আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোট গল্পঃ চাই না হতে দেবদাস

মদ খাওয়াটা কি খুব খারাপ? ছোটবেলা থেকে আমার মা-বাবা আমার লেখাপড়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়টায় সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা হলঃ তাদের ছেলে পরীক্ষায় যে রেজাল্টই করুক না কেন, মরালিটির শিক্ষায় যেন তার কোন কমতি না থাকে। আর তাই আমি সেই অল্প বয়স থেকেই অন্যান্য অনৈতিক কার্যকলাপের ন্যায় নেশাজাতীয় সকল মাদক, হার্ড ড্রিঙ্কের ওপরও চরম ঘৃণা পোষণ করে আসছি। সে ঘৃণা কেবল কাগজ কলমে ঘৃণা নয়। একদম সত্যিকারের। এমনকি সেজন্যে এই চব্বিশ বছরের জীবনে আমি একটা সিগারেটও টেনে দেখিনি।

মোদ্দা কথা, আমি বাবা মায়ের অতি বাধ্য ছেলে। কখনো তাদের কোন কথা অমান্য করবার দুঃসাহস দেখাইনি। অবশ্য আমি এখন যা লিখছি, তা পুরোপুরি সঠিক নয়। ব্যকরণগত ভুল আছে। যা লিখেছি, সেগুলো অতীত কালসূচক হবে।

কারণ ঘণ্টাখানেক আগেই জানতে পেরেছি যে আমার কর্মকাণ্ডে তারা অবাধ্যতার আভাস পেয়েছেন। ছবির নায়করা যেমন রাগারাগি করে বাড়ি ছাড়ে, আমার অবশ্য তা করতে হয় নি। কারণ আমি সে পরিস্থিতিতে নেই। আমি এখন নিজের পৈত্রিক বাড়ি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে আছি। আমার বাবা-মা এমুহূর্তে আছেন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে।

আর আমার অবস্থান ওকলাহোমা সিটিতে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখার জন্য আমি এখন এখানে। আমি বসে আছি একটা বারে। ওয়েটার বারকতক আমার কাছে জিজ্ঞেস করে গেছে আমার কি দরকার। আমি কিছু বলি নি।

শুধু মাথা নেড়েছি। তার ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে সে খুবই বিরক্ত। বিরক্ত অবশ্যি হওয়াই স্বাভাবিক। সন্ধের এই সময়টায় এখানে বেশ ভিড় হয়। বসবার জায়গা নিয়ে টানাটানি লেগে যায়।

এখনো তা-ই অবস্থা। কত লোকে চাচ্ছে একটি চেয়ার দখল করে গ্লাসে চুমুক দিয়ে অন্যভুবনে হারিয়ে যেতে। পারছে না স্থান সংকুলান না হওয়ায়। আর আমি সেখানে আস্ত একটা টেবিল দখল করে নিয়ে বসে আছি। কিছু অর্ডারও দিচ্ছি না।

এতে তো বার কতৃপক্ষের যথেষ্টই লস হচ্ছে। তবু তারা কিছু বলছে না আমায়। শুধু বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে। আশ্চর্য! এটা তো আমেরিকা, না কি? এরা এত ভদ্র হল কবে থেকে? যাইহোক, আমার সাথে আমার মা-বাবার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার গল্পটা বলি। বাড়াবাড়ি কিছুই হয় নি।

স্রেফ বাবা একটা চিঠি লিখে পাঠিয়েছে আমাকে। চিঠিটা ফর্মাল ইংরেজিতে লেখা। প্রিয় পুত্র, শুভেচ্ছা নাও। তোমার বিয়ের খবর পেয়েছি। তোমাকে অভিনন্দন।

কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি বা তোমার মা, কেউই এই অযাচিত সংবাদে প্রীত নই। বরং তোমার স্পর্ধা দেখে বিচলিত হয়েছি। তুমি কাউকে কিছু না জানিয়ে আকস্মিকভাবে একটা ভিনদেশি, ভিনসম্প্রদায়ের মেয়েকে বিয়ে করলে। এতে তোমার পরিবারের এবং তোমার বাবার এতদিনে তিলতিল করে অর্জিত মানসম্মান কিরকম ধুলোয় গড়াগড়ি খাবে, তা কি তোমার মনে একবারও আসে নি; এই-ই তোমার নিকট আমাদের জিজ্ঞাস্য। অবশ্য তোমার নিকট হতে আমরা এ প্রশ্নের সদুত্তর আশা করি না।

