আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: কুয়াশায় দুই তরুণি

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ শেষ বিকেলের নরম আলোর ভিতরে খাগড়াছড়ির আঁকাবাঁকা সড়কের পাশে হাঁটছিল তুষার । ওর পাশ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে কিছু দূরে একটা ক্রিমকালারের টয়োটা প্রাডো ব্রেক কষল। জানালায় দীপ্তর মুখ।

এই তুষার । দীপ্ত ডাকল। তুষার থমকে দাঁড়াল। ওর ভ্রুঁ কুঁচকে উঠেছে। বোঝা গেল দীপ্তকে দেখে ভারি অবাক হয়ে গেছে সে।

দ্রুত পায়ে প্রাডোর কাছে চলে আসে তুষার। গাড়িতে আরও অনেকে। কাঁচের আড়াল থেকে উঁকি-ঝুঁকি মারছে। তুই এখানে? তুষারের কন্ঠস্বরে বিস্ময়। দীপ্ত বলল, আমাদের আজ সাজেক যাওয়ার কথা ছিল।

সকালে দীঘিনালা থেকে রওনা হয়েছি। পানছড়ি পেরিয়ে গাড়ি নষ্ট হল। আজ রাতটা থাকার ব্যবস্থা করতে পারবি? তুষার মাথা নাড়ে। গাড়িতে ওঠ । দীপ্ত বলে।

তারপর দরজা খুলে দেয়। গাড়ির ভিতরে মুখগুলি পরিচিত । রাজি, জয়া, রাহী মল্লিক রাখি আর রিয়া। তুষার এদের চেনে । রিয়ার পাশে একটা শ্যামলা রঙের মেয়ে বসে।

আয়ত চোখে কেমন বিষাদ লেপ্টে আছে। এই মেয়েটাকে অবশ্য চেনে না তুষার। চোখে চোখ পড়তেই মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল মেয়েটি। রাজির গলায় একটা দশ মেগাপিক্সেলের প্যানাসনিক লুমিক্স ক্যামেরা ঝুলছে। রাজি তুখোর ফটোগ্রাফার।

গত বছর ডেইলি ডেলি সান- এ জয়েন করেছে। রাজি জিগ্যেস করে, তোমারে এত শুখনা দেখায় কেন দোস্ত? চুল পড়ে গেছে কেন? তুষার হাসল। বড় ম্লান সে হাসি। রাজিকে তো সত্যি কথা তো বলা যাবে না। সুতরাং চুপ করে থাকে তুষার।

দীপ্ত বলল, কোথায় যেতে হবে বল। সোজা যা। তারপর ডান দিকে টার্ন নে। তুষার বলে। দীপ্ত গাড়ি ছাড়ল।

জয়া বলল, তুষার ভাই। আপনাকে আল্লা পাঠাইসে। নইলে আমাদের বাঘভাল্লুকে খাইত। ঠিক, ঠিক । রিয়া বলে।

তুষার চুপ করে থাকে। জ্যোতির মুখটা মনে পড়ল ওর। এদের দেখে অবাক হয়ে যাবে জ্যোতি। দীপ্ত বলে, তুই কি এখন পানছড়ি থাকিস? হ্যাঁ। ঢাকায় আর ফিরবি না? দেখা যাক।

পানছড়ি সদরের উত্তরে এই জায়গাটার নাম লোগাং। লোগাং এর বুক চিরে একটি পাহাড়ি নদী বইছে । নদীর নাম চিংগ্রি। চিংগ্রি নদীর পাড়ে অনেক পাথর । তারই পাড়ে মাঠ।

সেই মাঠে একটা পরিত্যক্ত গীর্জায় থাকে তুষার। শীতের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। দীপ্তকে একটা মাঠের পাশে প্রাডোটা থামাতে বলল তুষার। সন্ধ্যা হলেও ঠিক অন্ধকার জমে ওঠেনি। আকাশে আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।

যদিও কুয়াশা ছড়িয়েছে। চাঁদের আলোয় চিংগ্রি নদী ও নদীর পাড় অলীক হয়ে আছে। গাড়ি থামতেই সবাই হইহই করে নেমে এল। মাঠের এক পাশে গির্জাটা আবছা কুয়াশায় ডুবে আছে। গীর্জাটি কোন কালে খ্রিস্টান মিশনারীরা তৈরি করেছিল কে জানে।

