ওঠা-বসা করার কথা শুনেই মুখ শুকিয়ে গেল রিজভীর। শরীফের অবস্থা চিন্তা করে খুব খারাপ লাগছে ওর। বেচারা। দুজনের কারো মুখেই কোন কথা নেই।

বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হবার জন্য তোয়ালা নিয়ে বাথরুমে যাচ্ছে শরীফ। হঠাত রিজভী দেখল শরীফের বাম কানের পিছনে শুকিয়ে যাওয়া জমাট রক্ত। লাল হয়ে আছে ডান চোখ। ভ্রুর উপরটা ফুলে গেছে আনেকখানি। দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় পিছন থেকে ডাক দিয়ে শরীফকে থামাল রিজভী।

কাছে গিয়ে ভালো ভাবে দেখল জখমগুলো। এগুলো কিভাবে হল- জানতে চাইল শরীফের কাছে। শরীফের চোখ দিয়ে শুধু টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করল। কোন কথা বলতে পারল না। মাথা নিচু করে শুধু ফোঁপাচ্ছে।

আর না পেরে রিজভীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল শরীফ। ওই মালু হারামিটা ওয়েট পেপার দিয়ে ঢিল মেরেছিল আমাকে। ওটাই ভ্রুতে লেগেছে একটু। আমি সরে না গেলে মাথাটা ফেটে যেত। কানটা ছিড়ে যাচ্ছে আমার।

শুনতে পারছি না কিছু ভালোভাবে। শরীফের ভেজা কণ্ঠে এসব শুনতে শুনতে রিজভীর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। ক্লাস নাইনের সবাইকে নিয়ে জরুরী মিটিং তলব করলো সে। মালু স্যারের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসতে চাচ্ছে সবাই। শরীফের অবস্থা দেখার পর সবাই বেশ উত্তেজিত হয়ে গেল।

মালু স্যারের ব্যাপারে আজ একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে। আধাঘন্টা সময় ধরে আলোচনা চলল। মালু স্যারের নামে প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপালের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল সবাই। শরীফকে হাসপাতালে নিয়ে গেল দুই বন্ধু। আর রিজভী বসল সাদা কাগজ নিয়ে অভিযোগ লিখতে।

অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, অমানুষিক মারধর- বিভিন্ন অভিযোগে ভরে উঠল অভিযোগ পত্র। এ ব্যাপারে সিনিয়রদের সাথে আলোচনা করলো ক্লাস নাইনের ছেলেরা। সিনিয়ররাও তাদের সমর্থন জানালো। পরের দিন সকালে একসাথে সবাই গেল প্রিন্সিপালের কাছে। অভিযোগপত্র জমা দিলো।

মালু স্যারকে হাউস মাষ্টারের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার দাবিও জানালো। প্রিন্সিপাল ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখবেন বলে আশা দিলেন ছেলেদেরকে। ####################################### বার্ষিক ক্রীড়ার চূড়ান্ত আয়োজন চলছে। এসময় কলেজকে ভিতর এবং বাহির থেকে দারুনভাবে সাজানো হয়। রাস্তার চারপাশে লাল সবুজ নীল হলুদ পতাকা।

পিচের রাস্তায় আঁকা হয় রঙিন আলপনা। ব্যানার-ফেস্টুনকে জীবন্ত করে তোলে মরিচবাতির রাত। এসময় কলেজের রুটিন বদলে যায়। অর্ধ দিবস ক্লাস হয়। কখনো ক্লাসই বন্ধ হয়ে যায়।

তখন খাকী ইউনিফর্ম খুলে খেলার পোষাকে নিয়মিত মাঠে যেতে হয়। দুপুর পর্যন্ত টানা খেলাধূলা চলে। খাবার পর ঘন্টাখানেক জিরিয়ে নিয়ে আবার রিহার্সেল শুরু হয়। সন্ধ্যার আযান পর্যন্ত ক্লান্তিহীন প্রাকটিস চলে। তারপর নাস্তা খেয়ে কিছুক্ষণ নিরলস বিশ্রাম।

এসময় অ্যাথলেটদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়। শরীরটা বিশ্রামে থাকে সন্ধ্যার পর থেকে। কিন্তু মানসিক কাজ শুরু হয় আবার। খাতাকলমে হিসাব নিকাশ জমে ওঠে। কোন ইভেন্ট থেকে কে কতো পয়েন্ট আনতে পারবে সেটার সম্ভাব্য একটা হিসাব হয়।