কারণ আমরা জানি যে এ প্রশ্নের সদুত্তর দেবার মত মানসিক পরিপক্বতা তোমার লোপ পেয়েছে যে কারণে তুমি এমন নিদারুণ অবাধ্যতা প্রর্শনের সাহস পেয়েছ। তাই আমি এবং তোমার মা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত যুবকের থেকে আমাদের আর কিছুই আশা করবার থাকতে পারে না। এর থেকে তোমার মৃত্যু হলে আমরা শান্তি না পাই, অন্তত স্বস্তি পেতাম। দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি তবে তা কৃত্তিমভাবে ঘটানো অসম্ভব নয়। আমরা তাই ঠিক করেছি, এখন থেকে প্রাণপণ চেষ্টা করব এই সত্যটাকে মেনে নিতে যে আমাদের যে সন্তান ছিল, তার মৃত্যু ঘটেছে।

এ উদ্দেশ্যে বাড়িতে থাকা তোমার সকল দ্রব্যাদি আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে। তোমার সাথে সরাসরি অথবা পত্র বা টেলিফোনযোগে পুনরায় যোগাযোগ করবার মনস্কামনা আমাদের নেই। এ বিষয়ে তোমার থেকে যথাযথ সহযোগিতা আশা করছি। ভাল থেকো, তোমার ভবিষ্যৎ সুখকর হোক। ইতি তোমার বাবা চিঠিটা আমার কাছে এখন আর নেই।

ছিঁড়ে ফেলেছি। কারণ চিঠিটা যখন পড়ছিলাম, তখন আসলেই আমার মানসিক অবস্থা ভাল ছিল না। হাস্যকর কাণ্ডকারখানা করছিলাম। এই দূরদেশে আপনজনও কেউ নেই যে আমাকে সান্তনা দিয়ে আমার পাগলামি দূর করবে। তাই চিঠিটা প্রথমবার কোনরকমে পড়া হতেই খেয়াল করলাম যে দীর্ঘ যাত্রার কারণেই বা আর যে কারণেই হোক, কাগজটা দুমড়ে-মুচড়ে গেছে।

খুবই রাগ হতে লাগল বাবার ওপর। একটা সমান ও সমতল কাগজে কি ছেলের কাছে শেষ চিঠিটা লেখা যেত না? এমনিতে তো সে সববিষয়ে পারফেকশনিস্টের ভূমিকা পালন করে। তাই প্রথমে কাগজটার ওপর বারবার হাত দিয়ে ঘষেই চেষ্টা করলাম সেটাকে সমান করতে। বাবার ছেলে হয়েছি কিনা, কোন কিছুতেই কোন ত্রুটি সহ্য করতে পারি না! কিন্তু দিনটা আমার আসলেই খারাপ যাচ্ছে। তাই কাগজটা সমান করতে তো পারলামই না বরঞ্চ বাবার কাছ থেকে পাওয়া শেষ চিঠিটারই ছাল-চামড়া সব উঠিয়ে ফেললাম।

কাগজটার তখন দর্শনীয় অবস্থা। আর নিজের ক্রোধ বশে আনতে পারলাম না। ফরাত করে কাগজটাকে ছিঁড়ে ফেললাম। এখন নিজের ওপর খুবই রাগ লাগছে। সামান্য কারণে বাবা-মায়ের শেষ স্মৃতিটাকে নষ্ট করে দিলাম।

অথচ একবারও মনে হল না যে কাগজটার ওপর পৃথিবীতে অবস্থানরত আমার সবচেয়ে বড় দুই শুভাকাংক্ষির কতখানি করে চোখের জল আছড়ে পড়েছে যে কারণে কাগজটা ভিজে গিয়ে নিদারুণ হয়ে উঠেছিল! আমি আসলেই এখন মানসিক বিকারগ্রস্ত। তাই প্রতি পদে পদে আমি ভুল করে চলেছি, ভুল বলে চলেছি। একটু আগে বললাম আমার মা-বাবা নাকি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষি। এ কথাটা ঠিক নয়। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শুভাকাংক্ষি দুজন নয়।