গীর্জার পিছনে একটা কবরখানা আছে। সেই কবরখানায় ফাদার রিচমন্ডের সমাধিফলকের পাশে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ কথাটা খোদিত আছে । গীর্জার সামনে মাঠ। সেই মাঠের সামনে চিংগ্রি নদী বইছে। নদীর পাড়ে দেবদারু গাছের সারি।

আর পাথর। ক্ষীণ জলের শব্দ শোনা যায়। নদীর ওপারে একটি মায়াহরিণ চাঁদের আলোয় কুয়াশায় মিলিয়ে গেল। একটা রাতচরা পাখি টি টি শব্দে উড়ে গেল। রাহী মল্লিক-এর কাঁধে একটা অ্যাকুয়েস্টিক গিটার।

ও ‘বাউলিয়ানা’ নামে একটি ব্যান্ডের লিড ভোকার। কবিতাও লেখে রাহী মল্লিক। পেশায় প্রচ্ছদ শিল্পী। তুষার ওর কবিতার বই ‘জোছনায় মায়াহরিণ’-এর একটা দূর্দান্ত রিভিউ লিখেছিল। সুতরাং তুষারের প্রতি কৃতজ্ঞ সে।

রাহী মল্লিক রাখির প্রেমিক। রাখির পরনে সাদা সালোয়ার-কামিজ। নীল সোয়েটার। বুকের ওপর সাদা ওড়না ঝুলিয়ে রেখেছে। চশমাপরা ফরসা চেহারার মিষ্টি একটা মেয়ে।

রাখি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী; হোম ইকনমিক্স- এ পড়ছে। রাহী মল্লিক বলল, সত্যম শিবম সুন্দরম। লোগাং যেন পৃথিবীর স্বর্গ তুষার। ঠিক, ঠিক। অসহ্য সুন্দর ।

আমি পাগল হয়ে যাব। রিয়া উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে। তারপর জয়াকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। রাজি শিহরণ টের পায়। ওর আর জয়ার বিয়েটা এ বছরই ।

ডিসেম্বরে। জয়া একট স্কুলে পড়ায়। চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গায়। জয়া আজ শাড়ি পরে আছে। শাড়ির রংট আকাশি।

তার ওপর কার্ডিগেন। কার্ডিগেনের রং ধূসর। রিয়া পড়ছে একটা প্রাইভেট ইউনিভারসিটি। বি বি এ। পড়াশোনা ভালো লাগে না রিয়ার।

দীপ্তর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা রিয়ার। দীপ্ত এ বছরই একটা মাল্টিন্যাশনালে জয়েন করেছে। রিয়া দৌড়ে গীর্জার দিকে যায়। ওর পরনে জিন্সের প্যান্ট আর লাল পুলওভার। পায়ে কেডস।

ভয়ানক সুন্দরী রিয়া। মডেলিং করছে। দীপ্ত কনজারভেটিভ বলে রিয়ার মডেলিং পছন্দ না। কিন্তু বিষন্ন শ্যামলা ওই মেয়েটি কে? জয়া বলল, তুষার ভাই। এ হল শুভ্রা ।

আমার বড় খালার মেয়ে। রাজশাহী থাকে। রাজশাহী ইউনিভারসিটিতে পড়ে। ঢাকায় বেড়াতে এসেছে। শুভ্রা হাসল।

যেন মেঘের ফাঁকে চাঁদ উঁকি দিল। তুষার কেঁপে ওঠে। বিষন্ন শ্যামলা মেয়েটি ওকে ভীষন টানছে। দীপ্ত পাঞ্জাবির ওপরে সোয়েটার পড়েছে। মুখভরতি দাড়ি।

অবশ্য টুপি পরেনি রাহী মল্লিক কেড়ে নেয় বলে। দীপ্ত খানিকটা থলথলে। সে তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল, খাওয়াদাওয়ার কি ব্যবস্থা দোস? তুষার বলল, কাছেই একটি গ্রাম আছে। ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে । বন্ধুর নাম জ্যোতি ত্রিপুরা।

আমি ওই গীর্জায় থাকলেও দু-বেলা ওর বাড়িতেই খাই। জ্যোতিকে বললে খাবারের ব্যবস্থা করবে। তোর সঙ্গে আমি যাব? দীপ্ত জিগ্যেস করে। যাবি? আয়। অ্যাই, তোরা কই যাচ্ছিস? রাখি জিগ্যেস করে।