পারফরমেন্স নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলে ঘন্টার পর ঘন্টা। প্রতিদিনই হিসাব বদল হয়। তুমুল উত্তেজনায় প্রতিটি রাত কেটে যায়। এসময়টাতে ক্যাডেট কলেজ যৌবনা হয়ে ওঠে। কোলাহল আর উত্তেজনার জোঁয়ার বইতে থাকে সবার শিরায়-উপশিরায়।

সিনিয়র জুনিয়র দুরত্ব ঘুচে যায়। কখনো যুদ্ধংদেহী চাহনি দেখায় কেউ কেউ- মাঠে জেতার আগেই মানসিকভাবে জেতার আশায়। শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী সবার মধ্যেই উল্লাস নেচে যায়। বার্ষিক ক্রীড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে রিজভী। সারাদিন প্রাকটিস করছে।

বড়দের সাথে প্রতিটা ইভেন্টে রিহার্সেল দিচ্ছে। ক্যাডেটীয় ভাষায় দৌড়-ঝাপের এসব রিহার্সেলকে বলা হয় ‘হিট’। রিজভী সবচেয়ে বেশী হিট দিচ্ছে প্রতিদিন। জুনিয়রদের জন্যেও অনেক সময় দিতে হয় ওকে। নতুনদেরকে হাতে-কলমে সবকিছু শিখিয়ে দিতে দিচ্ছে।

সবসময় তাদের পাশে থেকে উৎসাহ দিচ্ছে। সারাদিন ঘাম ঝড়িয়ে ক্লান্ত রিজভী রাতে একবার করে জুনিয়রদের রুমে টহলে যায়। কেউ আহত কিনা, কারো ব্যথা বাড়ছে কিনা- এসবের খোঁজ নেয়। এত ব্যস্ততায় সে অন্য সবকিছু ভূলে যায়। এভাবে স্নায়ুবিক উত্তেজনায় দিনগুলো কিভাবে যেন শেষ হয়ে যায়! পায়রা উড়িয়ে বাদ্য বাজিয়ে দ্যা গ্রেটেস্ট শো শুরু হয়।

বিজয় উল্লাস আর শ্লোগানে মুখরিত হয় চারপাশ। রিজভী অতিমানবীয় এক দৌড় দিয়ে রেকর্ড ভেঙে ফেলল। প্রায় তের বছর পর ৪০০ মিটার দৌড়ে নতুন একটি রেকর্ড হল। আনন্দধ্বনিতে কেঁপে উঠল আকাশ বাতাস। এতোকিছুর মধ্যে মতির কথা কারো মনেই ছিল না।

আবারো চ্যাম্পিয়ান হয়ে মতির কথা মনে হলো রিজভীর। মতিকে ডাক দিল সে। কিন্তু কোন সাড়া এলোনা। শরীফ এসে বললÑ মতি সামরিক হাসপাতালে আছে। অবাক হয়ে গেল রিজভী।

আবার কি হল! জানতে চাইল সে। দুইদিন আগে হঠাৎ করেই মাথা ঘুড়ে পড়ে যায় মতি। তারপর ওকে আমরা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে হাসপাতাল থেকে ওকে সামরিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। বলতে বলতেই শরীফ মন খারাপ করে ফেলে।

তারপর নিচের দিকে দিকে তাকিয়ে বলে- ওখানকার নিউরো স্পেশালিষ্ট বলেছে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওর মাথার অবস্খা খুব খারাপ। আরো আগে চিকিৎসা করানো দরকার ছিল। অনেক দেরী হয়ে গেছে। থমকে গেল রিজভী।

আবাক হয়ে জানতে চাইল- কেন! ওর কি হয়েছে রে। অসহায় চোখে শরীফ বলল- ওর ব্রেন শুকিয়ে গেছে। তিন মাস আগে আনলেও ওকে বাঁচানো যেত। এখন সম্ভাবনা খুব কম। দ্রুত ঢাকায় নিয়ে অথবা বাহিরে পাঠিয়ে একটা চেষ্টা করা যায় হয়তো।