সংখ্যাটা হবে তিন। আশ্চর্য! এত তাড়াতাড়িই আমি ইলিনার কথা ভুলে গেলাম? ও-ও কি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষির অন্যতম ছিল না? ছিল। অবশ্যই ছিল। কিন্তু মৃত্যু কি ভয়ানক। একটা মানুষকে তো সে ছিনিয়ে নিলই, সাথে সাথে তার আপনজনদের কাছে তার স্মৃতিটাকেও এরকম ঝাপসা করে দিল।

মাত্র ৬ ঘণ্টার ব্যবধানে সে একটা মানুষকে মন থেকে আড়াল করে দিল! হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছেন। ছয় ঘণ্টা আগেই ফুটফুটে মেয়েটা তার জীবনিশক্তি হারিয়ে মুর্তিমান, শীতল হয়ে পরপারে যাত্রা করেছে। এখন বলা যাক ইলিনার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের কথা। ওর সাথে দেখা হয়েছিল একটা কফিশপে।

আমি তখন কেবল এ দেশে এসেছি। সেটা প্রায় চার বছর আগের কথা। তো, আমি কফিশপে বসে কফির জন্য অপেক্ষা করছি। অর্ডার দেওয়া হয়েছে কিন্তু ওয়েটার নিয়ে আসতে বিলম্ব করছে। এমন সময় মেয়েটা যেন উড়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমি কি তোমার সাথে এই টেবিলটা শেয়ার করতে পারি? আমি যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম কিন্তু তবু বিব্রতমুখে বলেছিলাম, অবশ্যই।

কেন নয়! তারপর মেয়েটা নিজে থেকেই চেয়ার টেনে নিয়ে বসার পর বলল, তোমাকে ডিসটার্ব করায় খুবই দুঃখিত। আসলে সকালবেলায় তাড়াহুড়া করে বেরোতে গিয়ে পার্সটা আমার এপার্টমেন্টে ফেলে এসেছি। কিন্তু এখন আমার খুবই কফির পিপাসা পেয়েছে। তাই তোমার টেবিলে এসে বসলাম যাতে আমার বিলটা তুমিই পে কর। মেয়েটার এটুক কথা শুনেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম ও কিরকম ছটফটে আর প্রাণবন্ত।

আর শিশুসুলভ ব্যবহার দিয়ে আমাকে এমনই বিমোহিত করে ফেলল যে আমি আর বিব্রত মুখে বসে থাকতে পারলাম না। সেটা বোধ হয় সম্ভবও না। তাই আমি স্বাভাবিক হয়ে হাসিমুখে ওকে বললাম, তা বেশ তো! কিন্তু আমি কি জানতে পারি যে এখানে এত মানুষ থাকতে তুমি আমাকেই টার্গেট করলে কেন? মেয়েটাও মিষ্টি করে হেসে দিয়ে বলেছিল, তোমাকে টার্গেট করলাম কারণ এখানে তোমাকেই আমার সবচেয়ে 'বেচারা' মনে হল! আমি বিস্মিত হয়ে বলেছিলাম, কেন? কারণ এখানে সবাই-ই ডাবল, শুধু তোমাকেই দেখলাম যে বিরসমুখে বসে আছ একা একা। আমি ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু একা বসে আছি দেখেই বুঝলে কিভাবে যে আমি সিঙ্গেল, ডাবল নই? আমি তো কারো জন্যে অপেক্ষাও করতে পারি। না! তুমি তা পারো না।

আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে অবজার্ভ করছি। তুমি যদি কারও অপেক্ষায়ই বসে থাকতে, তাহলে একলার জন্যে কফি অর্ডার দিতে না। আচ্ছা বুঝলাম! তা, এখন তুমি চাও যে আমি তোমার জন্যেও অর্ডার দেই? উইথ ক্রিম না ব্ল্যাক? উইথ ক্রিম। বাই দ্য ওয়ে, তোমারই যে অর্ডার দিতে হবে, তেমন কোন কথা নেই। তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও দিতে পারো।

আবার আমার নিজ থেকে দিতেও আপত্তি নেই। বাট বিলটা তোমাকেই পে করতে হবে! আমি খামোকা তোমার বিল কেন পে করব? উফ! তোমরা এশিয়ানরাও যে এত কথা পেঁচাতে জানো, আগে জানা ছিল না! বাট তুমি আমাকে খামোকা কফিটা খাওয়াবে কেন? এই যে আমি তোমাকে সঙ্গ দিচ্ছি, এর বিনিময়ে তুমি আমার বিলটা পে করবে। আর শুনো, শোধবোধ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। এরপর কোনদিন তোমার সাথে দেখা হলে তুমি যেন আবার আমার কাছে ডলার চেয়ে বোসো না। আমি বাবা এসব ধার-কর্যের মধ্যে নেই! সেদিনের পর ইলিনার সাথে আমার আরও দেখা হয়েছে।

