আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই শহরের কোনো বিষন্ন কোণে... (২)

প্রকৃতিকে করো তব দাস-চে দ্য আইডল (ব্লগার নং - ৩১৩৩৯) এই শহরের কোনো বিষন্ন কোণে... (১) এই বাসার জানালার ওপাশে দুটো লম্বা বিল্ডিঙের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায় এক চিলতে। সেই ফাঁক দিয়ে চোখ ফেলে বসে আছে আরিফ। বাইরে রাতের আকাশ ভেজা বাতাসের কোলাহলে নির্ভার ঘুম দিয়ে আছে। মধ্যরাতের ছুটে চলা ট্রাক আর হাতেগোণা সিএনজি ট্যাক্সির শব্দ সে ঘুম ভাঙাতে পারে না। দূরে পুলিশের বাঁশি বাজে আর শব্দ হয় কারো ছুটে পালানোর।

আরিফের ঘুম আসছে না। দম ফুরিয়ে যাওয়া পুতুলের মত চেয়ে থাকে অদৃশ্য দৃশ্যমেলায়। দৃশ্যে দৃশ্যে ভাসে কিছু টুকরো টুকরো কথা, টুকরো টুকরো হাসি, আর তার মন খারাপিয়া মেঘের ঘনত্ব বাড়ায়। মাঈশা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? না, জেগে আছে নির্ঘুম? এপাশে পায়ে পা জড়িয়ে সানিম আর রাফি, ওপাশে তূর্ণা না থাকলে হয়তো উঁকি দেয়া যেত মাঈশার রুমে। বলা যেত, স্যরি।

আমি কী করবো? আমারও তো সহ্যসীমা আছে! ঝগড়াটা করা ঠিক হয়নি। আরিফ ভালো করেই জানে, সানিমের আচরণে কিছু মনে করার নেই। ও তো এমনই। পাগলাটে। নিজের কাজের কোনো ব্যাখ্যা কারো কাছে দেয় না, কারো কাজের ব্যাখ্যাও আশা করে না।

সানিমের মনের পরিচয়ও আরিফের জানা। ক্লেদ সব বাইরেই। যতটুকু তল পাওয়া যায়, সেখানে মলিন কিছু নেই। তবুও কোথাও কিছু একটা হয়ে যায়। মাঈশাকেও দোষ দিতে পারে না সে।

আরিফ এরকম অস্বস্তিবোধ করতে পারে আদৌ, সেটা কি সে কস্মিনকালে ভেবেছে! আরিফের অস্বস্তিবোধ বাড়তে বাড়তে কালো আকাশকে স্পর্শ করতে চায় আর অবোধের মত সব দোষ চাপায় সানিমের কাঁধে। দু'হাত দূরে ঘুমিয়ে পড়া সানিমকে মনে হয় যোজন যোজন দূরের। অথচ মোটেও সে দূরের কেউ নয়। ক্যাম্পাসের দিনগুলো ভেসে ভেসে যায় অন্ধকারের ক্যানভাসে। কত রাত একসাথে জেগে থাকা, সানিমের গল্পকে চিত্রনাট্যে রুপ দেয়া, হাঁটতে হাঁটতে পার হয়ে যাওয়া রাতের জোসনাপ্লাবিত মাঠ, তারপর আকাশের মুখোমুখি বসে থাকা উদ্ভ্রান্ত! তাদের একটা সংগঠন ছিলো, সেখানে ওরা নাটক করতো, গান গাইতো, অণুসিনেমা বানিয়ে প্রদর্শন করতো।

কত রাত কেটে গেছে নির্ঘুম একসাথে। রাত জেগে মঞ্চসজ্জা, তোরণ আর পোস্টার বানানো, রাস্তায় রঙ ঢেলে আল্পনা। আরিফ আরো পেরিয়ে যায় সময়, যখন সানিম তেমন কথা বলত না, চুপচাপ থাকতো; তখন ওরা মাত্র এসেছিলো এই ক্যাম্পাসে। কত জ্বালাতন, কত টিপ্পনি, অথচ সানিম কিছুই বলতো না। তখন যা কিছু ফাজলামি, সবকিছুর হোতা এই রাফি।

কে কলা কিনে এনে লুকিয়ে রেখেছে খাটের তলায়, কে রাতে ভূতের ভয় পায়, কার মধ্যে লুকিয়ে আছে ঘাড়ত্যাড়ামি, এসব ছিলো তার নখদর্পণে। কলা কখন কে এসে খেয়ে ফেলেছে, রুমের পেছনের জানালায় ভেংচি কাটা ভূতটা কবরস্থান না পাশের রুমেই থাকে সেসব কেউ হদিস করতে পারতো না। তারপর সানিমের খোলস ভাঙে। মিশতে শুরু করে, রাতের ডাবচুরি-কাঁঠালচুরির অভিযানে সেও শামিল হতে থাকে। আস্তে আস্তে সম্পর্ক বাড়ে, গভীর হয়।

