আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেন সেনাবাহিনীই মিসরের শেষ আশ্রয়স্থল?

গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত মিসর গণতান্ত্রিক জোটের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর পেছনে দেশটির সামরিক বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মিসরের জাতীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর এই সীমাহীন প্রভাবের কারণ কী? সেনাবাহিনী এবার যা করেছে, সেটি বিপ্লব না অভ্যুত্থান নাকি অন্য কিছু?
মিসরের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাবের অন্তর্গত কারণ নিয়ে এক বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে সিএনএন। ‘হাউ ইজিপ্টস মিলিটারি হোল্ডস দ্য কি টু কান্ট্রিস ফিউচার’ শিরোনামের নিবন্ধে বলা হয়েছে, মিসরে যা হয়েছে, তা কার্যত বেসামরিক সরকারের মোড়কে সামরিক অভ্যুত্থান।
সামরিক অভ্যুত্থান বলতে বোঝায়, একটি বেসামরিক প্রশাসনকে সরিয়ে দিয়ে সামরিক প্রশাসনকে পুনর্বহাল করা।

কিন্তু মিসরে এখনো বেসামরিক আমলাতন্ত্র বহাল আছে। বরং আপাতদৃষ্টি দেশটির সামরিক প্রশাসন বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এ যেন সেনা-সমর্থিত এক তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

সেনাবাহিনীর গোড়া
১৯৫২ সালের পর থেকে মিসরের রাজনীতি সেনাবাহিনীর তত্পরতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ২০১১ সালে গণবিক্ষোভের মুখে দেশটির সেনারা তাদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু হোসনি মোবারককে হাতছাড়া করতে বাধ্য হয়।

১৯৫২ সালে দেশটির রাজতন্ত্র উত্খাতে যে সেনা কর্মকর্তারা ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন মোবারক। তিনিও এসেছিলেন দেশটির প্রভাবশালী মহল থেকে। কিন্তু গণ-আন্দোলন তাঁকে সরে যেতে বাধ্য করে।
মোবারকের উচ্ছেদে সেনাবাহিনী উচ্ছেদ হয়ে যায়নি। বরং দেশটির শাসনব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ পোক্ত হয়েছে।

এর আগে সেনাবাহিনী তার নিজের কাজকর্ম ও ব্যবসাবাণিজ্যে মনোযোগী ছিল। মিসরের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কলকারখানা ছাড়াও দেশটির বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ করে থাকে। এ থেকে তাদের বিপুল অর্থ রোজগার হয়। এতোদিন অর্থনৈতিক কার্যকলাপের বাইরে সেনাবাহিনী অনেকে ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেনি। এর অর্থ এ নয় যে তারা এসব জায়গায় খবরদারি করতে পারতো না।



সেনাবাহিনীর প্রতি জনসমর্থন
মিসরের আধুনিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সব সময়ই দেশটির সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল। ২০১১-১২ সালে সরকার পরিবর্তনের কালেও অনেক মানুষ সেনাবাহিনীর প্রতি অবিচল আস্থা ধরে রেখেছিল। ওয়াশিংটনভিত্তিক জরিপ প্রতিষ্ঠান গালাপ ইনকরপোরেশন সে সময়ে এক জরিপ চালিয়ে জানিয়েছিল, দেশটির সেনা কর্তৃপক্ষের প্রতি জনগণের আস্থা ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ। মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুতির পর তাঁর সমর্থকেরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষেপে গিয়েছে বটে, তবে নতুন জরিপ বলেছে এখনো ৮০ শতাংশ মিসরীয় সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রাখে।
সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের এ সমর্থন কেবল আবেগ বা দর্শন প্রসূত নয়।

এর স্বার্থগত কারণও আছে। মিসরের প্রায় প্রতিটি পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য সেনাবাহিনীতে কর্মরত। মিসরে প্রতি পরিবার থেকে কেউ না কেউ সেনাবাহিনীতে কাজ করতে আইনত বাধ্য থাকে। মিসরের বিভিন্ন বিদ্যালয়েও যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাতে সেনাবাহিনীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে শেখানো হয়। সরকারি গণমাধ্যমেও সেনাবাহিনীর ইতিবাচক দিকগুলোকে বেশি বেশি করে প্রচার করা হয়।

মোবারকের পতনের পর এসব চর্চার কোনোটিরই পরিবর্তন হয়নি।

মুরসির সরকারের ভুল
গত বছর মুরসি ও তাঁর মুসলিম ব্রাদারহুড অনেকগুলো ভুল করেছে। তাঁরা এমন অসংখ্য কর্মসূচি হাতে নিয়েছে এবং কর্মনীতি নির্ধারণ করেছে, যা মিসরের বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
মুরসি ও তাঁর সরকার দেশটির ‘গেঁড়ে বসা’ রাষ্ট্রব্যবস্থাটিকে এতটুকু বদলাতে চাননি, বরং এটিকে নিজ দলের সুবিধা বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করেছেন।
ক্ষমতায় গিয়ে মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সেনাবাহিনীকে বাগে আনতে পেরেছেন, এটা ভেবে মুরসি বড় ভুল করেছিলেন।