কিন্তু সম্ভাবনা সমান সমান। মনটাই খারাপ হয়ে গেল রিজভীর। সব রাগ গিয়ে পড়ল ওই ডাক্তারটার উপর। প্রায় ছয়মাস থেকে ছেলেটা মাথাব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে। কিন্তু মেজর নালায়েক কোন পাত্তাই দেয় নি।

তার জন্যই আজ মতির এই অবস্থা। দুই কান গরম হয়ে উঠল রিজভীর। আর কিছু ভাবতে পারলো না সে। বাঁশির হুইসেল শুনে মুখ বাকা করে সবার সাথে মাঠ থেকে বের হয়ে গেল। ৮০০ মিটার দৌড় হচ্ছে।

একটু পিছিয়ে আছে শরীফ। সবাই ওকে পিছনে ফেলে চলে যাচ্ছে। অর্ধেক যাওয়ার পর চোখমুখ খিঁচে টানতে শুরু করল সে। শেষবাঁক ঘোরার সময় সবাইকে পিছনে ফেলে বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বিজয়ের লাল ফিতা টেনে নিয়ে গেল নাচতে নাচতে।

তারপর দুই হাত তুলে দিল আকাশে। ৮০০ মিটার দৌড়ের শেষের দিকে ওর গতি দেখে অবাক হয়ে গেল সবাই। টানটান উত্তেজনায় এভাবেই তিনদিন শেষ হয়ে গেল। রিজভী দ্বিতীয়বারের মতো সেরা হলো। সামনে এখন একটা হ্যাটট্রিক হাতছানি দিচ্ছে।

আর ওদের হাউসও বার্ষিক ক্রীড়ায় চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। হলুদ জার্সি খুলে মাথার উপর ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে নাচতে লাগল সবাই। সবাই সবার ঘাড় জড়িয়ে ধরে বিজয় উল্লাসের মুখরিত চিৎকারে কাঁপিয়ে দিল চারপাশ। তবে ডিসিপ্লিনে ভালো করতে পারেনি ওরা। কলেজের নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলার বছরব্যাপী পরীক্ষায় রানারআপও হতে পারেনি ওরা।

ওদের পজিশন তিনটা হাউসের মধ্যে তিন নাম্বার। রিজভী মজা করে বলল- থার্ড ইজ থার্ড। তিন জন নাকি ত্রিশ জনের মধ্যে দ্যাট ইজ নট ফ্যাক্ট। ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড- এর মধ্যেই তো আছি। আবারো উল্লাস রব উঠল হলুদ শিবিরে।

সন্ধ্যায় অডিটরিয়ামে বিনোদন সন্ধ্যা হলো। কনসার্টের সময় ধুমছে নাচানাচি করল রিজভী। রাতে খাবার টেবিলে বসে পোলাও মাংস খেয়ে শেষ করতে পারল না রিজভী। টেবিলের উপরের ফাঁকা জায়গাগুলো পুডিং এর পিরিচে ভরে যাচ্ছে। আনন্দ উপহার হিসেবে বড়ভাই আর বন্ধুরা সবাই পুডিং পাঠিয়েছে।

অনেকে আবার নিজে এসে হাত দিয়ে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। কলেজে এমনটা হয়। কেউ বিশেষ কিছু করে ফেললে সবাই তাকে এভাবেই সংবর্ধণা জানায়। সপ্তাহে একদিন করে ভালো খাবারের আয়োজন করা হয় কলেজে। তখন খাবারের সাথে মিষ্টি বা পুডিং দেয়।

জুনিয়ররা কোনকিছুতে ভালো করলে সেই মিষ্টান্ন সিনিয়ররা নিজে না খেয়ে জুনিয়রকে উপহার দেয়। এতো পুডিং খেয়ে পেট ভরে গেল রিজভীর। আর খেতে পারছেনা সে। রাতের বেলা দুইতলার সবাই বারান্দার উত্তরকোনে জড়ো হলো। বালতি উল্টো করে ধরে হ্যাঙ্গার দিয়ে পিটিয়ে ঢোল বাজাতে শুরু করল।

শরীফ হঠ্যাৎ সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেল। দু’কাঁধ ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে চড়া গলায় শুরু করল- ‘ঝাকানাকা ঝাকানাকা ঝাকানাকা দেহ দোলা না মনবলে মনবলে মনবলে দেহ খোক্কানা- মীরা বাঈই..’ শরীরে ঝাকি দিয়ে অন্ধকারের আঁবছা আলোতে নেচে নাচছে সবাই। মাঝরাতে গলা ফাটিয়ে গান গাওয়ার তথ্য মালু স্যারের কাছে চলে গেছে। কেউ হয়তো রিপোর্ট করেছে। বিচার পাঠিয়েছে স্যারের বাসায়।