ডিনারের ব্যবস্থা করতে। দীপ্ত বলল। রিয়া বলল, সজারু আর শুয়োরের মাংস পাওয়া যায় কিনা দেখিস। পাহাড়ে এলেই ওসব খেতে হবে ? দীপ্ত ফোঁস করে ওঠে। রিয়া বলল, হ্যাঁ, হবে।

ঝগড়া বাঁধে আর কী। তুষার দীপ্তর হাত ধরে টান দেয়। রিয়া আর দীপ্তর প্রায়ই নানা কারণে লেগে যায়। হাঁটতে হাঁটতে ওরা গীর্জার পিছনে চলে আসে। বাঁ পাশে খ্রিস্টান কবরস্থান।

ডান পাশে ঘন বাঁশঝাড়। ক্ষীণ জলধারার শব্দ পায় দীপ্ত। কাছেই কোথাও পাহাড়ি ঝোরা আছে। ওদের সামনে পাশাপাশি দুটি টিলা। মাঝখান দিয়ে গ্রামের যাবার পথ।

চারপাশে কুয়াশা ঘনিয়ে উঠেছে। একটা বনমোগর ডেকে ওঠে। তুষার হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত বোধ করে। শরীরের ভার আর সে সইতে পারছে না। দীপ্ত জিগ্যেস করে, জ্যোতি ত্রিপুরা কে? তুষার বলে, আমার এক বন্ধুর স্ত্রী।

আমার সেই বন্ধুর নাম সঞ্জয় ত্রিপুরা। বছর তিনেক আগে আমি একবার খাগড়াছড়ি এসেছিলাম। তখন ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ওর বউ জ্যোতির সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল। সঞ্জয় দীঘিনালা থেকে প্রকাশিত অরণ্যবার্তায় সাংবাদিক ছিল ।

ছিল মানে? সঞ্জয় মারা গেছে দু’ বছর হল। কি ভবে? সীমান্তে ইয়াবা চোরাচালান হয়। অরণ্যবার্তায় ইয়াবা চক্রের ওপর সরেজমিন প্রতিবেদন লিখেছিল সঞ্জয় । স্মাগলাররা টলারেট করেনি। ব্রাশ ফায়ার করেছিল।

ওহ্ । খানিকক্ষণ নীরব থেকে দীপ্ত বলে, জ্যোতি ঢাকায় ফোন করেছিল। আমি তখন ভোরের কাগজ-এ কাজ করি। খবর পেয়েই পানছড়ি চলে । জ্যোতি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল।

পরিত্যক্ত গীর্জাটাকে স্কুল করার পরামর্শ দিলাম। জ্যোতি এখন স্কুলে পড়ায়। গ্রামের ছেলেমেয়েরা আসে পড়তে। এখন আমিও পড়াই। দীপ্ত চুপ করে থাকে।

কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে নির্জন গ্রামটি। বাঁশের বেড়ার ফাঁকে মিটমিট আলো চোখে পড়ে। আর আদিবাসী মানুষের কন্ঠস্বর শোনা যায়। কয়েকবার ডাকতেই টংঘরের নিচে নেমে এল জ্যোতি । অবাক হয়ে দীপ্তকে দেখছে।

জ্যোতির পরনে কালো রঙের সারং। ব্লাউজের ওপর একটা চাদর জড়ানো। জ্যোতির গোলপানা হলুদাভ মঙ্গোলয়েড মুখে বিষাদ লেপ্টে আছে। এখনও সঞ্জয়ের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি মেয়েটি। তুষারের সাম্প্রতিক অসুখটাও কম যন্ত্রণা দিচ্ছে না ওকে।

তুষার বলল, জ্যোতি, আমার কয়েকজন অতিথি এসেছে? আজ রাতটা এখানে থেকে কাল ভোরে সাজেক চলে যাবে। রাতে গীর্জায় থাকবে। তুমি কিছু কম্বলের ব্যবস্থা করো। জ্যোতি চুপ করে থাকে। আর ভাত বসিয়ে দাও।