একদম রুটিন করে রোববার বাদে সপ্তাহের আর সবকদিন। কারণ ও আমারই ইউনিভার্সিটিতে সেম সাবজেক্টে আমার এক সেমেস্টার সিনিয়র ছিল। আমি লক্ষ্য করতে লাগলাম যে মেয়েটা ভার্সিটির সকলের কাছেই এমনকি টিচারদের কাছেও খুবই প্রিয় ছিল। অনেক ছেলেই ওর পেছনে ঘুরত ওর সাথে ডেট করবার জন্যে। কিন্তু আমার সাথেই ওর ভাবটা বেশি জমেছিল।

জানি না কেন। আমার এমন কোন এক্সট্রা অর্ডিনারি গুণও ছিল না যা দিয়ে আমি ওকে ইমপ্রেস করতে পারব। তবুও কিভাবে কিভাবে ঘটনাটা ঘটেই গেল। হয়ত ও বুঝেছিল যে একমাত্র আমার ওর প্রতি ভালোলাগাটাই নিখাদ ছিল। কিংবা এও হতে পারে যে আমি এশিয়ার একটা দরিদ্রতম দেশ থেকে এসেছি বলে ওটা ছিল আমার প্রতি ওর সহানুভূতি।

যাইহোক, ওর সাথে আমার বন্ধুত্বটা ক্রমেই আমাদেরকে পরস্পরের অনেক কাছে নিয়ে আসলো। যদিও সম্পর্কটা স্রেফ ঐ বন্ধুত্বতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কখনোই আমরা সেটাকে বাড়াবাড়ি পর্যায় নিয়ে যাই নি। ও সবসময় আমাকে ওর মনের কথা বলত। আমিও বলতাম।

জানতে পারলাম এই পৃথিবীতে ওর কেউ নেই। বাবা-মা বেশ ক'বছর আগেই মারা গেছে। যদিও বেঁচে থাকাকালীন তারা একসাথে থাকত না তবে মৃত্যুটা আকস্মিকভাবে একত্রেই হয়েছে। চারপাশে ওর অনেক বন্ধু আছে কিন্তু তারা যে কেউই প্রকৃত নয়, তা-ও ও আমাকে বলত। তবে ও আমাকে ওর প্রকৃত বন্ধু হিসেবেই যে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিল, সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।

তবে ওর একটা ব্যাপার আমাকে বেশ বিচলিত করত তা হল যে মেয়েটা এত প্রাণবন্ত, সে-ই কিনা কদিন পরপর রোগশোকে কাহিল হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে প্রথমে ওকে কিছু বলতে গেলেই ও হেসে ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিত। কিন্তু ব্যাপারটা যে মোটেই হেসে উড়োবার মত নয়, তা বুঝতে আমার বেশিদিন সময় লাগল না। ঘটনাটা মাসছয়েক আগের। আমরা বছরখানেকই হয়ে গেল একই এপার্টমেন্টে থাকতে আরম্ভ করেছি।

তবে সেটিকে কিছুতেই লিভ টুগেদার বলা চলে না। কারণ আমরা একে অপরের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। নিয়মবহির্ভূত কোন কাজে লিপ্ত হবার কথা কোনদিন মাথায়ও আনি নি। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে অবশ্যই আমার মনে একটা সুপ্ত বাসনা লুকিয়ে ছিল। ওকে কাছে পাবার।

তবে সে বাসনা দুর্নিবার নয়। তার উৎসও শরীরী নয়। পুরোটাই মানসিক। যাইহোক, একরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল তীব্র ফোঁপানির আওয়াজে। আমি ঘুম থেকে জেগে উঠে বুঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম শব্দটা কোনদিক থেকে আসছে।

অনেকক্ষণ ভাল করে শব্দটা শোনার পর বুঝলাম যে শব্দটা আসছে ইলিনার ঘর থেকে। আমি ছুটে গেলাম ওর ঘরে। ও ঘরের দরজা লক করে শুত না। তাই আমি ওর ঘরে ঢুকে দেখি ও নেই। শব্দটাও ততক্ষণে থেমে গেছে।