বাসা থেকে চলে এসেছে স্যার। গমগম করে হেটে এসে দাড়ালো উত্তরের বারান্দায়। চুপ হয়ে গেল ছেলেরা। সবাই একদম চুপ। মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকল তারা।

ডিসিপ্লিনে থার্ড হয়েছিস তোরা। আবার মাঝরাতে কুকুরের মতো চিৎকার করে কলেজের সবার ঘুম হারাম করছিস। যাহ, সবাই সবার রুমে চলে যা। তোদের বিচার কাল করব। সবগুলাকে ধরব আমি।

মন খারাপ করে সবাই সবার রুমে চলে গেল। কিছুখন বিছানায় শুয়ে থেকে- রিজভী ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম হলো না। পিছনের জানালায় চকচকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। ওহ! কি জ্যোসনা রাত।

ধবধবে পূর্ণিমা। শরীফকে ডাক দিল রিজভী। শরীফ কোন উত্তর দিল না। জানালার গ্রিলের ফুটো দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে শরীফ। কে জানে কি ভাবছে সে ! একটু পর জানালার পাশে গেল রিজভী।

গ্রীল ধরে দাড়ালো। আহ! কী সুন্দর ঝরঝরে বাতাস। এমন নিঃসঙ্গ রাতে একাকী বাতাসে গা এলিয়ে দিয়ে জ্যোসনাভেজা হতে যা লাগে! মন নাচে হরষে। আবার কখনো বিষণ্ন হয়ে ওঠে অজাগতিক বিষাদে। ################################ পরেরদিন কলেজের পিওন এসে শরীফকে ডেকে নিয়ে গেল প্রিন্স্রিপালের রুমে।

তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুইজন সিনিয়র শিক্ষক এবং মেজর দবির আছেন সেই কমিটিতে। একটা মাঝারি সাইজের টেবিলের তিনদিকে তিনজন বসে আছে আয়েসী ভঙিতে। সামনের খালি কাঠের চেয়ারটাতে শরীফকে বসতে বলল তারা। মেজর দবির শরীফের কাছে জানতে চাইল- বলো শরীফ, সেদিন কি হয়েছিল? তেমার কবিতা লেখা থেকে শুরু করে স্যারের কাছে ধোলাই খাওয়া পর্যন্ত সবকিছু খুলে বল।

মেজর দবির বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন করে প্যাচাতে লাগল ব্যাপারটা। একজন স্যার চুপচুপি বসে বসে প্রশ্ন এবং উত্তর সব কিছুর রেকর্ড লিখে যাচ্ছে। শরীফের দিকে রহস্যময় চোখে তাকিয়ে মেজর দবির জানতে চাইল- তুমি কি প্রেম কর? আর ইউ ইন লাভ? নো স্যার- সোজা উত্তর দিল শরীফ। তুমি অবশ্যই প্রেম করো। এই যে তোমার ডায়েরী।

বলেই শরীফের ডায়েরীটা টেবিলের উপর রাখলেন মেজর দবির। শরীফ একটু ঘাবড়ে গেল। মেজর বলল- সত্য কথা বলো, কোন সমস্যা নাই। শরীফ জানে না ক্যাডেট কলেজের রেড বুকে প্রেম করার নিয়ম আছে কি না। যদি নিয়মের বই ‘রেডবুকে’ প্রেমটাকে নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে তাহলে তো আবারো বিপদ।

প্রেম করার অপরাধে আবার নিজেরই পানিশমেন্ট হবে। তাই সে আর ঝুঁকি নিল না। আবারো জোর গলায় বলল- না স্যার। প্রেম করি না। মেজর কড়া চোখে তাকাল শরীফের দিকে।

এই ডায়েরীর অধিকাংশ কবিতাই প্রেমের কবিতা। আর তুলি নামে একটা মেয়ের নামও লেখা আছে এখানে। তাহলে এই তুলি টা কে? শরীফের দিকে ধারালো চোখ ফেলে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকল মেজর। একদম দ্বিধাহীনভাবে শরীফ বলল- স্যার, এটা একটা কাল্পনিক নাম। মেজর সাহেব শরীফকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে দেখে আরেকজন স্যার মুখ খুললেন।

