আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লালন শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ এবং ইবনু আরাবীর সুফিমত

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ In contrast to the legal-minded approach to Islam, Sufis emphasized spirituality as a way of knowing God. Ahmad S. Dallal আলোচনা শুরু করা যাক মাওলানা জালালউদ্দীন রুমির একখানি মরমী কবিতার তিনটি চরণ দিয়ে । Since we’ve seen each other, a game goes. Secretly, I move, and you respond. You’re winning, you think it’s funny. কার কথা বললেছেন ওই তুর্কি মিস্টিক? লালন যাকে সহজে পাননি? কে কথা কয় রে দেখা দেয় না/ নড়েচড়ে হাতের কাছে খুঁজলে জনম-ভর মেলেনা। কিংবা পাবে সামানে কি তাঁর দেখা? বেদে নাই যার রূপরেখা।

এই ‘অধরা’ মানুষকে ধরাই লালনের জীবনসাধনার মূল। মাওলানা রুমিও তদ্রুপ এক অদৃশ্য সত্তার সঙ্গে নিগূঢ় সম্পর্ক পাতিয়েছেন। সে সম্পর্ক বড় গোপন, বড় রহস্যময়। Secretly, I move, and you respond. সে সম্পর্ক বড় গভীর। নবম শতকে ইসলামী বিশ্বে পশমের পোশাক পরা (আরবি ‘আস-সৌফ’ থেকে সূফী শব্দটির উৎপত্তি।

আর ‘সৌফ’ বলা হয় পশমী কাপড়কে) একদল মরমী তত্ত্বদর্শী ইসলামের legal-minded approach অর্থাৎ শরীয়তের পাশাপাশি লালনীয় ভাবধারায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন ‘অজান’ খবর জানার জন্য। কেননা, অজান (unknown ) খবর না জানিলে হয় না ফকিরি ... এই ফকিরি করার সাধনায় নবম শতকে পারস্যের একদল সুফি বিকল্পধারার জীবন বেছে নিয়ে অর্ন্তজগতের দিকে যাত্রা করেন। কেন? কুরআন শরীফের সুরা নমল এর ৬৫ নং আয়াতে রয়েছে,‘বলুন! আল্লাহ ব্যতীত আসমান ও জমীনের কেউ অদৃশ্য বিদ্যা জানে না। ’ এই আয়াতের মরমী ভাষ্যে পশমী পোশাক পরা সুফিরা হয়তো আকৃষ্ট হয়ে থাকবেন। তারা অজান খবর জানতে চেয়েছেন: ধ্যানের পথে এবং প্রেমের পথে।

তদুপরি আল্লাহতে বিলীন হয়ে যাওয়াই ছিল তাঁদের অন্যতম লক্ষ। তাঁরা প্রচার করেন: আল্লাহর এবাদত তাঁর জাহান্নামের শাস্তির ভয়ে কিংবা জান্নাতের লোভে করা যাবে না। উনিশ শতকের বাংলায় সুনামগঞ্জের হাছন রাজার একটি গানে যেন অনুরূপ (অবিকল না হলেও প্রায় একই রকম) বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি শুনি: নামাজ রোজা ছাউড়া দিসি বেস্তে যাইবার ভয়/ নামাজ রোজা করিলে বেস্তে যাইবারে নিশ্চয়ই/ পরের মন্দ ছাইড়া দিছি দুজখেরি ডরে/ বেস্তে দুজখ এরাফে বন্ধু নিওনা গো মোরে। ইসলামী সুন্না ও শরীয়তের বিপরীতে সুফিগণ যাপন করেছিলেন এক বিকল্পধারার জীবন। ইবনুল ফারিজ নামে একজন সুফি কবির বক্তব্য আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে বৈ কী।

কেননা ইবনুল ফারিজ বলেছেন: ‘প্রিয়তমের স্মরেণ আমরা মুদামা নামীয় সরাব পান করলাম আর সম্মানিত সত্ত্বার সৃষ্টির পূর্বে তদ্বারা আমরা নিশাযুক্ত হলাম। ’ ( দেখুন: কুরআন ও সন্নাহ-এর মানদন্ডে সুফীবাদ। মূল: মুহাম্মাদ জামীল যাইনূ শিক্ষক, দারুণ হাদীছ, মক্কা-মুকাররমাহ। অনুবাদ মুহাম্মাদ হারূন হোসাইন। পৃষ্ঠা,১৬) কাজেই সুফি মতবাদের অবস্থান যে ইসলামের প্রচলিত বিধিনিষেধের বাইরে, তাতে আর সন্দেহ কী।