তারপরও আমি বাথরুমের দিকে চেয়ে দেখি যে তার দরজা ঈষৎ খোলা, ভেতরে আলো। বুঝলাম ইলিনা ওর ভিতরে। আমি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে শেষপর্যন্ত ঢুকে গেলাম বাথরুমে। গিয়ে দেখি বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ইলিনা কাঁপছে আর বেসিন ভরে গেছে রক্তে। বুঝলাম ওর এতক্ষণ রক্তবমি হচ্ছিলো।

আমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম, 'ইলিনা!' ও পেছন ফিরে আমাকে দেখেই তীব্রভাবে আমাকে আলিঙ্গন করে বলতে লাগলো, আমি তোমাকে ভালবাসি জাহিদ! আমি তোমাকে ভালবাসি। সেদিন রাতে আর আমাদের কারোরই ঘুমনো হল না। ও আমাকে খুলে বলল সব। আদ্যপান্ত। ওর শরীরে লিউকোমিয়া ধরা পড়েছে।

ওর আয়ু বেশিদিন নেই। বড়জোর টেনেটুনে আর দুবছর। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কবে ধরা পড়েছে? ও জানাল, আমার তখন ১৮ বছর। সব শুনে আমার খুবই রাগ হতে থাকল ওর উপর। ছেড়েই যদি যাবে তাহলে এতদিন ধরে এই মিথ্যে সম্পর্কের মানে কি? পরমুহুর্তেই আবার মনে পড়ল, ও তো আমাকে কোনদিন মিছে স্বপ্ন দেখায়নি।

আমাদের ভেতর সম্পর্কটাও কেবলই বন্ধুত্বের। তার বেশি একপাও আমরা এগোই নি। ও আমাকে কোন মিথ্যে বাধঁনে বাধাঁর চেষ্টা করে নি। এমনকি আমেরিকার মত দেশে থেকেও পরস্পরকে কোনদিন সেরকমভাবে চুম্বনও করি নি। ওর সাথে আমার ভালবাসার সম্পর্ক যতদূর এগিয়েছে, সবই তো আমার কল্পনায়।

শুধু আজই ও মুখ ফুটে আমায় ভালবাসার কথা বলল। এখন তো আর কিছুই করার নেই। সবই শেষ। তাই আমি নীরবে বসে রইলাম। আমার চোখ দিয়ে যে জল গড়িয়ে চলেছে, তা খেয়ালও করলাম না।

এভাবে কতটা সময় চলে গেছে, আমি জানি না। তবে আমার চোখের জল তখনো শুকোয়নি। ইলিনা আমার পাশে এসে আমার চোখের জল নিজের হাতে মুছে দিয়ে ফের আমাকে জড়িয়ে ধরে এক নিঃশ্বাসে বলে চলল, 'কষ্ট পেও না জাহিদ। আমি বাঁচতে চাই না। আমি শুধু চাই তোমাকে।

আমায় বিয়ে করবে? প্লিজ জাহিদ!' আমিও ওকে আলিঙ্গন করে বললাম, 'আমি এত সহজে তোমাকে হারতে দেব না। আমি ঠিক তোমায় বাঁচিয়ে রাখব। তোমায় সুস্থ করে তুলব। ' পরের ছমাস কাটল শুধুই ছুটোছুটিতে। আমি আমার সাধ্যমত দেশের খ্যাতনামা ডাক্তারদের কাছে ইলিনাকে নিয়ে যেতে লাগলাম।

কিন্তু কোথাও-ই কোন ভরসা পেলাম না। সকলেই হাসিমুখে বলল, 'ইটস টু লেট!' ব্যর্থ হয়ে হয়ে আমি তখন ক্লান্ত। ইলিনা আমাকে বলতে লাগল, 'দেখলে তো কোথাও কিছু হল না। এবার আমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ কর। প্লিজ আমায় বিয়ে কর।

' তবু আমি কিন্তু কিন্তু করতে রইলাম। বাবা-মাকে না জানিয়ে বিয়ে করাটা কি ঠিক হবে? আর সবচেয়ে বড় কথা, বিয়ের একসাইটমেনটে যদি ইলিনার বড় কিছু হয়ে যায়। যেটা থেকে ইলিনাকে বাঁচাতে এত চেষ্টা করা, সে যদি আরও নিকটে ঘনিয়ে আসে? কিন্তু ইলিনা তো নাছোড়। ওর এই শেষ ইচ্ছেটা না মানলে আমিও কি কোনদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো? তা-ও আমি ডাক্তারদের সাথে ফের কাউন্সেলিং করতে লাগলাম। তারাই বরং আমাকে আশ্বস্ত করল, 'বিয়েটা করেই ফেল ইয়ং ম্যান! এটা দেখবে টনিকের মত কাজ করছে।