আমিসহ আট জন। আমি রামুর ওখানে যাচ্ছি। মাছমাংস যা পাওয়া যায় রামু দিয়ে যাবে। ঠিক আছে। বলে জ্যোতি মাথা নাড়ে।

গীর্জার সামনে দাঁড়িয়ে শুভ্রা চারিদিকে তাকিয়ে দেখছিল। আর অবাক হয়ে গতরাত্রির স্বপ্ন ভাবছিল। চারপাশের দৃশ্য যেন গত রাত্রির স্বপ্নে দেখেছে ও। অন্ধকার পিচ্ছিল টানেলে ভেসে যাচ্ছিল। আর শোঁ শোঁ হাওয়ার শব্দ ... তারপর শুভ্র আলোয় কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ি নদী ।

আমি কি মুক্তি পাব? শুভ্রা অবাক হয়ে ভাবে। তুষার কে ভালো লেগেছে। জয়াও শুভ্রার কানে কানে এরই মধ্যে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে। ‘তুষার ভাই অন্যরকম। এখনও বিয়ে করেনি।

তোর অনেক ভাগ্য যে ওকে এখানে পেলি। ’ শুভ্রা স্বপ্ন দেখতে থাকে। গীর্জার সিঁড়িতে বসে থাকে ... গীর্জার ভিতটি মাটি থেকে বেশ খানিকটা ওপরে। মাঠ থেকে ভাঙাচোরা ঘাস-গজানো একটি সিঁড়ি উঠে গেছে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল চারদিক।

রাহী মল্লিক গিটার বাজাচ্ছিল। স্প্যানিশ সুর। রিয়া নাচছিল। নাচের ঢংটি ফ্লেমিঙ্কো। রিয়াকে উদ্ভিন্ন যৌবনা হিসপানিক নর্তকীর মতো লাগছিল।

রাজির ঠোঁটে একটা বেনসন লাইট জ্বলছিল। তারপরও কৌশলে এক ক্লিকে রিয়ার নৃত্যরত ছবি তুলে নেয় রাজি । রিয়ার বুক দুটি উন্নত। কাজেই ঈর্ষা হয় জয়ার। (ও শহরে ঈর্ষা জমা রেখে আসতে পারেনি বলে।

তবে কেন কে জানে তত ঈর্ষাও হল না। রাজী তো ফটোগ্রাফার ...) রাহী মল্লিক গিটার রেখে ঝুলি থেকে অনেকগুলি বিয়ারের ক্যান বের করল। জয়া রাখি আর রিয়া হাততালি দিয়ে ওঠে। রাজি হাসে। বিয়ার খেলে রিয়াকে কেমন দেখাবে-এই ভেবে ইষৎ উত্তেজনা বোধ করে।

টালমাটাল রিয়ার রিঅ্যাকশন লক্ষ করবে। ছবি তুলবে। শুভ্রা সিঁড়িতে বসে দূরের কুয়াশার নদী দেখছিল। ও জানে ওই নদীর পাড়ে বসে আজ রাতে ওর সঙ্গে তুষারের সঙ্গে কথা হবে। ভাব হবে।

এখন ও হাততালির শব্দে পিছন ফিরে তাকাল। জয়াদের উন্মাদনা শুরু হয়ে গেছে। ও জানে মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্যে এলেই তার ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা আদিম রিপু প্রকট হয়ে ওঠে। এদেরও তাইই হয়েছে। আজ রাতে জয়ারা উন্মাদ হয়ে উঠবে।

শুভ্রার হট্টগোল ভালো লাগছে না। এমনিতেই ও এখন বিপর্যস্ত আর ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। শুভ্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দীপ্ত আর তুষার কুয়াশায় ভেসে ওঠে। জয়া বলে, কি কি আইটেম থাকছে রে? ওর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।

দীপ্ত বলল, ভাত আর মুরগীর মাংস। নট ব্যাড! নট ব্যাড! ট্রাইবালদের রান্নার হাত ভালো। রাঙামাটিতে একবার খেয়েছি। অসাম। রিয়াও জড়িতকন্ঠে বলে।

‘ট্রাইবাল’ শবদটি খট করে বিধল তুষারের কানে। যেন ওরা অনেক দূরের কেউ। যেন ওরা বাংলাদেশি তরুণ-তরুণিকে বাঁচাতে ইয়াবা চোরাচালানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় না। রিয়ার হাতে বিয়ারের ক্যান দেখে দীপ্ত চিৎকার করে ওঠে। রিয়া! তুমিও ওসব খাচ্ছো! বলে দীপ্ত রিয়ার হাত থেকে বিয়ারের ক্যান ছিনিয়ে নেয়।

