আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার হবু বউ এবং একটি জীবন ঘেঁষা সত্যি গল্প।

আমি খুবই নিরীহ একটি প্রাণী। আমর দুটি করে চোখ, কান, হাত ও পা আছে। আমার একটি নাক ও একটি মুখ ও আছে। শরীরে লাল রক্ত আছে, বুকের মাঝে একটি হৃদয় ও আছে বোধ করি। মেয়েটি যখন বাঁশের সাঁকো দেখে, পার হতে পারবেনা বলে ঘোষণা দিল, তখন থেকেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।

তারপরে যখন সে তার জুতা জোড়া আমার হাতে দিয়ে বলল, দাদা আপনি এটা হাতে করে পার হন, আমি জুতা পায়ে পার হতে পারবোনা। তখন বিরক্তি চরম সীমায় পৌছাল। মুখে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললাম, ঠিক আছে। হাসির ফলাফল হিসাবে তার হাত ব্যাগটাও তার কাঁধ থেকে নেমে আমার কাঁধে এসে ঝুলে পড়ল। ছোট্ট একটা সাঁকো যখন সে আধা ঘণ্টা নিয়ে পার হচ্ছে তখন দুইপাশে ছোটখাটো একটা জনসমাবেশ তৈরি হয়েছে।

আমি ভগবানের দিকে মুখ তুলে বললাম, এই মাইয়া যদি সাঁকো থেকে পড়ে, আমি আজই তোমার নামে এক কেজি মিষ্টি কিনে খাব। কিন্তু আমার আশা পুরন হলনা। সে সফলভাবে সাঁকোর অপর পাশে আবতরন করল। এতক্ষণ যার গল্প করলাম, তিনি মাধুরী। না মাধুরী দীক্ষিত নন, শুধুই মাধুরী, ডঃ মাধুরী।

এই ঘটনা যে সময়কার, তখনও তার ঘাড়ে ডাক্তার হবার গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয় নাই। এই মেয়েটিকে আমি প্রথম দেখি ছবিতে। সাদাকালো পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি থেকে, দুই পাশে চুলের বেনি ঝুলিয়ে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমার ভিতর দিয়ে উনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এরপরে কেটে গেছে অনেকটা সময়। আমি তখন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র।

আমার ক্যাম্পাসে তখন অনিবার্য কারনবশত অনির্দিষ্ট কালের ছুটি চলছিল। আমিও মহাউল্লাসে মায়ের হোটেলে বসে বাপের অন্ন ধ্বংস করছি। এমনই একদিনে তিনি আমার বাপের সাথে আমাদের বাসায় এসে হাজির। ঘাটনাক্রমে আমি তখন বাসায় ছিলাম না। সন্ধ্যা বেলা সারা এলাকা টহল দেয়া শেষে যখন বাসায় ফিরলাম, ততক্ষণে তিনি আমার মায়ের বিছানা দখল করেছেন।

কথা বলতে যেয়ে দেখলাম, নাদুস নুদুস ভীষণ ফর্সা একটা মেয়ে চোখে চশমা পরে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে মিষ্টি খাচ্ছে। মুখে একটা হাসি দিয়ে বললাম, কেমন আছ? কি করছ? আমার চেয়েও হাসি হাসি মুখে সে জবাব দিল, দাদা পান খাচ্ছি। আপনি খাবেন? দারুন একটা ভ্যাবাচ্যাবা খেয়ে তখনকার মতো বিদায় নিলাম। রাত্রে মায়ের কাছে তার আগমনের কারন জানতে চাইলাম। জানতে পারলাম তিনি সেই বছরই মাধ্যমিক পরীক্ষায় এ পিলাচ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

পরদিন আমার গ্রামের বাড়ীতে তাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, আমার বাবা আমার গ্রামের বাড়ির অঞ্চলের একটি স্কুলের পরিচালনা পার্ষদের সভাপতি ছিলেন। কৃতি শিক্ষার্থী সম্বর্ধনার আইডিয়াটা ছিল আমার বাবার, তিনি এটা করেছিলেন গ্রামের অন্য ছাত্র ছাত্রীদের উৎসাহিত করার জন্যে। যদিও সকালে ঘুম থেকে উঠা আমার ইতিহাসে ছিলনা, তবুও পরদিন সকালে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমিও তাদের সাথে গ্রামের পথে রওনা হলাম। আমার গ্রামের বাড়ি যেতে কিছুটা পথ বাসে, কিছু অংশ ভ্যান গাড়িতে করে, বাকি অংশ হেঁটে যেতে হয়।

বাস থেকে নামার পর তাকে স্কুলে পৌঁছানোর মহান দায়িত্ব আমার বাবা আমার উপর অর্পণ করে নিজের শিষ্যদের নিয়ে চলে গেলেন সম্বর্ধনা দেবার উপহার সামগ্রী কিনতে। সামনের ৪/৫ কিলোমিটার রাস্তা আমাদের ভ্যানে করে যেতে হবে। তাই ভ্যান ঠিক করে তাকে নিয়ে রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভ্যানে করে যেতে যেতে অনেক কথা হল তার সাথে। আমি তার কথায় বুঝতে পারলাম সে গ্রাম বাংলার প্রকৃতির সাথে পরিচিত।

সবথেকে খুশী হলাম যখন জানলাম সেও আমার মতই ক্রিকেটে ভারতের সমর্থক। কিন্তু ফুটবলে ব্রাজিল শুনে সেই খুশী কমে গেল। তার ভাললাগা, মন্দলাগা, পছন্দ, অপছন্দ, তার জীবনের গল্প ইত্যাদি নানা কথায় কথায় ভ্যানের যাত্রা শেষ হল। সেখান থেকে হাঁটার রাস্তা শুরু। এই রাস্তায় হাটতে যেয়েই সেই সাঁকোর গল্প, যে গল্প প্রথমেই বলেছি।