বিয়েটা ওর মধ্যে বেঁচে থাকার ইচ্ছেকে চাগিয়ে তুলবে। দেখবে ওর সাথে আরও কটাদিন বেশি রোমান্স করতে পারছ। ' আসলেও হল তাই। বিয়ের পর ওকে আরও বেশি চাঙ্গা, ঝরঝরে দেখাতে লাগল। আমি আশা করতে থাকলাম কোন একটা মিরাকল ঘটার।

ইলিনাও আগের মত প্রাণবন্ত হয়ে গেল। কিন্তু তারপর কি আশ্চর্য! বিয়ের মাত্র ছয়দিনের মাথায়, হাসতে হাসতে ও মারা গেল। অসাধারণ সে দৃশ্য। হাসতে হাসতে মরার বিরল দৃশ্য, যা কেবল গল্প উপন্যাসে দেখা যায় তা আর আমার অগোচরে থাকল না! ##### ইলিনার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ফিরে এলাম। ভেবেছিলাম এপার্টমেনটে ফিরে প্রতিটা জিনিস থেকে ইলিনার গন্ধ নেব।

এখানের সবকিছুই তো ইলিনার নিজের হাতে সাজানো। সবেতেই তাই ওর ছোঁয়া লেগে আছে। কিন্তু তা আর হল না। ল্যান্ডলেডি এসে চিঠিটা দিয়ে গেল। বাবার চিঠি।

পড়া শেষ করে উদভ্রান্তের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে লাগলাম। আর আমি এখন বসে এই বারে। ভাবছি, ড্রিঙ্কসের অর্ডার কি দেব? মদ জিনিসটা কি আসলেই খুব খারাপ? এটা কি পারবে না আমার সব ব্যথা ভুলিয়ে দিয়ে নতুন এক ভুবনে নিয়ে যেতে? যে ভুবনে আমার ইলিনা জীবিত, বাবা-মাও নেই আমার উপর ভুল বুঝে? সর্বোপরি সুখ যেখানে অধরা নয়? যদি পারে, তবে কেন আমি এই সঞ্জীবনি সুধা থেকে বঞ্চিত থাকবো? কিন্তু মদ কি সত্যিই তা পারবে? নাহ! মদ তা পারবে না। তাছাড়া আমিও চাই না দেবদাস হতে। কারণ আমি জানি, "প্রতিদিন নতুন করে জন্ম হয় প্রতিটা মানুষের।

তার মধ্যে সৃষ্টি হয় নতুন ব্যক্তিসত্তার। নানা ঘটনা প্রবাহের ছায়ায় ঝাপসা হয়ে যায় তার পুরনো পরিচয়ের। আর যখন সেই অদৃশ্য ছায়া সরে যায়, নতুন দিনের আলোয় দৃশ্যমান হয় এক নতুন মানুষের। নতুন তার রুচি, নতুন তার নীতি, নতুন তার আদর্শ। নতুন জন্ম নেয়া মানুষ কখনো বা নতুন আদর্শে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে যায় সামনের পথে।

বুকে করে নিয়ে দিগন্তে মিলবার স্বপ্ন। আবার কেউ বা হয়ে যায় পথভ্রষ্ট। পূর্বের দিনে বুনে রাখা ফসলের বীজ দেখে বুঝে উঠতে পারে না কেমন তার অবস্থা, কেমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তারা। তারা অনুধাবনে ব্যর্থ হয় কেমন আবহাওয়া চতুর্দিকে, কোন হাওয়াই বা বইছে, উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার অবাধ্য চুলকে। পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা না বোঝার বোঝা এর খেসারত দিতে গিয়ে তিলতিল করে শেষ হয়ে যায় তারা, নিক্ষিপ্ত হয় আস্তাকুঁড়ে।

" আমি তাই মাথা উঁচু করে বসে, আগামীদিনের পরিকল্পনা করে ছক কষতে বসলাম। বারের ওয়েটার এখনো মহাবিরক্ত হয়ে আমাকে দেখছে। দেখুক না, আমার তাতে কি! (সমাপ্ত) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।