আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বোধ ( জীবনানন্দ দাশ )

লোকে বলে স্বপ্ন জোছনা বিহার, জোছনা কনা রাত্রি উজাড় ! আমি বলি এ বেলা চৈত্র বিহার, স্বপ্নে ছুরি চোখে আঁধার ! আলো — অন্ধকারে যাই — মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে! স্বপ্ন নয় — শান্তি নয় — ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়! আমি তারে পারি না এড়াতে সে আমার হাত রাখে হাতে; সব কাছ তুচ্ছ হয়, পণ্ড মনে হয়, সব চিন্তা — প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়! সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে! কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে সহজ লোকের মতো! তাদের মতন ভাষা কথা কে বলিতে পারে আর! — কোন নিশ্চয়তা কে জানিতে পারে আর? — শরীরের স্বাদ কে বুঝিতে চায় আর? — প্রাণের আহ্লাদ সকল লোকের মতো কে পাবে আবার! সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর স্বাদ কই! — ফসলের আকাঙ্খায় থেকে, শরীরে মাটির গন্ধ মেখে, শরীরে জলের গন্ধ মেখে, উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে চাষার মতন প্রাণ পেয়ে কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর পরে? স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়,কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে! পথ চলে পারে — পারাপারে উপেক্ষা করিতে চাই তারে: মড়ার খুলির মতো ধরে আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে তবু সে মাথার চারি পাশে! তবু সে চোখের চারি পাশে! তবু সে বুকের চারি পাশে! আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে! আমি থামি — সেও থেমে যায়; সকল লোকের মাঝে বসে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা? আমার পথেই শুধু বাধা? জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে সন্তানের মতো হয়ে — সন্তানের জন্ম দিতে দিতে যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময় কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয় যাহাদের ; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চলে জন্ম দেবে — জন্ম দেবে বলে; তাদের হৃদয় আর মাথার মতন আমার হৃদয় না কি? — তাহাদের মন আমার মনের মতো না কি? –তবু কেন এমন একাকী? তবু আমি এমন একাকী! হাতে তুলে দেখি নি কি চাষার লাঙল? বালতিতে টানি নি কি জল? কাস্তে হাতে কতবার যাই নি কি মাঠে? মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে ঘুরিয়াছি; পুকুরের পানা শ্যালা — আঁশটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে গিয়েছে জড়ায়ে; –এই সব স্বাদ –এ সব পেয়েছি আমি — বাতাসের মতন অবাধ বয়েছে জীবন, নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন একদিন; এই সব সাধ জানিয়াছি একদিন — অবাধ — অগাধ; চলে গেছি ইহাদের ছেড়ে — ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে, অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে, ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে; আমার সে ভালোবাসিয়াছে, আসিয়াছে কাছে, উপেক্ষা সে করেছে আমারে, ঘৃণা করে চলে গেছে — যখন ডেকেছি বারেবারে ভালোবেসে তারে; তবুও সাধনা ছিল একদিন — এই ভালোবাসা; আমি তার উপেক্ষার ভাষা আমি তার ঘৃণার আক্রোশ অবহেলা করে গেছি; যে নক্ষত্র — নক্ষত্রের দোষ আমার প্রেমের পথে বারবার দিয়ে গেছে বাধা আমি তা ভুলিয়া গেছি; তবু এই ভালোবাসা — ধুলো আর কাদা — । মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয় — প্রেম নয় — কোনো এক বোধ কাজ করে। আমি সব দেবতারে ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চলে আসি, বলি আমি এই হৃদয়েরে; সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়? অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়? কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন! মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন! শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন! এই বোধ — শুধু এই স্বাদ পায় সে কি অগাধ — অগাধ! পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ চায় না সে? করেছে শপথ দেখিবে সে মানুষের মুখ? দেখিবে সে মানুষীর মুখ? দেখিবে সে শিশুদের মুখ? চোখে কালোশিরার অসুখ, কানে যেই বধিরতা আছে, যেই কুঁজ — গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে নষ্ট শসা — পঁচা চালকুমড়ার ছাঁচে, যে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে — সেই সব।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।