সুফিবাদের উত্থান ও বিকাশ প্রসঙ্গে Ahmad S. Dallal লিখেছেন: During the 9th century Sufism developed into a mystical doctrine, with direct communion or even ecstatic union with God as its ideal. One of the vehicles for this experience is the ecstatic dance of the Sufi whirling dervishes. Eventually Sufism later developed into a complex popular movement and was institutionalized in the form of collective, hierarchical Sufi orders. (Dallal, Ahmad S. "Islam." Microsoft® Student 2008 [DVD]. Redmond, WA: Microsoft Corporation, 2007. Microsoft ® Encarta ® 2008. © 1993-2007 Microsoft Corporation. All rights reserved.) কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম লালনের ভাব-দর্শনের ওপর অষ্টম-নবম শতকের ভারতীয় অদ্বৈতবাদী দার্শনিক শঙ্করাচার্যের প্রভাব ঠিক কতটুকু পড়েছে। এমনটা ভাবার কারণ লালনেরই একটি গান: আল্লাহ, কে বোঝে তোমার অপার লীলে/ তুমি আপনি আল্লাহ ডাকো আল্লাহ বলে ... লালনের এ দুটি চরণে অদ্বৈতবাদী মনোভাব স্পস্টতই ধ্বনিত হয়। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদী দর্শনের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দর লিখেছেন, ‘... আত্মন বলতে আছেন একজনই; সেখানে দুই বলে কিছু নেই ... সমগ্র বিশ্বে অস্তিত্ব বলতেও আছে একটিই। এই অস্তিত্বকে যখন আমরা ইন্দ্রিয়মাধ্যমে দেখি তখন তাকে বলি জগৎ, অর্থাৎ জড়জগৎ। আবার যখন দেখি মনের মাধ্যমে তখন বলি চিন্তা, অর্থাৎ ধারণার জগৎ,এবং যখন যথার্থরূপে দেখি তখন বলি ইনিই সেই অনন্ত সত্তা।

এই কথাটি মনে রাখবেন যে মানুষের মধ্যে আত্মা বলে কিছু নেই ...অস্তিত্ব বলতে বোঝায় কেবল একটিই এবং তিনিই সেই আত্মন, সেই পরমাত্মা। এই পরমাত্মাকে যখন আমরা ইন্দ্রিয়মাধ্যমে দেখি তখন তিনি হন আমাদের দেহ; যখন দেখি চিন্তার মাধ্যমে তখন হন মন; এবং যখন দেখি স্বরূপে,তখন হন আত্মন, অর্থাৎ একমেবাদ্বিতীয়ম। ...দেহ মন ও আত্মাকে আমরা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করে থাকি তবু একথা ঠিক নয় যে এই একের মধ্যেই রয়েছে তিনের অস্তিত্ব। প্রকৃতপক্ষে সমস্তটাই হল আত্মন। এই এক সত্তাই দৃষ্টির তারতম্যে কখনও দেহরূপে, কখনও মনরূপে আবার কখনও পরমাত্মারূপে অভিহিত হচ্ছে।

’( বিবেকানন্দ সমগ্র । তৃতীয় খন্ড। রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন। পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫) ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে , শঙ্করাচার্যর জীবনকাল অষ্টম-নবম। সুফিবাদের উদ্ভব এবং বিকাশ ঐ শতকেই।