জয়া ঈষৎ জড়ানো কন্ঠে বলল, আহা, খাক না। এখন তো আর সপ্তম শতাব্দী না। তাই বলে গীর্জায় বসে তোরা বিয়ার খাবি! দীপ্তকে কেমন দিশেহারা দেখায়। এটা তো পরিত্যক্ত গীর্জা । ফরসেকেন।

রাখি বলল। তাই বলে মদ খাবি? মদ না হুজুর। বিয়ার। রাহী মল্লিক বলে। বলে হাসে।

রাখি ও জয়াও হি হি করে হেসে ফেলে । রিয়া এবার গলা চড়িয়ে বলে, মদ খেলে দোষ না! আর বিয়ে না করেও আমাকে কোলে নিতে দোষ হয় না তোমার? স্টপ! ভন্ড! তুই চুপ কর! রিয়া গর্জে ওঠে। শুভ্রা তখনও গীর্জার সিঁড়িতে বসে ছিল। তুষার দ্রুত পায়ে শুভ্রার পাশ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নীচে। তারপর কিছুটা দ্রুত পায়ে কুয়াশার মাঠে হাঁটতে থাকে।

এইসব হট্টগোল ওর ভালো লাগে না। ওর হইচই ভালো লাগে না বলেই ঢাকা শহর ছেড়ে পানছড়ি চলে এল। ওর অসুখটার নাম ডাক্তারের মুখে শোনা পর জ্যোতির গভীর মমতা পাবে বলে পানছড়ির নির্জনতায় চলে এসেছে । এখন মৃত্যুর আগে শুভ্রা কে দেখল সে। ওই দুঃখী মেয়েটি ওকে ভীষণ টানছে।

কেন যে মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা হল? নদীর পাড়ে এসে একটা বড় পাথরের ওপর বসল তুষার । দু’চোখ নদীর ওপারে। কুয়াশায় মায়াহরিণ খুঁজছে। যদি মায়া হরিণের দেখা পায়। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

অল্প অল্প শীত করছে। করুক। শিশির ভেজা শুকনো পাতায় কার যেন পায়ের মৃদু শব্দ। জ্যোতি কি খাবার নিয়ে এসেছে? এত তাড়াতাড়ি? তুষার মুখ ফিরিয়ে অবাক হয়ে যায়। শুভ্রা ।

মিষ্টিকন্ঠে বলল, বসতে পারি? তুষার মাথা ঝাঁকায়। ওর বুকের ভিতরে কেমন এক ব্যথা আর কষ্ট টনটন করে ওঠে। যদি সত্য কথাটা শুভ্রা কে বলা যেত! যদি মায়াহরিণের দেখা পেতাম ...ইস্ ...যদি ... শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, আপনি ড্রিঙ্ক করেন না। না? তুষার মাথা নাড়ে।

হাসে। আশ্চর্য! সিগারেটও খান না বুঝি? তুষার বলল, আগে খেতাম এখন খাই না। এক বছর হল ছেড়ে দিয়েছি। শুভ্রা চারিদিকে তাকায়। বলে, জায়গাটা খুব সুন্দর।

নামটাও সুন্দর। লোগাং । নদীর নামও সুন্দর। চিংগ্রি। মনে হয় অচেনা কোনও পাহাড়ি রাজ্যে চলে এসেছি।

ইস্, যদি সারাজীবন এখানে থাকতে পারতাম। তুষার হাসে। বলে, আমি আগে ঢাকায় থাকতাম। সাংবাদিকতা করতাম। এখন লোগাং থাকি।

গীর্জার স্কুলে পড়াই। বিশেষ কোনও কারণ আছে? মানে-লোগাং থাকার? জোছনার নদীর দিকে তাকাল তুষার। শুভ্রাকে সত্যি কথাটা কি বলব? শুভ্রা কে কি মিথ্যে বলা ঠিক হবে? জ্যোতি যখন জানে। তুষার বলল, মাস ছয়েক আগে আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে । শুভ্রা চুপ করে রইল।