সেদিন কেন এবং কিভাবে মালু স্যার শরীফকে মেরেছে এ ব্যাপারে জানতে চাইল সে। শরীফ সবকিছু খুলে বলল। কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিনে জমা দেয়ার জন্য একটা কবিতা লিখেছি। তা আমি পড়ে শুনাচ্ছিলাম রিজভীকে। স্যার জানালার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তা শুনে ফেলে।

এরপর রুমে ঢুকে আমার হাত থেকে ডায়েরী কেড়ে নেয়। তারপর আমাকে কানে ধরে টানতে টানতে অফিস রুমে নিয়ে যায়। শরীফ থেমে গেল । স্যার আবারো শরীফকে নির্ভয়ে সবকিছু বলতে বললেন। উনি চেয়ারে বসলেন।

আর আমি ছিলাম টেবিলের সামনে । আমাকে দাড়িয়ে রেখে অনেক গালিগালাজ করে আমাকে। একসময় টেবিল থেকে পেপার ওয়েটটা নিয়ে আমার মাথা সোজা ঢিল দেয়। আমি ভয়ে সরে যাই। ওয়েট পেপারটা আমার ভ্রু ছুঁয়ে চলে যায়।

ছলছল চোখে স্যারের দিকে একপলক তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে থুুতনিটা বুকের সাথে লাগিয়ে বসল শরীফ। স্যার চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে শরীফের চোখের উপরের ফুলে যাওয়া জায়গায় হাত দিয়ে দিলেন। চোখের কোনাটায় তখনও রক্ত জমে আছে। দুইঘন্টা পর শরীফের জবানবন্দী শেষ হলো। তারপর সিনিয়র ক্যাডেটদের কয়েকজনকে ডেকে মালু স্যার সম্পর্কে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করল তদন্ত কমিটি।

সবাই একই রকম অভিযোগ দিয়েছে। এই সুযোগে মাল স্যারের সাথে যেসব শিক্ষকের খারাপ সম্পর্ক তারাও ঢালাও ভাবে অভিযোগ করল। #################### টানা তিনদিন ধরে তদন্তের পর তেতাল্লিশ পাতার একটা রিপোর্ট জমা পড়ল প্রিন্সিপালের কাছে। প্রিন্সিপাল মালু স্যারকে তিতুমীর হাউসের হাউস মাষ্টারের পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। সাতদিনের মধ্যেই তিতুমীর হাউসের বিশাল টিভি রুমে স্যারের জন্য বিদায় সংবর্ধণার আয়োজন করলো ছেলেরা।

বিদায় অনুষ্ঠানে হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দেয়ার চেষ্টা করলেন স্যার। মন খারাপকরা মিছে ভাব নিয়ে স্যারের সামনে বসে বিদায়ী কথা শুনল সবাই। তারপর মন ভরে কেক, মিষ্টি আর ঠান্ডা কোক খেয়ে শান্তি ঢেঁকুর তুলে বারান্দায় জটলা পাকিয়ে আড্ডা দিতে শুরু করল দুষ্ট ও শিষ্ট ছেলেদের দল। আর বাথরুমের দিকে চলে গেল আরেকটা উপদল। বিষাদ কাঠিতে আগুন জ্বালিয়ে নিকোটিন তো নয় , যেন বিষাদময় কিছু অতীত পুড়িয়ে দিচ্ছে তারা।

দুই টান করে করে হাত থেকে হাতে বৃত্তাকারে ঘুরে একসময় শেষ হয়ে গেল একটি জ্বলন্ত বিষাদ কাঠি। একটি অগ্নিশলাকার কোমল উত্তাপ নিভিয়ে দিল কয়েক বছর ধরে জ্বলতে থাকা দহনজ্বালা। ----- (সামনে আসছে গল্প শেষের ছোট্ট এপিসোড) এর আগের পর্বের লিংক- ৬ষ্ঠ পর্ব, Click This Link ৫ম পর্ব- Click This Link ৪র্থ পর্ব- Click This Link ৩ম পর্ব- Click This Link ২য় পর্ব- Click This Link ১ম পর্ব- Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।