কাজেই সুফিবাদের ওপর ভারতীয় দর্শনের প্রভাব সম্পর্কে খোঁজখবর করতেই হয়। এবং তা করতে গিয়েই এ বিষয়ে প্রখ্যাত মার্কিন মনোবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক William James (1842 - 1910) - এর মতামত পেয়ে গেলাম তাঁর লেখা The Varieties of Religious Experience নামে এক বইতে। সে বইতে উইলিয়াম জেমস লিখেছেন:The Sufis have existed in Persia from the earliest times, and as their pantheism is so at variance with the hot and rigid monotheism of the Arab mind, it has been suggested that Sufism must have been inoculated into Islam by Hindu influences. কিছুটা চমৎকৃত হয়ে ভাবতে চাই যে জেমস-কথিত এই ‘হিন্দু প্রভাব’ (আসলে যা শঙ্করাচার্যের প্রভাবেরই নামান্তর) মুস কতদূর বিস্তৃত ছিল। স্পেনের মুসলিম রাজ্যে অদ্বৈতবাদী দার্শনিক ভাবনাটি পৌঁছেছিল কি? কেননা, স্পেনের আন্দালুসিয়ার এক সুফির মতবাদে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদের ধ্বনি পাই। সেই সুফির নাম ইবনু আরাবি (১১৬৫-১২৪০)।

স্পেনের আন্দালুসিয়ায় মুর্সিয়ার এক সম্ভ্রান্ত বংশে তাঁর জন্ম। পরে অবশ্য তিনি সিরিয়ার দামেস্কে স্থায়ী হয়েছিলেন। ইবনু আরাবির পুরো নাম অবশ্য আবু বকর মুহাম্মদ বিন আমি মুহয়ি আল দীন। জীবনভর প্রচুর লিখেছেন; সাকুল্যে কমবেশি চারশত গ্রন্থ। এর মধ্যে অন্যতম The Makkan Inspirations. খোদার প্রতি আরাবির অর্ন্তগত প্রগাঢ় ভক্তি তো ছিলই, সেই সঙ্গে ছিল তীক্ষ্ম বিশ্লেষনী মন ।

বিশ্বের নানান ধর্মের অজস্র বৈচিত্র সত্ত্বেও এক অর্ন্তগত ঐক্য অনুভব করেছিলেন ওই মহান সাধক। ফলে সুন্নী ওলেমাদের কঠোর সমালোচনা মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। ইবনু আরাবির সর্ম্পকে মক্কা-মুকাররমাহর দারুণ হাদীছ-এর শিক্ষক মুহাম্মাদ জামীল যাইনূ লিখেছেন, ‘সুফিবাদের এক শ্রেণি অদ্বৈবাদে বিশ্বাসী। তাদের নিকট স্রষ্টা ও সৃষ্টি (খালেক ও মাখলুক) বলতে কিছু নেই। সবই সৃষ্টি সবই ‘ইলাহ’।

এদের পুরোধা হচ্ছে সিরিয়ার -দামেস্ক -এ সমাহিত ইবনু আরাবী। ’ (কুরআন ও সন্নাহ-এর মানদন্ডে সুফীবাদ। পৃষ্ঠা;১২) ইবনু আরাবী ঠিক কি বিশ্বাস করতেন? বান্দাই রব, আর রবই বান্দা, আহা যদি জানতাম কে দায়িত্বশীল? যদি বলি বান্দাহ, আসলে তাই সত্য। অথবা যদি বলি রব। তবে কোথা হতে তিনি দায়িত্ব প্রাপ্ত হলেন? ইবনু আরাবীর বিরুদ্ধে অর্থডক্স মুসলিম ওলেমাদের উষ্মার এই কারণ।

অবশ্য অনেকেই আন্দালুসিয়ার সেই সুফি সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষন করেন। তাদের মতে ...To Ibn Al-Arabi love was more important than knowledge, a theory rejected by traditional Muslim scholars. তথ্যসূত্র কুরআন ও সন্নাহ-এর মানদন্ডে সুফীবাদ। মূল: মুহাম্মাদ জামীল যাইনূ শিক্ষক, দারুণ হাদীছ, মক্কা-মুকাররমাহ। অনুবাদ মুহাম্মাদ হারূন হোসাইন। (Dallal, Ahmad S. "Islam." Microsoft® Student 2008 [DVD]. Redmond, WA: Microsoft Corporation, 2007. Microsoft ® Encarta ® 2008. © 1993-2007 Microsoft Corporation. All rights reserved.) http://en.wikipedia.org/wiki/Ibn_Arabi ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     বুকমার্ক হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.