এতে হয়তো তিনি শান্তির ঢেঁকুর তুলেছেন, কিন্তু বাস্তবতাকে বদলাতে পারেননি। বরং অদক্ষতা ও অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন। সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মোহম্মদ হোসেন তানতাবিকে অপসারণ করেননি মুরসি। বরং পরিস্থিতি বুঝে সেনাবাহিনী নিজেই নিজের কাঠামো বদলাতে পেরেছে।
তানতাবি মুসরির সরকারে প্রথমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও পরে উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

যদিও মুরসি ২০১২ সালের আগস্টে তানতাবিকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করে নিজের উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন, তবুও এ ঘটনার ফল তানতাবির পক্ষেই গেছে। সেনাপ্রধান থাকার সময় ও পরে তানতাবি যেসব দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সেগুলো থেকে তিনি অব্যহতি পেয়েছিলেন।
সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরে গিয়ে তানতাবি বসিয়েছেন জেনারেল আবদেল-ফাতাহ আল-সিসিকে। মজার ব্যাপার হলো, মুরসির শাসনামলে সেনাবাহিনী নিজেকে একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করতো এবং কোনো ব্যাপারেই নিজেকে মুরসির সরকারের অধীন হিসেবে পরিচয় দেয়নি।
দেশটির বেসামরিক সরকারের কাজে জটিলতা যত বেড়েছে, সেনাবাহিনীর প্রত্যাশাও তত বেড়েছে।

তবে গত আড়াই বছরে দেশটির সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকাণ্ডের দিকে জনগণের একটি অংশ মনোযোগ দিয়েছে। এতোদিন কেউ এ ব্যাপারে তেমন কিছু বলেনি। অভিযোগগুলোর বেশির ভাগই তানতাবির শাসনামলের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সামরিক বাহিনীর ব্যবসা সংক্রান্ত।

পুরোনো সমস্যার জট এখনো
গত সপ্তাহে মিসরের জনবিক্ষোভ বলছে, মোবারকের শাসনামলে জনগণ যেসব সমস্যায় জর্জিরিত ছিল, এখনো সেগুলো বহাল তবিয়তে টিকে আছে। কিন্তু জনগণ এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সামরিক বাহিনীর দিকে তাকাতে চায়নি।

আর সেনাবাহিনীও ব্যারাকে থেকে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকঠাক চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। জনসম্পৃক্ত ইস্যু নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি।
গত বছর মুসরির সরকার যে সংবিধান প্রণয়ন করে, তাতে সেনাবাহিনীর স্বার্থ রক্ষার পূর্ণ ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংবিধানে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাও এতো বাড়ানো হয়নি যা সেনাবাহিনীর মতো একটি বৃহত্ সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। সংবিধানের এসব ধারার বিশেষ কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না।


মিসর দুর্নীতিতে ছেয়ে আছে। মুরসি এটি কমানোর কোনো চেষ্টা করেছেন বলে জানা যায় না। মুরসির আমলে পুলিশ বাহিনীর নির্যাতন বহাল থেকেছে। মুসরি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশটির পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যৌন নিপীড়ন ও বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার ঘটনাকে আগেও গুরুতর বলে মনে করা হতো না, এখনো হয় না।

এ নিয়ে ‘অপারেশন অ্যান্টি-হ্যারাসমেন্ট/অ্যাসল্ট অ্যান্ড হ্যারাসম্যাপ’-এর মতো অনেক সংগঠন তীব্র প্রতিবাদ করলেও তাতে সরকার সাড়া দেয়নি। নতুন সরকার কি এসব বিষয়ে মনোযোগ দেবে?

ভবিষ্যতের সংগ্রাম
দেশটির শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রয়োজন। এটি সময়ের দাবি। কিন্তু তা করতে যাওয়া যেকোনো সরকারের জন্যই কঠিন। দৃঢ় জনসমর্থন ও সাংগঠনিক দক্ষতা না থাকলে, এসব সমস্যা দূর করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।


২৫ জানুয়ারির বিপ্লবের দাবির বেশির ভাগই পূরণ করতে পারেননি মুরসি এবং এ কারণে জনসমর্থনও হারিয়েছেন। মিসরের নতুন সরকারকেও এ হিসাব-নিকাশ ঠিক করে বুঝে নিতে হবে। ভবিষ্যতের যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে চ্যালেঞ্জ হবে, জনগণের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন ও সত্যিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু দেশটির সেনাবাহিনী কি এসব দাবি বাস্তাবায়িত হতে দেবে? তার চেয়ে বড় কথা, দেশটির সেনাবাহিনী কি সত্যিকার গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে দেবে? উত্তর মিলবে ভবিষ্যতেই। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।