কোনভাবে তাকে নিয়ে স্কুলে পৌঁছে গেলাম। সেখানে সারাদিন ধরে চলল সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান। এর ভিতরে আরও অনেক ঘটনা আছে, সেগুলো আর বললাম না। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা বাসায় ফিরলাম। তারপরে আর একদিন আমাদের বাসায় বেড়িয়ে, সে চলে গেল তার বাসায়।

আর মূল সমস্যার শুরু এখান থেকেই। সে চলে যাবার পর থেকেই মনে হতে লাগলো আমি কিছু একটা আনুভব করছি। তার হাসি, তার তাকানো, তার কথা বলা, তার সবকিছুই ভাসতে লাগলো মনের আকাশে। সব বিশ্লেষণ করে বুঝলাম আমি তার প্রেমে পড়েছি। তখন মোবাইল এত সহজলভ্য ছিলনা।

যদিও আমার হাতে একটা মোবাইল ছিল, কিন্তু তার হাতে তো ছিল না। আমার একমাত্র ভরসা ছিল তার মায়ের একটা মোবাইল নাম্বার। তাই নিয়েই ঝাপিয়ে পরলাম যুদ্ধে। কিভাবে তার সাথে যোগাযোগ করবো, সেটাই তখন মূল সমস্যা। অনেক ভেবেচিন্তে একটা উপায় বের করলাম।

কিন্তু সফলতার সম্ভাবনা ছিল প্রায় ০% যাহোক মূল গল্পে ফিরে যাই। পরিকল্পনা মতো তার মায়ের মোবাইল নাম্বারে আমার একটা বান্ধবীর নাম দিয়ে একটা ক্ষুদে বার্তা পাঠালাম। লিখলাম জরুরী দরকার, সে যেন আমার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করে। তারপর শুরু হল অপেক্ষা। পরেরদিন সকালে তার ফোন পেলাম।

সে ফোন করল দোকান থেকে, আর তার সাথে আমার যোগাযোগ শুরু হল প্রতারণার মধ্য দিয়ে। প্রতারনা বলতে বান্ধবীর নামে ক্ষুদেবার্তা পাঠানোর কথা বললাম। আমার সাথে সে কথা বলল মাত্র ৩ মিনিট। কারন আমার সাথে কথা এতটুকু কথা বলতে যেয়েই তার হাতের পাঁচ ১৫ টাকা শেষ। খুব বেশী কিছু বলতে পারলাম না।

কিন্তু আমি তার কাছ থেকে আশ্বাস আদায় করে রাখলাম যে সে পরে আমাকে ফোন করবে। তারপর প্রথম প্রথম তার বান্ধবীর মোবাইলে কথা বলা শুরু করলাম। সেটা আস্তে আস্তে তার মায়ের মোবাইলে ট্রান্সফার হল। সময় সুযোগ মতো কথা চলত, আর তার সাথে সাথে ক্ষুদেবার্তা। আমি মনে হয় তখন প্রতিটা মুহূর্ত তার ফোনের অপেক্ষায় থাকতাম।

আহা! কত সুন্দর ছিল সেই অপেক্ষার সময়গুলো। এভাবেই কাটছিল দিন। এর ভিতরে তাকে একদিন বলে দিলাম, তোমাকে ভালোবাসি। এ কথা শোনার পর থেকে সে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল, ফোন ক্ষুদে বার্তা সব বন্ধ। চারপাশের বাতাস যেন ভারি হয়ে আসল।

প্রথমে সে আমাকে না বলে দিল। আমি চেষ্টা চালাতে লাগলাম। এইভাবে দীর্ঘ চেষ্টার পর সে তার মন পরিবর্তন করল। সেই দিনটা ছিল বোধ হয় আমার জীবনের সব থেকে সুখের মুহূর্ত। এখনো মনে হলে আমি শিহরিত হই।

সে হ্যাঁ বলার পর থেকে তাকে একটু দেখার জন্যে আমি পাগল হয়ে উঠলাম। তাকে দেখতে চলে গেলাম তার বাসায়। আসলে বাসায় না, দেখা হল ক্যাফেটেরিয়াতে। ওটা ছিল তার সাথে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ এবং প্রথম ডেট। তারপরে কেটে গেছে দীর্ঘ সময়।

আজ ৭/৮ বছর হয়ে গেল, আজও আমরা একসাথে আছি। আজীবন থাকব আসা করি। সেই ছোট্ট শুয়োপোকা আজ রঙিন প্রজাপতি। সে আজ ডাক্তার। আর আমি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে গাধা হবার চেষ্টায় এমবিএ করছি।

সামনের বছর বিয়ে করবো আমরা। জীবনে টাকা পয়সা দিয়ে অনেক কিছুই পাওয়া যায়, কিন্তু সুখ পাওয়া যায়না। আমরা সুখে আছি। সত্যিই অনেক সুখে আছি। হয়তো অনেক কিছুই নাই, অনেক অপূর্ণতা আছে, কিন্তু মনে সুখ তো আছে।

একটু রাগ করলে কেঁদে চোখ ফুলানো, ফোন ধরতে দেরি হলে চিন্তায় অস্থির হওয়ার একজন মানুষ তো আছে। একজন মানুষতো আছে যে আমাকে খুব খুব ভালোবাসে। হে ঈশ্বর তোমাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ এত সুন্দর আনন্দময় একটা জীবন দেওয়ার জন্য। আপনাদের দোয়া কামনা করছি আমরা।

আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ভালো থাকবেন সবাই। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।