অনেক ক্ষণ। অল্প অল্প কাঁপছে। কাঁদছে ও সম্ভবত। উপকথার দুঃখী মেয়ের মতো ওর চোখ বেয়ে মুক্তোর দানার মতো কান্নার বিন্দু পাহাড়ি নদীর শীতল জলে টুপটাপ টুপটাপ শব্দে ঝরে পড়ে। শীতরাত্রির নিথর গাছের পাতাও খসে পড়ে নদীজলে।

চারিদিকে কী অটুট নির্জনতা। আর চাঁদের আলো ও কুয়াশার শব্দহীন প্রেম। এ কার স্বপ্ন? নাকি এ দৃশ্যপট আকস্মিক? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? শুভ্রার চোখ দুটি এত মায়াবী। শুভ্রা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে, এ পৃথিবীতে আমার ... আমার যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। ভেবেছিলাম আপনার কাছে এসে আশ্রয় পাব।

তুষার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। ও জানত শুভ্রা দুঃখী। ও শুভ্রার উষ্ন বুকে আশ্রয় পেলে ধন্য হয়ে যেতে। কিন্তু মৃত্যু এত দ্রুত ঘনিয়ে আসবে কে জানত। সঞ্জয়ও কি জানত? ওকে ব্রাশফায়ার করবে স্মাগলাররা।

জ্যোতির শোক এখনও যায়নি। তারপর শুভ্রা তুষারকে ওর বিষন্ন জীবনের গল্পটি বলে ... শুভ্রার মা নেই ... শুভ্রার ছোট বোন আছে ... নাম সোনিয়া ... সোনিয়া দেখতে সুন্দরী তাই স্কুলে পড়ার সময়ই বিয়ে হয়ে গেল ... তখনই শুভ্রার মা মারা গেল ... বাবা আবার বিয়ে করেছে ... শুভ্রার বাবা শুভ্রারও বিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। লাভ হয়নি। শুভ্রা পরে রইল ... সৎ মার সঙ্গে বনিবনা হয়নি শুভ্রার ... সৎ মার চরিত্র ভালো না ... তার ঘরে ছেলেরা আসে ...রাগে-দুঃখে ঢাকায় ছোট খালার বাড়ি চলে এসেছে শুভ্রা। জয়া আর ছোট খালা শুভ্রাকে আগলে রাখলেও শুভ্রার খালু শুভ্রার পিছনে ঘুরঘুর করে।

ব্যাপারটা জয়া আর ছোট খালা টের পেয়েছে। খুব শীঘ্রি জয়াদের বাড়িও ছাড়তে হবে। বাড়ি ফেরারও তো উপায় নেই। এখন তুষার যদি ঠাঁই দেয়। তুষার চুপ করে থাকে।

এভাবে অনেক অনেক ক্ষণ কেটে যায়। তারপর কুয়াশায় নারীমূর্তি ভেসে ওঠে। জ্যোতি। তুষারের খোঁজে নদীর পাড়ে এসেছে। শুভ্রাকে দেখে থমকে গেল।

তুষার বলে, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে জ্যোতি। তুষারের কন্ঠস্বর গম্ভীর শোনায়। জ্যোতি চুপ করে থাকে। এর নাম শুভ্রা । শুভ্রার সঙ্গে আমার আজই পরিচয়।

আমি চলে যাওয়ার পর শুভ্রা লোগাং থাকবে। তোমরা দু’জনে গীর্জার স্কুলে পড়াবে। জ্যোতি শ্বাস টানে। তারপর ঝুঁকে শুভ্রার হাত ধরে। শুভ্রা উঠে দাঁড়ায়।

তুষারও উঠে দাঁড়ায়। তারপর কুয়াশার ভিতরে হাঁটতে থাকে। এই মুহূর্তে ওর ভীষণ নির্ভার লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে একবার পিছন ফিরে তাকায় তুষার । আবছা কুয়াশায় মুখোমুখি দাঁড়ানো দু’জন তরুণি কে দেখে ...।

মৃত্যুর ওপার থেকে এদের দেখবে তুষার ... আজ থেকে অনেক অনেক বছর পর ... দুটি তরুণি কুয়াশার নদীপাড়ে নিঃশব্দে মুখোমুখি বসে আছে ... উৎসর্গ: সানজিদা হোসেন। পানছড়ির মানচিত্রে লোগাং Click This Link ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.