অথচ আজ কী হলো! এত ঘৃণা করতে, দূরে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে কেন ওর? আরিফ ভেবে পায় না। পুলিশগাড়ির সাইরেন তার করোটি এলোমেলো করে দিলে ঘোর ভাঙে। উড়ে যায় রাতজাগা এক পাখি। যত দূর দেখা যায়, চেয়ে থাকে। রাতজাগা পাখির সাথে সে উড়তে শুরু করতে গিয়েও থেমে যায়।

মুঠোফোনে বার্তা আসে। মাঈশার। ' ঘুমাও। কিছুই হয়নি। ' আরিফ জানালার ফাঁক দিয়ে পাখিটিকে আর দেখতে পায় না।

শেষরাতের মৃদু হাওয়ায় উদোম গায়ে শুয়ে থাকা সানিমের শরীর ভাঁজ হয়ে যেতে থাকলে আরিফের মমতা হয়। কাঁথা দিয়ে ঢেকে দেয় ঘুমন্ত শরীর। ****** সূর্যউঠা সকালে ঘুম থেকে জাগার অভ্যেস তূর্ণার। শরীরে ক্লান্তি আর আলস্য থাকলেও সে উঠে পড়ে। পাশে মাঈশা ঘুমাচ্ছে শিশুর মত।

আলতো হাতে মাঈশার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দেয়। তারপর উঠে চায়ের কেটলি চাপায় চুলায়। ভাগ্যিস,মনে করে চায়ের সরঞ্জাম কিনেছিলো কালরাতেই, নইলে চা ছাড়া সকালটা হয়ে যেত পানসে। এই বাসায় একচিলতে বারান্দা আছে। বসার কিছু না থাকায় পুরোনো খবরের কাগজ বিছিয়ে আয়েশ করে চা খায়।

বারান্দাটা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। চা পান করতে করতে সে সদ্যপাওয়া চাকরীর কথা ভাবে। আর ছয়দিন পর জয়েনিঙ। যদি এখানেই সানিম আর মাঈশার হয়ে যেত! ভালো হত কী যে! কাল সন্ধ্যায় খারাপ লেগেছে অনেক। মাঈশা দ্রুত সামাল দিলেও সানিমের চোখে একটুখানি রেশ রয়ে গিয়েছিলো।

হেসেছে, অহেতুক বকেছে কিন্তু রেশটুকুন যায় নি। তূর্ণা জানে, জবটা ওর দরকার খুব। অথচ পাগলটা কী জানি কী উল্টাপাল্টা বলেছে, জবটা হয়নি। সানিমের সাথে ওর বন্ধুতা অবশ্য খুব বেশীদিনের না। ফাজলামি করে ভার্সিটি ডে'র প্রোগ্রামে নেচেছিলো সে।

নাচটা মনে হয় ভালোই হয়েছিলো, সানিম খুব সুন্দর করে শুভেচ্ছা জানায়। সেখান থেকেই টুকটাক কথাবার্তা। সবসময় দুষ্টুমি, চোখে মুখে উদাসীনতা সব মিলিয়ে খারাপ লাগে না। সকালটা অনেক সুন্দর আজ। তূর্ণার ফুরফুরে মনে হাওয়া লাগে অথচ ভালোলাগাটা ভাগ করে দেয়ার মত কেউ জেগে নেই।

তূর্ণার হঠাৎ করে মনে হয়, জবটা না পেলেই ভালো হতো। ঘুমন্ত বন্ধুদের সাথে হুট করেই কেমন জানি দূরত্ব হয়ে গেছে। বারান্দায় বসে থাকতে ভালো লাগে না। রুমে এসে ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে। কিছু পাঠ আরেকবার ঝালিয়ে নিতে হবে।

****** সানিমের ঘুম ভাঙে দুপুরের দিকে। হুট করে উঠে বসে। তারপর বিহবল কিছু সময় কেটে যায়। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো কেন! তারপর টের পায়, এজন্য দায়ী রাফি। মোবাইলে কার সাথে আলাপ করছে।

সেখান থেকে টুকরো টাকরা কথামালা সানিমের ঘুমন্ত কানে ঢুকে কান্ডটা ঘটিয়েছে। ট্রেড লাইসেন্স, অমুক সফটঅয়্যার, তমুক কোম্পানী আর হাবিজাবি! রাফির পাগলামি জানা আছে। ব্যবসা ঢুকেছে মাথায়। পাগলটার শান্তি আর নেই। আরে ব্যাটা, দু'দিনের দুনিয়া, এত ব্যবসা আর টাকা দিয়া করবি কী? সানিম সিগারেট ধরায় আর আড়চোখে দেখে, মাঈশার হাতে চায়ের কাপ।

সে হাঁক ছাড়ে, বউ,আমারে এককাপ খাওয়া না। মাঈশা নড়ে না। আরিফের চোখে স্থির হয়ে আছে মাঈশার দিকে। সানিম এসবের কিছুই খেয়াল করে না। সে পাশে পড় থাকা পত্রিকার শিরোনাম পড়ে যাওয়া মনোযোগে।

(চলবে মনে হয়!) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।